#অন্তরালে
#আরশিয়া জান্নাত
#পর্ব-১
:ঋতু তুমি আমাকে কেন ডিভোর্স দিবা?আমি কি করেছি বলবা তো?
:আমি তোমার সাথে আর থাকতে পারতেছিনা আসিফ! মিউচুয়ালি ডিভোর্সটা দিয়ে দাও এতেই দুজনের ভালো হবে।
:আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি তো।তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা আমি।এই বাবু তোমার কি হয়েছে বলো তো?এই তোমার কোনো বড় অসুখ হয়েছে?এজন্য আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ যাতে আমি কষ্ট না পাই তোমাকে ঘৃণা করি?
:কিসব বলতেছ তুমি? ধুর এসব কেন হবে!
:আমি নাটকে দেখেছি অনেক ।নায়িকাদের বড় রকমের অসুখ হলে ওরা এভাবে কষ্ট দিয়ে চলে যায়।সোনা বলোনা তোমার কি কিছু হয়েছে?
:তোমার মেয়েলি স্বভাবটার জ্বালা বাঁচি না।এতো ঢং পাও কই?আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা তুমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে পাঠিয়ে দিবা।আমি এখন বাবার ওখানে চলে যাবো।
:কি বলতেছ এসব তুমি কেন যাবা?আমি কেন সাইন করবো।আমি তো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।আচ্ছা ঠিকাছে আমার দোষটা কি তা তো বলবা?
:আমি আর একটা কথাও বলবোনা যা বলবে লয়ার বলবে
আসিফ ঋতুকে ঝাপটে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো।
:প্লিজ ঋতু এভাবে কষ্ট দিওনা।আমি পারিনা এসব নিতে।দেখ বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে।
ঋতু জোর করে ছুটটে চাইলে আসিফ দ্বিগুণ শক্তি দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলো।
:ছাড়ো বলছি।এভাবে জোর করে আটকে রাখতে পারবানা।
:খুব পারবো।আমার কলিজাটাকে কোনোদিন ছাড়বোনা আমি।
তারপর কপালে গভীর করে চুমু খেয়ে বললো,
আমার আদর উপেক্ষা করে চলে যেতে পারবে?এতো শক্ত তুমি?
:দেখ এরকম করে লাভ নেই আমার সিদ্ধান্ত বদলাবেনা।আমি…..
আসিফ ঋতুর ঠোঁট বন্ধ করে দিলো।ওর রাগ ক্ষোভ সব যেন বরফের মতো গলে যায় তেমন উত্তাপে জ্বলসে দিতে চাইলো ঋতুকে!
ঋতুর ঘোর কাটলো বেশ কিছুক্ষণ পর।ও ধস্তাধস্তি করেও নিজেকে ছাড়াতে পারলোনা।শেষে পরাজিত পাখির মতো হাল ছেড়ে দিলো।
বেশ খানিকক্ষণ পর আসিফ ঋতুকে ছাড়লো।তারপর বললো,
ঋতু তোমার উপর অধিকার খাটানোর ইচ্ছে আমার নেই।কিন্তু আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।কেন এমন করছো আমি সত্যিই জানিনা।তবে এতে কষ্ট কিন্তু কমবেনা কারোই।বরং আমরা দুজনেই দগ্ধ হবো।তুমি একটাবার খুলে বলে দেখ দুজনে মিলে সমাধান করবো।
:আমি তোমাকে ভালোবাসি না আসিফ।তোমাতে এখন আগ্রহ পাইনা।তোমার এইসব দমবন্ধ করা ভালোবাসা আমার সহ্য হয়না।আমি মুক্তি চাই।
আসিফ আর কিছুই বলতে পারলো না।ওর সামনে দিয়ে ঋতু চলে গেল সে টু শব্দ ও করলোনা।
এতো আকুতি মিনতির পরও যখন ঋতুর মন বদলালো না সেখানে জোর করে আর কি লাভ।
কেমন এক অজানা ঘোরে সারাটাদিন নিথর হয়ে পড়ে রইলো ঘরে।
ঋতু কি সত্যিই আসিফকে আর ভালোবাসেনা?
ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
।
।
ঋতুকে বাসায় দেখে চমকে উঠলেন সাদেক সাহেব।তবে কি সত্যিই তাঁর মেয়ে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো!
:বাবা আমি চলে এসেছি।আসিফ এর কাছে লিগ্যাল নোটিস পাঠিয়ে দাও।
:তুই জানিস তুই কি করতে যাচ্ছিস?ভেবেচিন্তে বলছিস তো?
:হ্যাঁ বাবা।অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
:তুই যা ভালো মনে করিস।তবে পরবর্তীতে….
:না বাবা পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো অনুতাপ আসবেনা।আমি যা করছি আসিফের ভালোর জন্য করছি।ওর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি।
সাদেক সাহেব তাঁর মেয়ের এই অসহায় মুখ দেখে ঢুকরে উঠলেন।তাঁর মেয়েটা এতো বড় ঝড় কিভাবে সামাল দেবে?
ডিভোর্স নোটিস দেখে আসিফ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।ঋতু সত্যি সত্যিই তাঁকে ডিভোর্স দিতে চায়? ভেতরটা কেমন শূন্যতায় ছেয়ে গেল।
ঋতু আর আসিফের বিয়েটা হয় পারিবারিকভাবে।তবে আসিফ ঋতুকে বিয়ের আগে থেকেই পছন্দ করতো।আসিফ তাঁর ছোটবোন আফিয়াকে কলেজ এ ড্রপ করতে গিয়েই প্রথম ঋতুকে দেখে এবং ভালোবেসে ফেলে।তখন ঋতু অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আর আসিফ প্রাইভেট ফার্মে জব করে।
এংগেজমেন্ট এর দুই বছর পর ওদের বিয়েটা হয়।কারণ ঋতু চেয়েছিল অনার্স কমপ্লিট করেই বিয়ে করবে।আসিফ ও জোর করেনি।বিয়ের আগে কখনও ঋতুর ইচ্ছের বাইরে দেখা পর্যন্ত করেনি।সবসময় ওর কথামতো চলার চেষ্টা করেছে।বিয়ের পর মন উজাড় করে ভালোবেসেছে।
তবে কি অতিরিক্ত ভালোবাসাটা ঋতুর কাছে অসহ্যকর হয়ে উঠেছে?
না আর ভাবতে পারছেনা সে।বাঁধ ভাঙা অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে সব।ঋতুকে ছাড়া আসিফ পারবেনা বাঁচতে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই ঋতুর ভেতরটা কেঁপে উঠলো।বিয়ের পর এই প্রথম সে আসিফকে ছেড়ে থাকছে।
মানুষটা নিজেকে সামলাতে পারবে তো?
এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ঋতুর মনটা ছেয়ে গেল।
আসিফের মা জাহানারা বেগম সকালেই ঋতুকে ফোন করলেন।
:আস্সালামু আলাইকুম মা ।কেমন আছেন?
:ওয়ালাইকুম আস্সালাম।ভালো আছি মা তুমি কেমন আছ?
:জ্বি ভালো।
:বৌমা আসিফের কি কিছু হয়েছে?ও কাল রাতে ফোন করে কান্নাকাটি করলো।জিজ্ঞাসা করতেই বলে কিছু না মা তোমাকে অনেক মিস করছি তাই।ছেলেটা আমার এভাবে কান্না করেছে শুনেই তো আমার কলিজাতে পানি নেই।
:মা আপনি বরং ঢাকা চলে আসুন।আপনারা থাকলে ও মনে জোর পায়।
:তুমি আছো না আমার ছেলেকে সামলাতে?তোমার উপর ভরসা করেই তো আমি আর তোমার বাবা এখানে নিশ্চিন্তে আছি।
:তবুও মা আপনারা তো অনেকদিন আসেন না।ও আপনাদের অনেক মিস করে।এসে বেড়িয়ে যান কিছুদিন ওর ভালো লাগবে।ওর এখন আপনাদের খুব দরকার।
:আচ্ছা দেখি তোমার বাবার সাথে কথা বলে।
বৌমা আমার পাগল ছেলেটাকে একটু দেখে রেখো।জানোই তো ও অনেক ইমোশনাল।নাহয় এতোবড় ছেলে মায়ের জন্য এভাবে কাঁদে! বোকা ছেলে আমার,একটু খেয়াল রেখো মা।
ঋতু মনে মনে বললো,দেখে রাখতে চেয়েছিলাম মা।কিন্তু আমি যে অপারগ!!আপনারাই এখন ওর দায়িত্ব টা নিন।আপনারা এসে ওকে সামলান।
বিকেলে সাদেক সাহেব আসিফকে ফোন করলো।যদিও আরো আগেই করা উচিত ছিল কিন্তু কিভাবে কি বলবে ভেবে উঠতে পারছিলেন না তিনি।তাঁর এতো পছন্দের জামাই আসিফ অথচ এখন কিনা বিচ্ছেদ ঘটাতে হচ্ছে!
বেশ কয়েকবার রিং হবার পর আসিফ ফোন রিসিভ করলো।
:হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম বাবা।কেমন আছেন?
:ওয়ালাইকুম আস্সালামু।আর ভালো থাকা! তুমি কেমন আছ আব্বু?
:আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।ঋতু ঠিকঠাক পৌঁছে ছিল?
:হ্যাঁ।বাবা তুমি ঠিক আছো তো?তুমি তো জানো ঋতুর কথার বাইরে আমরা কখনওই যাইনা।বড় আদরের মেয়ে কি না!তোমার কাছে এমন নোটিস পাঠাতে হবে আমাকে আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
:বাবা আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে নিশ্চয়ই কোনো কিন্তু আছে।ও হঠাৎ আমাকে কেন ডিভোর্স দিতে চাইছে আমি সত্যিই বুঝতে পারছিনা।
:তোমার শাশুড়ি তো ওর সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে।ও দরজা বন্ধ করে বসে আছে।কারো সঙ্গে কিছু বলছেনা।
:আপনারা ওকে কষ্ট দিবেন না প্লিজ।আমার সাথে যাই হোক ওর উপর প্রভাব ফেলবেন না।
:আমি জানিনা আব্বু কি বলবো তোমাকে।আমার মেয়েটার এতো সুন্দর সংসার নষ্ট হয়ে যাবে ভাবতেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
:আল্লাহ ভরসা।যা হবে ভালোর জন্যই হবে।
আসিফ স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও ওর ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে কি ভুল ছিল তাঁর।কেন এতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো ওর।
কিছুদিন আগে ও তো ঋতু ঠিক ছিল।অফিস থেকে ফেরার পর সবসময়ের মতো ঋতু ওকে জড়িয়ে ধরেছিল।আসিফ প্রায়ই বলতো,মাত্র বাইরে থেকে এসেছি।ঘামে ভিজে শরীরটা কেমন জঘন্য হয়ে থাকে।আর তুমি কিনা এই সময়টাতেই এতোক্ষণ ধরে রাখো!
তখন ঋতু হেসে বলতো,তোমার সবকিছুতে আমার ভালোলাগা কাজ করে।এমনকি ঘামেভেজা গন্ধটাও ।সারাদিন শেষে তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরলেও সমস্যা তোমার হুহ!
ও আসিফের কত যত্ন করতো,প্রায়ই নিজ হাতে খাইয়ে দিতো।অন্য সবার মতো শপিং নিয়ে বা শখ আহ্লাদ নিয়ে একটুও বিরক্ত করতোনা।বরং আসিফ নিজেই এটাসেটা নিয়ে আসতো, কোথাও যাওয়ার বায়না ধরতো।এই মানুষটা তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ভাবতেই চোখের পানি চলে আসে।
।
।
:আপনার কথামতো আমি আসিফকে ডিভোর্স নোটিস পাঠিয়েছি, আশা করি খুব শীঘ্রই আমাদের ডিভোর্সটা হয়ে যাবে।
:আমার মনে হচ্ছেনা এতো সহজে সেটা হবে।তোমাকে আরো কঠোরভাবে বিহেভ করতে হবে।যেভাবেই হোক ওর জীবন থেকে তোমাকে সরে যেতেই হবে।
:আমি এমনিতেই অনেক রুড বিহেভ করেছি।আর কতো করবো!এভাবে দুটো ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করে আপনার কি লাভ হবে?
:সেটা তোমার জানতে হবে না।তোমাকে যা বলছি তা ভালোয় ভালোয় করো নাহয় ….
:ঠিক আছে।আমি চেষ্টা করবো যাতে তাড়াতাড়ি ডিভোর্সটা হয়ে যায়।
:উহু চেষ্টা না অবশ্যই করতে হবে।
ঋতু সেখান থেকে বের হয়েই এলোমেলোভাবে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো।বিধাতা এ কোন পরীক্ষায় ফেললো তাঁকে।একদিকে তার জীবনের চেয়েও প্রিয় ভালোবাসার মানুষ অপরদিকে তার সবচেয়ে আদরের বোনের জীবন।এই কঠিন পরীক্ষা সে কিভাবে পার করবে?
(চলবে….)
nice