#অন্তরালে
#আরশিয়া জান্নাত
#পর্ব -৪
আসিফের ক্রিটিক্যাল অবস্থা শুনে সাদাত ভয় পেয়ে যায়।যতোকিছুই হোক আসিফ জেরিনের একমাত্র ভাই।প্রতিশোধ নিতে ওকে কষ্ট দিতে চেয়েছে মেরে ফেলতে না।অনুতপ্ত অশ্রুসজল চোখে মোনাজাত করে বললো,হে পরওয়ারদিগার আসিফ ভাইকে সুস্থ করে দাও।
_____________
জেরিন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো।দেশের যে আলাদা ঘ্রাণ আছে তা অন্য দেশে না গেলে বোঝা যায়না।প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরদেশে পাড়ি জমানো কত যন্ত্রণার তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সে।একমাত্র ভাইয়ের এমন অবস্থায় দূরে পড়ে থাকার শক্তি জেরিনের নেই।ভাইয়ের বিয়েটা পর্যন্ত মিস করেছে শুধুমাত্র একজনের জন্য।সেই অতীতকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে ভিনদেশি হয়ে ছিল।এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হসপিটাল যাওয়ার জন্য ক্যাব ভাড়া করলো।সেই চিরচেনা রাস্তা,বন্দর কর্ণফুলী নদী।”আই মিসড ইউ এ লট মাই লাভলি চিটাগং”।
হসপিটাল এ ঢুকবার সময় রিয়ার সাথে দেখা।রিয়া নিজ থেকে এসেই জেরিনকে বললো,
কেমন আছ জেরিন?তোমার তো কোনো খবরই নেই।কত খুঁজলাম তোমাকে।
জেরিন কোনোরকম ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,
আছি আলহামদুলিল্লাহ।তুমি কেমন আছ?
:আমার আর থাকা! পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে আমি শেষ।তবুও পাপ শেষ হচ্ছে না।
জেরিন চমকে উঠলো।কোন পাপের কথা বলছে রিয়া?আর জেরিনকেই বা এতো খোঁজার কি দরকার ছিল?
জেরিনকে আনমনা দেখে রিয়াই বলতে শুরু করলো,
তোমাদের এলাকার মুন্নাকে চিনতে না?ঐ যে *** গ্রুপের লিডার ছিল?
:হ্যাঁ চিনিতো।।উনি আমাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছিলেন।
:হুম।তারপর ক্যাম্পাসে সাদাত ভাই ওকে বেদম মেরেছিল।সেই প্রতিশোধ নিতেই তো তিনি সাদাতের নামে আজেবাজে কথা তুলেছিলেন।তোমার ভাইকে জানিয়েছিল ফারহানকে দিয়ে।
:কিন্তু ভাইয়া তো বলেছিল তুমি প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দেখিয়েছ,সাদাতের বাচ্চার মা হতে চলেছ এই কথা নিজে বলেছ…
:হ্যাঁ আমি বলেছিলাম।কারণ আমার তখন আর উপায় ছিল না।
:উপায় ছিল না মানে!!
:সবটা বলছি শোনো,ফারহানের সাথে আমার রিলেশন ছিল।ভালোবাসার সত্যতা জানান দিতে ওর সাথে আমার ফিজিক্যাল রিলেশন ও হয় যার ফলে আমি প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ি।ওকে বিষয়টি জানানোর পর ও আমাকে খুব ইগ্নোর করে।আমি তখন অসহায় হয়ে পড়ি।কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
ও তখন মুন্না ভাইয়ের আন্ডারে ছিল,উনাকে খুব মানতো।তাই আমি এই সব কথা উনাকে বলি যাতে উনি আমাকে হেল্প করে।উনি হেল্প করতে চাইলো কিন্তু শর্ত দিলো আমি যাতে তোমার ভাইকে বলি আমার বাচ্চার বাবা সাদাত।তাহলে ফারহান আমাকে বিয়ে করবে মুন্না ভাই নিজে সেই দায়িত্ব নিবেন।আমি সেদিন স্বার্থপরের মতো নিজের ভালোটাই বুঝেছি।তাঁদের শর্তে রাজী হয়ে আসিফ ভাইকে ঐসব বলেছি।আর ফারহানও অন্যসব মেয়েদের জড়িয়ে সাদাত ভাইয়ের নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছিল।
:এতো বড় মিথ্যে নাটক করলে।লজ্জা করলো না?
:একজন মা হিসেবে আমি তখন সব লজ্জা ভুলে গেছি।আমার সন্তানকে দুনিয়ায় আনার জন্য পিতৃপরিচয় দেওয়ার জন্য আমি সব করতে পারতাম। কিন্তু কথায় বলে না পাপ বাপকেও ছাড়েনা।
আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি জেরিন।ফারহান আমাকে বিয়ে করেছে ভোগ করার জন্য।আমার কোনো দায়িত্ব নেয়নি।আমার বাচ্চাটা দুনিয়াতে আসবার আগেই মারা গেছে।তুমি আমায় ক্ষমা করো জেরিন।
আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি এসব বলার জন্য।কিন্তু তোমাকে পাইনি।সাদাত ভাই অনেক ভালো মানুষ তোমাকে অনেক ভালোবাসে।আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চেয়েছি কিন্তু সাহসে কুলায়নি।আজ তোমার কাছে সব বলে আমি ভারমুক্ত হতে পেরেছি….
তারপর রিয়া চলে গেল।
জেরিন ফ্লোরে বসে বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো।সে সাদাতকে একটাবার সুযোগ দেয়নি কথা বলার।ওকে ভুলে যাওয়ার জন্য কানাডা চলে গিয়েছিল।অথচ আজ কিনা জানলো সাদাত নির্দোষ!!ওর মন তাহলে ঠিকই বলেছিল।আমি এখন কোথায় পাবো ওকে।এতোগুলো মাস আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি,ওকে ভরসা করিনি।
বেশ খানিকক্ষণ পর নিজেকে সামলে আসিফের কেবিনে গেল।ভাইকে এরকম অসুস্থ দেখে জেরিনের দুচোখ ভরে কান্না পেল।তাঁর এতো প্রিয় ভাইটা আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।
আজ বুঝি ওর কান্নার দিন…..
ঋতুকে দেখে জেরিন রেগে গেল খুব।
:তুমি এখানে কেন?ভাইয়াকে ডিভোর্স দেওয়ার পর এখন এসেছ দরদ দেখাতে?তুমি জানতে না ভাইয়া তোমাকে চোখে হারায়।কেন তুমি ভাইয়াকে এতো কষ্ট দিলে যে ভাইয়া সইতে না পেরে ……
:জেরিন তোমার রাগ আমি বুঝতে পারছি।কিন্তু জানোতো মাঝেমধ্যে প্রিয়জনের ভালোর জন্যই প্রিয়জনকে ছেড়ে যেতে হয়।তোমার কি মনে হয় আমি তোমার ভাইকে ভালোবাসিনি,তাঁর এই অবস্থা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে না?
:আমি কিছু জানিনা আমার ভাইকে সুস্থ করে তোলো।আমি ওকে এভাবে দেখতে পারছিনা।
ঋতু জেরিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
:সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।ধৈর্য ধরো
চারদিন পর আসিফের সেন্স ফিরে।
আসিফ চোখ খুলে দেখে ঋতু ওর হাত ধরে বসে ঘুমাচ্ছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অনেক ক্লান্ত।
তাঁর খুব ইচ্ছে করলো ঋতুর গালে ছুঁয়ে দিতে।আচ্ছা সেই অধিকার কি এখন তাঁর আছে?ঋতুর ঘুম ভাঙলেই সে কি আবার চলে যাবে !
নার্স এসে দেখলো আসিফের সেন্স ফিরেছে।সে বললো,
:এখন কেমন ফিল করছেন?
:ভালোই তবে খুব উইক লাগছে।
:তা তো হবেই যে দখল গেছে আপনার।অবশ্য আপনার ওয়াইফ যদি সেদিন ঠিক সময়ে এসে অপারেশন থিয়েটারে না ঢুকতো কি যে হতো! আপনি তো রেসপন্স করাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।বিপি বেড়ে কি এক অবস্থা…
তবে একটা কথা বলতেই হয় আপনি খুব লাকি।এমন ডেডিকেটেড ওয়াইফ পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার!
ঋতুর ঘুম ভাঙার পর দেখলো আসিফ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আসিফের সেন্স ফিরেছে দেখে ওর কলিজায় পানি এলো যেন।উঠে ব্যস্তভঙ্গিতে বললো,
:তুমি ঠিক আছ?কখন সেন্স ফিরলো দাঁড়াও আমি ডক্টর কে খবর দিচ্ছি।বাসায় ও ফোন করতে হবে..
:ঋতু….
:হুম কিছু বলবে?
:নার্স এসে দেখে গেছে।তোমাকে ব্যস্ত হতে হবেনা।
:বাসায় ফোন করি মা বাবা সবাই খুব টেনশনে আছেন উনাদের খবরটা দেই।
:আমি নার্সকে বলেছি বাসায় খবরটা দিতে।
:এতোকিছু করেছ কখন!এতো আগে তোমার সেন্স ফিরেছে ডাকোনি কেন আমায়।আমিও কেমন এতো গভীর ঘুমে চলে গেলাম কি করে।কত কেয়ারলেস দেখেছ!
:হুশ এতো কথা বলছো কেন?
:আচ্ছা চুপ করলাম।
:ঋতু আমার বুকে একটু মাথা রাখো..
:তোমার বুকের সেলাইটা এখনো শুকায় নি আসিফ,সবে অপারেশন হয়েছে।
আসিফ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
ঋতু ওর অভিমান বুঝতে পেরে আলতো করে
হাতটা রাখলো বুকের মাঝখানে ব্যান্ডেজ এর উপর।তারপর কান্না আটকানো গলায় বললো,
:কেন নিজেকে সামলাতে পারোনি?তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো একটাবারও ভাবলেনা।আমার কথা বাদই দিলাম মা বাবা জেরিন ওদের কথা তো ভাবতে পারতে….
আসিফ তাকিয়ে দেখলো ঋতু কেমন কান্না আটকে কেঁপে কেঁপে কথাগুলো বলছে।এই মেয়েটা বুঝি আমায় ভালোবাসেনা? সে নাকি নাদিমকে ভালোবাসে , এই তার নমুনা হুহ।
______
সাদাতের ঠিকানা ফোন নাম্বার খুঁজে বের করতে জেরিন তার সব বন্ধুকে বলে রেখেছে।আসিফ সুস্থ হলে এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলবে।
ঐদিকে সাদাত জেরিনের দেশে ফেরার খবর পেয়ে খুশিতে অস্থির হয়ে আছে।কিন্তু সামনে আসছেনা যদি ওকে দেখে ফের চলে যায় সেই ভয়ে।জেরিন অন্তত দেশে থাকুক চোখের সামনে থাকুক।
আসিফকে রিলিজ দেওয়ার দিন সকালে ঋতু অস্বস্তিতে পড়ে গেল।এতোদিন হসপিটাল এ ছিল বলেই সে সবসময় থাকতে পেরেছে।যত্ন নিতে পেরেছে।কিন্তু বাসায় চলে গেলে সে তো সবসময় যেতে পারবেনা।ওদের সম্পর্ক তো এখন আগের মতো নেই।কি করবে তখন?
আসিফের যাবতীয় জিনিসপত্র গাড়িতে রাখতে রাখতে জেরিন বললো,
ভাবী তুমি কি বাসায় যাবেনা?
:আমি কিভাবে…
:দেখো ভাবী এতোদিন ভাইয়া অসুস্থ ছিল তুমি উনার প্রপার কেয়ার করেছ।আমরা তখন এটা ভাবিনি তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে বা তুমি ভাইয়ের বৌ না।মা বাবা এখনো তোমাকে ছেলের বৌ ই ভাবেন।কাগজের টুকরো দিয়ে সম্পর্ক জাজ করা যায়না।
:জেরিন কাগজের টুকরোর দাম নেই বললে চলে? কাবিননামায় সাইন করেই কিন্তু সম্পর্কে জড়াতে হয়।সেটাও তো একটা কাগজ তাই না?
:সেটা ঠিক তবে ঐটাতে দুজনের সম্মতি ছিল।।কিন্তু তোমাদের বিচ্ছেদে কারোই সম্মতি ছিল না।না ভাইয়ার না তোমার।আমি জানিনা কোন প্রতিবন্ধকতায় তুমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ।তবে তুমি যে আমার ভাইকে অনেক ভালোবাসো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।আমি চাই তোমরা আজীবন একসঙ্গে থাকো।
জেরিন সাবধানে আসিফকে ধরে গাড়িতে বসালো।
ঋতুকে গাড়িতে উঠতে না দেখে আসিফ বললো,
যাবেনা?
ঋতু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
তুমি যাও আমি পরে আসবো।
:পরে আসবে মানে কি এখন চলো?
:না।এখন না।বাসায় কাজ আছে।আমি পরে গিয়ে তোমায় দেখে আসবো।সাবধানে থেকো আর ঠিকঠাক মেডিসিন নিও।একদম চিন্তা করবেনা।
:এমনভাবে বলছো যেনো তুমি থাকবেনা?ঋতু তুমি আমার বাসায় আসবেনা?
ঋতু কি বলবে বুঝতে পারেনা।।আসিফকে এসব বলে স্ট্রেস দিতে চায়না।কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন, কিভাবে বুঝাবে আসিফকে সমাজের চোখে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে!!
:কথা বলছোনা কেন?আমি তোমাকে ছাড়া যাবোনা।জেরিন তুই ওকে বল গাড়িতে উঠতে নাহয় খারাপ হয়ে যাবে।
:ভাবী প্লিজ গাড়িতে উঠো।ভাইয়া হাইপার হয়ে যাচ্ছে।
ঋতু কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসলো।জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।জীবনটা এতো কঠিন হবার কি দরকার ছিল?
আসিফ সিটে হেলান দিয়ে ঋতুর দিকে তাকিয়ে ভাবছে,আমি তোমাকে আজ ছাড়ছিনা ঋতু।আজ আমি জানবোই কেন আমাকে ছেড়েছিলে।
বেশ কয়েকবার রিং হবার পর সাদাত কল রিসিভ করলো,
:হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম ।
এতোদিন পর সাদাতের গলা শুনে জেরিনের হার্টবিট বেড়ে গেল।কিছুক্ষণ পর বললো
:ওয়ালাইকুম আস্সালাম।কেমন আছেন?
:জেরিন….
:হুম
:এতোদিন পর আমার কথা মনে পড়লো তোমার?
:আপনার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।আপনি কখন ফ্রি আছেন?
:বিকেলে ।
:আচ্ছা।সিআরবিতে থাকবেন।
:ঠিক আছে।
সাদাত বুঝতে পারছেনা জেরিন কেন তাকে ডেকেছে।এটা পজিটিভ নাকি নেগেটিভ সাইন?
ও কি কোনোভাবে জেনে গেছে আমার জন্য আসিফের ডিভোর্স হয়েছে!!
ঋতুর মা বাবা আর রায়া আসিফদের বাসায় এসেছে।ঋতু সবার জন্য চা বানাতে কিচেনে যাওয়ার পর জাহানারা বেগম ঋতুর মাকে বললো,
আপা ঋতু কেন আসিফকে ডিভোর্স দিয়েছে আমি জানিনা।আপনি তো জানেন আসিফ ঋতুকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে।ছেলেটা আমার ঋতুর জন্য মরতে বসেছিল।একটু আগে হসপিটাল থেকে ঋতু আসতে চায়নি বলে রাগারাগি করে কি এক কান্ড করেছে।এখন ও যদি চলে যায় আবার কি অঘটন ঘটে সেই চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।
:আপা আপনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই।কত করে বলেছি এমন সোনা ছেলেকে ছাড়িস না।ও নাছোড়বান্দা কিছুতেই মানলোনা।এখন কি করবো বলেন সমাজ তো মানবেনা।ডিভোর্সের পর ও কিভাবে এখানে থাকবে..
(চলবে…)