অনূসুয়া পর্ব-০৮

0
677

#অনূসুয়া
#পর্ব৮
#রাউফুন

বর্তমান

এসব ভাবতে ভাবতেই এক পর্যায়ে চেঁচিয়ে উঠলো সুসমা। সে আর অতীত ভাবতে চাই না। দিনকে দিন মানসিক রোগীতে পরিণত হচ্ছে সে। তার অতীত কেন তার পিছু ছাড়ছে না? কেন চাইলেও ভুলে উঠতে পারেনা তিক্ত অতীতটা? মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত স্মৃতি চারণে। মাথার স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্রি ভাবে।

‘এই যে হ্যালো মিস, সেই যে এসে চুপ হয়ে গেলেন আর তো কথা বললেন না? এক ঘন্টা হয়ে গেছে আমি অপেক্ষা করছি, কিন্তু আপনার মুখ থেকে কথায় বের হলো না! আপনার কথা তো দেখছি ভারী মুল্যবান! কথার ই যদি এতো দাম হয় না জানি আপনার একটা হাসির কত দাম বাপরে। এমন গোমরা মুখো মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। চুপ করে বসে থাকতে থাকতেই আবার হুট করেই চেঁচিয়ে উঠলেন এটা কোনো কথা? কানের মাথা খেলেন আমার। অবশ্য আমার আপনাকে দেখতে মন্দ লাগছিলো না। যেহেতু আমি আপনার ব্যাপারে সবটাই জানি, তাই আপনাকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য সময় দিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমি দেখি আপনার সময় নেওয়া শেষ হয় না। এক বছরও হয়নি আপনার ডিভোর্স হয়েছে সেক্ষেত্রে আপনার এরকম রিয়াকশনই আশা করা যায়।’

সুসমা অস্থির হয়ে উৎকন্ঠা নিয়ে সামনে থাকা সুপুরুষ এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘দেখুন মিষ্টার বিহান চৌধুরী আপনি চলে যান। আমি আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষ মানুষের সান্নিধ্য পেতে চাই না।আমি আপনাকে বিয়ের ব্যাপারে না বলতেই এসেছিলাম। কিভাবে বলবো ভেবে না পেয়েই চুপ করেছিলাম। দেখুন আমি মায়ের কথায় এখানে এসেছিলাম। কিন্তু আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি আজীবন এভাবেই কা’টাতে চাই, একা!স্যরি আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে বিভ্রান্ত করার জন্য!’

উঠে চলে এলো সুসমা। বিহান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বিরবির করলো,

‘এ কেমন মহিলা হ্যাহ্? যাক গে, উফফ বাঁচা গেলো। এমন গম্ভীর মেয়ে আমার মোটেও পছন্দ না। ভালোই হয়েছে চলে গেছে।’

রাস্তায় এসেই সুসমা রাস্তার অপর পাশে মেরাজকে লক্ষ্য করলো। এই লোককে কোনো ভাবেই বোঝানোটা টাফ হচ্ছে। বুঝ পাতা বে’টে খাওয়ালেও এই লোক বুঝবে না। সুসমা রাস্তা ক্রস করে ভেতরের সমস্ত রাগ মেরাজের উপর উগ্রে দিলো। মেরাজ সুসমাকে সব সময় এর মতো মুগ্ধ হয়ে দেখে গেলো। সুসমা রাগ ঝেড়ে বললো, ‘লজ্জা করে না আপনার? কোনো লজ্জা নাই না? এভাবে কেন অপেক্ষা করছেন আমার জন্য? মিনিমাম সেল্ফ রেস্পেক্ট টা অন্তত যার মধ্যে নেই তার আমার জীবনে কোনো জায়গা নেই। মানে টা কি হ্যাঁ? আমি যেখানে যাচ্ছি হেংলার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। কাজ নেই? বাউন্ডুলের মতো ঘুরে ঘুরে আমাকে ফলো করছেন। আমাকে কি একটু শান্তিতে বাঁচতে দিতে চান না? এমন নরক যন্ত্রণা কেন দিচ্ছেন আপনারা সবাই মিলে! আমি ডিভোর্সি, আমার কোনো কিছুর ঠিক নেই। আর আপনি সেই ছ্যাচড়ার মতো আমার পিছু নিয়েই যাচ্ছেন, নিয়েই যাচ্ছেন! কি করলে মুক্তি দিবেন বলুন তো? কেন আপনারা সবাই আমার পিছনে হাত ধুঁয়ে পরেছেন?’

‘আমি তোমার কোনো কথায় শুনতে চাই না। আমি কেমন ধ্যাটা সেটা নিশ্চয়ই জানো? আর আমি যদি বলি তোমার কষ্টের কারণ তুমি নিজেই তাহলে? তুমি তোমার জীবনে হইতো অনেকটা এগিয়ে গেছো কিন্তু আমি সেই একই জায়গায় পরে আছি, সেই নয় বছর আগের অনুভূতিতে। সেই একই হৃদয় দোলানে প্রেমে মত্ত আছি। আমি আমার প্রথম অনুভূতি ভুলতে চাই না। কারণ এতেই যে আমি সুখ পায়! আজও তোমাকে দেখলে আমি নয় বছর আগে ফিরে যায়, আমার প্রথম অনুভূতি, প্রথম প্রেমে পরাতে ফিরে যায়। আমি সেই ঘুরে ফিরে তোমাতেই আটকে যাচ্ছি, আমার মনটা আটকে যাচ্ছে শুধুই তোমাতে। প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি, তোমায় না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করছি একি কম বেদনার? এর চেয়েও বেদনা যদি তুমি আমায় দাও তবুও আমি সেই তোমাকেই চাইবো।’

মেরাজের ফোন ম্যাসেজ পড়ে চেয়েও শক্ত থাকতে পারলো না সুসমা৷ কঠিন মানবীর মতো আচরণ করতে পারলো না। ভেতরের দূর্বল চেতনা তাকে দমিয়ে দিচ্ছে। এই লোকের কাছে তার কোনো রকম রাগ, ক্ষোভ খাটে না। সে শেষ চেষ্টার মতো করে বুঝাতে চাইলো মেরাজকে। বলল,

‘শুনুন, এসব পা’গ’লামি বাদ দিন। আমি যে একজন খু’নি জানেন? আমার মতো খু’নির সঙ্গে থাকবেন না। আপনার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে। একদম নিঃশেষ হয়ে মিশে যাবেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন এই পৃথিবী থেকে। সুন্দর একটা মেয়েকে বিয়ে করুন,বাচ্চা কাচ্চার বাবা হোন, সুখে সংসার করুন। বাবা মাকে আর কষ্ট না দিয়ে তাদের পছন্দ সই বিয়ে করে নিন প্লিজ! আমার মতো নগন্য একজনের জন্য কেন এমন করছেন? আমি কোথা থেকে উঠে এসেছি তা কি জানা নেই আপনার?’

‘নিশ্চিহ্ন? সে তো অনেক আগেই হয়ে গেছি। তোমার চোখের ধারালো চাহনিতে নিঃশেষ হয়ে গেছি, সর্বহারা পথিকের মতো নিঃশেষ হয়ে গেছি তোমার প্রেমে। প্লিজ এই অধমকে ফিরিয়ে দিও না আর। ভৃঙ্গরাজ ফুল যত্ন ছাড়াও সুন্দর! তুমি আমার কাছে সেই অযত্নের ভৃঙ্গরাজ ফুল! তুমি কে, কি ছিলে কোথা থেকে এসেছো, তা জেনে আমার লাভ কি? আমার সেই অযত্নে বেড়ে উঠা সুন্দর ফুল টাই চাই! আর আমি জানি আমার পছন্দ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়! আমার পরিবারের সবাই তোমাকে সাদরে গ্রহণ করবে বলে অপেক্ষায়মান সেই কবে থেকে! আর তোমার এই সুন্দর হাত কখনোই কোনো খু’নির হাত হতে পারে না। তুমি আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য আর কত বাহানা দেবে সুসমা? যদি তুমি পৃথিবীতে সর্বোচ্চ, শ্রেষ্ঠ খারাপও হও তবুও আমার এই তোমাকেই চাই। আমি কখনোই তোমাকে ছাড়বো না তুমি কি তা এতোদিনেও বুঝো নি?’

আবারও একটা ফোন ম্যাসেজ এলো মেরাজের নাম্বার থেকে। সুসমা কোনো কিছুর পরোয়া করলো না। মেরাজকে পাশ কাটিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে গেলো৷ মেরাজ সুসমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে অশ্রু মুছে নিলো। চোখ মুছতে মুছতে পাগলের মতো হাসলো। মনে মনে ভাবলো, ‘তুমি আমার কাছে বাঁধা পরেও পরতে চাইছো না। আমি কি তোমায় পাবো না? তবে কেন তোমার প্রতি আমার এই টান? আমার ভালোবাসা যদি খাটি হয় তোমায় আমি ঠিক পাবো আমার বিশ্বাস!’

মেরাজ সুসমাকে ম্যাসেজ লিখলো আরও একটি।

‘তুমি সবাইকে ফেরাতে পারলেও আমাকে পারবে না,পারোও নি। কারণ তুমি মানো আমি সবার মতো না। আমাকে হটানো এতো সহজ হবে না। শেষ অব্দি চেষ্টা করে দেখতে পারো আমাকে তোমার পিছু নেওয়া থেকে আটকাতে পারো কি না। আমি আসবো তোমার বাড়িতে। এবার আর তোমার অনুমতির অপেক্ষা নয়, তোমার অনুমতির তোয়াক্কা আর করতে পারছি না। এর জন্য আমায় যে শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেবো। কিন্তু তোমায় হারানোর মতো শাস্তি আমি গ্রহণ করতে পারবো না। তোমার মুখ চেয়ে এতোদিন তোমার পরিবারকে জানাইনি, সম্বন্ধ নিয়ে যায়নি কিন্তু এখন যাবো। তৈরি থাকো।’

মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত নিয়ে বাড়ি ফিরে ঘরের দরজাটা আটকে দিলো সুসমা। সে কি করবে এখন? বাঁচার যে কোনো পথ অবশিষ্ট নেই। একদিকে অতীত তার পিছু ছাড়ছে না, অন্যদিকে মেরাজ আঠার মতো লেগে আছে। নাম্বার চেঞ্জ করে ফেললেও মেরাজ তার নাম্বার ঠিক পেয়ে যায়। এই এক বছরে এতো সীম চেঞ্জ করেছে যে বলার বাহিরে। কিন্তু তবুও কোনো না কোনো ভাবে নাম্বার ঠিক জোগার করে নিয়েছে মেরাজ৷ সে মেরাজকে আর কঠিন বাক্য ছুড়তে পারছে না। একটা মানুষকে আর কিভাবে, কত ভাবে বোঝানো সম্ভব? তার কথার তীরে প্রতিনিয়ত মানুষটা ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত হচ্ছে। তবুও হার মানছে না। আফসোস সে এমন ভালোবাসার একজন কাঙালকে নিজের জীবনে জায়গা দিতে পারছে না। পারছে না নিজের বিষাদে ভরে যাওয়া জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তাকে বিষাক্ত করে দিতে৷ সেদিন সুসমা বিবাহিত জানার পর মেরাজ আর সামনে আসেনি কিন্তু নিয়মিত চিঠি দেওয়া বন্ধ করেনি। সেগুলো সে পড়ে আবার পুঁড়িয়ে ফেলতো যখন রাশেদ অফিসে থাকতো। শাশুড়ী মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে চিঠি পড়াটা ছিলো সবচেয়ে কঠিন। কেন যেনো সে মেরাজের দেওয়া চিঠি গুলো না পড়ে থাকতে পারতো না। মনের বিরুদ্ধে গিয়েও চিঠি গুলো পড়তো। চিঠি গুলো পুঁড়ানোর সময় তার মনে হতো চিঠি নয় তার অন্তর ই পুঁড়ে যাচ্ছে।

কারিমা দরজার বাহিরে পায়চারি করছে। মেয়েকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় দরদর করে ঘামছেন তিনি৷ তার মেয়ে যা ধ্যাটা হয়েছে নিশ্চিত এবারের ছেলেটাকেও অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে। মেয়েকে নিয়ে পরেছেন মহা বিপাকে। এই মেয়ের সঙ্গে কিভাবে পারা যায়? বোবার সঙ্গে কি কেউ পারে? সর্বক্ষণ গাম্ভীর্যের সঙ্গে মুখটা সেটে বসে থাকে। মেয়েকে এখন তিনি ভয় পান, মেয়ের রাগ, মেয়ের মেজাজকে ভয় পান তিনি।

দপদপ শব্দ শুনে সুসমা দরজা খুলে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে পরলো। মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বুকের সঙ্গে হাত ভাজ করার পর কারিমা পায়চারি থামিয়ে আমতা আমতা করে বললেন,
‘ওখানে গেলি, ফিরে এসে কিছু তো বললি না। ছেলে পছন্দ হয়েছে?’

সুসমা সন্তর্পণে বললো, ‘ছেলে সুন্দর!’

কারিমার চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো৷ মেয়ে ডিভোর্স এর পর এই প্রথম কোনো ছেলেকে সুন্দর বলেছে। খুশিতে বললেন, ‘তার মানে তোর ছেলে পছন্দ হয়েছে? আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। আমি যায় তোর বাবাকে খবরটা দিয়ে আসি।’

‘আমি বলেছি আমি বিয়ে করবো? ছেলেটা অনেক সুন্দর। তারপর আবার অবিবাহিত! আমার উনত্রিশ আর ছেলেটার ত্রিশ৷ আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের বড় আবা প্রথম পাত্র! এমন ছেলের জীবন আমি নষ্ট করতে চাই না। তাই মানা করে দিয়ে এসেছি!’

কারিমা হতাশ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের গম্ভীর মুখ দেখে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও পারলেন না। আপন মনে বিরবির করে চলে গেলেন। সুসমা মায়ের যাওয়া দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে