অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-০২

0
712

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

২.

পার্কের মূল ফটক বন্ধ। সীমানার চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া৷ একপাশে খুঁজে দেখা গেল ভাঙা জায়গা আছে। সেখান দিয়ে কোনোমতে ঢুকে গেল দু’জনে। ভেতরে গিয়ে দেখতে পেল অনেকেই আছে ভেতরে। বেঞ্চে বেঞ্চে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা বেশ কিছু লোক। ঘাসের ওপরেও শুয়ে আছে কেউ কেউ। কিছু কুকুরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে। ওদের দেখে দুটো কুকুর মাথা তুলে চাপা গলায় গড়গড় করে আবার শুয়ে পড়ল।

দু’জন গিয়ে বসল কোণার দিকের এক গাছের নিচে। পার্কের সামনের ফ্ল্যাশলাইটের আলোর আভা কিছুটা এখানে এসে পড়েছে৷ দুজন দুজনার চেহারা দেখতে পাচ্ছে আবছাভাবে।

ইফতি এবার জিজ্ঞেস করল, “আপনার ঘটনা খুলে বলুন তো! তাহলে আমার সুবিধা হবে আপনাকে সাহায্য করতে।”

প্রিয়তী এতক্ষণ লোকটাকে মোটেও সিরিয়াসলি নিচ্ছিল না। নিজের চিন্তা নিজেই করছিল। এবার মনে হলো লোকটা বেশ ভালো। তার সাথে দেখা হওয়া অবধি একটা বাজে কথা বলেনি, খারাপ ইঙ্গিতও দেয়নি। পুরোপুরি ভদ্রলোক। এখন তাকে সাহায্যও করতে চাইছে আন্তরিকভাবে। আর সে নিজেও নিজের অজান্তেই লোকটাকে ভরসা করে তার সাথে পার্কের কোণে এসে বসেছে!

প্রিয়তী ঠিক করল সব বলবে। সে একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করল।

“আসলে আমার কাহিনী টিপিক্যালের মধ্যে একটু মসলাদার। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন এক ষণ্ডা মার্কা উজবুকের সাথে। পড়াশুনাও ঠিকঠাক জানে কিনা সন্দেহ। আমার শুরু থেকেই একেবারে পছন্দ ছিল না লোকটাকে। কথা বলে দেখলাম কেমন বোকা বোকা কথার স্টাইল। আসলে ঠিক বোকাও বলা যাবে না..বলা যায় খুবই বিরক্তিকর রকমের, অতিরিক্ত পরিমাণে ইলজিক্যাল বাজে কথা বকতে থাকে ক্রমাগত। বোঝাই যায় খালি কলসি। সে বাবাকে পটিয়েছে টাকাপয়সা দেখিয়ে। আসলে আমরা মধ্যবিত্ত ঘর তো, সারাজীবন কষ্টে কষ্টে কেটেছে, এখন বাবা বড়লোক পাত্র পেয়ে চাইছিল আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে, যাতে বিয়ের পর টাকাপয়সার জন্য কষ্ট করতে না হয়।

আমার যে লোকটাকে পছন্দ না, সেটা কত করে বোঝালাম বাবাকে! কিছুতেই সে রাজি হলো না বিয়ে ভাঙতে। ওই লোকের সাথেই বিয়ে দেবে। আমার বারবারই মনে হচ্ছিল লোকটা ভালো নয়। বিয়ের দিন সকালে, মানে আজকে সকালে আমি কিছু প্রমাণও পেলাম। লোকটার চরিত্রে দোষ ছিল। একাধিক মেয়ের সাথে তার কিছু অন্তরঙ্গ ছবি পাঠানো হয়েছিল আমার মোবাইলে। কে পাঠিয়েছিল জানি না।

আমি বাবাকে সব খুলে বললাম। বাবা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, এসব বানানো যায়। আমি জোর দিয়ে বললাম, দেখে তো ফটোশপ মনে হচ্ছে না। বাবা মোটেও পাত্তা দিলেন না আমাকে। আমি যখন জেদ করে কান্নাকাটি শুরু করলাম, তখন বললেন, পুরুষ মানুষের এমন দোষ থাকেই, বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।”

বলতে বলতে প্রিয়তী কেঁদে ফেলল। ইফতির খুব রাগ লাগছিল। সে মেয়েটাকে কাঁদতে দিল। কাঁদলে হয়তো ভালো লাগবে ওর। এরকম বাবা হয় কেমন করে!

প্রিয়তী কাঁদা শেষে চোখ-নাক মুছে বলল, “এরপর আমি কোনো উপায় না পেয়ে আমার বন্ধুদের সব খুলে বললাম৷ বন্ধুরা বলল পালিয়ে যেতে। কিন্তু কার সাথে পালাব? আমার কোনো প্রেমিকও নেই। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে এক ছেলে আছে, যে আমাকে দুই বছর ধরে পছন্দ করে। আমি পাত্তা দেইনি। আমি আসলে ওর জন্য কিছু ফীল করতাম না৷ কিন্তু আজ সকালে সে যখন বলল, চলে আয়, তোকে বিয়ে করে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব, ওই পালোয়ানকে বিয়ে করতে হবে না, তখন আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম৷ আমার কাছে একেতো আর কোনো অপশন ছিল না, তার ওপর ভাবলাম, ওই লোককে বিয়ে করার থেকে বন্ধু অনেক বেটার অপশন। তাই পালিয়ে চলে এলাম।

সে বলেছিল আমার জন্য এক জায়গায় অপেক্ষা করবে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম সে আসেনি। আর এলোই না। ফোনও বন্ধ করে রেখেছিল। হয়তো শেষ মুহূর্তে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেছে। কিংবা এতদিন আমার পাত্তা না দেবার প্রতিশোধ নিয়ে নিল!”

প্রিয়তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি সারাদিন পাগলের মতো ছোটাছুটি করেছি। কিন্তু বাড়ি ফেরার কথা মনেও হয়নি। ওই বাড়ির সবাই স্বার্থপর। ওরা আমার সাথে বাড়াবাড়ি করতে চেয়েছে, আমিও তাদের সাথে বাড়াবাড়ি করে এসেছি৷ এখন সেখানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার চিন্তা ছাড়া আর কোনো উপায় মাথায় আসেনি৷ সেজন্যই ব্রীজে গিয়েছিলাম।”

প্রিয়তী কাহিনী শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ইফতিও হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। সান্ত্বনার বাণীও মুখ দিয়ে বের হলো না। নিজেরই অসহায় লাগছে!

প্রিয়তী নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে বলল, “চলুন, আরেক কাপ চা খেয়ে আসি, ওইযে পার্কের বাইরে এখনো চাওয়ালা বসে আছে। আমার ঘন ঘন চা না খেলে মাথাব্যথা করে।”

“আপনার যেতে হবে না। আমি নিয়ে আসি।”

ইফতি ফিরল দুটো ওয়ান টাইম কাপে চা নিয়ে।

প্রিয়তী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “এবার আপনার কথা শুনব।”

ইফতি বলল, “আপনি যে কারনে মরতে যাচ্ছিলেন সেটাই আমারও কারন, শুধু ঘটনা ভিন্ন।”

প্রিয়তী দুই হাঁটু ভাজ করে তার ওপর থুতনি রেখে বলল, “বাহ, ইন্টারেস্টিং! বলে ফেলুন, শুনি!”

ইফতি হেসে বলল, “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি খুব মজার কোনো গল্প বলব, আপনি হাসার জন্য প্রস্তুত।”

“দুঃখের কাহিনী সবসময় দুঃখী মুখ করে শুনতে হবে এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি? আজব তো!”

“না, তবে আমার কাহিনী শুনে আপনি হেসেও ফেলতে পারেন।”

“কেন বলুন তো!”

“কাহিনীটাই এমন।”

“ভণিতা বাদ দিয়ে বলবেন?”

“না ভণিতা নয়, ভাগ্যের বিড়ম্বনা। গলায় মাছের কাটা আটকে থাকলে কেমন লাগে জানেন? ঠিক তেমন একটা সমস্যায় পড়েছি।”

“আচ্ছা সেটাই বলুন।”

“তার আগে বলুন তো, আপনার প্রেমিক থাকলে তার থেকে আপনি ঠিক কী কী এক্সপেক্ট করতেন? সে আপনার জন্য পৃথিবীর সবকিছু ছেড়ে দিক? বাবা মাকে ছেড়ে দিক?

“অফকোর্স না।”

“আচ্ছা, বলছি শুনুন।” নিচু গলায় বলল ইফতি।

প্রিয়তী তার আরেকটু কাছে চলে এলো কথা ভালোভাবে শুনতে। কোথাও একটা নাইটগার্ডের বাঁশি বাজল। একটা কুকুর মাথা তুলে সামান্য ঘেউ করে আবার শুয়ে পড়ল। ইফতি তার কাহিনী শুরু করল।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে