অনূসুয়া পর্ব-০৩

0
724

#অনূসুয়া
#পর্ব৩
#রাউফুন

‘বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাচ্ছে এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছো? এই যে জমিদারের বেটি, উঠেন! খাবেন!’

সুসমা চোখ কচলে উঠে বসলো। বিছানায় রাশেদ নেই। সে তো তাকে ডাকতে পারতো। পরক্ষণেই একটু আগে শাশুড়ী মায়ের করা সম্বন্ধে ফিক করে হেসে উঠলো। বললো, ‘আমার মা ও এভাবে বলে জানেন মা? সব মায়েরাই বুঝি এমন হয়?’

‘ভারী নির্লজ্জ মেয়ে তো তুমি? শাশুড়ীর কথায় হাসছো? আমি তোমার মা নয় আর তুমিও আমার মেয়ে নও তাই আমার সামনে এভাবে নির্লজ্জের মতো হাসবে না দাঁত বের করে। বাড়ির বৌরা এভাবে হাসে না যখন তখন। আমি কাজ করে ম’রছি আর তুমি পরে পরে ঘুমাচ্ছো জমিদারের বেটি বলবো না তো কি বলবো।’

ষোলো বছরের সুসমার হাসি হাসি ঠোঁটের কোন আস্তে আস্তে নিমজ্জিত হলো। চোখ অশ্রুতে টইটম্বুর হয়ে গেলো ওমন ধারালো কথায়। মাথা নত করে বললো, ‘দুঃখিত মা। আসলে আমি ঘুমাতে চাইনি। কাল রাতে ঘুম হয়নি তো সেজন্য কখন যে….!’

‘ছিঃ ছিঃ আমি না তোমার শাশুড়ী, আমাকে এভাবে বলতে লজ্জা করলো না তোমার? কাল রাতে ঘুম হয়নি এটা আবার আমাকে বলছো? ভেবেছিলাম নতুন জায়গায় এসেছো তাই একটু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছো এখন দেখি আসলেই বেলাজ্জা মেয়ে তুমি। ‘

‘আমায় ক্ষমা করবেন মা আর হবে না এমন!’

‘হো হো ঠিক আছে। নবাবজাদার বেটি আসুন, রুটি ভাজা শেষ। খেয়ে আমাকে উদ্ধার করবেন আসুন। না হলে তো আবার বাপের বাড়ি গিয়ে বলবেন খেতে দেওয়া হয়নি।’

‘মা আপনার রুটি বানাতেই দুপুর হলো?’

‘দুপুর হতে যাবে কেন?’

‘একটু আগে আপনি যে বললেন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো!’

‘তোমার সাহস তো কম না, আসতে না আসতেই আমার কথার ভুল ধরছো? কাল বাড়িতে পা দিয়ে আজই আমার মুখে মুখে কথা বলা দাঁড়াও হচ্ছে তোমার!’

বলেই গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন প্রজা। সুসমা ওভাবেই বসে রইলো কিছুক্ষণ। কি হলো কিছুই বুঝলো না। সে তো রাগ করার মতো কথা বলেনি। হঠাৎই তার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। নাড়ি ভুড়ি যেনো উলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে খিদেতে। গতকাল থেকে সে কিছু খাইনি এটারই ফল তার। হঠাৎই বিয়ের ব্যাপারে সে ছিলো সম্পুর্ন অজ্ঞ। তাই খাওয়া দাওয়া আর সয়নি। সে শুনেছিলো সব মায়েরাই নাকি এক হয় তবে শাশুড়ী মা’রা বুঝি এমন অন্য রকম হয়? মা শব্দের আগে শাশুড়ী আছে তাই বুঝি এমন ভিন্নতা? তার মাও মাঝে মধ্যে তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে তখন বলতো ‘নবাবজাদার বেটি, উঠো, উঠে চারটে গিলো।’ তখন সে সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে মাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরতো। শেষ মায়ের রাগ গলে জল হয়ে যেতো তক্ষুনি। তার হাসি দেখলে মা আর রাগ করে থাকতে পারতো না। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে কি হাসা মানা? তবে যে মা বলতো, ‘আমার এই লক্ষী মেয়েটার হাসি দেখলে আমি কেন কেউ-ই রাগ করে থাকতে পারবে না।’

তাহলে কি এই বাড়িতে পা দেওয়ার পর তার হাসি বিচ্ছিরি হয়ে গেছে?

তা শাশুড়ীর রাগ পরে যাওয়ার বদলে রাগ বেড়ে গেছে? শাশুড়ী মাকে শান্ত করতেই তো সে তার সুন্দর হাসি খানা দিয়েছিলো। নাকি আসলেই সব শাশুড়ী মায়েরা ভিন্ন হয়? এমনটা তো সে জানতো না।

পিড়ি পেতে সবাই খেতে বসেছে। শ্বশুর মশাই, ননদ রিয়া, দেবর মিথুন আর রাশেদ। শাশুড়ী মা বসে তাদের খেতে দিচ্ছে। সুসমা বসবে কি বসবে না দোনামোনা করতে করতে একটা পিড়ি পেতে বসেই পরলো। শাশুড়ী মা একবার কড়া চোখে তাকিয়ে শুকনো দুটো রুটি এগিয়ে দিলো সুসমার সামনে। সুসমা ভাবলো হইতো বাকিদের মতোই সবজি আর ডাল তাকে দেওয়া হবে। কিন্তু তা তো হলো না। করিম সাহেব এসব দেখলেন আড়চোখে। নিজের স্ত্রীর এমন এক চোখাপনা ব্যবহারে তার ভেতরটা কেমন যেনো করে উঠলো। পরের বাড়ির মেয়েটা একটা দিনও পুরো হয়নি এই বাড়িতে এসেছ। অথচ এমন দুর্ব্যবহার তার সহ্য হলো না। তিনি বললেন, ‘বৌমাকে ডাল সবজি দাও! শুকনো রুটি খাবে নাকি?’

‘ডাল সবজি নেই।’

‘মিথ্যা কথা বলো কেন মা? আমি তো দেখলাম আছে সবকিছু।’

‘রিয়া, বড়দের মধ্যে কথা বলিস কোন সাহসে?’

‘নতুন ভাবির সঙ্গে এমন করছো কেন মা?’ বললো রিয়া!

‘বেশি দরদ দেখালে তোর ভাগের টাও রেখে দিবো!’

রিয়া চুপসে গেলো। করিম সাহেব নিজের ডাল আর সবজি এগিয়ে দিতে নিলেই সুসমা বাঁধা দিয়ে বললো,

‘একি করছেন বাবা? আপনি খান প্লিজ! আমি খেতে পারবো। আমি বরং মার সাথেই খাবো। মা যেহেতু পরে খাবেন আমিও না হয় পরে খাবো।’

সুসমা রাশেদের দিকে তাকিয়ে রইলো কোনো কিছু শোনার আশায়। সে আশা করেছিলো রাশেদ অন্তত তার ভাগের ডাল টা এগিয়ে দিবে। বলবে, ‘আমার ভাগের ডালটা নাও। আমরা তো এখন একই দেহে দুটো মানুষ। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনি। তোমার সুখ দুঃখের দায়িত্ব তো আমার!’ কিন্তু না মানুষটা তো গোগ্রাসে গিলতে ব্যস্ত। অন্য দিকে কোনো ধ্যান নেই। এমন কেন মানুষটা? তার ক্ষেত্রে এমন উদাসীন কেন? তবে যে তাকে এতো পছন্দ করে বিয়ে করলো? পছন্দ না হলে নিশ্চয়ই বিয়ে করতো না?

‘বৌমা আমি এই সবজি দিয়ে খাবো। তুমি ডাল টা নাও মা। বাবা দিয়েছি তুমি মানা করো না।’

কথা শেষ করেই করিম সাহেব ডালের বাটি টা এগিয়ে দিলেন। ওমনি খপ করে ডালের বাটিটা ছিনিয়ে নিলেন প্রজা। বুকটা ভার হয়ে গেলো করিম সাহেবের। কিছু না বলতে পেরে তিনি রুটির থালা ঠেলে দূরে সরালেন। পিড়ি রাগে ছুড়ে ফেলেই চলে গেলেন বাইরে। রাশেদ কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি বউ হয়ে আসতে না আসতেই অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। তোমার জন্য বাবা না খেয়েই উঠে গেলেন। মা ওঁকে এক ফোটাও ডাল দেবে না। আমি বলে গেলাম। ওঁকে শুকনো রুটিই খেতে দেবে।’

থমথমে পরিবেশের মধ্যেই একে একে সবাই খাবার খেয়ে উঠে গেলো।

অনেক কষ্টে সুসমা দু টুকরো রুটি মুখে দিলো। তার গলা দিয়ে শুকনো রুটি নামছে না। সে আগে কখনোই শুকনো রুটি খাইনি। বাড়িতে মা খাইয়ে দিতো তাকে। দুই তিনটে পদের রান্না থাকতো অন্তত তার বাড়িতে। তিন বেলা নিয়ম করে খাওয়ার পর্বটা বেশ জমজমাটই হতো। তার পছন্দের সব খাবারই করার চেষ্টা করতো মা। সে রাশেদের খাওয়ার প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বাটিতে ডাল অবশিষ্ট আছে। তাই সে শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে সাহস করে বললো,

‘মা আমি কোনো ভাবেই শুকনো রুটি গলা দিয়ে নামাতে পারছি না৷ ডাল দিয়ে খাবো একটু? আপনার ছেলে যে ডাল টা খাইনি মানে বেশি হয়েছে সেটা দিয়ে খাই?’

কেন যে এই মেয়েকে তার সহ্য হচ্ছে না তিনি জানেন না। শুধু জানেন, এই মেয়েটা তার ছেলেকে নিজের রুপ দিয়ে ফাসিয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন ছেলেকে বড়লোক বাড়িতে বিয়ে দিয়ে যৌতুক দাবি করবেন। তার স্বপ্নে এই মেয়েটা জল ঢেলেছে। এই মেয়ের বাবা কানা কড়িও যৌতুক দেন নি। রাশেদ ও ওঁদের কাছে ভালো সেজে একটা পয়সাও নেই। তিনি কিছুতেই এই মেয়েকে শান্তি দেবেন না।
প্রজা সেই তড়িঘড়ি করে উচ্ছিষ্ট ডালের বাটিতে পানি ঢেলে দিলেন জেদ করে। হতভম্ব সুসমা দু চোখ
ভরা অশ্রু নিয়ে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ীর এহেন কাজে।

‘শুকনো রুটি না খেতে পারলে খেয়ো না বাপু৷ ওখানে পানি আছে পানিতে ভিজিয়ে খাও তাও আমার মাথা খেয়ো না। তা বাপের বাড়ি কি এমন ভালো খাবার খেয়েছো হু, যে শুকনো রুটি মুখ রুচছে না?’

সুসমার গলা দিয়ে পানিও নামলো না আর। কষ্টে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। এমন কিছু হবে সে কল্পনাও করেনি। এমন নিষ্ঠুর একটা কাজ কি করে করতে পারলো তার শাশুড়ী মা? কান্নার বেগ বেড়ে গেলো তার। তা দেখে নাক মুখ কুচকে প্রজা রুমে চলে গেলো। মজা করে ডাল সবজি দিয়ে চার পাঁচটা রুটি খেয়ে শরীর এলিয়ে শুয়ে পরল।

সুসমা আর রাশেদ নিয়ম রক্ষার্থে সুসমাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। সঙ্গে রিয়া আর মিথুনও গেলো। যাওয়ার পথে রাশেদ বললো, ‘সুসমা সকালের ব্যবহারের জন্য স্যরি। আসলে আমার মাথা ঠিক ছিলো না বাবা ওভাবে খাবার ছেড়ে উঠে যাওয়াই। তাই ওমন করে ফেলেছি৷ তুমি রাগ করো না বউ, প্লিজ বাড়িতে এসব আবার বলিও না হ্যাঁ। আর বাড়িতে যে-কদিন আছি মায়ের সঙ্গে একটু মানিয়ে নিও প্লিজ! মা এখন কোনো কারণে রেগে আছেন তাই ওমন করছে।’

রাশেদের এই টুকু ভালো ব্যবহারেই সুসমা খুশিতে কেঁদে দিলো। বললো, ‘আমি কিছু মনে করিনি। আপনি আমার পাশে থাকলে আমার কোনো কিছুতেই কষ্ট হবে না।’

‘শুনো আজকে তো যাচ্ছি তোমাদের বাড়িতে। লক্ষীটি, তোমার বাবাকে বলবা আমারে একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনে দিতে!’

‘কত টাকা লাগে মোবাইল কিনতে?’

‘এই ধরো পনেরো বিশ হাজার হলেই হবে!’

সুসমা অবাক হয়ে বললো, ‘বাবা ওতো গুলো টাকা কোথায় পাবে? বিয়ের জন্য তো এমনিতেই অনেক খরচ করতে হয়েছে এখন হাত খালি।’

‘শুনো চাকরি ওয়ালা জামাই পাইছে একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল দিতে পারবো না মাইয়ার সুখের জন্য? আর ফোনটা আমি তোমার জন্যই চাইছি। আমি অফিসে গেলে তোমার কাছে কল করে খোঁজ নিতে হবে না? আমার বাটন সেট-টা তোমাকে দিবো আর এন্ড্রয়েড আমি নিবো। এখন আমার কাছে টাকা নেই। মাস শেষে টাকা পেলে না হয় টাকাটা ফিরিয়ে দিবো বাবাকে। বাবা না পারলে তুমি বলবা টাকা আমাকে দিতে আমি কিনে নিবো।’

সুসমা চুপ করে রইলো। এখনো খিদেতে পেটের মধ্যে মোচড়াচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে মায়ের হাতের রান্না খাবে। মাকে বলবে তাকে খাইয়ে দিতে। মনে হচ্ছে কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয়নি । একদিন শুধু মাকে দেখেনি অথচ তার বোধ হলো কতদিন মাকে দেখেনি, বাবার আদর পায়নি। তার দু-চোখ ভরে উঠলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে