18.8 C
New York
Sunday, October 5, 2025

Buy now







অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-১৫+১৬

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১৫.

অনেক রাত করে ঘুমালেও ভোরে ঘুম ভেঙে গেল ইফতির৷ আজকের দিনটা অন্যরকম শুরু হলো। গতরাতের কথা ভেবেই অদ্ভূত লাগছে তার৷ আবার ভালোও লাগছে। প্রিয়তী এখনো ঘুমে। তাকে ডাকল না ইফতি৷ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

এরকম একটা ভোরের স্বপ্ন সে আগেও দেখেছে। শুধু এই ভোরে তার পাশে প্রিয়তী নয়, অন্য কেউ ছিল। মন খারাপের বাতাস বয়ে গেল যেন ইফতির মনে। কবেকার কথা সেটা? এই তো মাত্র বছর তিনেক।

তুবার সাথে জমিয়ে প্রেম চলছে তখন তার। এক সকালে তুবা হঠাৎ ফোনের পর ফোন দিয়ে পাগল করে ফেলল। ইফতি এতগুলো কল থেকে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হয়েছে কী?”

তুবা ধরা গলায় বলল, “খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে।”

“কী স্বপ্ন?”

“তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি৷ একটা জংলী এলাকায় আমরা ঘুরতে গেছি৷ তুমি হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেছ। আমি খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছি৷ অথচ তোমাকে পাচ্ছি না৷ পুরো জঙ্গলে আমি একা। তোমাকে চিৎকার করে ডাকছি, অথচ তুমি কোথাও নেই।”

ইফতি হেসে বলল, “এজন্যই বলে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাস। পরীক্ষা শেষে তো হাত পা ছেড়ে বসেছ৷ এডমিশনের পড়া পড়তে শুরু করো, দেখবে পরীক্ষা বাদে আর কোনোকিছুর স্বপ্ন দেখবে না।”

“উফ! তুমি সবকিছু এত হালকাভাবে নাও কেন? আমার সাথে দেখা করো প্লিজ! নইলে স্থির হতে পারব না।”

ইফতি দেখা করতে গিয়েছিল বিকেলবেলা। রোদ পড়ে আসা ঝিমঝিম একটা বিকেলে আলতো রোদে সেদিন তুবাকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল। ওর ফরসা গায়ের রঙের সাথে ফুটেছিল চাপা হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ। গালে লালচে ছোপ ব্লাশন নাকি জমাট রক্ত বোঝা যাচ্ছিল না। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুবা লজ্জা পেয়ে বলেছিল, “তাকাবে না একদম! তুমি খুব খারাপ।”

“কেন?”

“আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি তুমি আমাকে ততটা ভালোবাসো না৷ শুধু আমাকে দেখতেই তোমার ভালো লাগে।”

ইফতি অবাক হয়ে বলেছিল, “আজব তো! এরকম মনে হচ্ছে কেন তোমার?”

“কখনো তোমার ভয় হয়েছে যে আমি হারিয়ে যাব?”

“না তো৷ হারাবে কেন?”

তুবা মুখ গোমড়া করে বলেছিল, “এই তো প্রমাণ হয়ে গেল, ভালোবাসো না৷ ভালোবাসলে সবাই হারানোর ভয় পায়। এত রিলাক্স থাকতে পারে না।”

ইফতি হেসে তুবার হাত টেনে নিয়েছিল নিজের হাতে। তুবা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে বলেছিল, “আমাকে ছোঁবে না৷ সব বিয়ের পর।”

“ওমা! বিয়েতে তো দেরি আছে।”

তুবা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলেছিল, “তুমি তো একটা চাকরি পেয়েছ। এখন বিয়ে করে ফেলো না৷ আমি তোমাকে পুরোপুরি চাই। সারাক্ষণ তোমার সাথে থাকতে চাই।”

ইফতি বলেছিল, “আগে নিজে একটু স্থির হও। এত বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করা যায় নাকি?”

তুবা আরও রাগ করে বলেছিল, “এত বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রেম করা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না?”

“না। তুমি সংসার করতে পারবে?”

“খুব পারব!”

ইফতি তুবার গাল টেনে বলেছিল, “শোনো মেয়ে, তোমাকে আরেকটু বড় হতে হবে। আরেকটু ম্যাচিউর হতে হবে। তাহলে আমাদের সুন্দর একটা সংসার হতে পারে।”

তুবার সেদিনকার চেহারা দেখে বোঝা গিয়েছিল সে হতাশ হয়েছে। তুবা শুরু থেকেই বিয়ের জন্য পাগল হয়েছিল। ইফতি ওর কাছাকাছি গেলে মাঝেমধ্যে সংকুচিত হয়ে গিয়ে বলত, “বিয়ে করে নাও না। এভাবে আমার ভালো লাগে না।”

ইফতি তখনো সিরিয়াসলি বিয়ে করার কথা ভাবেনি৷ সে সবে পড়াশুনা শেষে কোনোরকম একটা চাকরি জুটিয়েছে। ইচ্ছে, এখান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আরও ভালো চাকরিতে ঢুকবে। বাড়ির প্রতি তখন সামান্য দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছে। মাস শেষে টুকটাক শখের জিনিসও কিনতে পারে। তুবার সাথে দেখা করলে ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে পারে। কিন্তু এসব পারলেও বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ বরং এই জীবনটা সে উপভোগ করতে চাইছিল কিছুদিন।

তুবার সেই স্বপ্ন দেখার পরের রাতেই ইফতি স্বপ্নটা দেখেছি। সে আর তুবা এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে। তুবা গুটিশুটি হয়ে আছে। ওর চুলগুলো খোলা। বিশাল চুলের রাশি ঢেকে রেখেছে ওর পুরো শরীর৷ বিছানা ভর্তি চুলে। ইফতি চুলগুলো গুছিয়ে সরাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।

তুবাকে পরদিন স্বপ্নটা বলার পর ও খুব হেসেছিল। কিন্তু কোনো মন্তব্য করেনি।

আজ হঠাৎ ঘটনাটা মনে পড়তেই ইফতির ভীষণ অস্বস্তি হলো। সে আবার ঘরের ভেতর ঢুকে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রিয়তীকে টেনে নিল নিজের কাছে। প্রিয়তী ইফতির বুকে মুখ গুঁজে অস্ফুটে কী যেন বলল। ইফতি বুঝল না, তার নিজেকে আবারও কেমন দুশ্চরিত্র মনে হতে লাগল।

(চলবে)

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১৬.

অফিস থেকে ফেরার পর ইফতি আর প্রিয়তীকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না৷ সেই যে তাকে এক গ্লাস শরবত দিয়ে উধাও হয়েছে, আর দেখা নেই। রান্নাঘরে মা আছেন, তাই গিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না ইফতির। বউকে ডাকলে আবার মা না জানি কী বলে বসেন!

ইফতি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। একসময় বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। খাবার টেবিল পেরিয়ে রান্নাঘর। টেবিলের কাছে তুবা দাঁড়িয়ে আছে। ইফতির মনে হলো মেয়েটা অসুস্থ। সে পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল তুবার। টলে উঠল সে। ইফতি ঝট করে ধরে ফেলল তুবার হাত।

তুবার সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। সম্বিত ফিরে পেতেই সে এক ঝটকায় ইফতির হাতটা ছাড়িয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে মিফতা বেরিয়ে এলো। তুবাকে অসংলগ্ন দেখে ছুটে এলো সে।

“কী হয়েছে?”

তুবা মিফতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। মিফতা তাকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ইফতি তখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হলো, সে যে ক’দিন তুবার বিষয়ে অতিরিক্ত ভাবছে এটা খুব ভুল হচ্ছে। তুবা এখন আর তার প্রেসয়ী নয়, সে তার ছোটো ভাইয়ের বউ। নিজের ছোটো ভাইয়ের বউকে নিয়ে ভাবার মতো ছোটোলোকী কাজ সে কী করে করতে পারছে! ঘেন্না ধরে গেল নিজের ওপর। নিজের ঘরে চলে এলো সে। গোসলে ঢুকল। আজ শরীরের নোংরার সাথে সাথে মনের নোংরাও ধুয়ে ফেলবে পুরোটা৷
__________________________________

তুবা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে এটা কী হলো? ইফতি যখন তাকে স্পর্শ করল তখন তার মনে হচ্ছিল জ্বলন্ত আগুন তার হাত ধরেছে। আগে এই মানুষটার স্পর্শই কত আকাঙ্ক্ষিত ছিল! তুবার বিশ্বাস হয় না সময় এতটা বদলে যেতে পারে! সে ভেতরে ভেতরে কতটা বদলেছে?

মিফতা বিয়ের প্রথম প্রথম যখন তাকে স্পর্শ করত, খারাপ লাগত না, তবে মনের গভীরে কষ্ট হতো। সে এখনো মাঝেমধ্যেই দুঃখবিলাসে মেতে ওঠে। তখন মিফতাকে পাত্তা দেয় না৷ নিজের অদৃষ্টের ওপর যে রাগ তা গিয়ে পড়ে নির্বিবাদ স্বামীর ওপর। ও বেচারা তো জানেও না তেমন কিছু। তাকে কত ভালোবাসে!

ভোরবেলা খুব খারাপ লাগছিল তুবার। গতকাল ইফতি আর প্রিয়তীর ঘুরতে বের হওয়া দেখেই ওর ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছিল। এতদিনের প্রেম কি ভোলা যায়? আর সে তো কোনো প্রেম নামক নাটক করছিল না৷ সময় কাটানোর জন্য প্রেম করছিল না। শুরু থেকেই সে ইফতিকে জীবনসঙ্গী ভেবে নিয়েছিল।

সে যাহোক, ইফতি এখন অতীত। তার এবার শুধুই মিফতাকে নিয়ে ভাববার সময়। ভোরের দিকে যখন মনের কষ্ট ছাপিয়ে শরীরের কষ্টটা বড় হয়ে উঠেছিল তখন মিফতা তাকে ছেড়ে বেরিয়ে যায়নি, কাছে এসে বসে সেবা করেছে৷ এমন ভাগ্য ক’জনার হয়? আজ অফিসেও যায়নি মানুষটা৷

তুবা মিফতাকে বলল, “শোনো, তুমি আর কতদিন আমার জন্য অফিস কামাই করবে শুনি? কাল সকালে আমাকে বাবার বাসায় দিয়ে লক্ষী ছেলের মতো অফিসে চলে যাবে।”

মিফতা একটু হেসে বলল, “তোমাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কোথাওই যাব না।”

“আর চাকরি চলে গেলে?”

“আরেকটা জুটিয়ে নেব।”

“দেখো, ফাজলামি করো না৷ এইটা সিরিয়াস বিষয়। আগামীকাল আমি বাসায় যাচ্ছি।”

“তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করে না তুবা।”

“আমার বড় ইচ্ছে করছে যে মায়ের কাছে যেতে!”

মিফতা কয়েক সেকেন্ড তুবার দিকে তাকিয়ে থেকে তার কাছে এসে তুবার মাথাটা বুকে চেপে বলল, “ঠিক আছে। ইচ্ছে পূরণ হবে।”

“আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। আর বেশি মিস করলে চলে যেও। হিল্লিদিল্লি তো আর যাচ্ছি না।”

“তুমি আমাকে মিস করবে না?”

“করবো।”

তুবা মিফতাকে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে ধরল। সে যাচ্ছে ইফতির স্মৃতি থেকে দূরে পালাতে। কিছুদিন ওখানে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরবে৷ এসব নতুন বিয়ের নাটকও আর দেখতে হবে না।
____________________________________

প্রিয়তীর আজ সারাদিন মন খারাপ ছিল। ওর খাপছাড়া কথাবার্তা, অমনোযোগী ভঙ্গী ইফতির চোখ এড়াল না৷ বেচারি এখনো মা বাবার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। প্রিয়তী সামনে থাকলে ইফতির মাথায় আর কিছুই আসে না। মিষ্টি এই মেয়েটাকে পৃথিবীর সব সুখে মুড়ে দিতে ইচ্ছে করে।

রাতে শুতে আসার সময় ইফতি প্রিয়তীকে জিজ্ঞেস করল, “মন বেশি খারাপ?”

“হুম।”

“কাল অফিসে যাব না আমি।”

“কেন?”

“তোমার বাড়িতে যাব।”

“পাগল হয়েছ?”

“না। একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। একটা মানুষ পরিবার থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সেটা মেনে নেয়া যায় না।”

“কিন্তু বাবা….”

“ভয় পেও না। আমি তো আছি। অপমান করলে করবে, বের করে দিলে দেবে, বাবা মা-ই তো!”

প্রিয়তী ইফতির কাছ ঘেঁষে এসে তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমার সবসময়ের ইচ্ছে ছিল আমার বর আমার বাবা মাকে নিজের বাবা মায়ের মতো সম্মান করবে, তাদের দেখেশুনে রাখবে।”

“আমি চেষ্টা করব প্রিয়তী।”

প্রিয়তীর সারাদিনের কষ্ট কিছুটা হলেও উবে গেল। দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো তার। স্বপ্নে দেখল মায়ের সাথে চুলোর ধারে বসে গল্প করছে সে। মা চুলো থেকে গরম ভাপা পিঠা নামিয়ে তার পাতে তুলে দিচ্ছে। আহা!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......

Related Articles

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Stay Connected

20,625ভক্তমত
3,633অনুগামিবৃন্দঅনুসরণ করা
0গ্রাহকদেরসাবস্ক্রাইব
- Advertisement -spot_img

Latest Articles