অন্তহীন প্রেম পর্ব-৫+৬

0
536

#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

—–কিভাবে হলো?
——তা জানিনা,
আমিবিছানাটা একটু গুছিয়ে দিলাম।
কমলা রুম থেকে বের হয়ে চিৎকার করে বললো,
——আবুল ভাই, দাদাকে নিয়ে আসেন।
একটু পরেই সিড়িতে দেখা ঐ ষন্ডা টাইপের লোকদুটো জুলকারনাইনকে ধরে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলো। জুলকারনাইনের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যথায় কাঁতরাচ্ছে। ক্ষত স্থানে বুলেটটা রয়ে গেছে। ওটা বের না করা অবধি এ রক্ত ক্ষরণ বন্ধ হবে না। আমার দিকে তাকিয়ে জুলকারনাইন বললো,
—–ম্যাডাম আপনি না ডাক্তার,পারবেন না আমার গুলিটা বের করে দিতে?
—–যন্ত্রপাতি ছাড়া বের করবো কিভাবে?
——কি যন্ত্র লাগবে বলেন আমায়?
—–আপাতত একটা ধারালো চকচকে ছুড়ি লাগবে?সাথে ডেটল আর এন্টিসেপটিক ক্রিম। একটু গরম পানিও লাগবে।
এ কথা শুনে কমলা দৌড়ে গিয়ে একটা চকচকে চাকু, ডেটল আর সেভলন ক্রিম নিয়ে ফিরলো। কমলার পেছনে আবুল একটা গামলায় করে গরম পানি আর তুলো নিয়ে আসলো।
আমি চাকুটা হাতে নিয়ে ভাবছি এটাকে তো জীবানুমুক্ত করতে হবে। এমনসময় আবুল লাইটার আর মোমবাতি নিয়ে আসলো। ওদের তৎপরতা দেখে আমি একটু অবাক হলাম। ওরা বেশ ট্রেনিংপ্রাপ্ত। আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়ে আবুল আর কমলা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
এরপর গরমপানিতে ডেটল দিয়ে ওতে তুলো ভিজিয়ে ক্ষত স্থান ওয়াশ করে নিলাম। ধারালো চাকুটা জুলকারনাইনের হাতের বাহুর ক্ষত স্থানে ঢুকিয়ে দিলাম। গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো।দাঁতে দাত চেপে ব্যথা হজম করে নিচ্ছে। তবে ওর দিকে না তাকিয়ে আমি বুঝতে পারছি ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু অস্বস্তি লাগছে। যাক অনেক কসরত করে বুলেটটা বের করতে সক্ষম হলাম। না হলে আমার ডাক্তারি বিদ্যার অমর্যাদা হতো। ঐ মুহুর্তে আমার দুটো চোখ ওর চোখের উপর আটকে পড়লো। পুরুষ মানুষের চোখ এতো গভীর আর এতো সুন্দর হয় ওর চোখ জোড়া না দেখলে জানা হতো না। আমি যেন নিজের অজান্তে একটু শিহরিত হলাম। চোখটা নামিয়ে নিলাম। তবে সেদিন এটুকু বুঝেছিলাম আমাদের শুধু দৃষ্টি বিনিময় হয়নি ভাবেরও আদান প্রদান হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললাম,
——আপনার সহ্যশক্তি প্রবল।
——এতো সুন্দর মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে জগতের সব যন্ত্রণা ভুলে থাকা যায়। পুরো একটা জীবনও পার করে দেওয়া যায়।
—–ভালোই কথা জানেন দেখছি?
আসলে ওর কথা শুনে আমি ভিতরে ভিতরে খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছি। সেটা ওকে বুঝতে দিলাম না। বুলেটটা বের করার পর রক্ত ক্ষরণ কমে আসলো। ক্ষত স্থান ভালো করে গরম পানি দিয়ে আবারও ধুয়ে দিলাম। তারপর তুলো দিয়ে ভালো করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। আমার কাজ শেষ হওয়ার পর জুলকারনাইন আমাকে বললো,
—–ডাক্তারি বিদ্যাটা ভালোই অর্জন করেছেন।
—–স্বীকার করছেন তাহলে?
এমন সময় কে যেন দরজা নক করছে।
——আসুন।
কমলা এক বাটি সুপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। সুপের বাটিটা সাইড টেবিলে রেখে কমলা একটা কাপড় দিয়ে মেঝের রক্তগুলো মুছে দিলো। তারপর ছুরি, গরম পানির গামলা বাকি সবকিছু নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কমলা চলে যাবার পর জুলকারনাইন আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
——আপনার এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।
আমি তাকিয়ে দেখছি সুপটা খেতে ওর কষ্ট হচ্ছে। কারণ গুলিটা ডান হাতে লেগেছে। বাঁ হাত দিয়ে খেতে পারছে না। আমি কাছে গিয়ে বললাম,
—–খাইয়ে দিবো?
——দিবেন?তাহলে তো ভালোই হয়।
আমি ওকে সুপটা খাইয়ে দিলাম। যতক্ষণ খাওয়ালাম ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সেই দৃষ্টিতে কোনো কামনা ছিলো না। এযেন নিখাদ ভালবাসার দৃষ্টি। জানো ওমর, আমি ওর ঐ চাহনিটা উপভোগ করছিলাম। তুমি তো প্রায় অভিযোগ করে আমায় বলতে, তুমি আমাকে যতটা অনুভব করো আমি নাকি তোমায় করি না। কথাটা তুমি একদম ভুলও বলোনি। তোমার প্রতি আমার ফিলিংসটা এমন ছিলো যে তুমিই আমার ভবিতব্য। সেখানে কোনো শিহরণ অনুভব করতাম না। আমার মাইন্ড এমনভাবে সেট হয়েছিলো যে তোমার সাথে আমার সারাজীবন থাকতে হবে। ছোটোবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়াতে সেখানে কোনো থ্রিল অনুভব করতাম না। কিন্তু সেদিনের পর আমি যেন সত্যি সত্যি জুলকারনাইনের প্রেমে পড়ে গেলাম। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
——আপনার কাছে নাপা আছে?
——হুম,ঐ আলমারীর ড্রয়ারে আছে।
আমি আলমারী খুলে ওকে নাপাটা খাইয়ে দিয়ে ঘুমাতে বললাম। ও আমাকে একটু অবাক করে দিয়ে বললো,
——হাতের এতো কাছে শত্রুকে পেয়ে মেরে ফেলার সুযোগটা হাতছাড়া করলেন কেন?চকচকে ধারালো ছুড়িটা তো আপনার হাতেই ছিলো।
—–আমাকে দেখে কি আপনার মনে হয়, আমি মানুষ খুন করতে পারি?যাক এখন আর কথা বলার দরকার নেই। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

জুলকারনাইনের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর চোখ দুটো ঘুমে ঢুলু ঢুলু। আসলে বুলেটটা বের করাতে ও খুব আরাম পাচ্ছে। রাতটা আস্তে আস্তে পার হয়ে যাচ্ছে। আমি বারান্দা থেকে রকিংচেয়ারটা নিয়ে এসে ওটাতেই বসে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ও ঘুমানোর কিছুক্ষণ পর দেখলাম ব্যথায় বারবার কঁকিয়ে উঠছে। কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। একবার মনে হলো কাউকে ডাকি। আবার ভাবলাম এখান থেকে ডাকলে যদি ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। রুম থেকে বের হতে ভয় লাগছে। এখানে বিদ্যুতের আলো নেই। তবে হ্যাচাক বাতির মতো অনেক হারিকেন জ্বালানো থাকে। তাতে অবশ্য পুরো বাড়িটা আলোকিত হয়। রুম থেকে বের হতে গিয়ে একটু চমকে উঠলাম। ষন্ডা টাইপের আবুল বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বললো,
——ম্যাডাম কিছু বলবেন?
——উনার মনে হয় জ্বর আসছে। মাথায় জলপট্টি দিতে হবে।
——আপনি রুমে যান। কমলাকে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
রুমে চলে আসার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কমলা একটা গামলায় পানি আর টাওয়েল নিয়ে আসলো। আমি টাওয়েলটা ভিজিয়ে ওর কপালে জলপট্টি দিয়ে দিলাম। কমলা এই ফাঁকে সুপের বাটি নিয়ে চলে যাবার সময় বললো,
——ম্যাডাম আমি জেগেই আছি। দরকার পড়লে আবুলকে দিয়ে খবর পাঠাইয়েন।
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। জলপট্টি দেওয়ার সময় ওর মুখটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। কি নিস্পাপ সুন্দর চেহারা! কোন বাবা মায়ের সন্তান? কেনোইবা এমন জীবন বেছে নিলো। আজ গুলি ওর শরীরে কিভাবে লাগলো?একবার জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা হলো। পরে মনে হলো অপেক্ষা করে দেখি ও নিজেই হয়তো বলতে পারে।

পাখির কিচির মিচির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জুলকারনাইনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি,ও আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়াতে বললো,
——আর কতোদিন টিশার্ট পড়ে থাকবেন।
আসলে এতো ঝামেলার মাঝে নিজের পোশাকের দিকে তেমন খেয়াল ছিলো না।
——কেন আপনার কি ভাগে কম পড়ে যাচ্ছে?
——না,তা নয়। মেয়েরা শাড়ি পড়লে খুব সুন্দর লাগে।
—–হুম,ওসব কথা থাক। এখন কেমন লাগছে সেটা বলুন?
——কালকের তুলনায় একশতগুন ভালো। তবে ক্ষত স্থানে যন্ত্রণা হচ্ছে।
——হুম, এন্টিবায়োটিক লাগবে। নাম লিখে দিলে ওষুধ আনা যাবে?
—–তা যাবে।
আমি একটা কাগজে কিছু ওষুধের নাম লিখে দিলাম। জুলকারনাইন কাগজটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি এই সুযোগে টিশার্ট আর ট্রাউজার চেঞ্জ করে জুলকারনাইনের এনে দেওয়া বাসন্তি কালারের শাড়িটা পড়লাম। অনেকদিন পর চিরুনী দিয়ে চুল আঁচড়ে একটা লম্বা বেনী করলাম। আলমারীতে লাগিয়ে রাখা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। আমায় খুব সুন্দর লাগছে। শাড়ির কুঁচিটা ঠিক করে আয়নার দিকে আবার তাকিয়ে লজ্জা পেলাম। আমার লজ্জাবনত মুখ দেখে ও বললো,
——অপূর্ব
আমি আস্তে আস্তে সম্মোহিত হয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।

চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

জুলকারনাইনের দিকে আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। একদম ওর কাছে পৌঁছে গেলাম। এতোটা কাছে ছিলাম যে ওর নিঃশ্বাসের শব্দ আমি শুনতে পারছি ঠিক সেই মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিলাম। আমার অন্তর আমায় বলে উঠলো রুবাইয়াত তুই এতো বড় ভুল করিস না। এই ভুলে তোকে অনেক বড় মাশুল গুনতে হবে। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বুঝতে পারছি ও আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। চটজলদি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
—–দেখি আপনার ক্ষত স্থানটা?
——ও এই ব্যাপার,
——-আপনি কি ভেবেছেন?
——না, তেমন কিছু না।
আমি ওর হাতটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–আপনি আমার এতো বড় উপকার করলেন বিনিময়ে যা চাইবেন তাই দিবো। শুধু আপনার মুক্তি দিতে পারবো না। সেই দায়িত্ব বস আমাকে এখনও দেয়নি।
—–ঠিক আছে, সময় মতো চেয়ে নিবো। আপাতত আমাকে রুম থেকে বেরুনোর অনুমতি দেন। আমি এখানকার চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। রুমের ভিতর বন্দী হয়ে থেকে আমার দম আঁটকে আসছে।
—–,কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে আপনি ভুলেও পালানোর চেষ্টা করবেন না। এখানে প্রতিপদে বিপদ ওৎ পেতে রয়েছে। বনের সাপ বিচ্ছু চিতাবাঘ তো আছে এছাড়াও মানুষরুপী হায়েনাও এখানে বসবাস করে। এই যে আমি যে গুলি খেয়েছি এটা আমার বিরোধীপক্ষরা করেছে। তেমনি ওরা যখন জানবে আপনি আমাদের বন্দী তখন আমাদের বিপদে ফেলতে আপনার চরম সর্বনাশ করে দিতে পারে। সুতরাং সাবধান থাকবেন।
——গুলি কি এরকম প্রায়শ খাওয়া হয়?
——এগুলো আমাদের কাছে পান্তাভাত।
——তাতো, বুঝতেই পারছি।
——আসলে এ লাইনে কাজ করবো আর খুন খারাবি গোলা গুলির সাথে খেলবো না তা কি করে হয়? খেলতে খেলতে এক সময় পান্তাভাত হয়ে যায়।
——আপনার নিজের জীবনের প্রতি মায়া নেই?
——মায়া থাকলে কি মৃত্যুকে নিয়ে প্রতি মুহুর্তে খেলতাম? খেলতাম না। এই যে আমাকে দেখছেন এ হচ্ছে এক জীবন্ত লাশ। যে লাশটা দশ বছর আগেই মরে গেছে।
এমন সময় কে যেন দরজায় টোকা দিলো। জুলকারনাইন এগিয়ে গিয়ে ভেজানো দরজার কপাট খুলে দেখে কমলা দাঁড়িয়ে আছে।
——কিরে কমলা, কিছু বলবি?
——আপনাদের দু,জনের নাস্তা কি রুমে দিয়ে যাবো?
—-না আজ রুবাইয়াত আমার সাথে টেবিলে নাস্তা করবে। তুই নিচে গিয়ে চটজলদি সব গুছিয়ে দে।
কমলা চলে যাওয়ার পর জুলকারনাইন আমার কাছে এসে বললো,
——এতোক্ষণ অনেক কঠিন কথাবার্তা হলো।এরমাঝে আপনাকে একটা জরুরী কথা বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম। ভীষণ সুন্দর লাগছে আপনাকে। চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ছে?
—–কিন্তু এভাবে পরনারীর দিকে তাকিয়ে থাকা ঠিক না।
জুলকারনাইন লজ্জা পেয়ে চোখটা নামিয়ে ফেললো। তারপর মাথা নিচু করে আমায় বললো,
——চলুন, ব্রেক ফাস্ট করে আসি।
একথা বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমিও ওর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। নিজেকে বাঁচাতে জুলকারনাইনকে আমি লজ্জা দিলাম। কারণ আমি অনেক আগেই ওর গভীর কালো চোখ দুটোর প্রেমে পড়েছি। তবে আমার মনে হয় শুধু আমি নই যে কোনো নারী ঐ স্বচ্ছ দিঘীর মতো কালো চোখ দুটোতে হারিয়ে যেতে চাইবে। ও যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তখন আমি খুব রোমাঞ্চিত হই। তবে আজ ওর কথাগুলো শুনে খুব কষ্ট অনুভব হলো। কি জানি হয়তো এক সমুদ্র বেদনার জল ওর বুকের গহীনে লুকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে আমার মনটা কেন যেন ওর সম্পর্কে খুব কৌতুহলী হয়ে উঠছে।
ডাইনিং এ এসে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বাশ দিয়ে ডাইনিং টেবিল বানানো হয়েছে। চেয়ারগুলোও বাশের তৈরী। কমলা নাস্তার আইটেমে বিন্নি চালের খিচুড়ী আর গরুর মাংস সাথে টক ঝাল মিষ্টির মিক্সড আচার। খেতে খুব অপূর্ব লাগলো। খাওয়া শেষ হতেই কমলা দু,মগ চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে জুলকারনাইন আমাকে বললো,
——আজ আমার হাতে কোনো কাজ নেই। হাতে গুলি খাওয়াতে বস ছুটি দিয়েছে। তবে যে কোনো মুহুর্তে ডাক পড়তে পারে। আপনি চাইলে আমার সাথে বাইরে ঘুরতে পারেন।
আমিও আর দেরী না করে সাথে সাথে আমার মত জানিয়ে দিলাম। চা শেষ করে দু,জনে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে বের হয়ে আমি প্রথমে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। ঘন জঙ্গলের আড়ালে আলো আঁধারীর খেলা, নাম না জানা পাখির ডাক,মাঝে মাঝে হরিণ দল বেঁধে ঘুরছে। আমি যেন এক নিটোল প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেলাম। জুলকারনাইনের দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওর মুডটাও আজ বেশ ভালো। আমি আর ও হাঁটতে হাঁটতে বড় পাথরের খন্ডের উপর বসে পড়ি। ওকে যতই দেখি ততই অবাক হই। শান্ত ভদ্র এবং আমার কাছে ওকে মেধাবীও মনে হয়। ওর বিষয়ে জানতে কৌতূহল দমন করতে না পেরে সাহস করে বলেই ফেলি,
——আমি বুঝে পাই না আপনার মতো স্মার্ট,সুদর্শন বুদ্ধিমান যুবক এই প্রফেশনে কিভাবে আসলো? আপনাকে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। ধরে নিলাম অাপনি ট্রাপে পরে এ লাইনে এসেছেন কিন্তু আপনি তো বেরুনোর চেষ্টা করতে পারতেন?
——-চোরাবালির নাম তো শুনেছেন? এই লাইনটা হচ্ছে চোরাবালি। এখানে আসলে সবাই শুধু নিচের দিকে তলিয়ে যেতে থাকে। সেই সাথে উপরে উঠার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
—–আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
——বুঝতে পারছি, আমার বিষয়ে আপনার অনেক কৌতূহল হচ্ছে। আসলে আমি আমার কথা কারো কাছে শেয়ার করি না। এতে শুধু কষ্ট বাড়ে।
—–কষ্টকে শেয়ার করতে হয়। এতে বেদনার ক্ষতটা সহজে শুকায়। আপনি আপনার কষ্টের কথাগুলো আমার সাথে শেয়ার করেন। দেখবেন কষ্টের বোঝাটা অনেক হালকা হয়ে যাবে। আপনার বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়?
—–নাহ। আজ দশ বছর ওদের সাথে আমার দেখাও হয় না কথাও হয় না।
—–এই লাইনে কি নিজ থেকেই এসেছেন?
——এখানে কেউ নিজে থেকে আসে না। আর মায়ের পেট থেকে কেউ সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায় না। আমিও ট্রাপে পড়েছিলাম। আমাদের মতো ট্রাপে পড়া ছেলেদের সন্ত্রাসী বানানো হয়। আমি তখন ঢাকা ভার্সিটিতে আই আর এ ভর্তি হয়েছি। একদিন অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দুই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। এমনকি গোলাগুলিও হয়। হঠাৎ আমার সামনে আমার ক্লাসের এক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়। দৌড়ে গিয়ে আমি ওকে পাঁজা কোলা করে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু এর মাঝেই পুলিশ চলে আসে। সিনিয়র ভাইয়েরা পালিয়ে যেতে বলে। কারণ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে রক্ষে থাকবে না। আমিও তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ওকে ঘাসের উপর ফেলে রেখে পালিয়ে যাই। পরে জানতে পারি ঐছেলেটা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়। খুন না করেও আমিও খুনের মামলার আসামী হয়ে যাই। পুরো জীবন আমার বরবাদ হয়ে যাই। দোষ না করে দোষী হওয়াতে আমার অন্তরটা সেদিন মরে যায়। সেই থেকে জীবন্মৃত লাশ হয়ে আজও বেঁচে আছি।
—–এখানে কি করে আসলেন?
—–আমি নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা মা আর আমরা দু,ভাই এই নিয়ে আমাদের সংসার। খুব সুখের সংসার ছিলো। বাবা ছিলেন সরকারি অফিসের কেরাণী। সিনিয়র ভাইয়েরা বললো এই মামলা চালাতে অনেক টাকার দরকার হবে। নয়ত ফাঁসীতে ঝুলতে হবে। আমার বাবার তো অর্থের প্রাচুয্য নেই। আমি তখন সিনিয়র ভাইয়াদের এ কথা জানাই। ওরাই আমাকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।সেই থেকে বসের সাথে আছি। আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করছি।
——আপনার নাম গুলতি জুলকারনাইন হলো কেন।
আমার কথা শুনে ও প্রচন্ড হাসতে লাগলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
—–আমার গুলতির নিশানা কখন মিস হয় না। এই কারনে বস আমার নাম দিয়েছে গুলতি জুলকারনাইন। আমার এসব কথা বলতে আর ভালো লাগছে না। এখানে কাছেই একটা ঝরণা আছে। চলুন সেখানটায় ঘুরে আসি।
ওর কথাগুলো শুনে আমার বুকের ভিতরটা ব্যথায় মোঁচড়াতে লাগলো। কি ভাগ্য ওর! কত সুন্দর জীবন হওয়ার কথা? অথচ নোংরা রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে ওর মতো বহু জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতাদের এসব আহত করে না। এই জীবনটা ও সমাজ সংসার কিংবা দেশের উপকারে লাগাতে পারতো।

——কি অত ভাবছেন বলুন তো? তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসুন। কখন আবার বসের ডাক পড়বে কে জানে?

ওর ডাক শুনে আমি দ্রুত হেঁটে ঝরণার কাছে পৌঁছে গেলাম। ঝরণা জল ছুঁয়ে দিতে আমার খুব ইচ্ছে হলো। আমি জলের পানে এগিয়ে যেতে লাগলাম। হঠাৎ একটা পাথরের খন্ডে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। জুলকারনাইন দু,হাতে আমাকে ধরে ফেললো। আমি ওর হাতের উপর শুয়ে ওর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলাম। মনটা খুব চাইছিলো ওর দু,চোখের মাঝে হারিয়ে যেতে। দু,জনের কারো মুখে কথা নেই। জুলকারনাইন আস্তে আস্তে আমার মুখের পানে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমি যেন বাঁধা দেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। ওকে দেখলে আমার এমন কেন হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে