#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
৩.
“আমার সমস্যাটাও টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত জীবনের সমস্যাই। ছোটোবেলা থেকে মা বাবার চাপিয়ে দেয়া ইচ্ছের ওপর চলতে হয়েছে৷ কোনোদিন একটা কথাও বলতে পারিনি তাদের ওপর, নিজের পছন্দের কিছু কোনোদিন পাইনি, কখনো অর্থের জন্য, কখনো মা বাবার ইচ্ছের জন্য। বাড়ির বড় ছেলে হওয়ায় স্যাকরিফাইজ করে যেতে হয়েছে সব৷
সেসব মানিয়েই নিয়েছিলাম। জীবনে সবকিছু তো আর পাওয়া যায় না৷ না পাওয়াগুলো অপূর্ণতার খাতায় জমা ছিল। দুঃখ ছিল না তেমন৷ কিন্তু শেষ ঘটনাটা মেনে নিতে পারিনি৷
যে মেয়েটাকে আমি ভালোবাসতাম, যার সাথে তিন বছরের সম্পর্ক, তাকে আমার ফ্যামিলি মেনে নেয়নি। মা কিছুতেই রাজি হলো না। তার এক কথা, প্রেম করে বিয়েটিয়ে মানব না। তোমাকে আমি নিজের পছন্দে বিয়ে দেব। তবু চেষ্টার ত্রুটি করিনি তাকে রাজি করানোর। তবে ফল শূন্য। শুধু মা’কে কষ্ট দেব না বলেই মেয়েটার সাথে ব্রেকআপ করে ফেললাম৷
কিছুদিন পর আমার ছোটো ভাই নিজের পছন্দে বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়িতে এলো। সে বাড়িতে বলারও প্রয়োজন মনে করেনি। আশ্চর্য বিষয় হলো, মা মেনে নিলেন! ছোটো ছেলের জেদের সামনে তেমন কিছুই বলতে পারলেন না। তাহলে আমার সাথে এত কড়াকড়ি কেন? তাদের কাছে কি আমার স্বপ্ন, ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই?”
“ব্যাস! এজন্য মরবেন?”
ইফতি হেসে বলল, “এত ছোটো কারনে টিনএজাররাও মরতে যায় না।”
“তবে?”
“আমার ছোটো ভাই কাকে বিয়ে করেছে আইডিয়া করতে পারেন?”
প্রিয়তী একটু অবাক হলো। সে জানবে কেমন করে? তারপর হঠাৎ কথাটা মনে হতেই গালে হাত দিয়ে বলল, “আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে?”
“হ্যাঁ!”
“এটা কেমন করে হলো?”
“আসলে আমার ভাইয়ের দোষ নেই। সে তো জানেও না আমাদের ব্যাপারে। মেয়েটাই প্রতিশোধ নিতে…”
প্রিয়তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলাম! আপনাকে দেখিয়ে দিল পরিবারকে কী করে রাজি করাতে হয়।”
“বলা চলে তাই-ই! কিন্তু আমি কি দোষী ছিলাম?”
প্রিয়তী একটু ভেবে বলল, “হ্যাঁ। আপনারও দোষ ছিল।”
“কী দোষ?”
“আমরা ভুলে যাই কথা দিয়ে কথা রাখাটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। ফ্যামিলির দোহাই দিয়ে কথা ভাঙা অন্যায়। আপনি যখন রিলেশনশিপে গেছেন তখন নিশ্চয়ই তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাহলে আপনার উচিত ছিল পরিবারের অমতে গিয়ে হলেও তাকে বিয়ে করা কিংবা প্রেম করার আগেই এটা শিওর হওয়া যে পরিবার থেকে সেটাকে কোন দৃষ্টিতে দেখবে। বিয়ে করে ফেললে পরিবার একসময় না একসময় মেনেই নেয়। আবার আপনার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখলে আপনি অতটাও দোষী নন। বাবা মায়ের স্বভাবতই একটা এক্সপেক্টেশন থাকে, তাদের অমতে গিয়ে তাদের কষ্ট দেয়াও উচিত নয়। তবে বড্ড আবেগী সিদ্ধান্ত! অথবা কে জানে! মা ছেলের বন্ডিং কতটা জোরালো তা ভাই আমার জানা নেই।”
ইফতি বড় একটা শ্বাস ফেলল। কিছুই বলল না।
প্রিয়তী জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হলো?”
“তারপর থেকেই বাড়িতে অসহ্য লাগছে। যতবার ওদের একসাথে দেখি, গা জ্বলে যায়৷ ভীষণ কষ্ট হয়। মা বাবার ওপর খুব রাগ হয়। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই।
এদিকে মা আমার জন্য মেয়ে দেখছেন৷ এক মেয়েকে তার খুব পছন্দ হয়েছে৷ তার সাথে বিয়ে ঠিকঠাক করে এসেছেন আমাকে কিছু না বলেই। সকালে ছোটো ভাইয়ের বউ আমার ঘরে এসে বলল, “ফিডিং বেবীর জন্য বউ ফাইনাল করা হয়েছে। দেখেছেন ছবি? নাকি বিয়ের রাতে দেখলেই চলবে?”
মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিলাম তারপর। আর আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছু না। আমি সুইসাইড করতে যাইনি। ঘুরতে ঘুরতে ওখানে চলে গিয়েছিলাম, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না বলে দাঁড়িয়েছিলাম। ওখানে দাঁড়ানোর পর থেকেই মনে উল্টোপাল্টা চিন্তা ভিড় করে আসছিল।”
“এখন কী করবেন? বাড়ি ফিরে যাবেন?”
“হ্যাঁ, আর কোথায় যাব? দু-চোখ যেদিকে যায় চলে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি আসলেই নেই।”
“আপনার কথা শুনে খারাপ লাগছে। সত্যিই ব্যাপারটা ঝামেলার। মধ্যবিত্ত মায়েরা ছেলেদের যে ফিডিং বেবী বানিয়ে রাখতে চায় এটা কিন্তু সত্যি! আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন৷ কেউ কেউ সেরকম হয়, কেউ কেউ হয় উল্টো। কিছু ক্ষেত্রে মায়ের আদর একটু বাড়াবাড়ি রকমের বোঝা হয়ে যায় এটা মায়েরা নিজেরাও বোঝে না।”
“হ্যাঁ কিন্তু শুধু আদর করলেই তো হলো না, আমাদের দিকটাও বুঝতে হবে। এইযে ছোটো থেকে বড় হওয়ার সময় প্রতি পদে পদে বুঝিয়ে দেয়া হয় আমাদের জন্য তাদের কতটা ত্যাগ করতে হয়েছে, এই ব্যাপারটাই পিছু টেনে রাখে। মন মানসিকতা বদলে দেয়। মেয়েরা ভাবে, পরিবারের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে যাওয়া ছেলেগুলো কাপুরুষ টাইপের, বিয়ে করতে না পারলে প্রেম করল কেন? আসলে অনেকে আছে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রেমিকাকে ঠকায়, তবে অনেকের পরিস্থিতির বাঁধাও থাকে এটা তো মিথ্যে নয়৷ আর সবাই কাপুরুষ হয় না। নিজের কথা না ভেবে তাদের হয় একূল, নয়তো ওকূল রক্ষা করতে হয়৷”
“হুম!”
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। রাত গভীর হয়েছে। চাঁদ ডুবে গেছে। আকাশে শুধু নক্ষত্রের মেলা। ঠান্ডা বাতাস বেড়েছে। প্রিয়তীর খুব হাসি পাচ্ছে ভাগ্যের ওপর। তার আজ কোথায় থাকার কথা ছিল, আর সে এখন কোথায়! বাতাসের মৃদু ধ্বনি তার মগজে নতুন কোনো চিন্তার জাল বুনে দিয়ে গেল। একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছে। বাঁচার একটামাত্র পথই আছে।
প্রিয়তী কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল, “একটা কথা বলব?”
“বলুন।”
প্রিয়তী বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল, “না থাক।”
“বলুন, সমস্যা নেই।”
প্রিয়তী সিদ্ধান্ত নিতে পারল না বলবে কি বলবে না। কথাটা অস্বস্তিকর, তবে তার নিজের স্বার্থে বলতেই হবে। ছেলেটা রাজি হতেও পারে।
“বলুন তো!”
“আমরা একটা কাজ করতে পারি, তাতে আমাদের দু’জনারই স্বার্থ রক্ষা হয়।”
“কী কাজ?”
“বিয়ে করা৷ আপনি আমাকে বিয়ে করে আপনার বাড়িতে নিয়ে যান৷ আপনার মা বাবার একটা শিক্ষা হবে। ছোটো ভাইয়ের বউকেও জবাব দেয়া হবে। আর আমারও একটা গতি হবে। নয়তো আপনাকে বাড়িতে ফিরে গিয়ে সেই মাম্মাস বয় সেজে বিয়ে করতে হবে, আর আমাকেও হয়তো বাড়ি ফিরে দুশ্চরিত্রের গলায় ঝুলে পড়তে হবে!”
ইফতি খুব একটা অবাক হলো না প্রস্তাব শুনে। তারও এরকম একটা কথা মাথায় আসছিল। সে তাই খুব একটা চিন্তাভাবনা না করে বলল, “ঠিক আছে।”
দুই কথায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেল তাদের। একে অপরকে কেউ ভালো করে চেনে না। নিজেদের দেয়া পরিচয় ব্যতীত অতীত সম্পর্কে জানার সময় বা সুযোগও নেই। তবুও ভাগ্যের পরিহাসকে বুড়ো আঙুল দেখাতেই বোধহয় এই শেষরাতে আচমকা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল তারা।
পরের কয়েক ঘন্টা চুপচাপ কাটল। দিনের আলো ফুটল। দিনটা গেল বেশ কর্মব্যস্ত৷ ইফতির কিছু বন্ধুদের সে খবর দিল। দুপুরের দিকে কাজি অফিসে তাদের বিয়ে হয়ে গেল।
গতকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি তাদের। বিয়ের পর একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াদাওয়া সারল তারা৷ তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল।
প্রিয়তীর পরনে গতকালের সেই লাল শাড়িটাই। বিয়ের সময় গয়নাগুলো আবার পরেছে। ইফতির এক বন্ধু বেলীফুলের গজরা নিয়ে এসেছিল, সেটা খোঁপায় পরে নিয়েছে সে৷ ঘোমটা টেনে দিয়েছে মাথায়। ইফতিও বন্ধুর জোরাজুরিতে পাঞ্জাবি পরেছে।
কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলল একটা মেয়ে। বয়স একুশ বাইশ হবে। দরজা খুলে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল মুখ হা করে। চোখ বিষ্ফারিত। যেন দরজা খুলে চোখের সামনে কোনো মানুষ নয়, গরিলার বাচ্চা দেখতে পাচ্ছে!
ইফতি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “ভেতরে যাব। সরো!”
মেয়েটা ধীরেসুস্থে সরল। তার চোখ আটকে আছে প্রিয়তীর দিকে। প্রিয়তী নিশ্চিত এটাই ইফতির এককালীন প্রেমিকা, বর্তমানে ছোটো ভাইয়ের বউ।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু