কি রে আমান, তোকে গত কয়েকদিন আড্ডায় দেখিনা। ক্লাস শেষে দৌড়ে বাসায় চলে যাস। অন্যসময় তো তোকেই ঠেলে ওঠানো যেতোনা আড্ডা থেকে। ঘটনা কি? প্রেম ট্রেম করছিস নাকি?
– আরে না বাসায় বাপজান খুবই প্যারা দিতেসে।
কিন্তু তুই না রাজীবকে বলতি তোর বাবা ওর বাবার মতো না। এসব ব্যাপারে খুবই ভালো। তোকে কোন দায়িত্বই মাথায় নিতে হয়না। শুধু পড়াশোনা ছাড়া সংসারের কিছুই তোর না জানলেও চলে।
– সেরকমই ছিল রে মিলা। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ যেন কি হয়েছে বাবার। আমাকে দিয়ে ঠেলে ঠেলে সব বাইরের কাজ করাচ্ছে।
বাইরের কাজ মানে?
– তুইতো জানিস আমার আম্মা একটু নরম সরম মানুষ। রান্না আর সংসার নিয়েই তার জীবন। বাসার সব বিল, বাজার, অফিসিয়াল কাজ সব বাবাই সামলাতো। তিন সপ্তাহ আগে হুট করে এসে বলে জীবন বীমা অফিসে যেতে তার কি যেন এক কাগজ জমা দিয়ে আসতে হবে। আমাকে অথোরিটির কাগজ সাইন করে দিয়েছে। তারপর আরেকদিন পাঠালো ব্যাংকে। কি কি সব কাগজ সাইন করা, এই একাউন্টের টাকা ঐ একাউন্টে নেয়া, নমিনি পেপার জমা দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। তার ওপর গত এক সপ্তাহ শুরু হয়েছে নতুন প্যারা। ভোর সকালে উঠে ফজর পড়ে ওনার সাথে হাঁটতে যেতে হয়। অল্প একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে পরেন তাও হাঁটতে যাওয়া চাই। আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিয়ে কয়েক কদম হেঁটেই পার্কে যেয়ে বসেন। তারপর শুরু হয় সম্পত্তির গল্প। কোথায় কি করেছেন, কোথায় কি আছে। আরে বলতো আমি এসব এখন জেনে কি করবো?
আংকেল বোধহয় তোকে বিয়ে দিয়ে দেবে রে। তাই ঘর সংসার বিষয় সম্পত্তি দেখভাল করা শেখাচ্ছে। হা হা হা।
– কর মজা যত পারিস। আমি গেলাম।
আরে এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?
– পপুলারে যেতে হবে। ওনার পরিচিত কার নাকি টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে যেতে হবে।
…………….
বন্ধুদের আড্ডা থেকে উঠে আসতে মন চায়নি আমানেরও।কিন্তু তার বাবা অপেক্ষায় থাকবে বলেছে তাই আর দেরী করতে ইচ্ছে করেনি। কি কারণে যে তার বাবা আজকাল যেকোন কিছু এমন আবদারের সুরে বলে তাই বুঝে উঠতে পারছেনা আমান। পড়াশোনার বাইরে আর কোন কিছুতেই এতোদিন তার বাবা তাকে মনোযোগ দিতে না দিলেও গত কয়েক সপ্তাহে যেন তিনি তার সে নিয়মের কথা ভুলে গেছেন। ঘরে ঢুকতেই বাবার মুখোমুখি পরে যায় সে।
– অফিসে যাওনি বাবা?
কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি। তোদেরকে তো সময়ই দেয়া হয়না। তাই ভাবলাম কয়েকটা দিন বাসায় থাকি।
– এই নাও তোমার রিপোর্ট।
পড়ে দেখেছিস?
– তোমার পরিচিত কার রিপোর্ট পড়ে আমি কি করবো বলো? আর তাছাড়া আমি তো আর ডাক্তার না, পড়েও কি কিছু বুঝবো?
…………..
সামনে সেমিস্টার ফাইনাল তাই সন্ধ্যার পর থেকে আজকাল পড়ার টেবিলে সময় দিতে হয় আমানকে। রাতে খাওয়ার সময় টুকটাক পারিবারিক আলাপ শেষে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পরে আমান। বাবার জন্য সকাল ভোরে উঠতে হয় বলে আজকাল একটু রাত না হতেই ঝিমুনি চলে আসে তার। গত কয়েকদিনের অভ্যাসে নাকি কোন এক অজানা অস্বস্তিতে ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় আমানের। তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। আরে আজব ব্যাপার তার বাবা আজ তাকে ডাকেনি। তাহলে কি তার বাবা আক্তার সাহেবের মাথা থেকে নিয়ম নীতির ভুত নেমে গেছে? আরো কিছুটা সময় বিছানায় গড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সে। রান্নাঘর থেকে মায়ের খুটখাট আওয়াজ আসছে।
– বাবা ওঠেনি আজ মা?
আমাকে বললো আগের রাতে ঘুম ভালো হয়নি, যেন ডাক না দেই। তুই ডেকে দেখতো ওঠে কি না। আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি বল।
উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকা আক্তার সাহেবের আর নাস্তা করা হয়না। ছেলে আমান যখন বাবা বাবা ডেকে সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দেয় ততক্ষণে মৃত্যুর ঠান্ডা হাতের পরশে তিনি বরফশীতল। মা মা করে ডাকতে ডাকতে মাটিতেই বসে পরে আমান। চোখ যায় জানালার কাছে রাখা টেবিলের ওপরের রিপোর্টের খামটাতে। দৌড়ে গিয়ে একতাড়া কাগজ বের করে আনে খাম থেকে। প্রতিটা কাগজের ওপরে রোগী হিসাবে তার বাবার নাম লেখা। চোখ আটকায় শেষ পাতায় মাথার সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে, গ্লায়োব্লাস্টোমা মাল্টিফরমি।
তারপরের ব্যাপারগুলো এতো দ্রুত ঘটে যায় যে আমানের মনে হয় সে বুঝি কোন নাটকের দৃশ্যে অভিনয় করতে থাকা এক নির্বাক অভিনেতা। তিনদিনের মিলাদ শেষে যখন বাসা ফাঁকা করে আমান আর তার মাকে একা রেখে সবাই বিদায় নেয় সেই প্রথম আমান টের পায় বাবা তাদের মাথার ওপরে কত বড় ছায়া হয়ে ছিল। মা পাশে থাকার পরও এক জীবনে আর কখনোই নিজেকে এতোটা একা মনে হয়নি তার। মনের ভেতর বয়ে চলে এক অনিঃশেষ আফসোস, কেন রিপোর্টের খামটা খুলে দেখলোনা? আরো একটু সময় কেন তার বাবাকে দিল না? মা ঘুমিয়ে গেলে পরে বাবার আলমারী খোলে আমান। সব কিছু কেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুছিয়ে রাখা, যেন বাবা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি চলে যাবেন শিগগিরই না ফেরার দেশে। মাঝের তাকে সাজিয়ে রাখা ফাইলগুলো টান দিতেই একটা চিঠি এসে পরে চোখের সামনে।ওপরে আমানের নাম লেখা।
বাবা আমান,
এই চিঠি যখন তুই পড়ছিস তখন সম্ভবত আমি অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা। ডাক্তার যেদিন বলে আমার মাথায় খুব ভয়ংকর ধরনের ক্যান্সার হয়েছে প্রথমে খুব স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করেছিল। ভেবেছি বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা করাবো, ভালো হয়ে ফিরে আসবো। তারপর জানতে পারলাম এটা এমনই একটা ক্যান্সার যে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যতোটা কম তারচেয়েও বেশী চান্স চিকিৎসা শুরু করে মৃতের মত পরে থাকা। তাই ভেবে দেখলাম সময়টুকু কাজে লাগাই।
তুই নিশ্চয়ই আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছিস গত কয়েক সপ্তাহ। এ বয়সে তো আসলে বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর কথা। আর আমি কি না তোকে জোর করে নিজের সাথে ধরে রেখেছি যতোটা সময় পেরেছি। কি করবো বল? আমার যে এক মূহুর্ত তোকে আর তোর মাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করতো না। জীবনে কতবার দুঃসময়ে ভেঙে পরার সময়ে মনে হয়েছে ইস মরে গেলে বাঁচতাম। আর যখন সত্যিই সেই নিশানা কাগজ হাতে পেলাম তখন শুধু মনে হয় কেন আমাকেই আমার প্রিয়জন ছেড়ে যেতে হবে? কেন আমার জীবনটাই এতো ছোট হতে হবে? কেন আরো কিছু সময় আমি পেলাম না? কত কি করার ছিল জীবনে, কিছুই তো করিনি। অনেক শখ ছিল তোর মাকে আর তোকে নিয়ে দার্জিলিং বেড়াতে যাবো। ম্যালের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘের দল গায়ে মেখে তোর মা আর তোকে নিয়ে চা খাবো। তুই কখনো সুযোগ পেলে নিয়ে যাস তোর মাকে।
এই পৃথিবী আরো হাজার বছর হয়তো টিকে থাকবে, অথচ আমার জন্য আর কয়েকটা বছর থাকলেতো আমি দেখে যেতে পারতাম তোর আরেকটু বড় হওয়ার সময়গুলো। বছর ঘুরলেই তুই অনার্স পাস করবি, মাস্টার্স দিবি, চাকুরী হবে, বিয়ে করবি, ঘরে ছোট ছোট কিছু দেবশিশু আসবে, অথচ শুধু আমি থাকবোনা সেই আনন্দগুলো ভাগাভাগি করে নিতে। আমরা সবাই একদিন মরে যাবো এটা সত্যি। তবু ডাক্তারের বেঁধে দেয়া নিজের মৃত্যু সময় জেনে এরকম একটা চিঠি লেখা যে কতোটা কষ্টের তা যদি তোকে বোঝাতে পারতাম! আমার মতো যেন আর কোন বাবাকে তার ছেলেকে এমন কোন চিঠি লিখতে না হয়।
তোকে গত কয়েক সপ্তাহে অনেকগুলো জায়গায় পাঠিয়েছি। চিঠির নীচে রাখা ফাইলগুলো খুললেই কারণ বুঝতে পারবি। যেন সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে সব কিছু সামলাতে হচ্ছে এরকম কিছু তোর মনে না হয় তাই যতোটা সম্ভব গুছিয়ে রেখেছি কাগজগুলো। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সবচেয়ে আনন্দময় ব্যাপার কি জানিস? নিজের প্রিয় মানুষগুলোর সান্নিধ্যে সময় কাটাতে পারা। সে হিসাবে তোকে আর তোর মাকে আমার জীবনে পেয়ে আমি সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। সৃষ্টিকর্তা তার সব বান্দাদের দেখে রাখার মালিক। তিনি যেন তার অপার করুণায় তোকে আর তোর মাকে শান্তিতে রাখে। মায়ের পাশে পাশে থাকিস। এক জীবনে আমি তার কোন আশাই বোধহয় পূরণ করতে পারিনি শুধু সংসারের জোয়ালটুকু ওর কাঁধে চাপিয়ে দেয়া ছাড়া। আমার হয়ে তুই ক্ষমা চেয়ে নিস। আমার ওপর তোর কোন রাগ থাকলে সেটাও মাফ করে দিস।
– তোর বাবা।
দু চোখের নোনাজলে চিঠির শেষের লেখাগুলো ঝাপসাই হয়ে গেছিল আর ক্ষণে ক্ষণে এক নিদারুন অন্তর্দহনে নিঃশেষ করে দিচ্ছিলো আমানকে, কেন সময় থাকতে আরেকটু সময় দেয়নি তার বাবাকে? এরকম দায়িত্ববান একজন মানুষের সন্তান হতে পারার ভাগ্যেই চোখের জল মুছে চিঠির ভাঁজ বন্ধ করে নামাজে দাঁড়ায় আমান।
জীবনে প্রথমবার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বলতে পারে,
রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস