অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-০১

0
1089

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

১.

“আপনি এখানে এত রাতে কী করছেন?”

প্রিয়তী ফিরে তাকাল। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার চাইতে এক হাত লম্বা, স্বাস্থ্য ভালো, গালে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে চশমা। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ বিব্রত, বিরক্ত আর একই সাথে চিন্তিত।

প্রিয়তী উত্তর দিল না৷ কে না কে! কথা বলতে এলেই বলতে হবে? সে মুখ ঘুরিয়ে আবার সোজা সামনের দিকে তাকাল। বাঁকা চাঁদের সামান্য আলো ছড়িয়ে পড়ছে পানিতে, পানি বয়ে চলার মৃদু শব্দ কানে আসছে। প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করেছে হঠাৎ করেই।

ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করল, “রাত কয়টা বাজে দেখেছেন? আপনাকে তো ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হচ্ছে। এখানে কী কাজ আপনার?”

প্রিয়তী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল এবার। বলল, “আপনার কি অভদ্র ঘরের মেয়ে প্রয়োজন? তাহলে অন্যদিকে যান।”

ছেলেটা হতবাক হয়ে চুপ করে গেল। মিনিটখানেক পর নিজেকে সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “কারো উপকার করতে যাওয়া হলো পাপ। জীবনে বহুবার এই পাপ করে ধরা খেয়েছি৷ এখন মরার আগে আরেকবার খেলাম। মাফ করবেন বোন। ক্ষমা চাই।” বলে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করে দ্রুত সরে গেল সেখান থেকে। গিয়ে দাঁড়াল ব্রীজের অন্যপাশে।

ব্রীজটা বেশ বড়। নিচে খরস্রোতা নদী। এই ব্রীজ বিখ্যাত আত্ম*হত্যার ব্রীজ হিসেবে। প্রতি বছর অন্তত দু’জন এই ব্রীজ থেকে লাফ দিয়ে জীবন বিসর্জন দেয়।

প্রিয়তীও এসেছে মরে যাওয়ার জন্যই। মনটাকে প্রায় প্রস্তুত করে ফেলেছিল, এমন সময় ছেলেটা এসে সব ভজঘট করে দিল। এখনও এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে চেয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু আছে তো এখানেই। আরেকজনের চোখের সামনে কি নিজের মতো মরা যায়?

এদিকে ইফতি ভাবছে মেয়েটার কথা। মেয়েটার পরনে যে পোশাক, তাতে মনে হচ্ছে কোনো অনুষ্ঠান থেকে এসেছে। এই চাঁদের আলোতেও রঙিন শাড়ি, চোখের গাঢ় কাজল আর গয়নাগাটি দেখা যাচ্ছে। বেশ সুন্দর মেয়েটা। গায়ের রঙ ফরসা। চাঁদের আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে। হঠাৎ গায়ে কাটা দিয়ে উঠল ইফতির। মেয়েটা মানুষ তো? এই নির্জন এলাকায় কুখ্যাত ব্রীজে এত রাতে কোনো মেয়ের তো আসার কথা না। এমন কি হতে পারে না, মেয়েটা কোনো এক সময় এখানে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এখন অতৃপ্ত আত্মায় পরিণত হয়েছে…

ঢোক গিলল ইফতি। আবার নিজেই নিজেকে শাসাল, সে তো মরতেই এসেছে। আত্ম*হত্যা করা আর ভূতের হাতে মরার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য হয়তো নেই।

সে বার বার ঘুরে তাকাচ্ছে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এখন তাকিয়ে আছে সোজা চাঁদের দিকে। আচ্ছা, ভ্যাম্পায়ার নয় তো? ইফতি খেয়াল করল মেয়েটা সোজা তার দিকেই আসছে। এখনই কি তাহলে তার জীবনের শেষ সময়?

প্রিয়তী ইফতির কাছে এসে বলল, “আমার একটা উপকার করবেন?”

ইফতির ভয়টা দূর হয়ে গেল। মেয়েটা মানুষই। ওর গা থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। চুড়ির টুংটাং শব্দ আসছে, বাতাসে চুল উড়ে মুখের ওপর এসে পড়ছে। এ ভূত হতেই পারে না।

“কী উপকার বলুন।”

“আমাকে একটা ছোট্ট ধাক্কা দেবেন।”

“কিহ?” ইফতি হা হয়ে গেল।

“হ্যাঁ। বুদ্ধি থাকলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমি কেন এসেছি৷ ঠিক যে কারনে আপনি এসেছেন, আমিও সেজন্যই এসেছি৷ এই উপকার করলে আপনার লাভই হবে, আমাকে ধাক্কা দিলে আমি নির্ঘাত মরব, সাঁতার জানি না। তারপর আপনার মনে যে গ্লানি তৈরি হবে, সেটা আপনাকে সাহায্য করবে একা একাই ঝাঁপ দিতে।”

“আপনি এসব কী বলছেন?”

“দেখুন, আমরা দু’জন একই পরিস্থিতিতে আছি৷ কেউই সাহস জোগাড় করতে পারছি না কাজটা করার৷ তাই একে অপরকে সাহায্য তো করতেই পারি, বলুন!”

“আর যদি আমার মরতে ইচ্ছে না হয় তাহলে আপনাকে সাহায্য করব কেন?”

প্রিয়তী বলল, “আমার মনে হচ্ছে আপনার টাকাপয়সার সমস্যা। আপনি এক কাজ করুন, আমার গয়নাগাটি নিয়ে নিন। খুলে দিচ্ছি৷ এই গলার হার, কানের দুল আর বালাজোড়া আসল স্বর্ণের। অনেক টাকা পাবেন। সব দিয়ে দিচ্ছি, শুধু একটু ধাক্কা…”

ইফতি বেকুবের মতো তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। আশ্চর্য তো! তার সাতাশ বছরের জীবনে সে এত অবাক কোনোদিন হয়নি।

★★★

“আপনারা এখানে কী করছেন?”

দু’জনেই চমকে তাকাল সামনে। অন্ধকার ফুঁড়ে কোথা থেকে আচমকা উদয় হয়েছে এক পুলিশ। তার গাঢ় নীল ইউনিফর্ম অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে। সম্ভবত লোকটার গায়ের রঙও কুচকুচে কালো। গলার আওয়াজ ভারী, কায়ে কাঁটা দেয়ার মতো।

দু’জনেই আমতা আমতা করতে লাগল। পুলিশের লোকটির নেমপ্লেট চকচক করে উঠল চাঁদের আলোয়। নাম কামরুল।

“কী হলো? কারা আপনারা? এইখানে কী?” আবারও গমগম করে উঠল পুলিশি গলা।

ইফতি একটু হেসে বলল, “কামরুল স্যার, আমরা আসলে একটু হাওয়া খেতে এসেছি।”

“এইটা হাওয়া খাওয়ার সময়?”

ইফতি কিছু বলতে গিয়ে আরেকবার চমকে উঠল। পেছনে দুই কনস্টেবল উদয় হয়েছে নিঃশব্দে। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ, এই পুলিশগুলো অশরীরি নয়তো?

তবু সে কথা চালিয়ে গেল কোনোমতে, “আসলে..আসলে..ওর বাসায় ভালো লাগছিল না তো তাই..”

“উনি আপনার কী হয়?”

“অফকোর্স প্রেমিকা নয়, প্রেমিকা নিয়ে কি কেউ এত রাতে বের হতে পারে?”

“ফাইজলামি করেন আমার সাথে?”

কামরুল নামক পুলিশ হঠাৎ খুব রেগে গেলেন। হম্বিতম্বি শুরু করলেন, “চলেন, পুলিশ স্টেশনে চলেন। এক রাত জেলের বাতাস খাইলে মাথা ঠিকঠাক জায়গায় চইলা আসবে।”

এবার প্রিয়তী ময়দানে নেমে পড়ল। খুব অনুরোধ করে বলল, “প্লিজ আমাদের যেতে দিন। আর কখনো রাত করে বের হবো না। আমারই দোষ। বাড়িতে বসে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। আসলে আজকে আমার দাদীর মৃত্যুদিবস তো, তাই তার কথা মনে পড়ছিল। ও সেজন্যই আমাকে নিয়ে এসেছে।”

প্রিয়তীর কথায় পুলিশদের মন নরম হলো বলে মনে হলো। এক কনস্টেবল বলে উঠল, “ছ্যার, ছাইড়া দ্যান।”

কামরুল সাহেবও হয়তো তাই ভাবছিলেন৷ তবু শেষ প্রশ্নটা করলেন, “কী হন আপনারা?”

ইফতি বলতে যাচ্ছিল তার বোন হয়, তার আগেই প্রিয়তী বলে ফেলল, “আমরা স্বামী স্ত্রী। মাত্র একমাস আগেই বিয়ে হয়েছে।”

“এইসব গয়নাগাটি পইরা আসছেন কেন? এতক্ষণ যে বাঁইচা আছেন এইটা তো আশ্চর্য বিষয়।”

কথাটা শুনে প্রিয়তীর মনে হলো, আসলেই তো! সে শোক-দুঃখে বাস্তব বুদ্ধি হারিয়ে বসে আছে। এতক্ষণেও যে ছিনতাইকারী ধরেনি এটাই আশ্চর্য।

পুলিশরা তাকে মেইন রোড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিল। এখন বাড়ি যেতে হবে।

প্রিয়তী ততক্ষণে সব গয়নাগাটি খুলে হাতব্যাগে ভরে ফেলেছে। ইফতি অবাক হয়ে মেয়েটার কান্ড দেখছে৷

এবার সে বলল, “যদিও ভেবেছিলাম কোনো উপকার করব না আপনার…তবু শেষ উপকার করতে চাইছি সেধেই। আপনার বাড়ি কোথায়? পৌঁছে দেই চলেন।”

প্রিয়তী আঁতকে উঠে বলল, “বাড়ি মানে? আমি তো বাড়িতে যাব না।”

“কেন?”

“সে অনেক কথা। আমার বাড়িতে যাওয়ার উপায় নেই। অন্য কোথাও যেতে হবে।”

“কোথায় যাবেন?”

“সেটা তো জানি না। সবচেয়ে ভালো হতো ব্রীজ থেকে ঝাঁপ দিলে। আপনার জন্য হলো না৷ সব আপনার দোষে হয়েছে। এখন আমি কোথায় যাব সেটা আপনি ঠিক করবেন।”

ইফতি হতবাক হয়ে গেল। ভারী বিপদে পড়া গেল তো! তার কী করা উচিত? একবার মনে হলো, ঝেড়ে দৌড় দিতে। মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে ধরতে পারবে না৷ এই স্বার্থপর মেয়ে তারপর যা খুশি করুক! কিন্তু পরক্ষনেই এই কাপুরুষোচিত চিন্তা সে বাতিল করে সত্যিই ভাবতে বসল এখন কী করা যায়। সে নিজেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আর ফিরবে না বলে।

সে শেষমেশ কিছু চিন্তা করতে না পেরে বলল, “সামনে একটা পার্ক আছে। চলেন গিয়ে বসি৷ এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেইফ না।”

প্রিয়তী রাজি হলো। তবে তার আগে ভ্রাম্যমাণ এক চাওয়ালার থেকে চা খেয়ে নিতে ভুলল না৷

চাওয়ালার সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করতেও ছাড়ল না প্রিয়তী।

“মামা, এত রাতে চা বিক্রি করছেন যে?”

মামা উত্তর দেন, “কী করমু খালা, বাড়িতে কেউ নাই। বউটা আরেকজনের লগে পলায়া গেছে। রাইতের বেলা বাড়িডা খাঁ খাঁ করে। মন চায় নিজেও পলায়া যাই। তাই রাইত জাইগা চা বেচি। আফনেগো মতো কয়েকজন কাস্টোমারও পাইয়া যাই।”

“আহারে…” চুক চুক শব্দ করল প্রিয়তী।

মামা চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, “কিন্তু খালা এমুন বেশিদিন চলব না। বিয়া করমু। মাইয়া দেখছি। মাইয়া বড় সোন্দর। পড়ালেখা জানে। এইবার এইট পাশ দিবো।”

ইফতির গলায় চা আটকে গেল। খুকখুক করে কেশে ফেলল সে। প্রিয়তী মুখ টিপে হাসছে। চাওয়ালার বয়স কম করে হলেও চল্লিশের ওপর।

ইফতি বলল, “বাল্যবিবাহ করতে চান? আপনি জানেন এটা অপরাধ?”

চাওয়ালা একগাল হেসে বলল, “গরীব ঘরের মাইয়াগো এট্টু তাড়াতাড়িই বিয়া হয়। এতে দোষের কিছু নাই।”

ওরা আর কিছু বলল না। ইফতি দাম মিটিয়ে দিল। দুজন চলল পার্কের দিকে। প্রিয়তীকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। ইফতি মনে মনে ভাবছে, কোন কুক্ষণে সে যে মরতে এসেছিল! নিজে ভূত হবার বদলে আস্ত ভূত কাঁধে চেপে বসেছে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে