অনূসুয়া পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
993

#অনূসুয়া
#পর্ব১৫ (অন্তিম পর্ব)
#রাউফুন

সুসমা অফিস থেকে বাড়ি এসে দেখলো, তার মা কান্না করছে। সে ছুটে গেলো বাবার ঘরে। কারিমা বেগম তেল মালিশ করতে করতে বললেন, ‘দেখ না মা, তোর বাবা কেমন যেনো করছেন। হঠাৎই তার শ্বাস কষ্ট বেড়েছে।’

সুসমা হাতের ব্যাগ ফেলে দিক বেদিক হয়ে ডক্টর কে কল করলো। ডক্টর আসতে দেরি হবে। তখন তার বাবা ইশারায় কি যেনো বলতে চাইছেন। হাতের ইশারাটা কারিমা বেগম বুঝলেন। তিনি তড়িঘড়ি করে কাগজ কলম এনে দিলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রহিম মিয়া বাম হাতে সেই কাগজে এলোমেলো করে কি যেনো লিখলেন। সুসমা কিছুই বুঝতে পারলো না কি হচ্ছে। সুসমার বাবা বিরবির করে তওবা পড়ে স্ত্রীর হাতে শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিলেন।

সুসমা শোকে পাথরের মতো বসে রইলো। কারিমা বেগমের কান্না শুনে পাড়া প্রতিবেশীর কয়েকজন এসে দেখে গেলো। মেরাজের পরিবারের সবাই এসেছে। সুসমা এক ভাবে বসে আছে। মেরাজ তার বোন আঁখিকে পাঠালো সুসমার কাছে। কিছু না বলে শুধু বসে রইলো আঁখি। দাফন কার্য দ্রুত সম্পন্না করা হয়েছে, রাত আটটার মধ্যেই। কারিমা বেগম স্বামীর বিছানার পাশ থেকে নড়ছেন না। স্বামীর শেষ বার এলোমেলো করে লিখে দেওয়া কাগজ খানা আঁকড়ে ধরে বসে আছেন।

সুসমাকে আঁখি এক ভাবে বসে থাকতে দেখে এবারে বললো, ‘আপু, আপনার গোসল করা উচিত এখন!’

সুসমা কেমন করে যেনো তাকালো। তারপর অদ্ভুত ভাবে বললো, ‘ওহ হ্যাঁ।’

সে টালমাটাল পায়ে হেটে যাচ্ছিলো। আঁখি এগিয়ে এসে বললো,’আপু আপনার শরীর দুলছে। আমি ধরে নিয়ে যাবো?’

‘ধরবে? ধরো!’

আঁখি গিয়ে সুসমাকে গোসল খানায় রেখে এলো। মেরাজ অস্থির হয়ে পায়চারি করলো। আঁখি ভাইয়ের এই অস্থিরতা দেখে এগিয়ে এলো। নরম গলায় বললো, ‘ভাইয়া, সুসমা আপু ঠিক নেই৷ ওঁ কেমন যেনো পা’থ’র হয়ে গেছে!’

মেরাজের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। সুসমার এই কষ্ট সে দেখতে পারছে না। সে সুসমার জন্য অপেক্ষা করলো। সুসমা আধ ঘন্টা পর মায়ের ঘরে গেলো। সে স্বাভাবিক, যেনো কিছুই হয়নি। কারিমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছেন। হাতে তখনও ধরে রাখা কাগজটা। সুসমা ধীরস্থির ভাবে কাগজ টা নিলো। কাগজে তিনটি শব্দ এলোমেলো ভাবে লিখা। সে কাগজ হাতেই এক ছুটে বাড়ির পেছেন এসে পরলো। এখান থেকে কবরস্থান বেশি দূরে নয়। সুসমা চেনে। মেরাজ সুসমার পেছনে পেছনে ছুটে আসছে। সুসমা জানে না সে এতোটা দ্রুত কিভাবে দৌঁড়ে আসছে।

শৈশবে বাবার কথার প্রতিধ্বনি বারবার তার কানে বাজতে লাগলো। কবরস্থানে আসতেই সুসমা পা থামিয়ে দিলো। নতুন কবরটা দেখতেই থমকে গেলো সে। হাতের কাগজ টা সেখানেই পড়ে গেলো। ঘোরের মধ্যেই কবরের কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। নিজেকে তার পাগল লাগছে। চোখের সামনে বাবার সাথে কাটানো শৈশব ভেস উঠলো। বাবার তাকে ঘাড়ে চেপে বসিয়ে ঘুরে নিয়ে বেরানো, স্কুলের প্রথম ভর্তির দিন, বাবার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত একে একে মনে পরতে লাগলো। সাথে সাথে গগন ভুলানো চিৎকার দিয়ে উঠলো। উন্মাদের মতো কবরের কাচা মাটির উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো। পেছন থেকে মেরাজ আর তার বোন আঁখিও এলো। মেরাজ ইশারা করলো আঁখিকে যেনো তাকে ধরে টেনে নিয়ে আসে। আঁখি টেনে নিয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু সুসমাকে নড়াতে পারলো না। মেরাজ ভেবে পেলো না এই পাট কাঠির মতো শরীরে এতো জোর এলো কিভাবে। উন্মাদের মতো ব্যবহার করছে সুসমা। নাকে মুখে মাটির প্রলেপ লেগে গেলো তার। লম্বা চুল গুলো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো বিশ্রি ভাবে। কান্নার আওয়াজে আশেপাশের লোকজন এসে জড়ো হতে লাগলো। মেরাজ আর সহ্য করতে না পেরে সুসমাকে ধরে উঠালো। সুসমা চেঁচিয়ে বললো, ‘আমাকে কেন অপরাধী বানিয়ে গেলে বাবা। আমি যে তোমার কথা রাখতে পারবো না। কেন করলে এমনটা।’

এক সময় মেরাজ ও তাকে ধরে আটকাতে পারলো না। মেরাজ চেয়েছিলো সুসমাকে স্পর্শ করবে না। পাছে যদি সুসমা ভেবে বসে মেরাজ তার দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে? সুসমা প্রবল জোর খাটিয়ে তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কবরের পাশে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরলো আবারও । হাুটগেড়ে বসে কবরকে জড়িয়ে ধরলো। কবরের মাটি ভিজে উঠতে লাগলো তার চোখের জলে।

‘বাবা, এই-যে বাবা উঠোনা,দেখো কে এসেছি? তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নাও বাবা, ও বাবা। আমি তোমার কথা রাখতে পারবো না। পারবো না রাখতে। আমাকে এভাবে একলা করে কেন চলে গেলে বাবা? কেন করলে?’

ডুকরে কেঁদে উঠলো সুসমা। বাবা যে তার সঙ্গে কথা বলছে না। কবরের উপরে মাথাটা এলিয়ে স্বশব্দে কাঁদতে লাগলো সে। কাঁদতে কাঁদতে সুসমা জ্ঞান হারালো।

মেরাজকে না চাইতেও সুসমাকে কোলে নিতে হলো। আসার সময় সে সাদা কাগজটা লক্ষ্য করলো৷ আঁখিকে ইশারা করতেই সেটা উঠিয়ে নিলো। সুসমা শরীরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যেনো মেরাজের শরীরেও ছড়িয়ে পরলো।

ঘুমের ঘোরে সে আবারও স্বপ্ন দেখলো সেই সাদা প্রিন্সেস গাউন পরা বাচ্চা মেয়েটিকে। আজকে বাচ্চাটি অন্যান্য দিনের তুলনায় হাসি খুশি। সুসমার ভীষণ ভালো লাগলো। সে বাচ্চাটিকে প্রথম বারের মতো স্পর্শ করলো। বললো,’ তুই আমার উপর রেগে নেই তো? আজকে তোকে খুব খুশি লাগছে। অন্যদিন তো গোমড়া করে রাখিস মুখ।’

‘মা, আজকে আমার অনেক খুশির দিন।’

‘খুশির দিন?’ অবাক হয়ে শুধালো সুসমা।

‘হ্যাঁ খুব খুশির দিন। আমার মায়ের বিয়ে হবে আমি খুশি হবো না? নানু ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে জানো? নানু ভাইও চাই তুমি সুখি হও!

‘বিয়ে করলে আরও একটা জীবন নষ্ট হবে। তুই কি চাস সেটা মা?’

‘জীবন নষ্ট হবে কেন? তুমি বিয়ে করে নাও। তোমার জীবনে আমি আবারও আসবো। আবারও তোমার কোলে ফিরবো। কিন্তু আবার যেনো আমায় সেই দমবন্ধকর মৃ’ত্যু দিও না। খুব কষ্ট, কষ্টের মৃ’ত্যু আমি চাই না।’

সুসমার ঘুম ভাঙলো ভোর বেলায় এই স্বপ্ন দেখে। ঘেমে জুবুথুবু সারা শরীর। সুসমা তার মেয়েকে এর আগেও স্বপ্ন দেখেছে, তবে আজ স্বপ্ন ভিন্ন। তার কেমন যেনো অস্থির লাগতে শুরু করলো। চোখ ভালো ভাবে মেলতেই দেখলো আঁখি তার বিছানায় পাশে বসে ঘুমাচ্ছে। সুসমা নিঃশব্দে উঠে বাইরে বেরোলো। মায়ের কাছে যেতে হবে। না জানি মায়ের কি অবস্থা হয়েছে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে সে হেলতে দুলতে দরজা খুললো। দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলো সে। মেরাজ দাঁড়িয়ে আছে। সে কি সারারাত এখানেই ছিলো? সুসমাকে বেরোতে দেখে মেরাজ অস্থির হয়ে ইশারায় জানতে চাইলো কেমন আছো।

সুসমা জবাব দিলো সে ভালো আছে। সে মায়ের রুমে গেলো। মা বাবার জায়গাটাই শুয়ে আছে। সুসমা গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। কারিমা বেগম নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন। মেয়েকে বুকে নিয়ে বেশ বেলা অব্দি শুয়ে রইলেন।

সুসমার বাবার মৃত্যুর দুই মাস পর সুসমা গেলো মেরাজের সঙ্গে দেখা করতে। মেরাজ বেশ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। তারা একটা ক্যাফেতে বসলো। সুসমা কফি অর্ডার দিয়ে মেরাজের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। মেরাজ টেক্সট করলো, ‘ হঠাৎ জরুরি তলব?’

‘বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে চাই।’

‘কি ইচ্ছে?’

‘আপনি বোধহয় জানেন’

‘দেখো সুসমা, তোমার বাবা তোমাকে তার শেষ ইচ্ছে জানিয়েছেন। আমাকে তো তিনি ধরা বাঁধা করে বলেন নি? আমাকে তো মানতে হবে না তাই না? তুমি যদি আংকেল এর কথা রাখতে আমায় বিয়ে করতে চাও তবে আমি বলবো সেটা করো না। কারণ আমার কাছে তোমার ইচ্ছের দাম সবচেয়ে বেশি। আমি চাই তুমি মন থেকে সিদ্ধান্ত নাও। আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারলেই বিয়েটা হবে!’

‘আমার কাছে বাবার এই তিনটি শব্দের ভার অনেক। “সুসমা বিয়ে করিস।” বাবার শেষ চাওয়া। আপনি না চাইলে আমি অন্য কাউকে বিয়েটা করে নেবো। নো প্রব্লেম।’

মেরাজ তো সুসমার আরও একটু কাছাকাছি যাওয়ার জন্য এভাবে বলেছে। তাই বলে সুসমা অন্য কাউকে বিয়ের কথা ভাববে। মেরাজ কিছু না বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো কফিশপ থেকে। সুসমা খানিক হাসলো। সে জানে একটু পর মেরাজ ম্যাসেজ লিখবে। হলোও তাই। মেরাজ ম্যাসেজ করেছে।

‘অন্য কাউকে বিয়ের ব্যাপারটা মাথা থেকে নামিয়ে দাও। আমি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো।’

সুসমা লিখলো,’আমার সোনার বাংলার পরের লাইনটা যেনো কি?’

মেরাজ হেসে ফেলে। লিখলো,
‘আমি জানি না। তুমি বলো তো দেখি!’

কফিতে চুমুক দিয়ে সুসমা লিখলো, ‘সর্বনাশ, বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে এইটাই জানেন না? বলুন, আমার সোনার বাংলা…আমি তোমায় ভালোবাসি!’

‘আমি তোমায় ভালোবাসি!’

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে