অনূসুয়া পর্ব-০৫

0
690

#অনূসুয়া
#পর্ব৫
#রাউফুন

[সাল ২০২৩ (মানে বর্তমান।)]

‘তোমার প্রাক্তন স্বামী ফোন কিনেছিলো তোমার বাবার দেওয়া টাকায়? এরপর কি হয়েছিলো? নিশা মেয়েটা কি তোমাদের জীবনে কা’টা হয়েই ছিলো? উফফ সবটা জানার জন্য এতো কিউরিসিটি জাগছে আমার! এতো ছোট জীবনে এতো কিছু কিভাবে সহ্য করেছো আমি ভাবলেই গা কা’টা দিয়ে উঠছে!’

‘সেসব পরে বলবো, লাঞ্চ টাইম শেষ। শুধু একটা কথা বলি শুনবে? শুনলে তোমার পিলে চমকে যাবে!’

‘কি কথা?’ সুসমা উঠে দাঁড়িয়ে একটু ঝুকলো রিক্তার দিকে। রহস্য ভরা কন্ঠে বলল, ‘ ঐ ঘটনার পর নিশা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলো। নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পর নিশার মৃ’ত দেহ পাওয়া যায় ময়লার স্তুপে!’

সত্যিই চমকে উঠে রিক্তা। বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে, ‘কিহ? নিশা নামের মেয়েটা মা’রা গেছে?’

‘হু! কেউ খুন করেছিলো জ’ঘ’ন্য ভাবে!’

‘পুলিশ খু’নিকে ধরেছিলো?’

‘উঁহু, কোনো রকম ক্লু খু’নি রাখেইনি!’

রিক্তা ভয় পেলো। তার শরীর বোধহয় মৃদু কাঁপছেও। তা দেখে সুসমা ফিসফিস করে বললো, ‘তুমি কি আমায় খু’নী ভাবছো নাকি? এভাবে দেখছো যে!’

রিক্তা মেকি হেসে কোনো রকমে বললো, ‘আরে কি বলো! তোমার মতো এমন হাম্বল মানুষ কিভাবে…!’

‘হতেও তো পারে আমি-ই খু’ন করেছি! তুমি একটা খু’নির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছো!’

রিক্তা আরও ভয় পেলো এমতা কথায়। সে কি তবে একজন ক্রিমিনাল এর লাইফ স্টোরি শুনছে? রিক্তার এমন অবস্থা দেখে হো হো করে দম ফাটিয়ে হাসলো সুসমা। হাসি থামিয়ে বললো,

‘জোকস আ’ পার্ট মিসেস রিক্তা! আমি তোমাকে একটু ভয় পাইয়ে দিচ্ছি!’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রিক্তা। সুসমা তা লক্ষ্য করে বললো, ‘এরপর আমার লাইফ স্টোরি না শোনাই ভালো হবে তোমার জন্য! আশা রাখছি আর আগ্রহ দেখাবে না!’

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রিক্তা বললো, ‘ঐ যে দূরে তাকিয়ে দেখো সুসমা। রোজ ছেলেটাকে দেখি দাঁড়িয়ে থাকে। তোমায় মুগ্ধ হয়ে দেখে। আমার মনে হয় ঐ লোকটা তোমায় পছন্দ করে। ভয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলে না। তুমি যা গম্ভীর হয়ে থাকো।’

সুসমা দুর্বোধ্য হাসলো। হেসে বললো, ‘ভয় পায় না, উনি বাকশক্তিহীন। আমি তাকে চিনি অনেক বছর থেকেই। নাম মেরাজ! সেও রাশেদের মতোই আমার জীবনে একটা কালো অতীত। ওহ স্যরি কালো অতীত কথাটা বোধহয় ঐ ব্যাক্তিটার জন্য প্রযোজ্য নয়।’

‘উনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই উনি কথা বলতে জানেন না। উনি যেহেতু কথা বলতে জানে না তবে তোমার সঙ্গে পরিচয় কিভাবে হলো?’

‘সে অনেক লম্বা কাহিনি। আমি বারণ করেছিলাম এভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না। উনি শুনেননি। দূর থেকেই দেখে চলে যায়। আমাকে কাগজে লিখেছিলো, “কথা না বলো তোমাকে দেখা থেকে বঞ্চিত করো না। এটা আমার অধিকার ধরে নাও। আমার না হও কিন্তু এই ছোট্ট অধিকার টা আমার থেকে কেড়ে নিতে কোনো ভাবেই পারবে না।” আমি এই পর্যায়ে কিছু বলতে পারিনি।’

‘ভারী অদ্ভুত তো মানুষটাহ! তুমি উনাকে গ্রহণ করছো না কেন সুসমা?’

আবারো হাসলো সুসমা। বললো, ‘আমি আমার অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে উনার মতো একজন ভালো মানুষকে জড়াতে চাই না।’

‘অনিশ্চিত মানে?’

‘না মানে আমি ডিভোর্সি আর সে এখনো আমার পথ চেয়ে বসে থেকে বিয়ে থা করেন নি। উনার নাকি বিশ্বাস একদিন আমি উনার হবো। কিন্তু আমি তো জানি তা সম্ভব না কোনো ভাবেই। যদি তাকে যথাযথ ভাবে ভালোবাসা দিতে না পারি তবে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কেন দিবো? একজন মানুষকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে কি লাভ?’

‘দেখো সুসমা আমি বলি কি, তুমি নিজের জীবনটাকে আরেকবার সাজানোর চেষ্টা করতে পারো। যে চলে গেছে তার মতো নিকৃষ্ট একজনকে ভালোবেসে একজন ভালো মানুষকে কষ্ট কেন দিচ্ছো? সে বোবা বলে কি এতো দ্বিধা তাকে গ্রহণ করতে?’

‘আমাকে দেখে কি মনে হয়, যে আমি কারোর একটা প্রতিবন্ধকতাকে হেয়ো করবো? আর তোমাকে কে বললো আমি এখনো আমার প্রাক্তন কে ভালোবাসি?’

‘তাহলে নিজেকে একটা সুযোগ দিচ্ছো না কেন?’

সুসমা হতাশার শ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তুমি বুঝবে না রিক্তা! কিছু মানুষ ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে, আবার কারো কারো কাছে ভাগ্য আপনি এসে ধরা দেই। এই দুটোর কোনোটার মধ্যেই আমি পরি না।’

সুসমা আর রিক্তার আর কথা হয়নি। অফিস থেকে ফিরে রোজকার মতোই ফ্রেশ হয়ে বাবাকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। নিজেও খেয়ে অফিসের টুকটাক কাজ করে শুয়ে পরলো। ঘুমের মধ্যে দেখলো, একটা প্রিন্সেস গাউন পরা ছোট্ট বাচ্চা দৌঁড়ে ছুটে আসছে তার দিকে। তার দৃষ্টি ঘৃণায় ভরা। মুখের আদলে বিরক্ত আর তীব্র আক্রোশ। সুন্দর চেরির মতো ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে আঁধো আঁধো কন্ঠে বলছে, ‘তুমি আমায় কেন মে’রে ফেলেছো? এতোটা কষ্ট কেন দিলে আমায়? আমি না তোমার মেয়ে! মা হয়ে আমাকে শেষ করে দিলে? এতোটা নি’ষ্ঠু’রভাবে হ’ত্যা করলে আমায়?’

‘বিশ্বাস কর মা, আমি, আমি তোকে মা’র’তে চাইনি। আমি যদি তোকে বাঁচিয়ে রাখতাম তবে যে তোকে আরও কষ্ট পেতে হতো। তার থেকে ভালো হয়েছে তোকে কোনো রকম কষ্ট না দিয়ে এই দুনিয়ার তিক্ততা, দুষিত নিঃশ্বাস থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। আমি তো ঠিক করেছি বল? বল, ঠিক করিনি?’

মুহুর্তেই রাগ মিশ্রিত আঁখি অশ্রুসিক্ত হলো৷ কন্ঠ খাদে নামিয়ে কাঁন্না মাখা গলায় বলল,’আমায় এতো যন্ত্রণা দিলে মা? এতোটা যন্ত্রণা কি আমার পাওনা ছিলো?’

বাচ্চাটি অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তাকে ঘৃণা করছে। ভীষণ ভাবে ঘৃণা। এই চোখে কারোর জন্য ভালোবাসা তৈরি হতেই পারে না।

‘যেও না মা। শুনে যাও মায়ের কথা একটি বার শুনে যাও! যেও না!’ সুসমা চিৎকার করে উঠে বসলো। এমন বাজে স্বপ্ন সে প্রায় প্রতি রাতেই দেখে থাকে। তার মেয়ে, তার সন্তান এই পৃথিবীর আলো দেখতেই তাকে সে নিঃশেষ করে দিয়েছিলো। সে চাইনি তার মতোই একটা নিকৃষ্ট জীবন তার মেয়েও পাক। এতো অন্ধকার সে মেনে নিলেও নিজের সন্তানকে একই অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দিতো না। তাই তো শেষ করে দিয়েছে,বেঁচে থাকলেই তো এমন অন্ধকারে হারাবে। মেয়েদের জীবনটাই তো সকল পুরুষ মানুষের কাছে পুতুল খেলা। জাষ্ট আ’ পাপ্যেট গেইম! হাহ্!

সুসমার গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরলো। প্রতিবারের মতোই আজকের রাতও তার নির্ঘুম যাবে। সে বারান্দায় গেলো। রাত বারোটা বাজে। তারা চট্টগ্রাম এসেছে প্রায় বছর খানেক হলো৷ রাস্তায় হলদে নীলাভ আলোয় একটা তীক্ষ্ণ ছায়া অবয়ব দেখা যাচ্ছে। সুসমা জানে, ঢাকা থেকে মানুষ টা এক মাত্র তার জন্যই এসেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে ঠিক এই সময় টাতে। পাশের বিল্ডিংয়ে উঠেছে যাতে সকাল বিকেল তাকে দেখতে পারে। আচ্ছা এই সময়ে যে তার ঘুম ভেঙে যায় এটা সে জেনেই কি এখানে ঠিক এই সময় টাই দাঁড়িয়ে থাকে? এখন যা ব্যাপক মশার উপদ্রব বেড়েছে তাতে করে এই লোককে খেয়ে শরীরের রক্ত শেষ করে দিবে৷ সুসমার কেমন যেনো লাগলো। রোজ রোজ এই লোক এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? অসুস্থ হলে কার দায়? যেহেতু তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে অসুস্থ হলে কি সেটার দায় তার উপর বর্তাবে? উঁহু তার দায় হবে কেন? সে কি বলেছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে? সুসমা গট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঠিক করলো আচ্ছা মতো শাসাবে আজ! আস্তে করে গেট খুলে ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরলো লোকটার। বুকের নিচে দু-হাত আড়া আড়ি ভাবে ভাজ করে দাঁড়ালো। লোকটা কি চমকে উঠলো তাকে দেখে? এই ঘন কালো চোখে কি যেনো একটা খেলা করে সব সময়! তার সরু ঠোঁটে সব সময়ের মতো মিষ্টি হাসি। তাকে দেখে হাসিটা প্রসারিত হলো। সেই হাসিকে গুরুত্ব না দিয়ে সুসমা তেজি কন্ঠে বলল, ‘এই সমস্যা কি আপনার? এখানে এতো মশার মধ্যে কেন দাঁড়িয়ে থাকেন প্রত্যেক দিন? একদম এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না৷ আমি বারণ করলাম। এই বুড়ির পিছনে আর কত ঘুরবেন? আমি বুড়ি হয়ে গেছি দেখেন না? আমাকে কি আর শাড়ী পরে আগের মতো সুন্দর লাগে? উঁহু! নাক টা থ্যাবড়ানো, ঠোঁট বেকে গেছে, বয়স বেড়ে চামড়া ঝুলে গেছে। স্কিন টোন কালচে হয়ে গেছে। এই দেখুন, ইইই এইযে দাঁতও একটা পরে গেছে। কি দেখে পরে আছেন আমার পেছনে? বিয়ে করতে পারেন না?’

সুসমা এতো কিছুর পরেও হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেরাজকে। তার রাগ বাড়ে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেই মৃদু। মেরাজ দু-কদম পিছিয়ে যায়। সোজা হয়ে নোটপ্যাড আর পেন বের করে সময় নিয়ে লিখলো কিছু একটা। লেখা শেষে এগিয়ে দিলো সুসমার দিকে। তখনো তার ঠোঁটে বিদ্যমান সুন্দর হাসি সুসমার নজরে আসছিলো। সুসমা রাস্তার লাইটের অল্প আলোয় লেখাটা পড়লো, ‘তুমি ভালোবাসো আর নাই বা বাসো আমি তো তোমায় ভালোবাসি। পাগলের মতো ঘুরবো, পিছু নিয়েছি কি ছাড়ার জন্য? নয় বছর অপেক্ষা করতে পেরেছি আজীবন পারবো। তবে আমাকে নিয়ে যে আজকে তোমার চোখে উৎকন্ঠা দেখেছি এরপর আর তোমার পিছু ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। তুমি নিজেও জানো না, না চাইতেও আমাতে মন দিয়ে বসে আছো তুমি! আমি আজকে ভীষণ খুশি জানো সুসমা? প্রথম বারের মতো তুমি আমায় ছুঁয়েছো যে।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে