অন্তহীন প্রেম পর্ব-১১+১২

0
558

#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব–এগারো
মাহবুবা বিথী

পরিনত বয়সের দুটো মানুষ বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলো। জুলকারনাইন আমাকে মুক্তি দিতে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু আমি ওর কাছে আমার ভালোবাসার প্রাপ্যটা আদায় করে নিয়েছিলাম। কারণ আল্লাহর কালাম স্বাক্ষী রেখে আমি ওকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। আর ও আমাকে ভালোবেসেছিলো। এবং এতোটাই ভালোবেসেছিলো যে হাসতে হাসতে নিজের প্রাণটা দিয়ে দিলো।আমি ওর দুচোখে আমার জন্য তীব্র ভালোবাসার অনুভব দেখেছিলাম। ও জানতো আমাকে ভালোবাসার অপরাধে ওর প্রাণটা চলে যেতে পারে।
আমাদের দুটো প্রাণ সেদিন একাকার হয়ে মিশে গিয়ে দুজনের চোখে সুখ নিদ্রাটা কেবল পেখম মেলেছিলো তখনি গুলির শব্দে আমার তন্দ্রা ছুটে যায়। পুলিশের গাড়ির হুইসেল বেজে উঠে। আমি জুলকারনাইনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞাসা করি,
——পুলিশ এখানে কিভাবে আসলো?
——এটা নিশ্চয় বসের কর্ম। নিজের খায়েস পূরণ হয়নি বলে আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলো।
তবে জুলকারনাইন অবাক হয়েছিলো এজায়গাটার খোঁজ বস কি করে পেলো। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে। পুলিশের সাথে আবুলও আসে। পরে শুনেছিলাম টাকার লোভে আবুল একাজ করেছিলো। পুলিশ ভিতরে ঢুকেই এলোপাথারী গুলি করতে থাকে। তখন ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। প্রতিটি গুলি ওর গায়ে এসে পড়ে। অথচ ঐ অবস্থায় ও আমাকে বলে,
—–রুবাইয়াত আমি কথা রেখেছি। তোমাকে বলেছিলাম না, আমি বেঁচে থাকতে কেউ তোমার গায়ে ফুলের টোকাও দিতে পারবে না। তোমার গায়ে একটা বুলেটও ছুঁতে দিবো না। তোমার জন্য যদি মরতে পারি তবে এ মৃত্যু আমার সুখের মৃত্যু।
আমি কলেমা পড়তে লাগলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ওকে হারানোর ক্ষতের যন্ত্রণায় আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমার আর্তচিৎকারে সেদিন বনাঞ্চলের রাত্রির নিরবতা খানখান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। ভাবতে পারো, বাসর শেষ হওয়ার আগেই যে নারীকে বৈধব্য বহন করতে হয় তার অন্তরের কষ্ট কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? অথচ আমার চিবুক গলায় তখন ওর লাভ বাইটের দাগগুলো লেগেছিলো। চিৎকার দিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপরের ঘটনাগুলো আমার মনে নাই। কতক্ষণ ঐ অবস্থায় পড়েছিলাম মনে নেই। তবে পানি ঝাপটানোর ফলে জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলে দেখি আম্মু আব্বু আর আয়ান আমার মুখের উপর হুমড়ি খেয়ে তাকিয়ে আছে। সেদিন থেকে আমি বিষাদের অতল সমুদ্রে ডুবে গেলাম। আমার এই আচরনে আব্বু আম্মু খুব বিরক্ত হয়েছিলো। একজন দাগী আসামির জন্য আমার কিসের এতো টান? ওকে হারানোর শোকে আমার মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে।
ওমর,এরপরের ঘটনাতো তোমার জানার কথা। কারণ আমি তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তোমার এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। যতসম্ভব তখন কাউকে চিনতে পারছিলাম না।
একথা গুলো বলার পর রুবাইয়াত ওর আদ্রনয়ন দুটো টিসু পেপার দিয়ে মুছে ফেললো। ও জানে না আদৌ কোনোদিন ও জুলকারনাইনকে ভুলতে পারবে কিনা? নাকি সারাজীবন এই দগদগে ঘা ওকে বয়ে বেড়াতে হবে।
রুবাইয়াতের নিরবতা ভঙ্গ করে ওমর বললো,
——এরপর তোমাকে ওখান থেকে সে রাতেই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আঙ্কেল আন্টি তোমাকে এভাবে দেখে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। নিজের সন্তানের এতো বড় ট্রাজিডি ওনারা মেনে নিতে পারেননি। তোমার এ অবস্থার কারণে আন্টির শরীর তো স্ট্রোক করে আগেই খারাপ হয়েছিলো। আর আঙ্কেলও এই পরিস্থিতি মেনে নিতে না পেরে চাকরিতে ইস্তফা দিলেন। আমিও এক নজর দেখতে তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার মুখে শুধু জুলকারনাইনের নামই উচ্চারিত হতো। রুবাইয়াত তুমি আমার কথায় কিছু মনে করো না কারণ সে সময় আমার জুলকারনাইনকে খুব হিংসে হতো।
রুবাইয়াত অপলক দৃষ্টিতে ওমরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
—-ওমর, তোমার আমার উপর কখনও রাগ হয়নি? কারণ তুমি তো আমার কাছে তোমার ভালোবাসার মুল্য পাওনি?
——না,রাগ হয়নি বরং ভীষণ মায়া হয়েছিলো। তোমাকে ভালোবাসার পর তুমি যখন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলে সেসময় আমি বুঝেছিলাম, ভালোবাসার মানুষকে কাছে না পেলে কতটা দহন হয় বুকের ভিতর। তাই আমিই তোমার চিকিৎসার ভার নিলাম। যদিও আঙ্কেল আন্টি খুব হতাশ হয়েছিলেন কিন্তু আমার আল্লাহপাকের উপর বিশ্বাস
ছিলো আমি তোমার ক্ষতের জায়গায় সহজেই মলম লাগাতে পারবো। কারণ ঐ একই আঘাতে আমিও যে ক্ষত বিক্ষত। আমার বিশ্বাস ছিলো তুমি একদিন ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। আল্লাহপাকের রহমতে বরং বেশ আগেই সেরে উঠলে। আল্লাহপাকের কাছে এই শোকরানার শেষ নাই।
——তুমি আমার জন্য এতোটা করলে অথচ তোমাকে দেবার মতো আমার কাছে কিছুই নাই। ওমর তুমি এবার খুব সুন্দর একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেলো।
——ঐ কাজটি আমার দ্বারা আর কখনও সম্ভব নয়।
——কেন সম্ভব নয়? তুমি রাজি থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে পাত্রী খুঁজে তোমার সাথে বিয়ে দিবো।
——কেন জোর করছো আমায়? তুমি নিজেকে দিয়ে তো বুঝতে পারো। জুলকারনাইনকে ভালোবাসার পরে তার জায়গায় তুমি কি অন্য কাউকে বসাতে পারবে? পারবে না। হোক না সে দাগী আসামি। তবুও সেতো তোমার ভালোবাসার মানুষ। আমার অবস্থা তাই। যে মনটা আমি একজনকে দিয়ে দিয়েছি। তারপরে অন্য কাউকে দেবার মতো আমার কাছে কিছু নেই।
—–আঙ্কেল আন্টি তো আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবেন? আর আমার মতো এক অপয়া অলুক্ষনে মেয়ের জন্য তুমি কেন তোমার জীবনটা নষ্ট করবে। এছাড়াও সমাজের চোখে আমি একজন ভ্রষ্টা নারী।
——কেন করবেন? তুমি আমার সম্পদ নও যে তোমার মনের উপর আমার কন্ট্রোল থাকবে। তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারো। সে অধিকার তোমার আছে। আমি বরং উসমানকে বিয়ে দিতে বাবা মাকে বলেছি। ওতো এ বছর বরিশাল মেডিকেল থেকে ডাক্তার হয়ে বের হচ্ছে। আর যতটুকু জানি ওর পছন্দের মেয়েও আছে। ওদের বিয়ে দিয়ে বাবা মা উনাদের আশা আকাঙ্খা পূরণ করে নিক। আর সমাজ তোমাকে যে নামেই ভূষিত করুক না কেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমৃত্যু কাল তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবো। আমার চোখে কি যেন পড়েছে খুব জ্বালা করছে।ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে একটু পানি দিয়ে আসি।

রুবাইয়াতের দৃষ্টি এড়ায়নি ওকে কথাগুলো বলতে গিয়ে ওমরের গলাটা যেন ধরে এলো। হয়তো নিজের চোখের জল আড়াল করতে ওর সামনে থেকে সরে গেল। টিনএজার থেকে একসাথে ওরা বড় হয়েছে। ওদের প্যারেন্টসদের চাওয়া অনুযায়ী বিয়েটা ঠিক হয়েছিলো। ঐ কারনে কিনা ও জানে না, ওমরকে প্রেমিক ভাবার ক্ষেত্রে রুবাইয়াতের কোনো থ্রিল অনুভব হতো না। তাই ওর জন্য ওমরের ভালোবাসার অনুভব কতটা গভীর সেটা বোঝার উপলব্ধি কখনও হয়নি। অথচ ওমর যে ওকে এতোটা ভালেবেসে ফেলেছে সেটা জানতে পারে নিজেকে আজ ওর অপরাধী মনে হচ্ছে।
অথচ জুলকারনাইনের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো রুবাইয়াত কখনও ভুলতে পারবে না। ওর বুকের আলমারীতে সেই স্মৃতিগুলো সযতনে ও সাজিয়ে রেখেছে। কোনো নিঃসঙ্গ দুপুর কিংবা একলা বিকেলের মুহুর্তে স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে স্বর্গীয় সুখে ও হয়তো ভেসে বেড়াবে কিংবা এই স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকবে । সারাজীবনের অতৃপ্তের দহনে পোড়া একজন ভালোবাসার কাঙ্গালকে ও কিছুটা সময় ভালেবাসায় ভরিয়ে দিতে পেরেছে এটা ভাবতেই রুবাইয়াত অনন্য অনুভবে হারিয়ে যায়।
ওমরকে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে কিনা রুবাইয়াত বুঝতে পারছে না। ওর নিচের অ্যাবডোমেনে একটা কাঁটা দাগ আছে। সিজার করার সময় ঐ স্থানটা কাটা হয়। ওর কি বেবি হয়েছিলো এটা নিয়ে ধোয়াশায় আছে। আর যদি হয়ে থাকে সে কোথায়? বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে কিছুই তো ও জানে না। ওর জীবনের দশ মাসের কোনো স্মৃতি এখন ওর মনে পড়ছে না। শুধু এটুকু মনে আছে ওর স্তনে খুব ব্যথা হতো।
রুবাইয়াত উম্মুখ হয়ে বসে আছে কখন ওমর ওয়াশরুম থেকে বের হবে। রুবাইয়াত ওর সন্তানের কথা ওমরের কাছে জানতে চাইবে। রুবাইয়াত জানালা দিয়ে দৃষ্টি বাইরে ছড়িয়ে দিলাে। ঝড় থেমে গিয়ে মেঘমুক্ত শুভ্র আকাশ। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রাতের পৃথিবীটা দেখতে লাগলো। মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদের আলোয় পুরো পৃথিবী আজ স্নান করছে।
ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর ওমরের চেহারা দেখে রুবাইয়াত মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। ওর চোখদুটো অঙ্গারের মতো লাল হয়ে আছে। রুবাইয়াত ভাবছে, ওমর কি এতোক্ষণ বাথরুমে বসে কেঁদেছে? ওমর বুঝতে পারছে রুবাইয়াত ওকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই প্রসঙ্গ ঘুরাতে রুবাইয়াতকে বললো,
——,চোখে কি যেন পড়লো। এতো পানি দিলাম তাও জ্বালা কমলো না। রাত দুটো বাজে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও রুমে চলে যাই। সকালে আমরা বাড়ির পথে রওয়ানা দিবো।
রুবাইয়াত ইতস্তত করতে লাগলো। তারপর নিজেকে সামলাতে না পেরে একসময় বলেই ফেললো,
——ওমর আমার তো একটা বেবি হয়েছিলো তাই না?
ওমর শকড খাওয়ার মতো করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো।
চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-বারো
মাহবুবা বিথী

ওমর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—–এ ব্যাপারে তুমি আঙ্কেল আন্টির কাছে জেনে নিও।
আসলে সত্যি কথাটা ওমর এই মুহুর্তে রুবাইয়াতকে জানাতে পারছে না কিংবা জানাতে চাইছে না। যদিও রুবাইয়াত এখন সুস্থ তবুও এই বিষয়টা ওকে জানানো ঠিক হবে না। নিরবতা ভঙ্গ করে রুবাইয়াত বললো,
—–আম্মু আব্বুর কাছে হয়তো জেনে নিবো কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তাই তোমার কাছে জানলে সমস্যা কি? আমার ব্রেস্টে এখনও ব্যথা আছে। মাঝে মাঝে জামা ভিজে যাচ্ছে। আর কাঁটা জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। খুব বেশী হলে মাসখানিক কিংবা দেড়মাস আগের ঘটনা। আমার আসলে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? আমার বেবিটা কোথায় কি অবস্থায় আছে?
—-আমি সেসময় সপ্তাহখানিকের একটা সেমিনারে অংশ নিতে ইউকে গিয়েছিলাম। তাই ঐ বিষয়টা আমার সঠিক জানা নেই। আঙ্কেল আন্টির মানসিক অবস্থা ভালো না থাকাতে উনাদেরকেও জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। তোমার একটা বেবি হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু বেবিটার ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা আমার জানা নেই। তোমার শরীরটা কেবল সেরে উঠলো। এখন এসব বিষয় নিয়ে এতো ভেবো না। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবো। তোমাকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। গুড নাইট।

ওমর রুবাইয়াতের প্রশ্ন এড়াতে কেবিন থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে গেল। রুবাইয়াত একটু অবাক হলো ওর বেবিটার খোঁজ খবর করা মা হিসাবে এটা ওর অধিকার। ওমর এটা নিয়ে লুকোচুরি করছে কেন ও বুঝতে পারছে না। তবে নিজ থেকে ও আর কিছু জানতে চাইলো না। কালতো বাড়ি যাচ্ছে। বরং আব্বু আম্মুর কাছেই পুরো বিষয়টা জানতে চাইবে।আসলে মাথাটা কেমন যেন করছে। খুব ভার হয়ে আছে। ও আর বেশিকিছু ভাবতে পারলো না। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

—-মাম্মাম তুমি কি আমাকে খুঁজছো?
রুবাইয়াত মাম্মাম ডাকে চমকে উঠে। মাম্মাম ডাক শোনা মাত্রই বুকের ভিতর শীতল হাওয়া বয়ে গেল। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো এ যেন দেবশিশু। তবে চেহারাটা যেন জুনিয়র জুলকারনাইন। রুবাইয়াত ওকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে আর বলে,
—–হ্যাঁ বাবাই আমি তো তোমাকেই খুঁজছি। তুমি ছাড়া আমার এতো আপন এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তো তুমি।
——মাম্মাম তুমি আর কাঁদবে না। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো। তুমি আর আমি তো আছি কিন্তু আমার বাবা কোথায়?
——বাবা,আকাশের তারা হয়ে গেছে সোনা।
—–এবার তাহলে তুমি আর আমি আকাশের তারা হয়ে যাই?
সাথে সাথে রুবাইয়াতের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফজরের আযান শোনা যায়। চোখের জলে রুবাইয়াতের বালিশটা ভিজে যায়। দু,চোখ ভেজা। ঘুম ভাঙ্গার পরেও ওর দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে। ওর জীবনটা এমন হলো কেন? এর উত্তর ও খুঁজবে কার কাছে?
ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে দুহাত তুলে আল্লাহপাকের কাছে বাচ্চাটার জন্য দোয়া করলো। যেখানেই থাকুক ও যেন ভালো থাকে।
এরপর হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে ভোরের হাওয়া গায়ে মাখতে ওর ভীষণ ভালো লাগলো। দূর থেকে তাকিয়ে দেখছে ওমর দু,কাপ চা আর আলুপুরি নিয়ে রুবাইয়াতের দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে ওমর রুবাইয়াতকে বললো,
—–কখন উঠেছো?
——আজ একটু সকালেই ঘুম ভেঙ্গেছে।
——বাড়ি যাবার আনন্দে?
রুবাইয়াত মুখে কিছু বললো না। ওমর রুবাইয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখটা যেন বিষাদে ঢেকে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ওমর রুবাইয়াতকে বললো,
—–আসো, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
রুবাইয়াত ওমরের পিছু পিছু রুমে এসে বিছানায় বসলো। ওমরও রুবাইয়াতের মুখোমুখি বসলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দু,জনে দুকাপ চা হাতে তুলে নিলো। ওমর আলুপুরি রুবাইয়াতের হাতে তুলে দিলো। ওর বিষাদমাখা মুখটা দেখে ওমরের বুকের ভিতরটা ব্যথায় মোঁচড়াতে লাগলো। মানুষের ভাগ্যটা বড্ড অনিশ্চিত। একবছরের মধ্যে কত কিছু ওদের জীবনে ঘটে গেল। ও কখনও কল্পনাও করেনি রুবাইয়াত আর ওর জীবনের পথটা এভাবে ভিন্ন ধারায় বয়ে যাবে। আজকে রুবাইয়াতের জীবনে ওরই তো থাকার কথা ছিলো। অথচ কোথা থেকে কি হয়ে গেল? ফোনের শব্দে নিরবতা ভেঙ্গে ওমর মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে রুবাইয়াতের আম্মু ফোন দিয়েছে।
——হ্যালো আন্টি, কেমন আছেন?
—–ভালো, তোমরা কখন আসছো?
—–এই তো এখনি বের হবো। রুবাইয়াতের সাথে কথা বলবেন?
রুবাইয়াত সাথে সাথে বলে উঠলো,
—–এখন আর কি কথা বলবো? একটু পরেই তো দেখা হচ্ছে।
——আচ্ছা ঠিক আছে। ও যদি বলতে না চায় থাক। তোমরা তাড়াতাড়ি আসো। সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করবো। রাখছি।
ওমর ফোনটা রেখে রুবাইয়াতকে বললো,
—–দ্রুত গুছিয়ে নাও। আমাদের সাথে নাস্তা করার জন্য আঙ্কেল আন্টি অপেক্ষা করছে।
—–আমার সবকিছু গুছানোই আছে। চলো বেরিয়ে পরা যাক।
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকাই আছে। ওমরের ক্লিনিকটা উত্তরায়। উত্তরা থেকে ইস্কাটনের দিকে ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে। ড্রাইভিং সিটে ওমর পাশে রুবাইয়াত বসে আছে। ওমর গাড়ি চালাতে গিয়ে আড় চোখে রুবাইয়াতকে দেখছে। রুবাইয়াত গাড়ির জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ওর শরীরটা এখানে কিন্তু অন্তরটা অন্য জগতে বিরাজ করছে। অথচ এই রুবাইয়াত কি চটপটে মেয়ে ছিলো। মুখটা খুব নির্মল। সবসময় মুখে ঝর্ণাধারার মতো হাসি লেগে থাকতো। রুবাইয়াতের সব কিছু ওমরের খুব ভালো লাগতো। হ্যাঁ এটা ঠিক লুতুপুতু প্রেমটা ওর রুবাইয়াতের সাথে কখনও হয়নি। কিন্তু দু,জন দুজনকে ভীষণ পছন্দ করতো। এক্ষেত্রে ওমর একটু এগিয়ে থাকতো। রুবাইয়াত যে ওকে অপছন্দ করতো তা নয়। কারণ ওরাতো মাঝে মাঝে এখানে ওখানে ঘুরতে যেতো। এমনতো নয় রুবাইয়াত যেতে চাইতো না। সানন্দেই ওমরের সাথে ঘুরতে যেতো। ওর খুব ইচ্ছা হতো রুবাইয়াতকে একটু স্পর্শ করতে কিন্তু পর মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিতো। মনকে এই বলে বোঝাতো এই তো আর ক,দিন পরে এই উচ্ছল মেয়েটা ওর বউ হবে। তখন না হয় পুরোটা উসুল করে নিবে। ইস্কাটনে পৌঁছে ওমরের ভাবনায় ছেদ পড়লো। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বনেট থেকে ওমর লাগেজ বের করে রুবাইয়াতকে সাথে নিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়ালো। রুবাইয়াতকে আসতে দেখে আশে পাশের ফ্লাটের মানুষগুলো উৎসুক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকাতে লাগলো। এমনকি লিফটে রুবাইয়াতের এক প্রতিবেশীর সাথে দেখা হলো। উনি রুবাইয়াতকে দেখে বললেন,
——কেমন আছো?
—–ভালো আছি আন্টি।
——পরিপূর্ণ সুস্থ হয়েছো তো? তোমার বাবা মাকে যা ভোগান্তিতে ফেললে?
ওমরের ঐ মহিলাকে খুব বিরক্ত লাগছিলো। মানুষের কথাবার্তার কি ছিরি! সুস্থ না হলে ও বাড়ি ফিরলো কেন? যাইহোক মহিলা ফোর্থ ফ্লোরে নেমে যাওয়াতে ওমর হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সেভেনফ্লোরে ওরা নেমে গেল। ডোরবেল বাজাতে রুবাইয়াতের আম্মু এসে দরজা খুলে রুবাইয়াতকে বুকে জড়িয়ে নিলো। রুবাইয়াতের আরষ্ট ভাব দেখে ওর বাবা বললো,
——-তোর কি শরীর খারাপ লাগছে মা?
—–না, তবে ভালোও লাগছে না।
আয়ান এসে বোনের হাত ধরে বললো,
—–আম্মু আজকে সব তোর পছন্দের নাস্তা বানিয়েছে। আমরা কতদিন পর পরিবারের সবাই একসাথে নাস্তা করবো এটা ভাবতেই মনটা খুশীতে ভরে উঠছে।
রুবাইয়াত আয়ানের সাথে রুমের ভিতরে চলে গেল। রুবাইয়াতের আম্মু টেবিলে নাস্তা বেড়ে দিতে কিচেনে চলে গেল।
ওমর এদের কথাবার্তা শুনে ড্রইংরুমে বসে বললো,
—–আঙ্কেল আমি তাহলে এখন বাড়ি চলে যাই?
——কি বলছো বাবা? তুমি না থাকলে তো আমার এই আনন্দ পরিপূর্ণতা পাবে না। তুমি আমার মেয়ের জন্য যা করলে এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।
——এভাবে বলবেন না আঙ্কেল। আমি কষ্ট পাই। আপনারা তো আমার আর রুবাইয়াতের সম্পর্কের ব্যাপারটা জানেন। আপনারা আমার অতি আপনজন। আপনাদের জন্য এটুকু করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

পরোটা, গরুর মাংস ভুনা, পায়েস, পাটিসাপটা পিঠা,ডিম পোজ, সাথে আপেলের জুস দিয়ে সবাই জম্পেশ ব্রেকফাস্ট করলো। শুধু রুবাইয়াত তেমন কিছু খেতে পারলো না। পাটিসাপটা পিঠা আর জুসটা খেলো। টেবিলে সবার নজর ছিলো ওরদিকে। খুব দ্রুত নাস্তা করে ও রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ওকে এরকম বিমর্ষ দেখে ওর বাবা ওমরকে বললো,
—–ওমর ও পরিপূর্ণ ভাবে সেরে উঠেছে তো?
—–আল্লাহর রহমতে ও এখন সম্পূর্ন সুস্থ। তবে ওর ভিতর অনেক টানা পোড়েন চলছে। ওর বেবির কথা জানতে চাইছিলো। যা কিছুই ওকে বলবেন খুব ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় বলবেন।
ওমর চলে যাবার পর রুবাইয়াতের মা জরিনাকে এঁটো প্লেটগুলো টেবিল থেকে নিয়ে যেতে বললো। উনি সবকিছু গুছিয়ে রুবাইয়াতের রুমে এসে দেখলো ও চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে। চলে যাবার উদ্যেগ নিতেই রুবাইয়াত শোয়া থেকে উঠে বসে ওর মাকে বললো,
——আম্মু আমার বেবিটা কোথায়?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে