অন্তহীন প্রেম পর্ব-০১

0
1100

#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চারিদিকে অন্ধকার ঘণিয়ে আসছে। আকাশের বুক চিড়ে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎস্ফুরণের হলদে আলো পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে। তারসাথে আত্মাকাঁপানো মেঘের গর্জন। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে রুবাইয়াত ভাবছে,প্রবল গর্জনে ঐ আকাশটা তার সব ক্ষোভ রাগ অভিমান পৃথিবীর বুকে কখন ঝড় কখনও বৃষ্টি হয়ে ঝরাতে পারে অথচ রুবাইয়াত ওর বুকের ভিতর পুষে থাকা রাগ তাপ অভিমান কিছুই ঝরাতে পারে না। যতদিন ও বেঁচে থাকবে এই ভার ওকে একাই বয়ে নিতে হবে।
শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে। তার সাথে পানির ঝাপটা এসে রুবাইয়াতের নাক মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। ওর যেন সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। ও আকাশের দিকে শুন্যদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে ওমর রুবাইয়াতকে এভাবে দেখে ছুটে এসে বললো,
——রুবা এভাবে ভিজো না। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আষাঢ়ের প্রথম বাদলে ভিজতে নেই। শরীর খারাপ করে। ঐ বৃষ্টির পানিতে অনেক জার্ম লুকিয়ে থাকে।
—-কে বলেছে তোমাকে? তুমি তো সাইক্রিয়াটিস্ট। আবহাওয়াবিদ তো নও? আর আমাকে নিয়ে তুমি কেন এতো ভাবো বলতে পারো?
আসলেই ওমর জানে না কেন রুবাইয়াতকে নিয়ে ও এতোটা ভাবে? এই ভাবনার ফলাফল যে শুন্য সেটা রুবাইয়াত যেমন জানে, ওমরও বুঝতে পারে। তবুও ওমর এক অদৃশ্য অধিকার বলে রুবাইয়াতকে বলে,
——আমি তোমার ফিজিশিয়ান। সেজন্য তোমাকে নিয়ে আমার ভাবনা হওয়াটা কি স্বাভাবিক ব্যাপার নয়? কাল তুমি হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে চলে যাবে। ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজে শরীরটাকে খারাপ করো না। রুমে গিয়ে টাওয়েল দিয়ে মুখটা মুছে ফেলো।
ওমরের কথা শুনে রুবাইয়াত করিডোর থেকে রুমের ভিতরে চলে আসলো। রুবাইয়াত খুব অবাক হয় ও চাইলেও কেন ওমরের কথার অবাধ্য হতে পারে না। ওমরের কথার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যাকে রুবাইয়াত অস্বীকার করতে পারে না। ওমরও রুবাইয়াতের পিছু পিছু রুমে এসে রকিং চেয়ারটায় বসে পড়ে। রুবাইয়াত টাওয়েল দিয়ে মুখটা মুছে বিছানায় বসে ওমরকে বলে,
——জানো, আমার না এই হাসপাতালের উপর অনেক মায়া পড়ে গেছে। এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না।
——শুধুই কি হাসপাতালের উপর মায়া পড়েছে? এখানে আর কারো উপর তোমার মায়া পড়েনি?
রুবাইয়াত এক বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওমরকে বলে,
——তুমি আমার জন্য যা করেছো এই জীবনে আমি তা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। তাই আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি উনি যেন সুখ আর শান্তিতে তোমার জীবন ভরিয়ে দিন।
রুমের ভিতরটা এই মুহুর্তে এক অদ্ভূত নিরবতা ছেয়ে আছে। ওমর মনে মনে ভাবছে তুমি যদি সারাজীবনের তরে আমার কাছে চলে আসতে এতেই আমার জীবনটা সুখ আর শান্তিতে ভরে উঠতো। সে আশাতো গুড়ে বালি। কাল রুবাইয়াত চলে যাবে। এ কথা ভাবতেই ওমরের বুকের বাঁ পাশটা ব্যথায় চিন চিন করতে থাকে।ওমর বিষাদ জড়ানো চোখে রুবাইয়াতের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছে,সেই ছোটো বেলা থেকে আপন করে পাবার তরে ও এই মেয়েটির পথ চেয়ে বসে আছে। যদিও ওমর জানে রুবাইয়াত আর কখনও ওর বাহুবন্ধনে ধরা দিবে না। তবু ওমরের বেহায়া মন এই সত্যটা মানতে চায় না। মাঝে মাঝে ওমরের রুবাইয়াতকে ছুঁয়ে দিতে মন চায়। ও এতো কাছে তারপরও মনে হয় রুবাইয়াত যেন অচিন দ্বীপের বাসিন্দা। সেই দ্বীপে প্রবেশ করার ভিসা ওমর হয়তো কোনোদিন পাবে না।
রুবাইয়াত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। আকাশের পেঁজা তুলোর মতো কালো মেঘ আর গোধুলীর আলো আঁধারি মিলে মিশে এক গভীর অন্ধকারের চাদর এই মুহুর্তে যেন পৃথিবীটাকে ঢেকে দিয়েছে। বাতাসের বেগ কিছুটা কমেছে। নিরবতা ভঙ্গ করে একসময় রুবাইয়াত ওমরকে বলে,
—–তোমার সাথে এখানে আমার কতোদিনের সংসার বলতো?
রুবাইয়াতের কথা শুনে ওমর অবাক হয়ে বলে,
—–কিসের সংসার?
——আরে বুদ্ধু ডাক্তারের সাথে রোগীর সংসারের কথা বলছি।
——তাতো মাস দশেক হবে।
——আমি দশ মাস তোমার সাথে আছি। ভাবতেই অবাক লাগছে। অথচ আমাদের এখন সংসার হওয়ার কথা ছিলো। এতোদিনে আমি হয়তো তোমার বেবির মা হয়ে যেতাম।
—–থাক না পুরোনো কথা? এখন ঐ কথাগুলো মনে করলে দুঃখ ছাড়া আর কিছুতো অর্জন হবে না।
——তা,তুমি ঠিক বলেছো। আচ্ছা তোমার কি আমার ঐ ভয়ঙ্কর অতীত সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হয় না?
—–কৌতূহল আছে বৈ কি
—–কখনও তো আমায় জিজ্ঞাসা করলে না?—–তুমি তো জিজ্ঞাসা করার মতো অবস্থায় ছিলে না? এছাড়াও নিজ থেকে তোমার ঐ শুকিয়ে যাওয়া ঘা টাকে আর ক্ষত বিক্ষত করতে ইচ্ছে হয়নি। যেদিন তুমি শোনাতে চাইবে সেদিনই শুনবো। এটাই আমার ইচ্ছা ছিলো।
—–তা ঠিক। কালতো আমি বাড়ি চলে যাবো। ভাবছি আজ যদি তোমার ব্যস্ততা না থাকে তাহলে আজ তোমাকে আমার রক্তাক্ত অতীতের গল্পটা শোনাতে পারি। কাহিনীটা তোমার শোনা উচিত তাহলে বুঝতে পারবে আমার সীমাবদ্ধতা।
মাগরিবের আযান শোনা যায়। ওমর নামাজের জন্য রুবাইয়াতের কাছে সাময়িক বিদায় নিয়ে হাসপাতালে মসজিদে চলে যায়। এই ফাঁকে রুবাইয়াত ও নামাজ আদায় করে পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের কাছে ওর ফেলে আসা অতীতের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করে। দোয়ার গভীরতায় চোখের দু,কুল ছাপিয়ে বাদলের ধারায় ওর ওড়না ভিজে গেছে ও বুঝতেই পারেনি। নামাজ শেষ করে রুবাইয়াত ওমরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। আসলে ওমরকে ওর ফেলে আসা অতীতের কথাগুলো জানানো উচিত। তাহলেই ওমর বুঝতে পারবো রুবাইয়াতের কাছে ও যা আশা করে সেটা কোনোদিন দেওয়া সম্ভব নয়। এতে রুবাইয়াতের দায় কিছুটা হলেও কমবে। ওর জীবনটাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। ওমরের সাথেই ওর ঘর বাঁধার কথা ছিলো। অথচ হঠাৎ ধেয়ে আসা সুনামী ঝড়ের প্রকোপটা রুবাইয়াত সেদিন সামলাতে পারেনি। সেই সুনামীর স্রোতে ওর সব স্বপ্ন আর আশাগুলো হারিয়ে গেল। যার উপর কারোর কোনো হাত ছিলো না। সে সময় সবাই যেন নিয়তির হাতে বন্দী।দরজা নক করে ওমর দু,মগ চা আর গরম গরম কলিজা সিঙ্গাড়া নিয়ে রুমে আসলো। রুবাইয়াতের হাতে একমগ চা তুলে দিলো। নিজে আর এক মগ চা আর সিঙ্গাড়া হাতে নিয়ে বললো,
—–আমাদের হাসপাতালের কলিজা সিঙ্গাড়াটা ভীষণ টেস্টি তাই না?
রুবাইয়াতও সিঙ্গাড়াতে কামড় বসিয়ে বললো,
—–তা অবশ্য ঠিক বলেছো। আমার গরম চায়ের সাথে সিঙ্গাড়া ভীষণ ফেবারিট।
রুবাইয়াতের ঐ ভয়ঙ্কর অতীতের কথা শোনার জন্য ওমরের ভিতরে এক ধরনের উুসখুস শুরু হলো। বহুদিন থেকে জানার কৌতূহল ছিলো। যদিও পেপার পত্রিকার মাধ্যমে অনেকটাই জানা হয়েছে। কিন্তু ঐ খবরগুলোর সত্যতা কতটুকু কে জানে? আজকাল খবরের কাগজগুলো নিজেদের পত্রিকার কাটতির জন্য অনেক রঙচঙ মাখিয়ে নিউজ করে।
রুবাইয়াতের কথায় ওমর ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে।
——তোমার মনে আছে নিশ্চয় সে সময় মোস্ট ওয়ান্টেট বিশ জন সন্ত্রাসীকে ধরার জন্য এ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি হয়।
——হুম, সেসময় পত্রিকা মারফত জেনেছি। তবে তোমার ঘটনা ঘটার পরে আমার আব্বুর কাছে ডিটেইল শুনেছি।
——আব্বু যেহেতু পুলিশের হাই অফিসিয়ালী জব করে তাই অনেক অফিসারের সাথে আব্বুকেও এই মিশনে অংশ নেওয়ার জন্য উপর থেকে আদেশ আসে। এক বছর আগের কথা বলছি। তুমি তো তখন পিজিতে কোর্সে ঢুকেছো। এরমাঝে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ঊনিশজন সন্ত্রাসীকে অলরেডী ধরতে সক্ষম হয়। তখন সমস্ত দেশী বিদেশি মিডিয়া গুলো এই সফল অপারেশনের প্রশংসা করে। সেই প্রশংসার ঢেউয়ে আমরাও ভেসে যাচ্ছিলাম। সবশেষে ধরার কথা গুলতি জুরকানাইন বাহিনীকে। তার আস্তানা ছিলো টেকনাফের গভীর জঙ্গলে। আব্বু পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স নিয়ে টেকনাফের জঙ্গলে চলে যায়। সেখানেও মোটামুটি সফল হয়। কিন্তু পালের গোঁদা জুলকারনাইন আর বডি গার্ড ফসকে পালিয়ে যায়। তুমি তো জানো আমার সেদিন চিটাগাংয়ের পাট চুকিয়ে ঢাকায় চলে আসার কথা। এয়ারে আসার কথা ছিলো। কিন্তু মেডিকেল কলেজে আমাদের ইর্ন্টাণ ডাক্তারদের একটা সম্বর্ধনা ছিলো। সেই কারনে রাত এগারোটার ট্রেনে ঢাকায় আসার প্লান করি। অনুষ্ঠান শেষ করে দশটার দিকে ট্রেন স্টেশনে চলে আসি। আমি আসার সাথে সাথে পুরো স্টেশনে কারেন্ট চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। এমন সময় একটা বলিষ্ঠ হাত একটা ছোটো টাওয়েল দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে