#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
ঐ আগুন্তকের কথা শুনে জুলকারনাইন বলে উঠল,
——তুই কিভাবে জানলি ওদের পরিনতির কথা?
——পত্রিকায় পড়েছি।
—–শোন, পত্রিকাগুলো সবসময় সঠিক কথা ছাপে না।
—–যাইহোক আমাদের সহপাঠিরা যে ভালো অবস্থানে নেই সেটা তো মানছো? কিন্তু এদিকে তুমি কি করছো? শত্রুর মেয়েকে রাজকন্যার মতো করে রেখেছো।
——আমরা কিন্তু একজন নির্দোষ মানুষকে বন্দী করেছি। সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। অন্যায় করেছে ওর বাপ। অবশ্য ওর বাপের দোষ দেওয়াটাও ঠিক না। ওরা সরকারের হুকুম তামিল করছে। সেজন্য ওকে এটুকু সম্মান করা আমাদের উচিত বলে আমি মনে করি।
—–কিন্তু সরকারের এই আদেশ পালনে ওর বাপই তো সবচেয়ে অগ্রগামী।
——শোন, রাজু এই মুহুর্তে মাথা গরম করে কোনো কিছু করা যাবে না। বিশ জনের উপর যে হুলিয়া জারি করেছিলো তারমধ্যে ঊনিশ জনকেই ওরা ধরতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং একটু সামান্য ভুলে অনেক বড় কিছু ঘটে যেতে পারে কথাটা মনে রাখিস। রাত অনেক হয়েছে রুমে চলে যা।
ওদের কথপোকথন শুনে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দেও আমি তখন চমকে উঠছি। ঘরের ভিতর চাপ চাপ অন্ধকারগুলো আমাকে গ্রাস করছে। নিজের বাবা মা ভাইয়ের জন্য বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। এই কয়দিন আমি এতোটা ভয় পাইনি। সেই মুহুর্তে মনে হলো হয়তো আর কোনোদিন আমি আমার প্রিয়জনকে দেখতে পাবো না। তোমার সাথে আমার ঘর বাঁধা হবে না এটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা মা ভাইকে আর দেখতে পাবো না সেটা ভাবতেই দুচোখ দিয়ে কান্নার জল উথলে পড়লো।
এ পর্যন্ত বলে রুবাইয়াত চুপ হয়ে গেল। বাইরে তখন বাতাসের বেগ কমে গেছে। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি ঝড়ছে। ওমর চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে বললো,
——সেদিন আমার কি অবস্থা হয়েছিলো জানতে চাইলে না।
——সে কথা জেনে কি হবে বলো? কষ্ট তো বাড়বে বই কমবে না।
——হুম, তা ঠিক। কিন্তু আমিও তো এ কষ্ট বইতে পারছি না। তোমাকে যেদিন ওরা ধরে নিয়ে গেল আমি পাগলের মতো তোমাদের বাসায় ছুটে গেলাম। আঙ্কেল তো এ খবর পেয়ে টেকনাফ থেকে পুরো চিটাগাং এ পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছে। পরে শুনেছিলাম আঙ্কেলরা বুঝতে পেরেছিলো ওরা তোমাকে কোথায় নিয়ে গেছে। কিন্তু তোমার জীবন হানির আশঙ্কায় অ্যাকশনে যেতে পারছিলো না। তোমাকে সে মুহুর্তে উদ্ধার করতে না পেরে আঙ্কেল ডিপ্রেসড অবস্থায় ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। কারণ আন্টির সেসময় একটা সিভিয়ার স্ট্রোক হয়। আয়ানের সামনে তখন ভর্তি পরীক্ষা। ঘটনার আকস্মিকতায় ও কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। আমি আন্টিকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করি। আন্টিকে নিয়ে আমরা তখন জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাচ্ছি। টানা সাতদিন আন্টি আইসিইউ তে থাকে। আঙ্কেল এসব দেখে সিদ্ধান্ত নেয় জুলকারনাইন বাহিনীর যে কয়েকজন সদস্য বন্দী আছে তাদের কাছ থেকে কথা বার করতে হবে। এজন্য ওদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে ওদের এমনভাবে ট্রেনিং করা হয় জান চলে যাবে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বার করবে না। এরফলে অত্যাচার একটু বেশি করাতে একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে। আব্বু তখন আঙ্কেলকে বলেছিলো মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে। কারণ সামান্য একটু ভুলে তোমার বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। অসুস্থ দু,জনকে আব্বুর আন্ডারে পিজিতে ভর্তি করা হয়। আমি সে সময় এতোটাই ডিপ্রেসড ছিলাম কোর্সের পড়াশোনা সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম। দিনরাত বাসায় দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকতাম। খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা ছিলো না। আমার অবস্থা দেখে আম্মু একদিন আমায় বললো,
——রুবাইয়াতকে তো উদ্ধারের চেষ্ঠা চলছে। ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। মানসিকভাবে তোকেও অনেক শক্ত থাকতে হবে। রুবাইয়াত যখন যেভাবেই ফিরে আসুক আমার মেনে নিতে সমস্যা নেই। এটা নিয়ে তুমি চিন্তিত হইও না। বরং নিজেকে শক্ত রেখে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করো ও যেন সহিসালামতে ফিরে আসে। কারণ রুবাইয়াতকে নিয়ে তোমার দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হবে। এজন্য শারীরিক এবং মানসিক উভয়দিকে নিজেকে সুস্থ সবল রাখতে হবে।
আম্মুর এই কথায় আমি কিছুটা সামলে উঠি।
—–এখন মনে হচ্ছে সেদিন জুলকারনাইনের সাথে ঐ লোকের এদের অসুস্থ হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কথা হয়েছে। তবে সেদিনের ওদের ঐ কথাবার্তা শোনার পর আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। রাত আসলেই মনে হতো এই বুঝি আমার জীবনের শেষ রাত। এদিকে যে মহিলাটা আমার দেখাশোনা করতো ওকে ওখানে সবাই মহুয়ার মা বলে। পরদিন সকালে মহুয়ার মা আমায় এসে বললো,
——বস আপনাকে এই কটেস থেকে বের হতে নিষেধ করেছে।
একবার মনে হলো ওকে জিজ্ঞাসা করি,
“কারণটা কি”?
পরে মনে হলো জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না। ওতো জুলকারনাইনের খাস লোক। এর থেকে রাঁধা যদি এদিকটায় আসে তাহলে ওর কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিবো। পাহাড়ে তখন বৈসাবী উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। সারাদিন কটেজে বন্দী থাকতে ভালো লাগছে না। বিকালের দিকে কটেজের বারান্দায় বসে ভাবতে লাগলাম,” আমাকে যে করেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে”। এজন্য রাঁধার সাহায্য প্রয়োজন। দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে রাঁধা ছুটে এসে আমায় বললো,
—-দিদি, তুমি আজ ঝিরির স্নান করতে গেলে না কেনে? দাদা বারণ করেছে?
আমি মুচকি হেসে কথা ঘুরিয়ে ওকে বললাম,
—–মাথায় দু,বেনী করে ফুল গুঁজে দেওয়াতে তোমাকে পরীর মতো সুন্দর লাগছে।
ও আমার কথা শুনে খুব খুশী হয়ে বললো,
—–কাল থেকে আমাদের বৈসাবী উৎসব চলবে। এজন্য আজ একটু সেজে দেখলাম আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? বছরের শেষ দু,দিন আর নতুন বছরের তিনদিন ধরে আমাদের এই উৎসব চলতে থাকে। শেষদিন দাদাও এই উৎসবে যোগ দেয়। নানা ধরণের স্টল থাকে। ওখানে পাহাড়ীদের তৈরী থ্রিপিছ শাল ব্যাগ ঘর সাজানোর জিনিসপত্র থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের রাইড মেলা উপলক্ষ্যে আনা হয়। তুমি যদি যেতে চাও আমি দাদাকে বলে দেখতে পারি?
আমি যে জায়গায়টায় ছিলাম সেখানে চারদিকে উঁচু পাহাড়। পাহাড়গুলো একটু পাথুরে ধরণের। তাই বুঝে পাচ্ছিলাম না এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তাটা কোনদিকে হতে পারে? তাই কৌশলে রাঁধাকে জিজ্ঞাসা করলাম এখান থেকে তোমাদের উৎসবের জায়গাটা কতদূর। ও আমায় বললো,
—–পথটা একটু বিপথজনক। খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে হয়। তারপর কিছুদূর হেটে সামনে দেখতে পাবে প্যান্ডেল খাটানো হয়েছে। তবে বৃষ্টি হলে ঐ পথে যেতে।। একটু সমস্যা হয়। পথটা পিচ্ছিল হয়ে যায়। একপাশে ঝিরি থাকাতে পড়ে গেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এমনিতে ঝিরিতে খুব বেশী পানি থাকে না। কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টি হলে ঐ ঝিরিতে তখন খুব স্রোত থাকে। সেসময় ওখানে কেউ পড়ে গেলে তাকে খঁুজে পাওয়া মুশকিল। বললে নাতো যাবে কিনা?
——আচ্ছা চিন্তা করে তোকে পরে জানাবো।
—– জানিও,সন্ধা হয়ে আসছে,আমি তাহলে এখন বাড়ি যাই। মা আবার চিন্তা করবে।
ও চলে যাওয়ার পরপর দূরের মসজিদে মাগরিবের আযান শোনা যায়। মহুয়ার মা এসে ঘরে বাতি দিয়ে গেল। আমিও তোলা পানি দিয়ে ওজু করে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম।
পরদিন থেকে যেহেতু উৎসব শুরু হবে তাই রাত থেকেই পাহাড়ীরা আয়োজন শুরু করেছে। চারিদিকে খুব সুন্দর পিঠা পায়েশের সুবাস ভেসে আসছে। আবহাওয়াটা বেশ সুন্দর। না শীত না গরম। পাহাড়ে সন্ধার পরপরেই সবাই রাতের খাবার খেয়ে নেয়। ওদিকে খুব ভোরে উঠে। মহুয়ার মা সাতটার মধ্যেই ঘরে রাতের খাবার দিয়ে গেল। আমিও দ্রুত খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন খুব ভোরে উঠলাম। পাহাড়ী ছেলেমেয়েরা ঝুড়ি ভরে ফুল তুলেছে। নিজেরাও ফুল দিয়ে সেজেছে। রঙ বেরঙের পোশাক সবাই পড়েছে। মহুয়ার মা আমাকেও সকালের নাস্তা হিসাবে নানা ধরণের পিঠা পায়েস দিয়ে গেল। আমিও কটেজে বসে আমি আমার পালানোর প্লান মাথায় আঁটতে লাগলাম। মেলার শেষদিনটাকে আমি বেছে নিলাম। কারণ ঐ দিন অনেক রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে। রাতভর পাহাড়ী মদ খেয়ে সব বুৃঁদ হয়ে পড়ে থাকে।
শেষদিন সবাই সংসারের কাজ দ্রুত সেরে মেলার দিকে রওয়ানা দিলো। বিকালের দিকেই আমি যে এলাকাটায় থাকি সেটা নিরিবিলি হয়ে গেল। কিন্তু আবহাওয়া বাঁধ সাধলো। প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। তারসাথে আকাশ কালো করে মেঘ আসছে। কিন্তু আমাকে ঘাবড়ে গেলে তো চলবে না। বুকে সাহস রাখতে হবে। প্রথমে খুব জোরে বাতাস বইলো। এরপর নামলো মুষলধারে বৃষ্টি। আমি অপেক্ষা না করেই বৃষ্টি মাথায় বের হয়ে গেলাম। আমি এখান থেকে বের হয়ে সোজা ডিসি অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করবো। ডিসি অফিসে কোনোভাবে পৌঁছাতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। পথে নেমে বুঝলাম রাঁধা ঠিক বলেছে। বৃষ্টিতে আসলেই এই পাহাড়ী পথ পিচ্ছিল হয়ে গেছে। গাছের শিকড় বাকড় ধরে হাঁচড়ে পাঁচড়ে ঐ খাড়া পথে উঠার চেষ্টা করছি। একসময় পা স্লিপ করে ঝিরিতে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম।তার আগেই একটা গাছের ডাল ধরে সমূহ বিপদ আটকালাম। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি উত্তাল স্রোতে ঝিরির পানি বয়ে চলেছে। অতি সপ্তপর্ণে ডাল ধরে আবার রাস্তায় উঠে আসলাম। পাহাড়ে আবার ঝুপ করে সন্ধা নামে। মুহুর্তে চারিদিক অন্ধকারে তলিয়ে গেল। এমন সময় নজরে পড়লো আমার থেকে আট দশ ফিট দূরে এক দাঁতালো জানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে। আমার মেরুদন্ড দিয়ে তখন শিরশিরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। ও ক্রমেই আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমি না সামনে আগাতে পারছি আর না পিছনে যেতে পারছি। নিজের ভাগ্যকে আল্লাহপাকের উপর ছেড়ে দিয়ে দোয়া দরুদ পড়ে চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। এমন সময় পিস্তলের গুলির শব্দ আমার কানে ভেসে আসলো। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি জানোয়ারটা মাটিতে পড়ে আছে আর জুলকারনাইন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
—–পালাতে যাচ্ছিলে তাই না?
চলবে