অনূসুয়া পর্ব-০৬

0
685

#অনূসুয়া
#পর্ব৬
#রাউফুন

(অতীত)
বাড়ির সকল কাজ সেরে ঘেঁমে জুবুথুবু হয়ে সুসমা একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ক্লান্ত শরীর খানা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিলো। তখনই শাশুড়ী মায়ের ডাক পরলো। সে তো সব কাজ শেষেই রুমে এসে শুয়েছে তবে আবার ডাকছে কেন? হ্যাঁ এখন সে প্রায় সব কাজই শিখে গেছে। আগে না পারলেও এখন প্রায় সব রান্নায় পটু হয়ে গেছে। তার রান্নাও রাশেদ খুবই পছন্দ করে৷ রাশেদ যখন থেকে তাকে কলেজ ভর্তি করিয়েছে তখন থেকেই শাশুড়ী মায়ের তার উপর আরও রাগ বেড়েছে। এক বছরে জীবনটা বিষাক্ত হয়ে গেছে তার। এখন তাকে ডাকার পর যদি না যায় তবে আরেকটা ঝামেলা হবে যেটা সে চাইছিলো না। ঢাকায় এসে রিয়া আর মিথুনকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে! রিয়া ক্লাস নাইনে আর মিথুন ক্লাস সিক্সে পড়ছে। সুসমার বিরতিহীন কাজ করার ফলে শরীর প্রচন্ডভাবে দূর্বল লাগছে। সে নিজের দূর্বল শরীর টাকে টেনে তুলে শাশুড়ী মায়ের সামনে দাঁড়ালো। আস্তে করে শুধালো,

‘হ্যাঁ মা বলুন মা!’

‘কাজ ফেলে শুয়ে আছো যে। কাজ না করে সারাদিন শুয়ে বসে তো এই বাড়িতে খাওয়া চলবে না বৌ! এই রুপ কতদিন থাকবে শুনি? রুপ আর কয়দিনের? নিমতা ফুল যতদিনের। নিমপাতা যেমন সক্কাল বেলা ফুটে আবার রোদ উঠলে ঝর ঝর করে ঝড়ে পরে, তেমনই রুপ ক্ষনস্থায়ী বুঝছো। এতো বসে থেকে রূপ বাড়িয়ে লাভ নাই।’

সুসমা শাশুড়ী মায়ের মুখের উপর কথা বলেনা৷ লোকে শুনলে কি বলবে? লোকে বলবে বউ শাশুড়ী কাটকী৷ কি লজ্জার কথা! সে নমনীয় ভাবে বললো,

‘মা সব কাজ তো করা শেষ!’

‘বললেই হলো সব কাজ শেষ? চাল বেছেছো?’

‘হ্যাঁ বেছেছি মা।’

‘তাহলে কাপড় ধুয়ে দাও!’

‘এটাও করেছি!’

‘ভাত রান্না হইছে, তরকারি, সবজি, রাশেদের জন্য পাবদা মাছ রেধেছো? ঘর মুছেছো?’

‘ হ্যাঁ মা!’

‘এতো তারাতাড়ি? আচ্ছা, এখানেই দাঁড়াও আসছি!’

প্রজা রুমে গেলেন। আলমারি খুঁজে একটাও কাপড় পেলেন না। তিনি ক্রোধে গর্জন করে উঠে বললেন, ‘আমার কাপড় চোপড় সব কই? আর রিয়া মিথুনের কাপড়ও তো দেখছি নেই।’

‘কোনো কাপড়ই নেই ধোঁয়ার!’

হতভম্ব প্রজা কিয়ৎক্ষন দাঁড়িয়ে সুসমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েকে এতো জ্বালাতন করেও কাজ হচ্ছে না। কোনো ভাবেই ছেলের ঘাড় থেকে নামাতে পারছেন না তিনি৷ এই বউ বিদেয় করে টাকাওয়ালা বাবার কোনো মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ের দেবেন ভেবে রেখেছেন কিন্তু বিয়ের পর থেকে এই এক বছর পর্যন্ত এতো অত্যা’চার করার পর এই মেয়ে পরে আছে এখানে।

সুসমাকে আরও জ্বালাতে পুরো ঘরে ছাঁই ছিটিয়ে দিলেন৷ এই ছাই গুলো রাশেদ এনেছিলো মাছ কাটার কাজে লাগবে বলে। ছোট মাছ বা বড় মাছ এগুলো তো আর ছাঁই ছাড়া কা’টা সম্ভব না। শাশুড়ী মা যে এমন একটা কাজ করবে সেটা তার ধারণাও ছিলো না। তাই বলে ইচ্ছে করে এভাবে ঘর নোংরা করবে? এটা কি শুধুই তাকে বসে থাকতে দেখতে চাই না সেজন্যে?

‘ঘরটা নোংরা, দেখছো না? মুছে ফেলো। আমি এক্ষুনি আসছি! এসে যেনো দেখি ঘর মোছা শেষ।’

বলেই সুসমার হতবিহ্বল হওয়া মুখ খানা পেছনে ফেলে চলে গেলেন প্রজা। ছাদে গিয়ে রাগে জেদে ধোঁয়া কাপড় গুলো ছাদেই ফেলে পা মা’ড়িয়ে নোংরা করে হাতে নিয়ে ফিরে এলেন।

‘এই নাও তোমার কাজ! কাপড়ে এক ফোঁটা ময়লাও যেনো না থাকে। না হলে বুঝতেই পারছো কি হবে! এখন কাজ আছে? তো বসে থাকা লাগবে না। কাজ করে নাও। রাশেদ আসবে খেতে! সময় মতো যেনো টেবিল রেডি থাকে!’

সুসমার ঘর মোছা শেষ হয়নি আবার এরকম একটা
কাজ এসে হাজির হলো। এই মুহুর্তে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছে সুসমা। এতোটা বিকৃত মন মানসিকতা কারোর কি করে হয়? এই মহিলার মন কি সে কখনোই পাবে না? সে ঘর মুছা শেষ করে কাপড় নিয়ে ধুঁয়ে দিলো। কাপড় ধোঁয়া শেষে আবার ছাদে গেলো৷ কিন্তু এবারে একটা কৌশল অবলম্বন করলো। কাপড় গুলো না শুকাতে দিয়ে ওভাবেই ছাদে রেখে চলে এলো। গোসল করে বাথরুম থেকে সুসমার কাছে কাপড় চাইলো প্রজা। কাপড় এনে দিতে বললে সুসমা এনে দিলো। ভেজা কাপড় দেখে গর্জে উঠলেন প্রজা। দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘এই ভেজা কাপড় আমি পরবো?’

সুসমা একটু হেসে উত্তর দিলো, ‘আমি তো জানি না মা। এগুলো তো পরে ধুয়ে দেওয়া হয়েছে তাই হইতো শুকাইনি। কারণ আপনার কাপড় ধুয়ে শুকাতে দেওয়ার পর রোদ ছিলো না। আপনি যদি দ্বিতীয় বার না ধুঁতে দিতেন তাহলে তো কাপড় শুকাতোই।’

কথা শেষ করে সুসমা রান্না ঘরে চলে গেলো। প্রজা অনেকক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে ভেজা কাপড়ই পরে নিলো। কারণ অবশিষ্ট আর একটিও কাপড় ছিলো না। ভেজা কাপড় পরে থাকার পর তার ঠান্ডা লাগছিলো তবুও জেদ করে রুমের দরজা আটকে বসে রইলো।

রাশেদ আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে দুই মাস হলো।কারণ আগের থেকে এখন চাকরিটা ভালো ছিলো। ভালো মাইনে মাস গেলে হাতে পাবে। রাশেদ সঠিক সময় এসে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেলো। সুসমা গোসল করে এসে খেতে গেলো। বাড়ির কেউ-ই তার সঙ্গে খাবার খাই না। সবার শেষে খাবার টা সেই খাই। খিদেতে পেটে মোচড় দিচ্ছে বার বার। সে পাতিলের তলানিতে উচ্ছিষ্ট ভাত পেলো। চোখের জল ফেলে ঐটুকু ভাতই খেয়ে নিলো। ভাত তো সে কম রান্না করেনি তবুও কম পরলো কেন? খিদেতে অল্প ভাতই যেনো তার কাছে অমৃত লাগছিলো। সে ভাবলো আজ হইতো কেউ বেশি খেয়ে ফেলেছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এঁটো বাসন কোষন মেজে ক্লান্ত হয়ে পানি পান করলো৷

রাশেদ সন্ধ্যায় ফিরলো মুখ থমথমে করে। রুমে ঢুকে গলা ফাঁটিয়ে ডাকলো সুসমাকে বার কয়েক।
প্রতিদিনের মতোই রাশেদ আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সুসমা। স্বামী নামক মানুষটার মন পেতে কত কিছু না করছে সে। তার বিশ্বাস রাশেদ একদিন তাকে ঠিক বুঝবে। কিন্তু নতুন চাকরি পাওয়ার পর রাশেদের মতিগতি আরও পালটে গেছে। অফিস থেকে এসে দুটো ভালো মন্দ কথাও জিজ্ঞেস করে না। সে খেয়েছে কি না, সারাদিন কি কি করেছে, কেমন কা’টিয়েছে সে বাড়িতে। অফিস গিয়ে আগে যেটুকু দুই মিনিটের জন্য কল দিতো এখন তাও বন্ধ করে দিয়েছে। এখন অফিস থেকে এসেই অফিসের কাজ করবে নয়তো ফোনে কথা বলবে। ঘন্টার পর ঘন্টা হেসে হেসে কথা বলবে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তাকে দেখতেই বিরক্তিতে মুখটা পাংশুটে করে ফেলে। সে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলবে, ‘অফিস থেকে কত জরুরি কল আসে জানো? বাড়িতে তো শুধু বসে বসে খাও। আমি কাজ করে এসে রোজ রোজ তোমার এসব ন্যাকামো সহ্য করতে পারি না৷ আমি অনেক টায়ার্ড আমাকে একা ছেড়ে দাও।’

এই সময়ে সে রাশেদকে একই সঙ্গে ভালোওবাসে আবার ঘৃণাও করে। কোনো ব্যাক্তিবিশেষের প্রতি এরকম দ্বৈত অনূভুতি হওয়ার কারণ সে জানে না। অবশ্য রাশেদই প্রথম নয় তার শাশুড়ী মায়ের প্রতিও সে এরকম অনূভব করে। সে প্রতিবাদও করতে পারে না আবার এখান থেকে পালাতেও পারে না বাবার সম্মানের কথা চিন্তা করে৷ এক বছর হয়েছে বিয়ের এর মধ্যে যদি শরীরে ডিভোর্সি তকমা লেগে যায় তবে যে লোকে তাকে আর তার পরিবারকে ছিঃ ছিঃ করবে। এই সমাজে বেঁচে থাকাটা তার জন্য দূর্বিষহ হয়ে উঠবে।

কিন্তু আজকে রাশেদ অফিস থেকে আসার পর অত্যন্ত ভয়ে রুমে যেতে পারছিলো না সুসমা। রাশেদকে অদ্ভুত লাগছে। সে রুমে যেতেই সুসমার হাতে গ্লাস দেখেই আছড়ে ফেলে দিলো রাশেদ। রাগে, ক্রোধে ভাঙা কাচ তুলে তার হাতে বসিয়ে দিলো৷ সুসমা চিৎকার করে উঠলো। হাত থেকে গল গলিয়ে র’ক্ত পরতে লাগলো। সুসমার চেঁচানোই প্রজা জানালা দিয়ে দেখলো ঘটনাটা। কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে আবার নিজের ঘরে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে রইলো। রিয়া, মিথুন ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে ছিলো এক জায়গায়। সুসমার শ্বশুর বাড়িতে ছিলো না৷ উনি থাকলে হইতো এতো কিছু ঘটানোর সুযোগ পেতো না রাশেদ। ঘটনার আকস্মিকতায় হঁকচকিয়ে গেলো সুসমা। কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝলো না। রাশেদ সুসমাকে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো, ‘তোর নাগরে যে রোজ রোজ চিঠি দেই আমি কি জানি না? আজকে আবার দেখি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কলেজে ভর্তি করিয়েছি কি তোকে এগুলো করার জন্য? তোর নোংরামি আজ আমি বন্ধ করে দিবো।’

কিছু বুঝে উঠার আগেই রাশেদ নিষ্ঠুরের মতো বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো সুসমাকে৷ হাটু ভেঙে গলা চেঁপে ধরেছে পা-টা। সুসমার দম বন্ধ হয়ে প্রাণ পাখি বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। গোঙানির শব্দ ছাড়া মুখ দিয়ে শব্দও বের হচ্ছে না। সেই মুহুর্তে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঠেলেও সরাতে সক্ষম হয়নি সুসমা। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসে তার৷ রিয়া আর মিথুন এসব দেখে ছুটে বাবাকে ডাকতে চলে যায়। শেষ সময়ে সুসমার চোখ বেয়ে পানির কণা উপচে পড়ছিলো। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো রাশেদ।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে