অন্তহীন প্রেম পর্ব-০২

0
710

#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

আমার যখন জ্ঞান ফিরে আসলো তখন গভীর রাত। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা আর শেয়ালের ডাক শুনছি। এতে মনে হলো আমি শহর ছেড়ে অনেক দূরে। বাড়িটা ছিলো অনেকটা কটেজের মতো। কাঠ দিয়ে তৈরী। একটা খাট বিছানো ছিলো। ঘরের এক কোনে পিলসুজে মিটমিট করে বাতি জ্বলছে। সেই আবছায়া আলোতে ঘরের পরিবেশটা ভৌতিক মনে হচ্ছে। ঘরের এক পাশে একটা চেয়ার আর একটা টেবিল রয়েছে। ওখানে একটা পানির জগ আর গ্লাস উপুড় করে রাখা আছে। তৃষ্ণায় আমার বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। কারণ আমি হাত পা বাঁধা অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছি। মুখেও কসটেপ মারা আছে। আমি জানি না কতক্ষণ আমি জ্ঞানহারা ছিলাম। এই অজ্ঞান অবস্থায় আমার সাথে কিকি ঘটেছে তাও জানি না। এক অজানা ভয় আর নিজের এমন ভাগ্য দেখে দু,চোখের কোল বেয়ে কান্নার জল উথলে উঠলো। জানো সেদিন খুব আপন করে মৃত্যুকে আমি আহ্বান করেছিলাম। খুব চেয়েছিলাম সকালে সূর্যের আলো দেখার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। এভাবে আমাকে কিডন্যাপ করে আনার কারনে এই সমাজ সংসার আমার গায়ে কলঙ্কের তিলক বসিয়ে দিবে।যা কোনোদিন মুছবার নয়। যদিও আমি ভার্জিন থাকি। বারবার সমাজ আর সংসারের কাছে আমার ভার্জিনিটির পরীক্ষা দিতে হবে। আমি যদি সেদিন পালিয়ে চলে আসতাম তোমাদের পরিবারও আমাকে মেনে নিতো না। যদিও এই ঘটনার উপর আমার কোনো হাত ছিলো না। এসব ভেবেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মৃত্যুও ধরা দেয়নি। কারণ আমার সেদিনের থেকে আরোও খারাপ কিছু এ জীবনে দেখা বাকি ছিলো। হয়তো এই কারনে মৃত্যুও আমার কাছে আসেনি। আমি তখনও জানি না কে আমাকে কিডন্যাপ করলো। মেডিকেল কলেজে আমার তেমন কোনো শত্রুতো ছিলো না। বাবা পুলিশের বড় অফিসার হওয়ার কারনে টিচার বন্ধুবান্ধব সবার কাছে এক্সট্রা খাতির পেতাম। বরং আব্বুর প্রটোকল আমি নিতে চাইতাম না। কি জানি, নিলেই হয়তো ভালো হতো। আব্বু বহুবার আমাকে পুলিশ ফোর্স নিতে বলেছিলো। আমার কে যেন ইচ্ছে হতো না। অস্বস্তি লাগতো।
যাই হোক পরে মনে হলো আব্বুতো সন্ত্রাসী ধরার মিশনে জড়িত। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো এই কাজটি করেছে। সকাল হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইলাম। দূর থেকে ফজরের আযানের সুর ভেসে আসছে। এদিকে বাথরুমের চাপ লেগেছে। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে একজন বয়স্ক উপজাতি মহিলা পরনে পাহাড়ী ড্রেস, দরজা খুলে রুমে ঢুকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললো,
——আপনি বাথরুমে যাবেন?
আমিও মাথা নেড়ে বললাম,
—–হু,
আর কিছু বলার ক্ষমতা ছিলো না। আমার মুখ কসটেপ দিয়ে আটকানো ছিলো। মহিলা আবার বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে আমার হাত পায়ের বাঁধন মুখের কসটেপ সব খুলে দিলো। আমি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হলাম। হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে দেখি টেবিলে খাবার ঢাকা রয়েছে। সেই খাবারের সুবাসে পেটের ভিতরটা ক্ষুধায় মোচড় দিয়ে উঠে। আমার কাছে মোবাইল না থাকার কারনে কতটা সময় পার হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সেই মহিলা আবার রুমে এসে বললো,
—–খেয়ে নিন। বস আসবে আপনার সাথে দেখা করতে।
এতো খিদা লেগেছিলো যে মহিলা বলার সাথে সাথে আমি খেতে বসলাম। মোটা রুটি আর পাহাড়ী মোরগের ভুনা মাংস। ভীষণ মজা লেগেছিলো। সেদিন খেতে খেতে মনে হয়েছিলো এতো টেস্টি খাবার আমি মনে হয় সারাজীবনে খাই নাই। আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ঐ মহিলা প্লেট বাসন নিয়ে গেল। তার প্রায় আধ ঘন্টা পর এক সুদর্শন পুরুষ আমার রুমে আসলো। ছ,ফিটের মতো লম্বা চুলগুলো আর্মিদের মতো ছোটো করে কাটা ক্লিন শেফ উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মেদহীন বলিষ্ট শরীরে ব্লাক জিন্স আর ব্লাক শার্ট পড়া ছিলো। শার্টের হাতাটা গোটানো ছিলো।মানুষটার দিকে আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম।
রুবাইয়াতের মুখে সুদর্শন পুরুষের বিবরণ শোনা মাত্রই ওমরের মুখের মানচিত্র কিঞ্চিত পরিবর্তন হলো। সেটা অবশ্য রুবাইয়াতের চোখ এড়ালো না। এবং ওর প্রতি ওমরের এখনও এই অনুভূতি দেখে একটু অবাক হলো। ওমরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে রুবাইয়াত বললো,
—–তখন বুঝিনি ও যে জুলকার নাইন। বেশ কিছুদিন পরে জেনেছিলাম আব্বুদের মিশন যাকে খুচ্ছিলো এ হলো সেই।
এ পর্যন্ত বলে রুবাইয়াত নিরব হয়ে গেলো। সে সময় কিছু সময়ের জন্য রক্তাক্ত অতীতে ও হারিয়ে গেলাে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে যাবার পর ওমর জিজ্ঞাসা করলো,
—–এরপর কি হলো?
তারপর জুলকারনাইন আমাকে বললো,
——আপনি এখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আপনার কোনো ক্ষতি আমরা করিনি। আমার কাছে আপনি যতদিন থাকবেন আপনার নিরাপত্তা আমি শতভাগ নিশ্চিত করবো।
ওর কথা শুনে আমি ওকে পুরোপুরি ট্রাস্ট করতে পারছিলাম না। তবে অবাক হচ্ছিলাম ও আমার দিকে না তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলো। আমার বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে ও হয়ত কিছুটা আন্দাজ করছিলো তাই আবারও বললো,
——আপনার পায়ের নখের ক্ষতি আমি হতে দিবো না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
ওর কথা বলার মাঝে একটু সফটনেস ছিলো। তাই আমিও সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
——আমাকে এভাবে ধরে আনার কারণটা জানতে পারিকি?
—–অবকোর্স। আপনার বাবার হাতে আমাদের কয়েকজন লোক বন্দী আছে। ওদেরকে ছেড়ে দিলে আমরাও সম্মানে আপনার পরিবারের কাছে আপনাকে ফিরিয়ে দিবো। শুধু আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
—–কি কাজ?
—–এই মুহুর্তে কিছুই করতে হবে না। কারণ আপনার বাবা আপনাকে উদ্ধারের জন্য তার সমস্ত ফোর্স ব্যবহার করছে। কিন্তু আমি জানি উনি এই জায়গাটার খোঁজ পাবেন না। আপনাকে খুঁজে না পেয়ে যখন কিছুটা হাল ছেড়ে দিবে তখন আপনি মেসেজ পাঠিয়ে আমাদের দাবিটা জানিয়ে দিবেন।
—–আপনার কি ধারণা আমি মেসেজ পাঠালে আব্বু আপনার দলের সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দিবে?
আমার মুখে সন্ত্রাসী শব্দটা শোনা মাত্রই ওর চোয়ালের পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেল। তারপর একটু রুঢ় ভাবে বললো,
—–মায়ের পেট থেকে কেউ সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায় না। তাকে সন্ত্রাসী বানানো হয়। সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পড়া কিছু মানুষ নিজেদের সুবিধা আদায় করার জন্য আমাদের মতো কিছু মানুষকে ওরা সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরী করে। যাক সে কথা। এখন আসল কথায় আসি। আপনাকে যেহেতু তুলে নিয়ে এসেছি আপনার বাবা আমাদের লোকদের ছেড়ে দিতে বাধ্য। আর আপনি কিন্তু ঘুর্ণাক্ষরে পালানোর চেষ্টা করবেন না। তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হবে। এ কথাগুলো বলে জুলকারনাইন চলে যায়। এরপর ওরা আমার মোবাইল ছাড়া সবকিছু আমার হাতে তুলে দেয়। তবে জুলকারনাইন আমাকে যে বলেছিলো ও আমার নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করবে কাজেও তাই করেছে। পাহাড়ী পরিবেশে কয়েকদিন ভালোই কাটলো। ঐ জায়গাটা এমন ছিলো দিনের বেলাতেই সুর্যের আলো ওখানে পৌঁছাতো না। চারিদিকে ছিলো একদম ন্যাচারাল বিউটি। নাম না জানা কত ফুল এখানে ওখানে ফুটে রয়েছে। ঝিরিতে মিষ্টি ছন্দে পানি বয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা দলবেঁধে ঝিরিতে গোসল করতে যায়। আসার সময় সবাই এক কলসী করে পানি নিয়ে ফেরে। এর মাঝে একটা বারো তেরো বছরের মেয়ের সাথে আমার ভালোই বন্ধুত্ব হলো। ওর সাথে ঝিরিতে আমিও গোসল করতে গিয়েছিলাম। তবে আমার সীমানা বেঁধে দেওয়া ছিলো। ওর বাইরে আমার যাওয়া নিষেধ। ঐ মেয়েটার নাম ছিলো রাঁধা। ও একটু সিক ছিলো। পিরিয়ডের সমস্যা ছিলো। আমি ওর বাবা মাকে ডেকে ওকে চিকিৎসা করার পরামর্শ দেই। কোন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তাও বলে দেই। পরে মেয়েটা সুস্থ হয়ে যায়। এসব নানাবিধ কারনে ও আমার শুভাকাঙ্খি হয়। আসলে জুলকারনাইন যতই বলুক “আপনি পালানোর চেষ্টা করবেন না”। কিন্তু পালাতে তো আমাকে হবেই। আমি ওদের বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাই পালানোর জন্য আমার একজন হেল্পিং হ্যান্ড দরকার। সেই কারনে ঐ মেয়েটাকে এভাবে হাত করে নিলাম। তবে সপ্তাহখানিক পর একদিন গভীর রাতে আমার কটেজের বাইরে বেশ চিৎকার চেঁচামেচি শুনলাম। আমি খাট থেকে নেমে জানালার ধারে এসে শুনলাম কেউ একজন জুলকারনাইনকে বলছে,
—–ওর বাপ যেহেতু এই কাজ করেছে আমাদেরও উচিত ওকে ওসপার করে দেওয়া।
ওসপার শব্দটার অর্থ যদিও বুঝিনি কিন্তু এটুকু বুঝলাম আমাকে হয়তো শেষ করে ফেলতে বলেছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে