#অনূসুয়া
#পর্ব১২
#রাউফুন
(অতীত)
পঞ্চাশ গজ দূরে কাত হয়ে পড়ে আছে এক তরুণী। একটু আগে জঙ্গলের সামনে রাস্তার ধারে দেখে এসেছিলো সুসমা। মেয়েটির মৃ’ত লাশ পেছনে ফেলে এসে সুসমা সেই ধুলো মাখা জঙ্গলে-ঘেরা টিলার উপর দিয়ে হেঁটে সামনে এগোতে লাগলো। হঠাৎই সে থেমে গেলো। নিঃশব্দে মোটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পরলো সে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গলা চৌচির হয়ে মরুভূমির ন্যায় হয়ে গেছে একদম। তৃষ্ণায় ধুঁকছে সে। সে লক্ষ্য করলো ধুলোর ওপর বসে কুকাচ্ছে একটা বুড়ো। আর জঙ্গলের মাঝ বরাবরই যে মাটির রাস্তাটা, সেই রাস্তার ঠিক মাঝখানে কুড়ি একুশ বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটাকে ঘিরে রেখেছে তিনজন টগবগে জোয়ান। মেয়েটির হাত, পা রশিতে বাঁধা। চোখের অশ্রুতে টইটম্বুর আঁখিতে ছেয়ে আছে মুখের আদল খানি। এলোমেলো চুল ঘাম আর চোখের জলে ভিজে একাকার। হাত পা ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটি। প্রাণের ভয়ে তার চোখে আকুতি, কি নিদারুণ ভাবে তার প্রাণ ভিক্ষা চাইছে তার চোখ দুটো। সুসমা সহ্য না করতে পেরে শাড়ীর আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে নিলো। কোমড়ের কাছায় রাখা ধাঁ’রা’লো ছু’রি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে সেই ধুলো মাখামাখি হয়ে থাকা বুড়োটা তাকে টেনে ছেচড়ে একটা ছোট্ট কুঠুরিতে নিয়ে গেলো। ভারী জঙ্গলের আড়ালে সেই কুঠুরি এতোটা ছোট যে বসে বসে ভেতরে যেতে হলো সুসমা আর বুড়োকে। বুড়োটার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সুসমা আক্রোশে বললো,
‘আমাকে আপনি টেনে কেন আনলেন? ওঁরা ঐ মেয়েটির সঙ্গে কেমন করছে জানেন? ওঁকে মে’রে ফেলবে ওঁরা।’
বুড়োড়া খিটখিট করে হাসলেন। বুড়োর হলুদ লালচে দাঁত দেখে সুসমার শরীর শিরশির করে উঠলো। এই বুড়োটা আবার মানুষ খেকো নয় তো?তাকে এভাবে টেনে আনার কারণ কি? বুড়োর যা বয়েস তাকে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু সে, সে তো এভাবে বসে থাকতে পারবে না এখানে। তাকে বাঁচাতে হবে মেয়েটিকে। তার মেজাজ বিক্ষিপ্ত হলো। ক্ষুব্ধ হয়ে বললো, ‘এখানে একটা নোং’রা’মি হচ্ছে আর আপনি হাসছেন? আমাকে যেতে দিন আমায় বাঁচাতে হবে মেয়েটিকে।’
আশ্চর্য জনক হলেও এই মুহুর্তে সুসমার নরম, স্নিগ্ধ, সুন্দর মুখ খানা কঠোর হয়ে গেছে। জেদ আর ক্ষোভে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অন্ধকারে থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেল বুড়োটা। একটু এগোল বুড়োটা। ভাঙা খড়খড়ে গলায় বললো, ‘এখানে এসব হয়। তুমি, এখানে যেচে মৃ’ত্যু’র দিকে কেন এগিয়ে যাচ্ছো? এখানে এলেই বা কি করে?’
সুসমা বিরক্ত হলেও বললো, ‘আমার স্বামীকে অনুসরণ করে এদিকে আসছিলাম। তাছাড়া আমার ননদকে পাওয়া যাচ্ছে না। একুশ বাইশ বছরের তরুণী। ঠিক ঐ মেয়েটির মতো। এদিকে আমরা সবাই আমার ননদকে খুঁজতে ব্যস্ত অথচ আমার স্বামী সন্ধ্যায় কোথায় যেনো বেরিয়ে আসছিলো। আমার কাছে তার হাবভাব স্বাভাবিক লাগেনি৷ বোনের হারিয়ে যাওয়ায় সে একটুও চমকালো না। তবে কেমন বিচলিত লাগছিলো তাকে। আমি এর আগে কখনোই বাড়ির বাইরে পা রাখিনি। আমার স্বামীকে সন্দেহ হলেও ধরতে পারিনি। আজকে বেরিয়েছি ননদকে খোঁজার বাহানায়৷ অতঃপর আমার স্বামীকে ঐ জঙ্গলের রাস্তায় আসতে দেখি। হঠাৎই সে গায়েব হয়ে যায় আমার সামনে থেকে আর তারপর আর পায়নি। কিন্তু এদিকে এমন সরু রাস্তা দেখে এগিয়ে আসছিলাম, তখনই একটা মেয়ের মৃ’ত দেহ দেখতে পেলাম। মাটিতে মুখ থুবড়ে পরে আছে। গন্ডগোল আছে বুঝে আমি এগোচ্ছিলাম আর আপনাকে দেখলাম। এরপর তো জানেনই বাকিটা।’
বুড়ো সবটা শুনে আলতো, নিভে যাওয়া স্বরে বললো,
‘তুমি অপেক্ষা করো একটু৷’
বুড়ো একটা ঝুড়ির মতো ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করলো।এরপর আবারও নৈকট্যে এসে বললো,
‘এই নাও আমার হাতে বানানো নানা রকম পাতা দিয়ে বানানো স্প্রে, চাইলেই তুমি সাহায্য করতে পারো মেয়েটিকে। আমি বুড়ো মানুষ, ওঁদের মতো জোয়ান দের সঙ্গে পারবো না। ওঁরা যখনই আমাকে দেখতো, আমাকে আঘাত করার চেষ্টা চালাতো। তখনই স্প্রে করে পালিয়ে যেতাম। কিন্তু আজকে আশ্চর্যের বিষয় হলো আগে যত মেয়ে এনেছে, মেয়ে গুলোকে ওঁরা আজকের আগে জীবিত আনেনি। এই মেয়েটাই এখনো অব্দি জীবিত আছে। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে, সেজন্য মেয়েটির সঙ্গে এখনো কিছু করেনি। আমি নিশ্চিত কিছু করবেও না।’
সুসমার মাথা ঘুরতে লাগলো। এতো এতো খু’নের উৎস কি তবে এরাই? এই বিশ কুড়ি বছরের মেয়েরা হারিয়ে যাচ্ছিলো, এক মাত্র এই লোক গুলোর জন্যেই? এতো নিখুঁতভাবে ওঁরা কাজ করে যে, এদের শনাক্ত করা ইম্পসিবল হয়ে যাচ্ছিলো৷ এতো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে পুলিশের কাছে যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে সবকিছু৷ কেসের আগা মাথা ধরার চেষ্টা করেও পারেনি পুলিশ কর্মকর্তারা। সুসমা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,
‘আপনি আমাকে সাহায্য করছেন কেন? কি উদ্দেশ্য আপনার?’
‘কোনো উদ্দেশ্যে নেই।’ সুসমা বিশ্বাস করলো না। সে দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাইলে লোকটি তার ভাঙা শক্ত খিটখিটে হাতে তার হাত চেপে ধরে স্প্রে এগিয়ে দিলো। আর বললো,
‘যদি দেখো, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই তবে সোজা এই খানে চলে আসবে। এই গুপ্ত কুঠুরির খোঁজ এই পর্যন্ত পায়নি, এতো বছর এখানে থাকছি!’
‘আপনি এখানে থাকেন কেন?’
‘আমার এই দিন দুনিয়ায় কেউ-ই নেই৷ আমাকে আমার আপন ছেলে এখানে, এই জঙ্গলের গহীনে ফেলে চলে গেছিলো, এরপর থেকেই এখানেই থাকা হয়।’
সুসমা যেনো কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। লোকটার একেকবার একেক রকম বিবরণ দেওয়া কথা। তাই সে বললো,
‘এই কারণ হতেই পারে না। আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনি তো চাইলেই এখান থেকে চলে যেতে পারেন! যান নি কেন?’
‘র’ক্তের স্বা’দ পেয়েছি। ওঁদের র’ক্ত চাই, র’ক্ত। ওঁরা আমার মেয়েকে খু’ন করেছিলো আমার চোখের সামনে। ওঁদের র’ক্ত চাই আমার। র’ক্ত চাই। এর আগেও অনেককে শেষ করেছি আমি এবারে আরও শেষ হবে। আমি ছাড়বো না ওঁদের কাউকেই!’ হঠাৎই অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠলো বুড়োটা।
সুসমা এবারে যেনো আরও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চাইলো লোকটার দিকে। মনে হচ্ছে বুড়োর কথা বানোয়াট। সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললো, ‘তাহলে প্রথম বার মিথ্যা বললেন কেন? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আপনাকে।’
‘আমি মিথ্যা বলি নাই। মেয়ের শোকে পা’গ’ল হয়ে যাওয়াই জঙ্গলে ছেড়ে গেছিলো আমার ছেলে। তবে আমার ছেলে জানতো না আমি এখানেই আসতে চাইতাম। মেয়েকে তো বাঁচাতে পারিনি। এঁদের কারণেই আমার মেয়ে আজ নেই। আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারিনি। বাবা হিসেবে অক্ষম আমি! অক্ষম! ওঁদের ছাড়বো না আমি কিছুতেই।’
বুড়ো হাউমাউ করে কাঁদছে। সুসমা ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে হাটু মুড়ে বেরোলো কুঠুরি থেকে। হাতের টর্চ সন্তর্পণে জ্বালাচ্ছিলো আর নেভাচ্ছিলো সে। ভয়ে সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি হলো তার। শরীরের লোম কা’টা দিয়ে উঠছিলো তার। জীবনে প্রথমবার এমন লোহমর্ষক ঘটনার সম্মুখীন হতে চলেছে সে। অল্প এগিয়ে যেতেই সে শুনলো রিনরিনে মেয়েলি স্বর।
‘বলেছি তো যাব না আমি!’ চড়া সুরে বলল মেয়েটি। ভীষণ ভীত এবং অধৈর্য দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। সে আড়াল থেকে দেখলো মেয়েটির মুখ খুলে দেওয়া হয়েছে তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না মুখ টা৷
‘যাচ্ছো তুমি মেয়ে বসের হুকুম।’ শরীরের তুলনায় ঘাড় মোটা এমন একজন বলল। মোটা পোশাক পরনে, কোমরে সিক্সশূটার গুজে রাখা।
‘বসকে মেয়েটির কথা আগেই বলেছি কিন্তু এখনো কেন যে আসলো না।’ ঝাঁঝ লোকটার কণ্ঠে।
‘জানতাম, মেয়েটিকে জোর করেই নিয়ে যেতে হবে!’
দুই কদম এগোল লোকগুলো। মেয়েটি ভয়ে গুটি শুটি হয়ে পেছাচ্ছিলো। পিছিয়ে গেলোও। মেয়েটির সারা মুখে আতঙ্কিত ভাব বিরাজমান। চেঁচিয়ে বললো,
‘তোমরা সবাই কাপুরুষ, তোমাদের বস্-ও! একজন নিরীহ মেয়ের সাথে জোর করতে বাঁধছে না তোমাদের?’
মেয়েটির মুখ পুনরায় কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হলো। মেয়েটি আর কথা বলতে পারলো না। সুসমার কেন যেনো স্বর টা চেনা চেনা লাগলো। একটু অন্য রকমের কন্ঠঃ।
খরখর শব্দে হাসলো ঘাড়-মোটা লোকটা। হাসি থামিয়ে বললো, ‘কেউ যখন অবাধ্য হয়, তখন তাকে জোর করতেই হয়!’
হাত বাড়িয়ে মেয়েটার কব্জি চেপে ধরল লোকটা। কিন্তু ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো মেয়েটি। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল এবার। বাঁধা হাত খানা গুটিয়েই দ্রুত হাত চালালো। ঘাড় মোটা লোকটার গালে লাগলো। কাত হয়ে পড়ে গেল লোকটা।
সেই সুযোগে সুসমা আওয়াজ না করে এগিয়ে গেলো। এখনও ওঁর উপস্থিতি টের পায়নি কেউই। সুসমা বুড়োর হাতে তৈরি করা স্প্রে খানা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে কাছে গেলো। নাকে শাড়ী চেপে স্প্রে করতেই সবাই লুটিয়ে পরলো। রাগে হিংস্রতায় সে ঘাড় মোটার হাত আর পে’টে ছু’ড়িঘা’ত করলো।
সুসমা একজনকে আঘাত করলেও বাকিদের পারলো না। তার হাতের টর্চ খানা পরে গেছিলো একটু দুরেই। সেই আলো এসে পরলো সুসমার মুখে৷ মেয়েটি সুসমাকে দেখতেই উম উম শব্দ শুরু করলো।
‘সরে এসো, বাছা!’ বুড়োটা এগিয়েই নিচু কণ্ঠে নির্দেশ দিলো।
তপ্ত লোহার ছ্যাকা খেয়েছে যেন, সেভাবে থমকে দাঁড়ালো সুসমা হঠাৎই কুজো বুড়োকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেখে। বুড়োর হাতে ধাঁ’রা’লো অ’স্র। তার মুখের চামড়া কুকড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। তার কোমরের কাছে চলে গেছে তার ডান হাত। বাম হাতে ধা’রা’লো অ’স্র। বিরক্তি আর ভর্ৎসনা দেখা গেলো বুড়োর নীলচে, ধুসর চোখে।
‘এই নর্দমার কীট গুলো কোত্থেকে উঠে এসেছে!এদেরকে মে’রে নিজের হাত নোংরা করো না মেয়ে। আমি দেখে নিচ্ছি!’ রাগে চেঁচাল বুড়োটা।
পরপর সব গুলো লোককে অনেক গুলো আ’ঘা’ত করে ঝাপ দিয়ে বুড়োটা হাউমাউ করে সেই রক্তের উপর হামলে পরলো। যেনো এতেই তৃপ্ত সেই বুড়ো। যেনো কতদিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম বুড়ো। সুসমার মনে পরলো বুড়োর কথা, “র’ক্ত চাই। র’ক্ত!” সুসমা সেই দৃশ্য সইতে না পেরে অন্যদিকে ফিরে বমি করে দিলো ঘেন্নায়। হাতের ছুড়ি কোমড়ের গাছিতে গুজে মেয়েটির কাছে গেলো। হাতের-পায়ের বাঁধন খুলতেই দেখলো রিয়া। অন্ধকার হলেও কাছ থেকে সে রিয়াকে চিনতে পারলো। রিয়া টর্চের আলোয় সুসমাকে দেখেছিলো।ভেঙে যাওয়া গলায় রিয়া বললো,
‘ভাবি, তুমি এখানে? কিভাবে?’
সুসমা পরিচিত মুখ দেখতেই জাপটে ধরলো নিজের ননদকে। রিয়া হাউমাউ করে কাঁদছিলো। বুড়োর র’ক্তের নেশা চেপে বসেছে শরীরে। ভয়ে শিটিয়ে গেলো সুসমা আর রিয়া। এখন বুড়ো যদি তাদেরকেও কিছু করে বসে? খু’ন চেপেছে তার মাথায়। শরীরে বিন্দু মাত্র শক্তি না থাকা সত্ত্বেও দুইজন দুজনের হাত চেপে ধরে দৌঁড়ে ছুটে চললো। সুসমা জানে না জঙ্গলের কোন মাথায় আছে তারা। কিন্তু যে পথে এসেছে সেই পথ অনুসরণ করেই দৌঁড়াতে লাগলো। এক পর্যায়ে দৌড়াতে গিয়ে তারা কোনো নরম কিছুর সঙ্গে বাঁধা পেলো। পা আঁটকে যেতেই ধাম করে মুখ থুবড়ে পরলো তারা। সুসমা তখন আসার সময় টর্চ টা উঠিয়ে নিয়েছিলো। টর্চের আলো ফেলতেই ছিটকে সরে গেলো দুজনেই। যাওয়ার সময়কার মৃ’ত দেহখানা দেখলো। থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরে তারা আবার দৌঁড় শুরু করলো।
#চলবে