#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৪।
একটা তীব্র পারফিউমের ঘ্রাণ লাগছে নাকে। তির তির করে ঘ্রাণটি নাকের ভিতর প্রবেশ করছে। চেনা পরিচিত একটি ঘ্রাণ। হাত-পা বাধা অবস্থায় চেয়ার বসে আছে জয়নব। অজনা, অচেনা ভয় নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । চোখ দুটি-ও বাঁধা। জয়নবের মনে হচ্ছে, তার বুঝি দিন ফুরিয়ে এলো? পৃথিবীর বুকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে কি সে? শরীর কাঁপছে জয়নবের। মাথা, কঁপাল ভর্তি ঘাম। মুখ দিয়ে বলে যাচ্ছে,
“হেল্প…..হেল্প, কেউ আছেন? সামবডি হেল্প মি…. প্লিজ!”
কথা গুলো বাড়ি খেয়ে যেন ফিরে ফিরে এলো জয়নবের কাছেই। বন্ধ ঘরে কথা বললে যেমন আওয়াজ হয় ঠিক তেমন শোনাচ্ছে এই মুহূর্তে! আচ্ছা সে কোথায় আছে? লাষ্ট মুহূর্তে ওই কালো পোশাকধারী লোকটিকেই দেখেছিলো জয়নব। তীক্ষ্ণ কালো কুচকুচে চোখ তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। আজ লোকটি মুখ ঢাকা ছিলো না। ঠোঁটে ছিলে শ্লেষের হাসি। আবছা আবছা মনে আছে জয়নবের। লোকটি কে সে চিনে। খুব ভালো করে চেনা। মাথার মাঝের নার্ভ গুলোতে আরো পেশার দিলো জয়নব। ঠিক তখনি চোখে বাঁধন খট করে খুলে গেলো। জয়নব পিটপিট করে তাকালো। একটি ঘরের মাঝ বরাবর চেয়ারে বাঁধা জয়নব। ক্ষীণ,রাশ ভরী আলো জ্বলছে। খট করে আওয়াজ হলো। জয়নবের সামনে ভেসে উঠলো তিনটি অভিমূর্তি। ঘরটির ও প্রান্তে কাচের দেয়াল ভেদ করে ঠিক ওপাশে চেয়ারে বসে আছে। আয়ান আর ওই দুটি ওয়ার্ড বয় বসে আছে চেয়ার। জয়নবের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সে ডাকলো,
“আয়ান ভাইয়া… আয়ান ভাই.. আ… য়া….ন ভা…ইয়য়য়া”
নাহ্ আয়ন নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জয়নবের দিকে। স্থীর চাহনি। চোখের পাতা নড়ছে না, চোখের মনি গুলো চুপ। জয়নবের শরীরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো মুহূর্তে। কি হয়েছে তাদের?
ঠিক তখনি শোনা গেলো পায়ের শব্দ। বন্ধ ঘরে শব্দ হচ্ছে, খট খট খট। থেমে গেল জয়নবের পিছনে। জয়নব উপলব্ধি করতে পারল। এক বিশালদেহী মানব। জয়নব পিছনে ঘুরতেই জয়নবের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। কন্ঠ নালিতে কথা গুলো টুপ করে বসে রইলো। কম্পিত কন্ঠে বলল,
“ডা… সা.. হি.. র!”
লোকটি মুহূর্তেই ঘর ফাটানো হাসি দিলো। বলল,
“আই হেইট ইউ ডিয়ার।”
বলেই চোখ টিপলো লোকটি। কালো পোশাকধারী লোকটি যে এই ব্যক্তি বুঝতে বাকি নেই জয়নবের। কিন্তু কি অদ্ভুত! কালো পোশাকে আগাগোড়া মোড়ানো লোকটি বয়স পঞ্চাশ এ মুহূর্তে ধরা যাচ্ছে না। জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। নিজেকে শান্তু করতে চেষ্টা করলো। কন্ঠে যথাযথ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
“এ সব কিছুর পিছনে আপনি ছিলেন! আগেই বোঝা উচিত ছিলো।”
লোকটি দৈত্যের মতো কেঁপে কেঁপে হাসলো। বলল,
“ও মাই মাই লিটিল বেবি, তুমি এত চালাক হবে ভাবতে পারিনি!”
জয়নব চুপ করে দেখতে লাগলো লোকটিকে। ভদ্র মানুষের আড়ালে একটি হিংস্র পশু। জয়নব ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ডা. সাহির আবার বলল,
” তোমার বোন এত দূর কিন্তু আসতে পারেনি জানো। তার আগই.. মাঠের বাহিরে! তোমার বাবার প্লেন সব ভেস্তে গেল। কিন্তু তুমি? ইউ ক্লেভার গার্ল। আই লাইক ইট। ”
কথাটুকু শুনে জয়নব চমকালো। বলল,
“বাবার প্ল্যান মানে?”
সাহির ভ্রুকুচকে জয়নবের দিকে ঝুঁকল। হিসহিসিয়ে বলল,
“হে তোমার বাবারই প্ল্যান সব। ওই শালার জন্যই আজ ধরা আমাদের রহস্য প্রকাশ পেতে চলল। নয়তো আজ ৫০ বছর ধরে আমাদের কাজ সম্পর্কে কাক পক্ষীও টের পাই নি।”
জয়নব বিস্ময়ে বুঁদ। সাহির হেসে বলল,
“সুইটহার্ট! তুমি কিছু জানো? না জেনে লড়তে নেমে গেলে?”
সাহির এবার হেটে কাঁচের দেয়ালে দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তির মতো বলল,
” তোমার বাবা একজন গোয়ান্দা বিভাগের সদস্য ছিলেন। তার প্ল্যানেই রুফাইদা এই হসপিটালে আগমন ঘটেছে। আর বেচারি… নরগ যন্ত্রনা ভোগ করছে!”
জয়নবের কিছুই বুঝতে পারলো না প্রথমে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে লাগলো সে। তারপরই প্রশ্ন করে বসে,
“আপনি.. আপনি এসব আগে থেকেই জানতেন?”
“অফকোর্স লিটিল বেবি। আমি না জানলে জানবে কে? তোমার বাবা চুনোমাছ ভাবে ধরতে চেয়েছিল আমাদের। কিন্তু আমরা??? বোয়ালমাছ! তবে হে বেচারা রুফাইদা ভাল চেষ্টা করেছিলো। আমার ছেলের মাথাটাও খেয়ে দিয়েছে একবারে। বেচারা অভিনব বিয়ে করেও বুকে পেলো না কাছে…!”
বলেই মুখ “চ” শব্দ করল। সাহির আবার বলল,
“জানো তোমার বাবাকে মারতে চেয়েছিলাম নিজ হাত। বাট শালা আগেই পটল তুললো।”
জয়নবের রাগে, দুঃখ কান্না পেলো। হাত পা বাঁধা না থাকলে এবার হয়তো একে এখানেই শেষ করে দিতো। জয়নবের কন্ঠে ধরে এলো,
“আমার বোন কই!”
ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠলো জয়নব। লোকটি ফিচেল হাসলো,
“আছো নরকে আছে!তবে বেশি দিন দুনিয়ায় মেহমান নয় সে।”
এ পর্যায় জয়নব চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“আমার বোনের কিছু হলে তোকে আমি মেরে কুত্তাকে খাওয়াবো!”
লোকটি হো হো করে হেসে উঠলো,
“তাই নাকি? তোমার মতো পুচকে আমার কি করবে শুনি?”
জয়নব হাত পা খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। লোকটিকে বিশ্রী গালি দিয়ে বলল,
“নারীর বলে নরম ভাবিস না। একটা সুযোগ পেলে তোর মাথা কেঁটে আমি ফুটবল খেলবো!”
সাহির ভরকে গেলো। পিত্তি একটা মেয়ে তাকে শাসাচ্ছে! এটি খুব অপমান জনক সাহিরের কাছে। সে হাত তালি দিলো। একটি লোক আসতেই সাহির জয়নবের হাত খুলে দিতে ইশরা করলো। বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েই জয়নব হামলে পড়লো সাহিরে উপর। সাহির ঠিক তখন স্ব জোড়ে চর বসালো জয়নবের গালে।এতে কিছুটা বাঁধা পড়লো। তাতেও খেন্ত হলো না জয়নব। সাহিরের মুখেও চড় বসিয়ে দিলো ওর গালে। সাহির স্তম্ভিত হলো। একটি পিচকে মেয়ের এত তেজ তার সহ্য হলো না। আরেক হাতে জয়নবের চুলের মুঠি ধরে হেলিয়ে নিলো পিছনের দিক। এতই জোড়ে টানলো চুল! জয়নব চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সাহির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” শোন মেয়ে আমার কাছে এখনো তুমি পিঁপড়ে। আমি কি করতে পাড়ি? তা এক পলক না হয় স্বচোখে দেখে নাও,?”
বলে কাচের দেয়ালে ঠেসে ধরলো জয়নবকে। জয়নব আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। সাহির তাকে এমন ভাবেই চেপে ধরেছে কাচের দেয়ালের সাথে যেন এখনি ভেঙ্গে কাচের ওপাশের রুমটিতে ঢুকে যাবে। জয়নব পিছন থেকে লোকটিকে ধাক্কা দিতে লাগলো। সাহির তখনি আরেক হাতে দুটি আঁটকে নিলো। তারপর মুশফিক বলে কাউকে ডাকলো। জয়নবের মাথায় তখন মুশফিক নামটি কেচ করলো। এটি যে তারই বোনের বন্ধু একজন? কাচের ওপাশের রুমটিতে প্রবেশ করলো মুশফিক, খাটো, মোটা একটি ছেলে। চোখে চশমা গায়ে ডাক্তারি এপ্রন।লোকটি হাতে তিনিটি সিরিজ। জয়নব প্রথমে কিছুই বুঝলো। সাহির তা ভালোমতোই বুঝেছে। তাই জয়নবকে বলল,
“ছোট বাবু আমার জানো? ওই সিরিজ গুলোতে কি আছে?”
জয়নবের নড়াচড়া থেমে গেলো। ভয় ভয় চোখে তাকালো সাহিরের দিক। সাহির বাঁকা হাসছে। জয়নবের উদ্দেশ্যে আবার বলল,
“ড্রাগ… এলএসডি!”
জয়নবের পিলে চমকে উঠলো। সাহিরকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো। আয়ান ভাই আয়ান ভাই বলে আর্তনাদ করতে লাগলো। কিন্তু লাভ হলো না। জয়নব এবার মুশফিককে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আয়ান ভাই না আপনার বন্ধু? তাকে কেন মারতে চাইছেন? ভাইয়া উনাকে ছেড়ে দিন, উনার কোনো দোষ নেই! আল্লাহর দোহাই লাগে! প্লিজ আয়ান ভািকে কিছু করবেন না? তার কি দোষ??”
সাহির ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“তার দোষ? সে বেইমানি করেছে আমার সাথে। তাকে তো মরতেই হতো!”
জয়নব থমকালো,
“মানে… আয়ান ভাই আপনাদের সাথে?”
সাহির মাথা নাড়লো। জয়নবের এবার পাগল পাগল লাগলো নিজেকে৷ ছল ছল চোখর তাকিয়ে রইরো ওই পাশের রুমটিতে। মুহূর্তের মাঝে আয়ান নিজের গলা কেঁটে ফেলেছে। পাশের দুটো লোকও তাই করলো। পুরো রুম রক্তে লাল হয়ে গেলো। জয়নব সেখানেই বসে পড়লো। পুরো দুনিয়া এখন তার গুরছে। সাহির তার সামনে বসলো। এক আগুল দিয়ে মুখ উঁচিয়ে ধরলো জয়নবের। হেসে বলল,
“আমার ক্ষমতা কতটুকু তা তোমার ধারণার বাহিরে মেয়ে। শুধু শুধু নিজের জান খোয়াতে চেয়েও না। পড়তে এসেছো পড়ে, ভালো ডাক্তার হয়ে বেড়িয়ে যাও। পাকনামি আর করো না! ”
জয়নব তাৎক্ষণিকভাবে বলে উঠলো,
“এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো। আপানাকে জেলের ভাত না খাওয়াতে পাড়লে আমার না জয়নব নয়!”
সাহির হেসে দিলো,
“চ্যালেঞ্জ করছো?”
জয়নব চোখের পানি মুছে নিলো। বলল,
“তেমনিই ভেবে নিন!”
লোকটির চোখে মুখে অহংকার ফুটে উঠলো। জয়নবের কথা তাচ্ছিল্য করে বলল,
“ওকে দেখা যাবে, তোমার দৌড় কতটুকু। যদিও আমার কাছে নিছক এক মশা সমতুল্য তুমি? তবে এই খেলাটা আমি পুরোপুরি উপভোগ করতে চাই!”
জয়নব হাসলো। বলল,
” যখন জানতাম না এই খেলাটা অপরপ্রান্ত থেকে খেলছে কে? তখনি নেমে পড়েছিলাম খেলতে। আর এখন তো জানি, খেলোয়াড়টা কে? ”
জয়নব রুমটি থেকে বেড়িয়ে এলো। পিছনে এক পলক তাকিয়ে দেখলো, “৩০৩ নং রুম!”
—————-
রুফাইদা শুয়ে আছে। খাটের দু প্রান্তে বাঁধা দুটি হাত। ঠিক তখনি দুটি ডাক্তার ভিতর ঢুকলো। রুফাইদা ভয়ে কেঁপে উঠলো। আর্তনাদ করে উঠলো,
“নাহ্………!”
চলবে,