#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
ভয়ে আমার শরীর কেঁপে উঠলো। দাঁতাল জানোয়ারটা দেখে যতনা ভয় পেয়েছিলাম তার থেকে যেন আরো বেশী ভয় পেয়ে গেলাম। ঐ বিশালদেহী লোকটা আমাকে আলতো করে তুলে নিয়ে বেশ দূরে রাখা একটা পিকআপের ভিতর বসিয়ে দিয়ে বললো,
——আমি প্রথমদিনই বলেছিলাম,পালানোর চেষ্ঠা করলে পরিস্থিতি অনেক খারাপ হবে। অথচ সেই কাজটাই করা হলো।
একথা বলে লোকটি গাড়ি স্টার্ট দিলো। আমি পরিস্থিতির চাপে পরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছি। একদিকে ফসকে গেল মুক্তির পথ অন্যদিকে খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখা। এখন মনে হচ্ছে এই লোকটার হাতে ধরা পড়ার চেয়ে পশুটার আক্রমনে মৃত্যুটাই মনে হয় শ্রেয় ছিলো। লোকটা একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে যে পথ দিয়ে আমি এসেছি গাড়িটা সে পথে যাচ্ছে না। তবে মানতে হবে ড্রাইভিং ভালো জানে। একদিকে গভীর খাদ অন্যদিকে সুউচ্চ পাহাড়। খুব সুন্দরভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। আমি নিজের অজাম্তে মনে মনে তখন দোয়া করছিলাম গাড়িটা যেন খাদে পড়ে যায়। কারণ এরপর আমার সাথে কি হতে পারে সেটা ভাবতেই আমি যেন শিউরে উঠি। যদি আমার নারীত্বের চরম অপমান হয় তাহলে এ কলঙ্কিত মুখটাকে আমি কিভাবে ঢেকে রাখবো। আত্মহত্যাতো করতে পারবো না। সেতো মহাপাপ। সামান্য দু,দিনের পৃথিবীর জন্য আমি তো আমার আখেরকে বিক্রি করে দিতে পারবো না। এদিকে একটানা কয়ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজে এখন খুব শীত করছে। তার সাথে শুরু হয়েছে একটানা হাঁচি।
পথটা বেশ চড়াই উৎড়াই। সমতল নয় বুঝা যাচ্ছে। আমার হাঁচির শব্দে মনে হয় গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। ঘন্টা খানিক গাড়ি চালিয়ে এক গভীর জঙ্গলে বাংলোটাইপের দোতলা বাড়ির সামনে গাড়িটা থামলো। চট জলদি লোকটা গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে আমায় বললো,
——নামুন তাড়াতাড়ি।
আমার মনে হয় তখন অলরেডী শরীরে জ্বর এসেছে। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। তারপর নিজের সমূহ বিপদের চিন্তায় গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে একটু হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। লোকটা হ্যাঁচকা টানে একহাতে আমাকে তুলে অন্যহাতে গাড়ির দরজা বন্ধ করে হেঁছড়াতে হেঁছড়াতে আমাকে টেনে নিয়ে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় বেশ বড়সড় রুমের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি আসার সময় সিঁড়ির কাছে দু,জন ষন্ডা টাইপের লোক দেখলাম। তাদেরকে দেখে মনে হলো, ওরা যেন কোনো মুভির সুটিং দেখছে। আচরণগুলো খুব অদ্ভূত। হয়তো সন্ত্রাসীরা এমনই হয়। নানারকম অন্যায় কাজ আর খুন খারাবী করতে গিয়ে ওরা মনে হয় অনূভূতি শুন্য হয়ে যায়। রুমে বসে এরপর আর আমার সাথে কিঘটতে পারে সেটা ভাবতে লাগলাম আর আল্লাহপাকের কাছে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগলাম। জ্বরের বেগটা মনে হয় বাড়তে লাগলো। আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। এরকম মানসিক চাপ আর জ্বরের ঘোরের টাল সামলাতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
জ্বরের বেগটা কমে যাওয়াতে আমার মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সবার আগে নজরে আসলো আমার গায়ে টিশার্ট আর পরনে ট্রাউজার। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। আমার কেন যেন মনে হলো ঐ মানুষটা সুযোগ পেয়ে নিশ্চয় আমার ক্ষতি করে ফেলেছে। আমার মতো একটা অল্পবয়সী সুন্দরী নারীকে পেয়ে ওকি আমায় ছেড়ে দিবে? আমার বিশ্বাস করতে মন চাইলো না। আর আমার কাপড়ই বা বদলে দিলো কে? জামা সালোয়ার সব চেঞ্জ করা হয়েছে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। বিছানায় চোখ বন্ধ করে আমি হেঁচকি তুলে কেঁদেই চলেছি।আমার কান্নার শব্দে কেউ একজন রুমে প্রবেশ করলো। আমার চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে হলো না । মনে হলো চোখ খুললেই তো মানুষরুপী ঐ জানোয়ারের চেহারাটা আমায় দেখতে হবে। কিছুক্ষণ পর একটা হাত আমার কপালে এসে পড়লো। রিনরিনে মিষ্টি কন্ঠে আমায় বললো,
—–এখন কেমন লাগছে ম্যাম?
নারীকন্ঠের শব্দে আমি চোখের জল মুছে তাকিয়ে দেখলাম পয়ঁত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সের এক মহিলা স্নেহভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উনাকে দেখে একটু সাহস পেয়ে কষ্ট করে বিছানায় উঠে বসলাম। তারপর উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
—–আমার পরনের কাপড় কে চেঞ্জ করেছে?
উনি মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই জুলকারনাইনের দিকে ঝোল টেনে বললেন,
—–আমাদের দাদা হচ্ছেন ফেরেস্তার মতো মানুষ। উনি খুনখারাবী করতে পারে কিন্তু নারীর গায়ে হাত দিয়েছে আজ অবধি এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
—–আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু এটা ছিলো না।
—–বলছি। বৃষ্টিতে মনে হয় আপনি অনেকক্ষণ ভিজেছেন। তাই জ্বরের ঘোরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমি এখানে রান্নার কাজ করি। বাংলোর পাশেই আমি আর আমার স্বামী থাকি। আপনি অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে দাদা চটজলদি আমাকে ডেকে পাঠায়। আমি এসে কাপড় চেঞ্জ করে দাদার টিশার্ট আর ট্রাউজার আপনাকে পরিয়ে দেই। তবে এই কাপড়গুলো একদম নতুন। দাদা কখনও পরেননি।
একথা শোনার পর একটু শান্তি পেলাম। নয়তো কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত কিনা এই আমার কপালে ছিলো।
——আপনার জন্য একটু সুপ নিয়ে আসি?
——না, আমি কিছু খাবো না।
——শুনেছি, আপনি নাকি একজন ডাক্তার। তাহলে তো জানেন অসুখ হলে পথ্য খেতে হয়। এছাড়া আমার সাথে এতোক্ষণ ধরে দাদাও জেগে আছেন। উনিও আপনার মাথায় জলপট্টি দিয়েছেন। তারপর যদি খাওয়া দাওয়া না করেন তাহলে হয়তো দাদা রেগে যেতে পারে।
আমি আর কিছু বললাম না। মহিলাটা রুম থেকে বের হয়ে গেল। যদিও এতোক্ষণ ঐ লোকটাকে মনে মনে অনেক গালমন্দ করেছি কিন্তু এখন লোকটার প্রতি আমর ধারণা কিছুটা ভালো হলো। তারপরও মনটা বলে উঠলো কাউকে এই মুহুর্তে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। দরজা নক করার শব্দে বললাম,
——ভিতরে আসুন,
এ কথা বলে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি জুলকারনাইন। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
——এখন কেমন আছেন? যে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন?
আমি মনে মনে ভাবলাম, লোকটাকে একটু ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। আর এই লোকটার সাথে ভালো ব্যবহার করে আমাকে এখান থেকে আবার পালানোর উদ্যেগ নিতে হবে।
—–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
——-কি কারনে, আপনাকে পালাতে না দেওয়ার জন্য?
আমি কথার উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে বসে থাকলাম। লোকটা আমার কাছে তার কথার জবাব না পেয়ে বললো,
——আমি বুঝে পেলাম না, গভীর জঙ্গলে রাতের বেলায় এই পাহাড়ী এলাকায় পালানোর মতো সাহস আপনি কেমন করে পেলেন? সাহসী পুলিশ অফিসারের মেয়ে বলে কথা তাইনা? বাপকা বেটি সেপাইকা ঘোড়া, কুছ নেহী থোড়া থোড়া। মেলায় বসে আমার কেন যেন মনে হলো, আপনি এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেন। তাই পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে উৎসব স্থান থেকে ছুটে এসেছি। পালাতে পারলে আপনাকে আমি ধন্যবাদ দিতাম। কিন্তু আপনি তো এক বুনো জন্তুর সামনে পড়ে জানটা খোয়াতে বসেছিলেন।
এরপর একটু গম্ভীর হয়ে আমায় বললেন,
——পাহাড় কিন্তু খুব অশান্ত জায়গা। এখানে যেমন নানারকম হিংস্রপ্রাণি বাস করে তেমনি মানুষরুপী কিছু জানোয়ারও বাস করে। তাদের সামনে পড়লে আপনাকে ছিঁড়ে কুঁড়ে খেতে ওরা এক মুহুর্ত দেরী করবে না। বিভিন্ন গ্রুপের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ী এলাকাগুলোকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে। সুতরাং ভুলেও আর একাজটি করতে যাবেন না। আর আমি আপনাকে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি,আমার হেফাজতে আপনি যতদিন থাকবেন আপনার নারীত্বের অপমান আমি কোনোদিন হতে দেবো না। ভাগ্যিস আপনার এই পালানোর বিষয়টা আমি ছাড়া আমাদের দলের আর কেউ জানে না। যদি অন্য কেউ জানতো এতোক্ষণে বসের কানে এ খবর পৌঁছে গেলে আপনি তো বিপদে পরতেন সাথে আমার বিপদ ও ডেকে আনতেন।
আজও আমি খেয়াল করলাম লোকটা কথা বলার সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেনি। বেশিরভাগ সময়ই মাথা নিচু করে কথা বলেছে। একবার দু,বার যাও তাকিয়েছে সে দৃষ্টি খুব ভদ্র ছিলো।
একটু পরেই ঐ মহিলা মুরগীর মাংসের একদম র,সুপ সাথে একটা ডিম সিদ্ধ। খাবার আনার সাথে সাথে জুলকারনাইন আমার কাছে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমাকে খেতে বলে ঐ মহিলাটিও রুম থেকে চলে গেল। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনছি। মনে হয় ভোর হয়ে আসলো। আমি একচামচ সুপ মুখে দিলাম। আমার কাছে অমৃতের মতো লাগলো। আদা কুঁচি করে দেওয়া আছে। তারসাথে লেবুর রস। এতো সুন্দর লেবুর ঘ্রাণ জীবনে মনে হয় এই প্রথম অনুভব করলাম। খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। মুহুর্তে সুপটা শেষ করে ফেললাম। তারপর ডিমসিদ্ধটাও মুখে পুড়লাম। মুখে দিয়েই বুঝলাম এটা আমাদের শহরের ফার্মের মুরগীর ডিম নয়। এ হচ্ছে পাহাড়ী মুরগীর ডিম। পানি খেয়ে একটু যেন এনার্জি পেলাম। রুমটার দিকে এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। একটা খাট পাতা আছে।একটা কাঁচ লাগানো কাঠের আলমারী। রুমের একপাশে শরীরচর্চার কিছু যন্ত্রপাতি রাখা আছে। তাতেই বুঝলাম এই রুমটা মনে হয় জুলকারনাইনের। রুমের পাশে একটা বারান্দা রয়েছে। সেখানে একটা রকিং চেয়ার বসানো আছে। আমি রকিংচেয়ারে বসে এই গভীর জঙ্গলে ভোরের অপরুপ দৃশ্য দেখলাম। পাখির ডাক ভোরের মৃদুমন্দ হাওয়া, ঘন গাছপালার জন্য সুর্যের আলোটা বেশ দেরী করে আসে। আলো আঁধারির এই সময়টা খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে ভোরের শীতল হাওয়ায় শরীর মন জুড়িয়ে গেল।
আমি বসে বসে আবার প্লান কষতে লাগলাম। এরপর আমাকে কি করতে হবে? বেশ কিছুদিন আমাকে একটু নিস্ক্রিয় থাকতে হবে। এখানকার হাবভাবটা আগে বুঝতে হবে। ঐ মহিলা তো মনে হয় পালানোর ব্যাপারে আমাকে কোনোরকম সাহায্য করবে বলে মনে হয় না। যেভাবে দাদা দাদা করে মুখে ফেনা তুলছে তাতে ওর উপর ভরসা করা একদম ঠিক হবে না। এখানকার বাড়িগুলো বেশ উঁচু কাঠের পাটাতনের উপর করা। সিঁড়িগুলো আলগা থাকে। রাতের বেলা সিঁড়িগুলো সরিয়ে রাখা হয়। নয়তো হিংস্রপ্রাণি উঠে আসতে পারে। এরমাঝে কমলা একটা নতুন বাসন্তি কালারের টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি সাথে পোটিকোর্ট ব্লাউস সহ আমাকে দিয়ে গেল। আর আমার পরনের সেদিনের ভেজা পোশাকটা ধুয়ে শুকিয়ে রুমে দিয়ে গেল।
দু,দিন পরের কথা। রাত তখন বারোটা বেজে গেছে। জঙ্গলে একটা সুবিধা আছে। একটা করে প্রহর পার হলে মোরগ ডেকে উঠে। আবার শেয়ালও ডাকে। এতে কিছুটা হলেও সময়টা বুঝা যায়। হঠাৎ মাঝ রাতে কমলা দরজা নক করে বলছে,
——আপুমনি দরজাটা খোলো। দাদার খুব বিপদ।
ঐ মহিলার নাম ছিলো কমলা। আমি বিছানা থেকে দরজা খুলে বললাম,
——উনার কি হয়েছে?
——দাদার দু,হাতে গুলি লেগেছে। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।
চলবে