#অন্তরিক্ষ_প্রণয়
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৮
ময়মনসিংহ ফিরে গিয়ে প্রিয়তা তার ভাইকে সবটা জানায়। প্রিয়তা আশা করেছিল ওর ভাই ওর পাশে থাকবে। কিন্তু না! এক ভাইও তার বোনের সিকিউরিটি চায়। পরিবারহীন ছেলের কাছে বোন বিয়ে দিতে তারও চিন্তা করতে হয়। প্রিয়তার ভাই থম মেরে তারপর কল কেটে দেয়। আর এদিকে প্রিয়তা টেনশনে শেষ। তার প্রচন্ড ভয় করছে। যদি তার পরিবার আকাশের কেউ নেই বলে মেনে না নেয়! প্রিয়তা তৎক্ষণাৎ আকাশকে কল করে। কল রিসিভ করে আকাশ বলে,
–আসসালামু আলাইকুম রানী সাহেবা।
–ওয়ালাইকুমুস সালাম। শোন, আমাকে তুমি আজকেই বিয়ে করবে।
আকাশের কথার জবাবে প্রিয়তা এভাবে দেয়। আকাশ তো অবাক! হুট করে বিয়ের কথা কেনো? আকাশ প্রিয়তাকে জিজ্ঞাসা করে,
–কি হয়েছে? হুট করে বিয়ের কথা?
প্রিয়তা অস্থির মনে বলে,
–জানি না আমি। তুমি আমাকে আজকেই বিয়ে করবে। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। বিয়ে না করলে আমি খারাপ কিছু করে বসবো।
আকাশ প্রিয়তাকে শান্ত করতে বলে,
–আচ্ছা শান্ত হও তুমি। তুমি বাহিরে আসো। দুপুরের খাবার আমরা বাহির থেকে খাবো আর তোমার কথাও শুনবো।
প্রিয়তা রাজী হয়ে ফোন কেটে দেয় তারপর একটক লাল শাড়ী বের করে পড়ে নেয়। সাথে সোনালি ঝুমকো। সুন্দর করে সেঁজে সে আকাশের সাথে দেখা করতে যায়। রেস্টুরেন্টে গিয়ে প্রিয়তা আকাশকে সব বলে। আকাশের মন তখন থেকেই খারাপ হয়ে যায়। তারা দুজনেই জানতো, হয়তো আকাশের পরিবার নেই এটার জন্যই বাঁধা আসবে।
আকাশ প্রিয়তাকে বলে,
–তোমার পরিবার রাজী না প্রণয়ি। আমার সাথে সত্যি তোমার জীবনের সিকিউরিটি নেই। যার পরিবার নেই, তার জীবনের কি ভরসা! তুমি তোমার পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নেও।
প্রিয়তা রেগে আকাশের কাছে উঠে এসে কলার ধরে বলে,
–আমার ভালোবাসা কি সস্তা মনে হয়? আমি কি তোমার সব জেনে ভালোবাসিনি? সবটা জেনেই তো তোমাকে ভালোবেসেছি। তাহলে কেনো সরে যাবো? আমরা দুজন মিলে আমাদের পরিবারকে মানাবো। আর আমাকে তুমি এই মূহুর্তে বিয়ে করবে। সামনে কাজি অফিস আছে। তোমার ফ্রেন্ডদের কল লাগাও।
আকাশ প্রিয়তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেও অসমর্থ। তারপর আকাশের চার ফ্রেন্ডের সাক্ষিতে আকাশ ও প্রিয়তার বিয়ে হয়ে গেলো। প্রিয়তার মন থেকে ভয় কিছুটা হলেও কমে গেছে। সে এখন তার আকাশকে নিজের করে পেয়ে গেছে।
প্রিয়তা আকাশকে বলে,
–তুমি একটা এক রুমের বাসা নিবে। আমি তোমাকে নিয়ে সেখানে শিফট হবো।
আকাশ প্রিয়তাকে থামিয়ে বলে,
–না তার দরকার নেই। ইন্টার্ন শেষ হলে আমি ও তুমি চট্টগ্রাম চলে যাবো। তোমার ট্রান্সফার করিয়ে নিবো চট্টগ্রাম মেডিকেলে।
প্রিয়তা নাছোড়বান্দা। সে এখন থেকেই আকাশের সাথে থাকবে। আকাশের আর কি করা! রাজী হয়।
হোস্টেলে গিয়ে প্রিয়তা তার রুমমেটদের বলে বিয়ের কথা। রুমমেটরা ভালো ওরা মেনে নেয়। তবে বিপত্তি হয় মেহের জেনে যায়। মেহের প্রিয়তার রুমে এসে প্রিয়তাকে ধাক্কা মেরে বলে,
–এতোদিন ভাবতাম, তোর পরিবার রাজী হবে না। কিন্তু তুই তো অনেক চালাক! আকাশকে বিয়ে করে নিলি! তোর জীবন আমি নরক বানাবো দেখে নিস।
প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে গেছে। এমনিতে তার পরিবার নিয়ে টেনশন আর এখন এই মেহের! প্রিয়তার রুমমেট সিনিয়র মেয়েটা প্রিয়তাকে শান্ত করে চলেছে কিন্তু প্রিয়তা কেঁদেই যাচ্ছে।
এক সপ্তাহ পর,,
প্রিয়তার পরিবার জেনে যায় বিয়ের ব্যাপারটা। মেহের জানিয়েছে এটা। প্রিয়তার বাবা-মা, ভাই ময়মনসিংহ এসে প্রিয়তাকে প্রথমেই থাপ্পড় দেয় আকাশের সামনে। আকাশ বাঁধা দিতে গিয়েও প্রিয়তা ভাইয়ের শাসানি দেখে কিছু বলতে পারেনা। প্রিয়তার বাবা-মা তাদের মেয়েকে এক পরিবারহীন ছেলের কাছে রাখতে নারাজ কিন্তু প্রিয়তা যাবে না আকাশকে ছেড়ে। প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–ওর পরিবার নেই বলে যে ও খারাপ তা কিন্তু না। একটা ছয় বছরের বাচ্চার কি এতো কিছু মনে থাকে? তোমরাই বলো! ওরে যে পেলে বড় করেছে তার হায়াত বেশি ছিলনা বলেই আজ আকাশ পরিবারহীন। আমি ওকে ভালোবাসি। প্লিজ তোমরা মেনে নেও।
প্রিয়তার বাবা রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
–আমার মেয়ে তুমি। তোমার ভালো মন্দ আমি বুঝি। তুমি এই ছেলেকে ছাড়বে নয়তো আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে না।
প্রিয়তা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু তারা রাজী না। প্রিয়তা শেষে বলে,
–তোমরা একসময় না একসময় আমাকে বিয়ে দিতেই। তখন হয়তো না চাওয়া স্বত্বেও আমাকে একটা বোঝা বয়ে বেরাতে হতো। আমি নিজের পছন্দে একজনকে বিয়ে করেছি। তোমরা আমাদের মেনে নিলে আকাশের পরিবার তো তোমরাই হতে। কেউ ইচ্ছা করে এতিম হয় না। পরিবার কেউ ইচ্ছা করে হারায় না। এখন আমিও কি ওকে একা করে দিবো? একসাথে থাকার ওয়াদা করেছি আমি। পারবো না আমি ছাড়তে ওকে। তোমরা নাহয় ভেবে নেও যে তোমাদের মেয়ের বিয়ে দূরে কোথাও হয়ো গেছে বা বিয়ের পর তো মেয়েরা পর হয়ে যায়! যা সমাজের রিত! সেটাই ধরে নাও।
প্রিয়তার একথায় ওর বাবা তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করে। প্রিয়তার মা মেয়েকে কিছু বলতেও পারলো না। প্রিয়তার ভাই আকাশের কাছে এসে বলে,
–আমার বোনের যদি কোনো সময় এতটুকুও চোখের পানির কারন তুমি হও তবে সেদিন আমি নিজে আমার বোনকে নিয়ে যাবো আর তোমার ব্যাবস্থা করবো।
চলে যায় ওরা। প্রিয়তা কান্নায় ভেঙে পরে। আকাশ পুরোটা সময় নির্বাক হয়ে দেখে গেছে। সে চায়নি বাবা-মা ও সন্তানের বিচ্ছেদ হোক। আকাশ প্রিয়তার কাছে বসে বলে,
–পারলে মাফ করো। আমি কখনোই চাইনি আমার মতো কেউ পরিবারহীন হোক। তোমার বাবা আমার জন্যই তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো।
আকাশ আর দাঁড়ায় না। চলে যায়। প্রিয়তার কান্না আরো ভারী হলো। প্রিয়তার রুমমেট দুজন আর ইফা ও রামিসা প্রিয়তাকে থামানোর চেষ্টা করছে।
_______
আরো সাতদিন কেটে যায়,
প্রিয়তা সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে। আকাশও চুপচাপ। দুজনের মধ্যে কথা কমে গেছে। আকাশের বন্ধুরা একটা একরুমের বাসার ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। আকাশ ও প্রিয়তা সেখানে শিফট হবে এই চলতি মাসটা শেষ হলে এক চুড়ুই পাখির সংসার গড়ার অভিপ্রায়।
প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনেছে আকাশ। কয়েকমাস থাকবে এখানে তারপর তো চট্টগ্রাম শিফট হবে। ইফা ও রামিসা প্রিয়তাকে ঘর গুছাতে সময় পেলে সাহায্য করে। সব গুছানো শেষে প্রিয়তা রুমের সাথে এটাচড ব্যালকনিতে যায়। রাতের আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আকাশ পেছোন থেকে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে সেও রাতের আকাশ দেখতে ব্যাস্ত। প্রিয়তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফোঁটে। দিনশেষে তার ভালোবাসার মানুষটা তার। প্রিয়তা একটা ছন্দ কাটে,
“ধরো তোমার আকাশ হলাম,
ছড়িয়ে দিলাম একগুচ্ছ তারা!”
আকাশ প্রিয়তার ঘারে মুখ গুঁজে বলে,
–আমার প্রণয়ি তার আকাশের বুকে এক ফালি একক চাঁদ। তার মিষ্টি আলোতে পরিণয় পায় সকল প্রণয় গাঁথা। আমার অন্তরিক্ষ প্রণয় আমার প্রণয়ি।
প্রিয়তা লাজে রাঙা হয়। আকাশের দিকে ঘুরে তার বুকে মাথা রাখে। চাঁদনিরাতে এক নবদম্পতির ভালোবাসার রাত।
________সময়ের চলমান পাতায় লিখা হয় প্রতিটি সুখকর প্রণয় কথন। আকাশ তার প্রণয়িকে সবসময় আগলে রাখে। আকাশকে ইদানিং প্রিয়তা অনেক ক্লান্ত দেখে। চোখ-মুখও কেমন যেনো রক্ত শূন্য লাগে। প্রিয়তা আকাশকে মাঝো মাঝেই জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে? কিন্তু আকাশ সবসময় হাসি মুখে জবাবা দেয় যে তার কিছু হয়নি। প্রিয়তা আকাশের খাবার দাবারে একটু নজর দেয়। আকাশের খাবারের প্রতিও অনেকটা অনিহা এসে গেছে। প্রিয়তা জোর করে তাকে খাওয়ায়। প্রিয়তা আকাশকে নিয়ে অনেক টেনশনে থাকার ফলে নিজের দিকটা দেখেই না যে তারও ইদানিং গা গুলায়। ফোর্থ ইয়ারে উঠে গেছে প্রিয়তা। আকাশও হসপিটাল অথারিটির সাথে কথা বলে তার চট্টগ্রাম মেডিকেলে ট্রান্সফার করিয়েছে সাথে নিজেরটাও। রেজাল্ট ভালো আকাশের সাথে ইন্টার্নিতেও অনেক ভালো রেকর্ড তাই তাকে রিকুয়েস্টের ভিত্তিতে জলদি চট্টগ্রাম মেডিকেলে জয়েন হবার পারমিশন দিয়ে দেয়।
চট্টগ্রাম যাওয়ার একমাস পর প্রিয়তা নিজের প্রেগনেন্সি টেস্ট করিয়ে জানতে পারে সে প্রেগনেন্ট। আকাশকে ময়মনসিংহ যেতে হয়েছে। কোনো কারনে সিনিয়র ডাক্তার তাকে ডেকেছে। প্রিয়তা তার বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে এটা জানাতে যে তারা নানা-নানি হতে চলেছে। কিন্তু প্রিয়তা বলার আগেই প্রিয়তার বাবা প্রিয়তার কল কেটে দেয় এই বলে যে তার কোনো মেয়ে নেই!
কান্না করতে করতে প্রিয়তা রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। পরেরদিন ভোরে কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলে আকাশের সাথে মেহেরকে বধুবেশে দেখে চমকে যায়। যখন মেহের বললো, কালকে রাতে আকাশ তাকে বিয়ে করেছে তখন প্রিয়তা এতোটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে যে কি বলবে বা করবে তার মাথায় আসছে না। পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সে মানতেই পারছে না তার আকাশ তাকে একদিনের ভিতর পর করে দিবে। কই পরশু রাতেও তো কথা বলেছিল! তখন তো এরকম কোনো কিছু বলেনি বা কথার ধাঁচ আগের মতো ছিল। তাহলে!
প্রিয়তা আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ একদম চুপ করে তাকিয়ে আছে। চোখ-মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। মেহের প্রিয়তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে। প্রিয়তা চোখের পলক ফেল। যাচ্ছে বিনা শব্দে। তার ভিতরে কি হচ্ছে তা সে ব্যাক্ত করতে পারছে না। মেহের প্রিয়তার জিনিস পত্র আকাশের রুম থেকে বের করে দেয় আর নিজের জিনিস রাখে। প্রিয়তা আর আকাশ কিন্তু এখনও দরজার কাছে। একে অপরের দিকে শুধু তাকিয়ে আছে, কেউ কোনো কথা বলছে না।
মৌনতা ভাঙে তখন যখন মেহের বলে,
–আকাশ বেবি, এই মেয়েটাকে কি এখানে রাখবে? আমার একে সহ্য হচ্ছে না। আমি কিন্তু তোমাকে ওর কাছে যেতে দিবো না।
প্রিয়তা আকাশের জবাবের আশা করছে কিন্তু আকাশ এখনো নির্বাক। প্রিয়তার মাথা কাজ করছে না। প্রিয়তার দমবন্ধ লাগছে। মেহের প্রিয়তার জিনিস পত্র বাহিরে ফেলে দেয় সাথে প্রিয়তাকেও ধাক্কা মেরে বের করে দেয়। প্রিয়তার তখন হুঁশ হয়। সে বন্ধ দরজার বাহিরে বসে চিৎকার করে কান্না করে কিন্তু বন্ধ দরজার ভিতর থেকে তার প্রিয় মানুষটার কান পর্যন্ত হয়তো পৌঁছায় না। প্রতিবেশিরা বলা বলি করতে থাকে। তাদেরও বিশ্বাস হয়না যে আকাশ এমন কিছু করতে পারে!
তখন প্রিয়তার কাছে রামিসার কল আসে। প্রিয়তা রামিসার সাথে কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না। রামিসাও কান্না করছে কিন্তু তার কারন কেউ জানে না। রামিসা প্রিয়তাকে জানায় সে চট্টগ্রাম চলে এসেছে। তারপর প্রিয়তাকে নিয়ে যাবে ঢাকা। কারন রামিসা এখন ঢাকাতে চলে গেছে। হৃদয় ও রামিসা কয়দিন পর বিয়ে করবে। রামিসা ও সাগর এক ঘন্টা পর এসে প্রিয়তাকে নিয়ে যায়। প্রিয়তা একদম চুপ হয়ে গেছে। মুখে কোনো রা নেই। আর যাওয়ার আগে বারবার বন্ধ দরজার দিকে দেখছিল কিন্তু সেটা খুলেনি।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।