অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-০৫

0
1956

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৫।
চারিদিকে নিঃশব্দ, নিঝুম রাত। তলিয়ে আছে ঘুমের শহরের পুরো রাজ্য। ঘুম নেই জয়নবের আখিতে। তার কঁপালে সুক্ষ্ম ভাজ। এই ঘরটিতে চারটি সিট আছে। পাশের দুজন আজ বাড়িতে চলে গেছে। একজন গভীর ঘুমে মগ্ন। জয়নব এবার চোখ ফিরালো আশে-পাশে। কিছুক্ষন আগেই তার তন্দ্রা লেগে ছিলো। রাতে নিস্তব্ধতা তাদের ঘরটিতে যেন কিছু মানুষের হাটা চলার আভাস পেলো। মনে হচ্ছিলো খুব সপ্তপর্ণে কেউ ঘরটিতে প্রবেশ করেছে।জয়নবের সিক্স সেন্স ভালো। তার মনে হয়েছিলো এই ঘরটিতে সত্যি কারো বিরাজমান আছে। জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। এ যেন নতুন নয় আজ কদিন জাবত তার সাথে এমন হচ্ছে। যেখানেই যাচ্ছে? মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফোলো করছে। কিন্তু কেন? কেন কথাটির উত্তর নেই । জয়নব ঘরের স্তিমিত আলোর মাঝে ঘরটি ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। অথচ সে আলোটি এমনি যে টচ মেরেই খুঁজতে হবে আলোটি। জয়নব বুক ভরে শ্বাস টানলো। একদিনে অনেক তথ্য জোগাড় করেছে সে তার বোন সম্পর্কে। রুফাইদার ব্যাচের কিছু আপু রুফাইদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই কথাটা এড়িয়ে গিয়েছে। তো কেউ বলেছে,

“মেয়েটি হেল্পফুল ছিলো। আমাদের সহায়তা করতো। হোস্টেলে কারো অসুখ পড়লেই তাকাই পাশে পাওয়া যেত।”

আবার কেউ কেউ নাক ছিটকে বলেছে,

“বখে যাওয়া মেয়ে। ছেলেদের সাথে নাকি খুব খোলামেলা সম্পর্ক ছিলো তার। বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ছিলো সে। রাতের আধারে একবার নাকি ছাদে ধরা পড়েছিলো হোস্টেল সুপারের কাছে। তা নিয়ে পুরো হোস্টেল যেন গুঞ্জন। ”

জয়নব যেন মাঝ দরদিয়তে পড়ে। বোনের সম্পর্কে এমন বিদঘুটে কথা হজম হয় না তার ক্রোদ নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলে,

“আমার বোন খুব ভালো। সি ইজ দা বেস্ট সিস্টার ইন দা ওয়ার্ল্ড! তোমাদের কথা বিশ্বাস করি না আমি!”

কিন্তু তবু-ও বয়ফ্রেন্ড ছিলো? এটি কেমন খটকা লাগলো যেন তার। কারণ তার বোন ছুটির দিন গুলো যখন তার পাশে থাকতো কখনোই প্রেমলাপ করেনি ফোনে বা বাবা-মা বিয়ের কথা তুললেও রুফাইদা লজ্জা মাখা মুখে বলতো,

“তোমরা যা ভালো বুঝো!”

জয়নব হতাশ হয়ে গেলো। না চাইতেও বয়ফ্রেন্ড উরপ বিজয় ভূঁইয়া নামক লোকটির ঠিকানা জোগাড় করে রুফাইদা। তার দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। তখন যে এত বড় থাক্কা তার জন্য অপেক্ষা করছে? সে জানতোই না।
লোকটি দরজা খুলে খড়খড়ে গলায় বলল,

“কি চাই!”

অতি বিনয়ের সুরে যখন জিগ্যেস করে,

“আপনি কি বিজয়?”

“হে আমি বিজয়। কি কাজ?”

“আপনি রুফাইদাকে চিনেন?”

বিজয়ের কঁপলা চিন্তার ভাজ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে জিগ্যেস করে উল্টো,

“তুমি কে?”

চকিতে উত্তর দেয়,

“আমি ওর ছোট বোন?”

বিজয় ভূঁইয়া বললেন,

“তো আমার কাছে কি চাই?”

“আপুর সাথে আপনার রিলেশন ছিলো?”

বিজয় ভিতর দিক উঁকি দিয়ে বেড়িয়ে এলো বাহিরে। দরজাটা চাঁপিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,

“প্রাক্তন সে আমার। তার উপর মরে টরে গেছে সে। এখন কি চাই তোমাদের?”

জয়নব স্তম্বিত, হতবিহ্বল। আমতা আমতা করে বলল,

“আপুর সাথে আপনার কত দিনের সম্পর্ক ছিলো?”

“৬ মাস!”

কন্ঠস্বর এবার কেঁপে উঠলো যেন খানিটা,

“ব্রে..ক আপ কে করেছিলো?”

“কে আবার? আমি করেছি! করবোই বা না কেন? ওর বেড পারফরম্যান্স একদম বিচ্ছিরী ছিলো!”

কান গরম হয়ে গেলো জয়নব। চেঁচিয়ে উঠে গালি দিয়ে বলল,

“কুত্তা! তোরা সব মিথ্যা বলছিস! মেরে দিবো তোদের। ”

বলে গলা টিপে ধরলো বিজয়ের। বিজয় হঠাৎ হামলায় নিজেকে রক্ষে করতে পারলো না। এদিকে জয়নবের সাথে আসা কুয়াশা তাকা সামলে বলল,

“কি করছিস বইন ছাঁড়। পুলিশ কেস হয়ে গেলে আমাদের ডাক্তারীগিরি ছুটে যাবে। ছাড় এরে!”

পুরো বাঘীনির মতো গলা চিপে ধরেছে জয়নব। এই মুহূর্তে কুয়াশার কাছে মনে হচ্ছে জয়নব কোনো রণচন্ডী। কুয়াশা ঢোক গিললো। মেয়েটি বিজয়কে না ছাড়লে লোকটি পটল তুলবে যেন।কুয়াশা অনেক কষ্ট ছাঁড়িয়ে ফেললো। লোকটি ঘাবড়ে গেছে খুব।মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে বেচারা। জয়নব রাগের ঠেলায় তার গোপন অঙ্গ পিশে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” এবার তুই দেখাস বেড পারফরমান্স কুব ভালো করে জংলি কোথাকার!”

কুয়াশার হো হো করে হাসি পেলে চেঁপে গিয়ে টেনে নিয়ে বের হলো তারা। বিজয় মাটিতে পড়ে কাঁটা মুরগীর ধাপা ধাপি করছে। কুয়াশা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে জয়নবের কাঁধ চাপরে বলল,

“সাব্বাস মেরে শেরনি। যে খেল দেখালি। লোকটি সত্যি আর শুতে তো দূর মূত্র বিয়োগ ও করতে পারবে না।”

হেসে উঠলো দুজনেই। কিন্তু মনের মাঝে আরো সন্দেহ বীজ বপন করতে লাগলো।

জয়নব এবার অন্ধকার ঘরটি থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় এলো। চারতলা বিল্ডিং এর শেষ দিকটায় তার ঘর। বারান্দায় মৃদুমন্দ আলো জলচ্ছে। বারান্দায় একটু কার্নিশ ঘেসে দাঁড়িয়ে দূরেন আকাশ আর লাল-নীল গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে তাদের হাসপাতালটাও সুন্দর দেখাচ্ছে। এত রাতে মানুষ জনের আনাগোনা চলছে। তার পাশেই হচ্ছে বয়েজ হোস্টেল। আর ঠিক তার পাশেই ঘেষে চলে গেছে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে ছোট থেকেই পছন্দ জয়নবের। হাসপাতাল টা খানিকা পাহাড়ি এলাকায় পড়াতে সেই সুযোগ পেলো সে। ঠিক সেই মুহূর্তে জয়নবের চোখে পড়লো আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা দুটি লোক দেয়াল টপকে তাদের বিল্ডিং এ প্রবেশ করল। জয়নবের পিলারের আড়ালে লুকিয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ। রাতের আধারে এ লোক গুলো কি করতে চায়? দেখতে লাগলো সে।

লোক দুটো দুজনের মাঝে কিছু কথা বার্তা বলে টুপ করে চলে গেলো বয়েজ হোস্টেলে। কিছুক্ষণের মাঝেই একটি বস্তা টানতে টানতে বের হলো একজন। এদিক সেদিক তাকিয়ে বস্তা নিয়ে বের হতে লাগলো। আলোর কাছে আসতেই জয়নব দেখতে পেলো একটি হাত। আর দাঁড়ালো না সে। এক ছুঁটে নেমে এলো চারতলা থেকে। মাঠের কাছে আসতেই চেঁচিয়ে বলল,

“তোমরা কারা? কাকে নিয়ে যাচ্ছ? কি করেছো ওর সাথে?”

লোক দুটি ঘাবড়ে গিয়ে দুজনের দিকে তাকালো। জয়নবকে দেখেই বস্তা কাঁদে নিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো। জয়নব-ও পিছু ছুটছে। জয়নব কিছুতেই বুঝতে পারলো না তাদের গেট ম্যান কেন আসচ্ছে না তার চিৎকার শুনার পরেও? হয়তো তারাও মিলে আছে এদের সাথে? সেদিকে আর ভাবলো না জয়নব। পাশেই একটি গাছের ডাল পড়ে থাকতে দেখে ছুঁড়ে মারলো তাদের গায়ে লোক গুলো হুড়মুড় করে পড়ে গেলো নিচে। পড়ে গেলো বস্তাটাও আর বেড়িয়ে এলো মাথা টা। জয়নব স্পষ্ট দেখলো সিনিয়র আয়ান ভাই। চোখ দুটি বড় বড় করে উচ্চারণ ও করলো সে। কিন্তু ততক্ষণে আর আওয়াজ বের করতে পারলো না মুখ দিয়ে। কেউ অতি আদরের সহিত কোমরে এক হাত চেঁপে ধরেছে। কাঁধের মাঝে তার উষ্ণ আর্দ্র তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে। অন্য সাইডে গলার মাঝে সূক্ষ্মভাবে ইনজেকশন পুশ করে দিল। জয়নব সেখানেই স্তব্ধ। ঝাপসা চোখে দেখতে পেলো লোক দুটি আয়নকে তুলে নিয়ে যেতে লাগলো। জয়নব হাত দিয়ে ইশরা করতে চাইলো, মুখ দিয়ে কথা বলতে চাইলো। কিছুই পারলো। শুধু বুঝতে পারলো, পরম মমতায় কেও কোলে তুলে নিলো তাকে। আলো আধারে মাঝে এক জোড়া কালো কুচকুচে নয়ন জোড়া মালিক। তারপর..তারপর আর কিছু মনে নেই জয়নবের।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে