#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১১
#বর্ষা
সাঈদাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইলিয়ানা।আজই শেষদিন রিইউনিয়নের।অনেকে তো অলরেডি প্রস্থান করেছে।ইলিয়ানার হৃদয়ে চলছে উত্থাল পাত্থাল ঝড়। ইলিয়ানা আগ বাড়িয়ে কথা না বলায় আহান স্যারও কিছুই বলেননি।তবে ইলিয়ানা লক্ষ্য করেছে আড়চোখে তাকানোর বিষয়টা।ওই বিষয়টাই তো হৃদয়ে ঝড় তুলতে যথেষ্ট।
—আর কাঁদিস না। মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে।
ইলিয়ানা কথাটা বলেই হেসে দেয়।সাঈদাও একটা কিল মেরে ইলিয়ানাকে ছেড়ে দেয়।কান্নাও থামিয়ে হেসে দেয়। অন্তরা কালই চলে গিয়েছে।বাচ্চাটা নাকি মায়ের অনুপস্থিতিতে কান্না কাটি করে জ্বর বাধিয়েছে।আর তাসনিম গিয়েছে আজ।অনন্যা রিইউনিয়ন থেকে বিদায় নিলেও গাজীপুর থেকে যায়নি কেননা তার বাবার বাড়ি এই স্থানেই।হয়তো বিকেলের দিকে দেখা করতে আসবে।
—কিরে তোরা দুইটা কান্নাকাটি করতাছোস কেন?
মেহেরের কথায় ইলিয়ানা আর সাঈদা সেদিকে তাকায়। মেহেরের ওপরেও ওদের রাগ কেননা বিকেলের দিকে দুলাভাই এসে নিয়ে যাবে ওকে।আর সেটা কিছুক্ষণ আগেই বলেছে সে।ইলিয়ানা রাগ করে চলে যায় সেখান থেকে।হয়তো এখন আর বেষ্ট ফ্রেন্ড নেই তাই বলে কি আগের মতো কথাগুলো শেয়ার করা যায় না!কই যখন তারা কিশোরী তখন তো মেহেরের সুখ-দুঃখ সবকিছুর খবরই থাকতো ইলিয়ানার নিকটে।সময় বদলানোতে সত্যিই পরিস্থিতি আর ব্যক্তিত্ব বদলেছে।
আজ দিন কয়েক বাদে চড়া রোদ উঠেছে।ইলিয়ানার মনে হাহাকার।আজ তার দিন কয়েকের বেষ্টু রুমানের জন্মদিন।তবে যে সে উইশ করবে না তাকে। কেননা রুমানের দূর্বলতা যে এখনো রয়েছে সে।ইলিয়ানা হঠাৎ করে বলে ওঠে,
—ভালোবাসায় দুইজন ব্যক্তি সুখে থাকলেও তৃতীয় একজন চরম কষ্ট পায়।রুমান আমায় ভালোবেসে আমায় না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে আর আমি তাকে না পেয়ে!কই সে তো আমার অভিমান,রাগ বোঝে না,তবে কি আমি তাকে পেয়েও হারাবো আমার অভিমান,রাগের কারণে?
ইলিয়ানা আর ভাবে না।সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়। আজকের দিনটা শুধু। অবশ্য ইলিয়ানা তো আরো দিন দুয়েক থাকবে বাংলাদেশে। কেননা সে যে কথা দিয়েছে তার ইলমা আপু আর রায়হান ভাইকে।
★
ইলিয়ানা ফোন হাতে দাঁড়িয়ে।চারদিন পরে তার ফ্লাইট।আর কাল নাকি ইলিয়াস চৌধুরী কাজের সূত্রে বাংলাদেশে আসছেন।ইলিয়ানা যে কথা দিয়েছে ইলমা আপু আর রায়হান ভাইকে যে সে ভাইয়ের বাড়ি বেড়াবে।তবে কি পারবে না ইলিয়াসের কারণে!চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবুক সে।কিছু চিন্তা করলেই মাথায় ব্যথার সৃষ্টি হয়।
ইলিয়ানার দ্বিতীয় ভাবনা আহান স্যার কোথায়। কেননা লোকটা যেন নিরুদ্দেশ হয়েছে।একবারের জন্যও আজ ইলিয়ানার সামনে ধরা দেয়নি।ইলিয়ানার হৃদয়ে লালন করা অনুভূতিটা আহত হচ্ছে।
ফোনের কর্ক ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় ইলিয়ানার ভাবনা। কিছুটা নড়ে চড়ে উঠে ফোনটা রিসিভ করে সে।তবে রাগান্বিত হয় পরক্ষণেই অপরপ্রান্তের প্রথম সম্বোধন শুনে। নিজ ভাষায় প্রকাশ করছে অনুব্যক্তি।
”বেবি, কবে দেশে ফিরবে ? আমি আর সহ্য করতে পারছি না।তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হচ্ছি।জলদি ফিরে আসো। বিয়ে করে একেবারে নিয়ে আসবো তোমায় আমার নামে”
ইলিয়ানা মাড়ির দাঁত একটা আরেকটার উপর চেপে ধরে।ম্যাসেঞ্জারের কল সে কেন ধরলো এই ভুলের জন্য নিজেকে থাপ্পর মারতে গিয়েও মারে না। অবশ্য তার নিজেরই ভুল বিরক্তিকর,অসহ্যকর মানুষদের লাই দিয়েছে সে নিজেই।সে চাইলেই ব্লক করতে পারতো।তবে তা করেনি। রেস্ট্রেক্টড করা ছিলো।রায়দা ফোন নিয়ে গেমস খেলছিলো।আর খেলতে খেলতে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে পুরো গোলমাল করে দিয়েছিলো। হয়তো তখনই আন রেস্ট্রেক্টড হইছে।
ইলিয়ানার ভাবনার মাঝে কল কেটে যায়।আবারো কল আসে।ইলিয়ানা ভাবনাচ্যুত হয়।অবাক হয় কেননা সে তো কল রিসিভ করেই ছিল তাহলে আবার কিভাবে কি!ইলিয়ানা অবাকতা কাটানোর পূর্বেই কলটা আবারো কেটে যায়।ইলিয়ানা দ্রুত আইডি রেস্ট্রেক্টড করে দেয়।আইডিটার নিকনেম ”বিরক্তিকর ব্যক্তি” ইলিয়ানা বাংলায় দিয়েছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে.
ইলিয়ানা দূরে দাঁড়ানো লাবিব স্যারের দিকে হাঁটা দেয়।স্কুল মাঠটা প্রায় ফাঁকা। বেশিরভাগই চলে গিয়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন রয়েছেন। ইলিয়ানাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে লাবিব স্যার ভীত হোন।তবে নিজেকে সংযত রেখে নিশ্চুপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
—স্যার ভাবীর ছবি দেখাবেন না?
লাবিব স্যার ভ্রু কুঁচকে ইলিয়ানার দিকে ফিরে তাকান।পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী কথা বলার পূর্বে সামনে পড়া চুলগুলো ডান হাত দিয়ে পেছনের দিকে সরিয়ে দেন।
—কোন ভাবী?(লাবিব)
—আপনার বউ
—আমার স্ত্রী তোমার ভাবী হয় কি করে?(লাবিব)
—বাহ রে ক্লাস এইটে থাকতে যে আপনাকে ভাই বানিয়েছিলাম ভুলে গেলেন! অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা কেননা আপনি তো ভাইয়া থেকে ছাইয়া হয়েছিলেন।
—মুখে লাগাম রাখো।আর তোমার কারণে যে ছড়াছড়ি হইছিলো (লাবিব)
—পিকনিকে আমাকে জোর করে নিজের সাথে রোলার কোস্টারে উঠিছিলেন।স্যারদের সামনে।সেটাও তো আমার কারণেই হইছে। তাই না?
লাবিব স্যার মাথা নুইয়ে ফেলে।আর কি বলার আছে তার। নিজের দোষে সে দুইটা জীবন বীভৎস করেছিলো।প্রথম ইলিয়ানার আর দ্বিতীয়ত নিজের।ইলিয়ানা মুচকি হেসে বলে,
—স্যার আমি জানি আপনি আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র আপু শায়লাকে বিয়ে করেছেন।নীড় কিন্তু সম্পূর্ণটাই শায়লা আপুর প্রতিচ্ছবি হয়েছে।
—ইলিয়ানা?
মাহিরের ডাকে স্যারের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলো ইলিয়ানা।আবার দেখা হবে কি হবে না।মাহির প্রপোজ করেছিলো একবার ইলিয়ানাকে।তবে ইলিয়ানা বুঝিয়ে সুঝিয়ে না করে দিয়েছিলো। কেননা মানুষ ভুল একবার করে,দুইবার করে কিন্তু তৃতীয়বার করে। মানুষ দুইবারেই শিখতে পারে।
—বল কি বলবা?(ইলিয়ানা)
—তুমি আমাকে এখনো তুমিতেই রাখছো দেখে খুশি হলাম (মাহির)
—আমি ফাহিম,আয়ান,এরাম ওদের তুই করে বলি কেননা ওরা আমার বাল্যকালের বন্ধু তাই।আর তোমাকে/তোমাদের তুমি করে বলি কেননা স্বল্প পরিচিতদের তুই করতে বলতে ওড লাগে।(ইলিয়ানা)
—ভুল বললা। মানুষ কিন্তু তার প্রিয় ব্যক্তিকেই তুমি করে বলে(মাহির)
—তার মানে বলতে চাচ্ছো আহান স্যার, মুহাম্মদ স্যার,প্রিন্সিপাল স্যার সবার প্রিয় আমরা!(ইলিয়ানা)
—আমি তা কখন বললাম?(মাহির)
—স্যাররা তো আমাদের তুমি করেই বলে। সেক্ষেত্রে তোমার কথার মানে কি দাঁড়ায়?(ইলিয়ানা)
—স্থানভেদে অর্থ পরিবর্তিত হয়।(মাহির)
—ঠিক তেমনি স্থানভেদে অর্থ পরিবর্তিত হওয়ায় এবং তুমি আমার স্বল্প সময়ের ক্লাসমেট হওয়ায় আমি তোমায় তুমি করে বলি।অন্য মানে বের করো না যেন!(ইলিয়ানা)
মাহির যুক্তির কাছে হেরে গেছে।নিজের কথার কারণেই সে আজ হারলো। অবশ্য স্কুল লাইফ থেকেই ইলিয়ানাকে কেউ যুক্তি তর্কের বিষয়ে হারাতে পারেনি।তবে মারামারির মাঝে খুব কমই কিংবা পাওয়া যায়নি বললেই চলে।কি নিশ্চুপ আসতো!বন্ধুরা আসলে হাসি ফুটতো নয়তো এককোণে গুটিয়ে বসে থাকতো।তবে আশ্চর্যের বিষয় এই মেয়েটার বন্ধুগুলো ছিলো এই স্কুলের তৎকালীন সবচেয়ে চঞ্চল পাঁচ সদস্য!
★
ইলিয়ানার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।রাত হয়ে এসেছে।আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা।তারপর সব বন্ধুগুলো আবারো আলাদা। অবশ্য এখন ওদের টিমের এখানে আছে ইলিয়ানা,সাঈদা আর আফরোজা।কবে না কবে আবারো দেখা হবে কে জানে!
সাঈদা আর আফরোজা বাইরে গেছে।কি যেনো কিনবে!ইলিয়ানা আন্দাজ করতে পেরেছে।আফরোজাকে নিস্তেজ দেখেই সে বুঝে গিয়েছে মেয়েলী সমস্যা হয়েছে। অবশ্য এই সময়টা না হলে যে একটা মেয়ের মা হয়ে ওঠা সম্ভব না।এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আল্লাহ তায়ালা মেয়েদের মা হওয়ার ক্ষমতা দান করেন।তবে এক্ষেত্রেও আল্লাহ তাআলা সুন্দর বিচার করেছেন। নারী-পুরুষকে একজন আরেকজনের ওপর নির্ভর করেছেন।নারী যেমন পুরুষহীন মাতৃত্বের স্বাদ নিতে অক্ষম,ঠিক তেমনি পুরুষও নারীহীন পিতৃত্বের স্বাদ গ্রহণে অক্ষম।
ইলিয়ানার ফোনে জ্যাকের ফোন আসে।ইংরেজি কয়েক শব্দ উচ্চারণ করে জ্যাক বলে,
—ম্যাম ম্যারিও স্যার ড্রিংক করে মাতলামো করছে।
—রুমে লক করে রাখো।(ইলিয়ানা)
—ম্যারিও স্যার বারবার আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।(জ্যাক)
—আমি কি বলেছি শুনোনি?(ইলিয়ানা)
—সরি ম্যাম (জ্যাক)
ইলিয়ানার ধমক খেয়ে বেচারা সরি বলে ফোন কেটে দেয়।বুঝতে পারে আজ ইলিয়ানা বেজায় চটেছেন।যখন তখন বর্ষণ হতে পারে।তাই আর ঘাটায় না ইলিয়ানাকে।কল রেখে ম্যারিও কে রুমে বন্ধ করে দেয়।এনি কিছু বলতে গিয়েও বলে না। কেননা মিনিট দুয়েক আগেই প্রিয় মানুষটার হাতে সর্বশক্তি প্রয়োগকৃত চড় পড়েছে তার গালে।
ইলিয়ানা মোবাইলটা শক্ত করে ধরে সামনের পানে তাকিয়ে। অবশ্য এতক্ষণ যাবৎ সে তাঁবুর বাইরেই দাঁড়ানো। দূর থেকে দেখতে পায় আহান স্যারের গঠনের কেউ এগিয়ে আসছে তারই দিকে।ইলিয়ানা প্রচন্ড খুশি হয়।এগিয়ে যেতে গিয়েও যায় না।
আহান স্যার পাশে এসে দাঁড়ায়।দুজনেই নিশ্চুপ।ইলিয়ানার নিশ্চুপতা সহ্য হয়না।ইলিয়ানা জানে লোকটা এমনই।প্রথম কয়েক মুহূর্ত নিজ থেকেই কথা বলতে চাইলেও পরমুহূর্তেই এমন ভাব করবে যেন সে ইলিয়ানাকে সহ্য অব্দি করতে পারে না।
—কোথায় গিয়েছিলেন?(ইলিয়ানা)
—একটা জায়গায়।(আহান)
—কোন জায়গায় তাই জানতে চেয়েছি।(ইলিয়ানা)
—জেনে কি করবে?(আহান)
—আমার মাথা করবো। বিরক্তিকর!(ইলিয়ানা)
—কি?(আহান)
—কি?(ইলিয়ানা)
—তুমি না বিরক্তিকর বললা।তা কেন বললা?(আহান)
—আপনার কি আমাকে রাগাতে অনেক মজা লাগে?(ইলিয়ানা)
—তুমি রাগছো?(আহান)
ইলিয়ানা রাগাশ্রয়ী মুখশ্রীতে তাকায়।আহান স্যার ইলিয়ানার রাগাশ্রয়ী মুখশ্রীতে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটাকে রাগলে খারাপ লাগে না।বেশ সুন্দরই লাগে।যেন আল্লাহর বেশ যত্নে বানানো মানুষ। অবশ্য আল্লাহর সকল সৃষ্টিই অসম্ভব সুন্দর।
চলবে?
#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১২
#বর্ষা
ইলিয়ানা সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রিইউনিয়ন ত্যাগ করেছে।রায়হান ভাইয়ের বাড়ি রিক্সায় মিনিট দশেকের দূরত্ব।ইলিয়ানা রিক্সায় চড়ে বসে। কিছুক্ষণের মাঝেই পৌঁছে যায় রায়হান ভাইয়ের বাড়ি দরজায়।তবে আসার পূর্বে ভাগ্নে,ভাগ্নি,ভাতিজা,ভাতিজির জন্য চকলেটস,কেনডিস সব আনিয়েছে জ্যাককে দিয়ে। জ্যাক আশ্চর্য হলেও তেমন কিছুই বলেনি। কেননা ইলিয়ানার হুমকিতে জ্যাক এখনো ভীতস্থ।
ইলিয়ানা ফ্লাটে প্রবেশ করতেই বাচ্চারা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ইলিয়ানাকে।তবে নুকতা কিছুটা দূরত্ব রেখেই দাঁড়ায়।ইলিয়ানা একদম অবাক হয় না। ছোটবেলায় তার বোনটা তাকে সবসময় নন মাহরাম পুরুষদের থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলো।সে ক্ষেত্রে ইলিয়ানা তো নুকতার বাইয়োলজিকাল খালামনি না,সেহেতু তারা মাহরামও না।
ইলিয়ানার কষ্ট হলেও বাস্তবতা সে মেনে নিয়েছে। কেননা সেই ছোট্টটি থেকেই সে বাস্তবতা মেনে নিতে শিখেছে। প্রথমে ভাবীর প্ররোচনায় ভাইয়ের পরিবর্তন।
ইলিয়ানা বাচ্চাদের হাতে চকলেটস দিয়ে ইলমা আপুকে বলে ফ্রেশ হতে রুমে চলে যায়।লাগেজ থেকে টপস আর প্লাজু বের করে পড়তে নিলেও পরমুহূর্তেই মন পড়ে এগুলো এখানে পড়লে সেই অড মুহূর্ত ফেস করবে। কেননা ভাই-বোনের সাথে দূরত্বটা বছরের! অভিমানের।
১০ বছর পূর্বের ফ্লাশ ব্যাক,,,,,,,
”ইলিয়ানা,সামনের বছর তোমার এসএসসি পরীক্ষা আর তুমি মোবাইলের ভেতর ঢুকে আছো?এ কেমন প্রস্তুতি নেওয়া তোমার!”
সাবিনা বেগমের কথায় একবিন্দু হেলদোল না দেখিয়ে ইলিয়ানা মোবাইল টিপতেই থাকে।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতর ভক্ত বলে কথা।এতদিন কবিতা পড়েছে আর এখন কবিতা লেখা।মিসেস সাবিনা মেয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলে রায়হানকে বলেন,
”রায়হান তোর বোন কি করছে দেখ!আজ বাদে কাল প্রথম টিউটোরিয়াল আসছে।আর সে বসে বসে মোবাইল টিপছে!”
ভাইকে বলার সাথে সাথেই গম্ভীরমনা রায়হান ”ইলিয়ানা” বলে ডাকার পূর্বেই ইলিয়ানা বই খাতার ভিরে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।পুরো বিছানায় বই খাতা দিয়ে তার গম্বুজ তৈরি করা।রায়হান হাসে বোনের কর্মে। মেয়েটা তাকে যে বড্ড ভয় পায়।
ইলিয়ানা সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত পড়ে খাওয়ার নাম করে সেই যে ওঠে তারপর ফোন নিয়ে বসে পড়ে। প্রতিদিনের মতো প্রিয় মানুষটিকে বিরক্ত করতে ম্যাসেজ দেয়।হ্যা দশম শ্রেণীর ছাত্রীর মনে তখনি প্রণয়ের উদ্ভাবন হয়।তবে এ ভালোবাসা প্রথমে ছিলো শুধু মাত্রই প্রিয় ব্যক্তির তালিকায়।যা এখন প্রণয়ে রুপ নিয়েছে। কিসের লুকোচুরি আর!যখন সেই মানুষটি জানে যে ইলিয়ানা তাকে ভালোবাসে।তখন অনুভূতি লুকানো কি যায়!
ইলিয়ানা একটা ম্যাসেজ দিয়েই ইউটিউবে মুভি দেখতে শুরু করে।তবে তার অভিজ্ঞতাকে ভুল প্রমাণিত করে আহান স্যার।মুভি শেষে মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হয় সে।প্রায় ঘন্টাখানেক আগে রিপ্লাই দিয়েছে আহান স্যার।ইলিয়ানা অবাক এবং হতভম্ব হয়।এভাবেই চলছিলো দিনগুলো।তবে হঠাৎ নেমে এলো ইলিয়ানার জীবনে ধ্বংস।
দিনটা ছিলো রবিবার।কোনো এক কারণে স্কুল বন্ধ। সারাদিন ঘুমিয়ে কাবার করার চিন্তা করলেও ভোর করেই ঘুম ভাঙে তার। তবে প্রতিদিনের মতো আর তার মাতা সাবিনা বেগম জেগে ওঠেন না।ইলিয়ানার জীবনটা যেন থমকে দাঁড়ায়।কাল রক্তদানের পর শরীর দূর্বল থাকায় জ্ঞান হারিয়ে সে রাত্রি কাবার করেছে।তাই মায়ের শরীরের উত্তাপ হারানো শরীর জড়িয়ে ঘুমিয়ে থেকেও উপলব্ধি করেনি সে।
কাঁদতেও পারেনি বেচারি।স্তব্ধ বসে ছিলো।জ্ঞান হারিয়ে পুরো একঘন্টা পড়ে ছিলো।ইলমা এসে বোনকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেই চলেছিলো।মেয়েটা একটুও নড়চড় করেনি।এযেন মা হারিয়ে অতি কষ্টে পাথর হওয়া!
ইলিয়ানা সেদিন একটা কথাই বলেছিলো,”আজ আমার সব শেষ।হয়তো তোমাদের সাথে সম্পর্কের শেষ আজ থেকেই শুরু।”
শান্ত কন্ঠে এতোটুকু বলেই অঝোর ধারায় কেঁদে বলে উঠেছিলো,
”আম্মু আব্বু তো আমায় সেই ছোট্টটি রেখেই চলে গেলো।আর তুমিও আমায় একা করে চলে গেলে!আমি আজ তোমাদের ছাড়া পুরোপুরি অনাথ হয়ে গেলাম।”
ইলিয়ানার সেই কষ্ট দেখার কেউ ছিলো না।ইলমা আপু ছোট্ট নুকতার কান্না থামাতে ব্যস্ত ছিলো। ইলিয়ানার কান্না কেউ দেখেনি।স্কুল কামাই ছিলো পুরো দশটা দিন।কেউ একটা খোঁজও নেইনি।প্রথম কয়েকটা দিন দু-চারজনের ম্যাসেজ থাকলেও কেউ আর ম্যাসেজ দেয়নি।
দশদিন পরে স্কুলে গিয়ে দরখাস্ত লেখে সে স্কুল কামাইয়ের ছুটি নিতে।স্যারকে দরখাস্ত দেখায়।স্যার পড়ে দেখে না। বরং ধমকে জিজ্ঞেস করে বাসা থেকে গার্ডিয়ান দিয়ে ফোন দেওনি কেন।ইলিয়ানার কান্না পায়।তবে একফোঁটা অশ্রুও গড়ায়নি।ইলিয়ানা ক্লাসটিচারের ধমক শুনে বলে ওঠে,
”স্যার প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে ছুটি নিয়ে আসি?”
স্যার রাগ দেখিয়ে বলেন,”যাও”
সেদিন ইলিয়ানা এতো সকালে প্রিন্সিপাল স্যারকে খুঁজে পায়নি।স্যার আসেননি। কেননা তিনি অন্য একস্কুলে জয়েন করবেন।ইলিয়ানা অনেক সময় বাইরে অপেক্ষা করে ক্লাসে আসলে স্যার তাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেও কারণ না জেনে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করে।ইলিয়ানা আর কান্না থামাতে পারে না। কেঁদে দেয়।কাছের বান্ধুবীগুলো তাকে মেন্টাল সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করে।তবে মা হারার কষ্ট কি তা কি কেউ বোঝে!
ইলিয়ানা স্যারকে বলে,”স্যার আমি যেহেতু আপনাকে কল করেনি, পাশাপাশি প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে সাইনও আনতে পারিনি।আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি।সাইন আনতে পারলেই আসবো”
ইলিয়ানাকে ক্লাসটিচার রাগ দেখিয়ে বলে,”তোমার ইচ্ছে হলে দাঁড়িয়ে থাকো,বসে থাকো,ক্লাসের বাইরে যাও।যা মন চায় করো”
ইলিয়ানা ক্লাসের বাইরে চলে যায়। রাগ সংবরণ করতে না পেরে উল্টো করে রাখা বেঞ্চে জোরে করে নিজের হাত মারে সে।পাশের ক্লাস থেকে আহান স্যার ইলিয়ানাকে পর্যবেক্ষণ করে।একটা সময় বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
”বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?”
ইলিয়ানা ততক্ষণে কান্না থামিয়েছে তবে রাগ কমেনি একবিন্দুও।তাইতো প্রিয় মানুষটির সাথেও রাগ দেখিয়ে বলে,
”আমার ইচ্ছে হয়েছি দাঁড়িয়ে আছি। আপনার সমস্যা?”
আহান স্যার মুচকি হেসে বলেন,”ইচ্ছা হলে দাঁড়িয়ে থাকো”
আহান স্যার চলে যান।ইলিয়ানা সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বার এক নিচ তলা থেকে ঘুরে আছে।একবার জানালার কাছে দাঁড়ায়,তো আবার ফিরে এসে চারতলার নিজ ক্লাসের সামনে উল্টো করে রাখা বেঞ্চে বসে পড়ে।আহান স্যার এবার ইলিয়ানাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। ইলিয়ানাদের ক্লাস টিচারকে জিজ্ঞেস করেন।ইলিয়ানার মতো তাদের ক্লাস টিচারেরও উত্তর এমন ছিলো যে,”ওর ইচ্ছে হইছে তাই ও এখানে বসে আছে!”
আহান স্যার কিছু হয়তো বলে গিয়েছিলো।তাই তো ইলিয়ানাকে একটু পর ভেতরে আসতে বলেন ক্লাসটিচার।তবে দোষ না করেও কথা শোনানোতে সে বলে যখন পার্মিশন আনতে পারবো তখনই ঢুকবো।সেদিন ইলিয়ানা পার্মিশন নিয়েই ঢুকেছিলো।
দেখতে দেখতে দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিলো।তবে মায়ের মৃত্যুর আগেরদিন যেই দাদুকে সে রক্ত দিয়েছিলো সেই দাদুর সাথে আবারো দেখা হয় তার। অবশ্য দাদুটাই তাকে দেখে দৌড়ে আসে।তবে আজ তিনি একা ছিলেন না।ছিলেন একটা কমবয়সী ভাইয়ার মতো পুরুষ।আর একজন মাঝবয়সী পুরুষ। তাদের কথায় ইলিয়ানা যেন বিশতলা ছাদ থেকে পরে।মাঝবয়সী লোকটা ইলিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
”ইলিয়ানা মাম্মাম কেমন আছো তুমি?কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে ডেডকে রেখে!”
ইলিয়ানাকে অবাক করে সেদিন কিছু তথ্য তার সামনে আসে।সব অস্বীকার করে বাসায় ফিরে আসে সে।তবে বাসায় এসে আশ্চর্য চকিত হয় যে তার ভাই তাকে না জানিয়েই বিয়ে করে এনেছে আজ।মেয়েটা অনেক সুন্দর।ইলিয়ানা কষ্ট পেলেও খুশি হয়।ভাইকে জানায় না আজকের ঘটনা।ইলিয়ানার খুশিটা হয়তো ধরার ছিলো না।
তাইতো ইলিয়ানার টেস্ট পরীক্ষার মাঝেই রায়হান ওর বিয়ে ঠিক করে অচেনা কারো সাথে।কি কান্নাটাই না কাঁদে সেদিন ইলিয়ানা।তবে শেষমেশ রাজি হয়।বাবা-মা মরার পর অধিকাংশ ভাই-বোন যে পর হয়ে দাঁড়ায়!তবে বিয়ের দিন রাতে ইলিয়ানার বাঁধা ভেঙে ইলিয়াস পুলিশ নিয়ে হাজির হয়।হাতে ডিএনএ রিপোর্ট।ইলিয়ানা ওর হারিয়ে যাওয়া বোন।ও ওর বোনকে নিয়ে যাবে।ইলিয়ানা কষ্টে এতোটাই কাতর হয়ে পড়েছিলো যে বর নামক ব্যক্তিটিকে না দেখেই রায়হানের অবাধ্য হয়ে ইলিয়াসকে ভাই বলে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো।কে ছিলো তার বর?
ইলমা আপু আসতে অনেকটা দেরি করেছিলো।তাইতো ইলিয়ানাকে অন্য কারো বুকে লুটোপুটি খেতে দেখে টেনে নিজের কাছে এনে ঠাসিয়ে দু’ঘা লাগিয়েছিলো।সেই যে অভিমান হলো, এসএসসি অব্দি গাজীপুরে থাকলেও যোগাযোগ করেনি আর পালক ভাই-বোনের সাথে।নিজ পরিবারের সাথেই মানিয়ে নিলো!নিজ স্কুল থেকে এসএসসি দিয়ে একেবারেই নিরুদ্দেশ হলো।নাম,পরিচয় কতকিছুই না পরিবর্তন হলো।ইলিয়ানার গলায় নাম লেখা লকেটটা আঁকড়ে এখনো জীবনটা অতিবাহিত করছে!
ফ্লাসব্যাক শেষ;(বিঃদ্রঃ ঘটনাক্রমে আরো কিছু অতীত সামনে আসবে।যা বর্তমানকে নাড়িয়ে দিবে)
ইলিয়ানা বাচ্চাদের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠে।যেন জেনিকে ওদের মাঝে খুঁজে পায়।জেনিকে যে ছোট্টটি থেকেই একদম কাছে পেয়েছে সে।যেমন প্রথম কয়েকবছর নুকতাকে পেয়েছিলো সে।তাইতো জেনির মতো নুকতার প্রতিও আলাদা টান তার।তমা ভাবীর কথায় তাচ্ছিল্য যে যুক্ত ছিল তা প্রকাশিত করেই তিনি বলেন,
”ইলিয়ানা দেখে যাও তোমার পরিচিত কয়েকজন লোক এসেছেন”
ইলিয়ানা ড্রয়িংরুমে গিয়ে অবাক হয়।আহান স্যার এসেছেন। কিন্তু কেন?আর তার সাথে এতোগুলো লোকই-বা কেন?
চলবে?