#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ৮
#বর্ষা
ভোর হতেই ঘুমেরা অক্ষু হতে বিদায় নিয়েছে।সময়ের ব্যবধানে থাকলেও অভ্যাস হয়ে গেছে মাত্র দিন দুয়েকের মাঝেই। তৃতীয়তম দিন রিইউনিয়নের। সহসা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন শিক্ষকদের সাথে পরিচিত হওয়ার। অর্থাৎ নতুন শিক্ষকদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে আজ স্কুল মাঠে আসার। অবশ্য প্রথমদিন বর্তমান প্রিন্সিপাল সকলের সাথে মিট করে গেছে।
ইলিয়ানা লেডিস লং শার্ট,জিন্স আর চুলগুলো উঁচু করে বেঁধে নিয়েছে।ঘাড়ের ওপর দিয়ে দুপাশে ওড়না ফেলেছে।আর কাঁধে ছোট ব্যাগ। সুন্দর লাগছে তাকে।এখানে আসার পর সে থ্রীপিস ছাড়া অন্য কিছুই পড়েনি।তবে আজ পড়েছে। কেননা আজ অনেক বেশিই ছোটাছুটি করতে হবে।আর এই ছোটাছুটির মাঝে কমফোর্ট না থাকলে তা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ।তাই..
—ইলিয়ানা কোথাও যাচ্ছিস?
মেহেরের প্রশ্নে পিছু ফেরে ইলিয়ানা।ট্যান্ট থেকে মাত্রই বেরিয়েছে সে।ব্যাগ নিতেই ঢুকেছিলো।আর স্কুল ওয়াসরুম থেকেই ফ্রেশ হয়ে ড্রেশ চেঞ্জ করে এসেছে।
—হ্যা রে।একটু মৌচাকের দিকে যাবো।কেন কোনো দরকার?
মেহের কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললো,
—দোস্ত আমি তো গাজীপুরেই আছি।মন চাচ্ছে আম্মুর সাথে দেখা করে আসি।তবে আম্মু জানলে অনেক রাগ করবে যে আমি এখানে সবার সাথে থাকছি।এই বিষয় নিয়েই ভয় লাগছে।
—আরে চিন্তা করিস না।তোর শাশুড়ি আম্মুকে কল দিয়ে ধরিয়ে দিবি।আন্টি আর না করতে পারবে না তোকে এখানে থাকতে।(ইলিয়ানা)
—তাই যেন হয়।(মেহের)
—আচ্ছা তুই কি এখন যাবি?(ইলিয়ানা)
—না,ভেবেছি দুপুরের দিকে যাবো।সকালে কিংবা বিকালে নতুন শিক্ষকরা আসবে। তাদের দেখবো।(মেহের)
—হুম,দেখে আমাকে জানাইস।মনে আছে তো আমি একজন শিক্ষককে বিয়ে করবো।হি হি হি(ইলিয়ানা)
—হা হা হা।মনে থাকবে না আবার!তুই যে পাগল ছিলি আহান স্যারের!(মেহের)
ইলিয়ানা ঘড়ি দেখে মেহের দিকে তাকিয়ে বলে,
—আচ্ছা দোস্ত থাক।আমার আসতে আসতে বিকেল হবে।আর আমাকে ফোনে না পেলে চিন্তিত হোস না।আর কেউ চিন্তিত হলে তাকেও চিন্তিত হতে নিষেধ করিস।
—আচ্ছা।বাই দ্যা ওয়ে তোকে কিন্তু সো বিউটিফুল লাগছে।(মেহের)
—থ্যাংকস।
—ওই হারামী আমি বলছিলাম না ফ্রেন্ডসদের মাঝে নো থ্যাংকস,নো সরি। তুই দাঁড়া খালি,তোর খবর আছে।
ইলিয়ানা থ্যাংকস বলেই দৌড় দিয়েছে।আর তার পিছু পিছু দৌড় লাগিয়েছে মেহের।সবাই অবাক হয়েছে ওদের এভাবে দৌড়াতে দেখে।ইলিয়ানা একছুটে রিক্সায় উঠে চলে গেছে।আর মেহের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকছে তাকে।তাসনিম সেখানে এসে একবার ইলিয়ানার চলন্ত রিক্সার দিকে তাকিয়ে আবার মেহেরের মুখের দিকে তাকায়। দুষ্টুমি মার্কা হাসি দিয়ে পেছন থেকে মেহেরকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
—সুইটহার্ট…ওপস সুইসাইড আমাদের বেবি কি তোমার জামাই নিয়ে পলাইছে!হা হা হা
মেহের ”ইয়ার ফিরছে তু শুরু হোগেয়ি ” এমন লুক দিয়ে চলে যায়।তাসনিম হাসতে থাকে। একবার হাসা শুরু হলে এই মেয়েকে থামানো কষ্ট সাধ্য। অনন্যা পিঠে থাপড়িয়ে তাসনিমকে বলে,
—আর হা করে হাসিস না মশা ঢুকবো।
তাসনিমের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ছোট চোখ করে অনন্যার দিকে তাকায়।আজ যেন ওরা সবাই তাদের ছোটবেলায় ফিরে গিয়েছে।ইশ,কতই না মজা করতো ওরা ছোটবেলায়!ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দৌড়াদোড়ি করা।ক্যান্টিনে বসে থাকা।স্যারের কাছে ধরা পড়তে নিলে ওয়াসরুমে দৌড় দেওয়া।আরো কত কি!
★
রিক্সায় বসে বসে ইলিয়ানা হাসছে। ছোটবেলার দৃশ্য গুলো ফিরে আসছে চোখের সামনে।ইলিয়ানা একটু পরই হাসি বন্ধ করে ফোন লাগায় ‘ভাই’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটায়।আজ মেডিকেল বোর্ডের সকলেই আসবে। অনেকে অলরেডি উপস্থিত।যদি রোগীর অবস্থা পজেটিভ থাকে তবে আজ রাতের মধ্যেই অপারেশন করা হবে।প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টার এ অপারেশন!
—হাই, জেহের কেমন আছো(ইলিয়াস)
—আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।তুমি কেমন আছো?(ইলিয়ানা)
—ভালো।তা এত সকাল সকাল ভাইয়ের কথা মনে পড়লো যে?(ইলিয়াস)
—ভাইয়া তুমি বলতে চাও আমি তোমায় মনে করি না!(ইলিয়ানা)
—আরে আমার অভিমানী দেখি রাগ করেছে! আচ্ছা ভাইয়া সরি।রাগ করো না।(ইলিয়াস)
—ভাইয়া ডেডকে কল করেছিলাম ধরেনি।হয়তো আবারো ফ্রেন্ডসদের সাথে নতুন ট্রিপে যাওয়ার প্ল্যান করছে।তাই তোমায় বলছি শোনো,আমাকে হয়তো আজ ফোনে পাবে না।তাই চিন্তা করো না।ডেডকে এবং ভাবীকেও জানিয়ে দিও।(ইলিয়ানা)
—কেন জেহের?কোনো সমস্যা?আমায় বলো।আমি সলভ করে দিবো।(ইলিয়াস)
—ভাইয়া উদ্দিগ্ন হয়ো না।আমি একজন চিকিৎসক ভুলে গেলে চলবে!একটা সার্জারি আছে। সময়সাপেক্ষ বিষয়।তাই বললাম চিন্তা করো না।(ইলিয়ানা)
—আচ্ছা, জেহের অল দ্যা বেষ্ট।(ইলিয়াস)
—হুম,আচ্ছা ভাইয়া রাখছি।(ইলিয়ানা)
ইলিয়ানা কল কেটে দেয়।ফোনটা মুখের সামনে এনে ভাবতে থাকে কল দেবে কিনা তাকে। অবশ্য সেই দশবছর আগে নাম্বারটা মনে করেছিলো।এখন স্মরণে না থাকলেও নাম্বারটা সেভ করা আছে।একবার ভাবে কল দেবে,আরেকবার ভাবে দেবে না।তবে শেষমেশ ইলিয়ানা কল দেয় আহান স্যারকে।দুই থেকে তিনবার রিং হতেই কেউ কল রিসিভ করে।
—আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন?
ওপাশ থেকে পুরুষনালী কন্ঠস্বর ভেসে আসে।কন্ঠটা আর কারো নয় বরং আহান স্যারের।ইলিয়ানা নিঃশব্দ হাসে।তারপর বলে,
—ওয়ালাইকুমুস সালাম।তা আপনাকে কে কল করতে পারে?
—ইলিয়ানা?(আহান)
—হুম
—আমার নাম্বার তোমার কাছে ছিলো?(আহান)
—কত বছর আগেই তো মুখস্থ করেছি।আপনাকে তো শুনিয়েও ছিলাম।(ইলিয়ানা)
—তাহলে এতদিন ফোন না দিয়ে আজ এতো কাছে থেকে ফোন দিচ্ছো কেন?(আহান)
—কিছু জানাতে (ইলিয়ানা)
—কি?(আহান)
—আমায় আজ ফোনে না পেলে কিংবা খুঁজে না পেলে চিন্তিত হবেন না।রাত এগারোটার আগে ফিরে আসবো যেখানেই থাকি না কেন!আর বেশি জরুরি হলে তানহা হসপিটালে নিচে জিজ্ঞেস করতে পারেন।(ইলিয়ানা)
—তুমি হসপিটালে কি করতে যাবা?(আহান)
—প্রয়োজন আছে তাই।আচ্ছা রাখছি। সাবধানে থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ (ইলিয়ানা)
—তুমিও। আল্লাহ হাফেজ (আহান)
কল কেটে আহান স্যার ভাবুক হোন।তবে কাজের তৎপরতার মাঝে ইলিয়ানাকে দুইবার টেক্সট করে আবারো কাজ করতে থাকেন।হয়তো ইলিয়ানা ম্যাসেজ পাবে,হয়তো পাবে না।তাই বলে কি হয়েছে!ম্যাসেজ দিতে তো বাঁধা নেই।
★
রাত দশটা পঞ্চাশ। হসপিটাল থেকে মাত্রই বেরিয়েছে ইলিয়ানা।রোগীকে অর্ধদিনের অবজারভেশনে আইসিইউতেই থাকতে হবে।সকালে এসেই সব ডক্টরদের সাথে আলাপ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় আজই হবে অপারেশন।এদিকে চলতে থাকে ডক্টরদের আলাপ আলোচনা। আরেকদিকে রোগীর শরীরে চলতে থাকে স্যালাইনের প্রবেশ।রোগীর পরিবার আনতে ব্যস্ত রক্ত প্রদান কারী। এককথায় সবাই প্রস্তুত হয়ে দুপুর দুইটার দিকে অপারেশন থিয়েটারে দল ঢোকে।দুই ধাপে অপারেশন হয়।যেহেতু হার্ট ট্রান্সপেলেশন আগে হয়েছে।সেহেতু সাবধানতা অবলম্বন করেই হার্ট ব্লকের উপশম শুরু হয়। তাছাড়া রোগী দুইবার হার্ট অ্যাটাক অলরেডি করেছে।তাইতো এতো রিস্কি অপারেশন!সবশেষ সন্ধ্যা সাতটার দিকে অপারেশন সাকসেসফুল হয়।
সব ডক্টররা ফ্রেশ হয়ে রোগীর কন্ডিশন দেখে।মেডিসিন ডিসাইড করে। রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা অপারেশন থিয়েটারেই করা হয়েছিলো কেননা রক্ত অনেক বেরিয়ে যাচ্ছিলো।
—ডক্টর জেহের চৌধুরী আপনার নাম-ডাক তো সারা এশিয়া মহাদেশে ছড়ানো। ইউরোপের দেশগুলোতেও কম খ্যাতি নেই আপনার।তা এত অল্প বয়সেই কি করে সম্ভব হলো?(সিনিয়র ডক্টর আরমান মাল্লিক)
—উমমম..স্যার আমি আমার স্টাডি গ্যাপ দেইনি।দেশে এসএসসি দিয়ে যখন প্রদেশে গেলাম। তৎক্ষণাৎ মেডিকেল স্টাডির জন্য এপ্লাই করলাম।তবে এইচএসসি তো লাগবে।তাই সেটা কমপ্লিট করতে আড়াই বছরের জায়গায় দেড় বছরের টার্গেট নেই।আর তারপর সবচেয়ে কম সময়ে মেডিক্যাল কোর্স কমপ্লিটে ঢুকে পড়ি।তিনবছরে কমপ্লিট করেই।ইন্টার্নির পাশাপাশি সার্জারি নিয়ে একটা কোর্স কমপ্লিট করি একবছরের। এভাবেই চলছে।আর দেখতেই পারছেন এখন কোথায় আছি!(ইলিয়ানা)
—তা ঠিক ম্যাম।তবে বিশ্বাস হয় না আপনি এত কমবয়সে এত নামকরা কার্ডিওলজিস্ট জেহের চৌধুরী।(ডক্টর মোতালেব হোসেন)
—আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না (ইলিয়ানা)
এভাবে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে রোগীকে আবারো দেখতে যায় ইলিয়ানা।ডক্টররা আজ হসপিটালেই অবস্থান করবেন।একটু রেস্ট প্রয়োজন সবার।ইলিয়ানাকে থাকতে বললেও সে থাকতে পারবে না।তাইতো তিন ঘন্টা নিজ দায়িত্বে অবজারভেশন করে কিছু মেডিসিন অন্যান্য ডক্টরদের সাথে শলা পরামর্শ করে চেঞ্জ করে দেয়।যতই সে নামকরা চিকিৎসক হোক না কেন এমনও অনেক কিছু আছে যা তার থেকে অপারেশনে উপস্থিত চিকিৎসকেরা ভালো জানেন।তাইতো এই শলা পরামর্শ।
★
রাত এগারোটা পনেরোতে স্কুল মাঠে পৌঁছে অবাক হয় ইলিয়ানা।সবার সামনেই আহান স্যার ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ইলিয়ানা।তবে মুহুর্তবাদেই জোরে এক চড় লাগায়।ইলিয়ানার কান আর মাথা ধরে যায়।সে বুঝতেও পারে না তার দোষটা কি!
—আপনি আমায় মারলেন?
ইলিয়ানা ছলছল চোখে জিজ্ঞাসা করতেই আহান স্যার রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলে,
—কোথায় ছিলে সারাদিন?কত চিন্তা করেছি আমরা ধারণা আছে?কই তানহা হসপিটালে তো তোমার কথা কেউ বলতে পারলো না।তাহলে বল কোথায় ছিলে তুমি?
আহান স্যার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে থাকে ইলিয়ানাকে।লোকটা যে বেশ তেতেছে বুঝতে পারে ইলিয়ানা।রাগ হয় তার কেন এই লোকটা তাকে মারলো এই নিয়ে।তবে পরক্ষণেই মনের মাঝে প্রজাপতিরা উড়তে শুরু করে।লোকটা তার মানে ওর জন্য চিন্তা করছে।ভালোবাসে নাকি?
—আমি তানহাতেই ছিলাম। আপনি হয়তো ভালো করে খোঁজ নেননি।আর তাছাড়া আমি মেহেরকেও তো বলে গিয়েছিলাম।আর আপনাকেও তো বলেছিলাম যে এগারোটার আগে ফিরবো।
—এখন কয়টা বাজে?(আহান)
—এগারোটা বিশ।সরি(ইলিয়ানা)
—ইলিয়ানা গ্রোআপ।তোমার জন্য সবাই চিন্তা করে।এরকম বাচ্চামি করলে জীবন চলবে না।আর কি এমন গুরু দায়িত্ব করছিলে যে ফোন ধরতে পারলে না?
লাবিব স্যার তাচ্ছিল্য করে কথাগুলো বলে।নীড়কে ওর চাচা এসে নিয়ে গেছে।ছেলেকে নিয়ে রিইউনিয়নে সমস্যা হচ্ছে বলেই ছেলেকে বাড়ি পাঠিয়েছে। অবশ্য সমস্যাটা রিইউনিয়নে নয়, বরং তার ফ্লার্ট করায় হচ্ছিলো।লাবিব স্যার বলার সাথে সাথেই আহান স্যার তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাতেই সে আর কিছু বলে না।ইলিয়ানাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—তুমি কোথায় গিয়েছিলে তা তুমি আমায় জানিয়েছো।এখন আমি তোমায় জানাবো তুমি সেখানে যাওনি।(আহান)
আহান স্যার কাউকে ফোন করেন।কল রিং হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কল রিসিভ হয়।লাউড স্পিকারে দেওয়া।আহান স্যার জিজ্ঞেস করে,
—ম্যাম ইলিয়ানা নামক কোনো মেয়ে কি আপনাদের হসপিটালে এসেছে?
অপরপাশ থেকে জবাব আসে,
—স্যার আপনাকে কতবার বলবো যে ইলিয়ানা নামে এখানে কেউ আসেনি।প্লিজ স্যার শুধু শুধু ডিস্ট্রাব করবেন না। আপনার অন্য কোনো প্রশ্ন থাকলে করুন নয়তো রাখুন।
আহান স্যার ইলিয়ানার দিকে তাকায়।ইলিয়ানা আহান স্যারের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে,
—ডক্টর ইলিয়ানা জেহের চৌধুরী তো আজ হসপিটালেই ছিল তাই নয়কি মিস?
অপরপাশ থেকে কোনো জবাব আসে,—জ্বী!তবে আপনি?
সবাই আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়।সবার চোখেই আজ এক প্রশ্ন।কে ইলিয়ানা?আসলেই তো তিনদিন শেষের পথে তাদের রিইউনিয়নের তবুও ওরা কেউ জানে না ইলিয়ানার প্রফেশন কি!
চলবে?
#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#বোনাস_পর্ব
#বর্ষা
”তুই ডক্টর জেহের চৌধুরী?”
অনন্যার প্রশ্নে সেদিকে ফিরে তাকায় ইলিয়ানা।মাথা ঝাঁকায় অর্থাৎ হ্যা সেই ডক্টর জেহের চৌধুরী।অনন্যাসহ বাকি সবাই অবাক হয়।প্রথমত সবার জানা মতে ইলিয়ানার নাম ইলিয়ানা বিনতে মুজিবুর।দ্বিতীয় সে যে এতো বড় চিকিৎসক তাও সবারই অজানা।নাহ,সাঈদাও জানতো না যে তার বন্ধু এতো বড় চিকিৎসক।কখনো পোষ্টও করেনি ইলিয়ানা এ বিষয়ে।
—আমাদের আগে জানাস নাই কেন এবিষয়ে?
অন্তরার প্রশ্নে কি উত্তর দেবে তাই ভাবছিলো ইলিয়ানা। তার পূর্বেই আহান স্যার বলে উঠে,
—ম্যাম জানতাম না আপনি এত বড় চিকিৎসক।দুঃখিত আপনাকে অজান্তেই থাপ্পর মেরে বসেছি।
ইলিয়ানার বুকটা ছ্যাত করে ওঠে।ইলিয়ানা চাইনি কেউ তার আসল পরিচয় জেনে তাকে সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তার থেকে দূরত্ব বানিয়ে ফেলুক।আহান স্যার চলে যেতে নেয়।ইলিয়ানা পিছু করতে নিবে তার পূর্বেই জ্যাক ফোন করে।ইলিয়ানা জ্যাকের কল কেটে আহান স্যারের হাত ধরে আটকায়। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাদের দিকে।
ইলিয়ানা আগে ভয় পেতো কেউ যদি তার অনুভূতি সম্পর্কে জেনে বাসায় জানিয়ে দেয় এই ভয়।তবে এখন আর তা পায় না।এখন সে আত্মনির্ভরশীল। পাশাপাশি তার ভাই,বাবা নিজেই চায় এখন সে কাউকে নিজ জীবনে আনুক।তাইতো এখন প্রকাশ্যে যদি নিজের ভালোবাসার ইজহার করেও তাকে না পায় থাকবে না কোনো গ্লানি।তবে আফসোস নিয়ে বাঁচা যাবে না যে,ইশ আমি যদি তাকে সামনাসামনি প্রপোজ করতাম সে হয়তো মেনে নিতো! ইলিয়ানার ফোনে জ্যাক অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে।তবে ইলিয়ানা ফোন সাইলেন্ট করে সবার সামনে নিজ অনুভূতিকে প্রকাশ করে।সেদিন যা ছিল গেমের ছলে তা আজ বাস্তবে।
—ভালোবাসা কি তা আপনার থেকেই জেনেছি আমি।না,আপনি শেখাননি আমায়।আমার অনুভূতিরা শিখিয়েছে আমায় আপনিই সে যে আমার অনুভূতি।হ্যা,দশম শ্রেণীতে থাকতে ইগোর বসে কয়েকটা দিন আপনার সাথে কথা বলেনি।একদিন মিসবিহেভ করেছি।আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাম আগের মতো।তবে অনুভূতিগুলো এখনো সেই আগের মতো।আপনার ভালোবাসায় এমনি ভাবে জড়িয়েছি যে আর কাউকে জীবনে আনার প্রয়োজন বোধ করেনি।আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন?
ইলিয়ানা নিজের সব ইমোশন ঢেলে কথাগুলো বলেছে।সে কাঁদছে।আহান স্যারের চোখ জোড়া চলছে। হয়তো তারও কান্না পাচ্ছে।তবে পুরুষ মানুষের সবার সামনে কান্না করা যে বারণ।আহান স্যার ইলিয়ানার হাত ছাড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান অন্যদিকে।হয়তো কান্না লুকাতে।ইলিয়ানা একদৃষ্টিতে সেই পথের দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ ইলিয়ানার গালে কেউ ঠান্ডা হাত লাগায়।ইলিয়ানা চোখ তুলে চেয়ে অবাক হয়।জ্যাক,ম্যারিও ক্যালিস,নোয়া আর এনা দাঁড়িয়ে আছে।জ্যাক মাথা নুইয়ে ফেলে ইলিয়ানা চোখ তুলে তাকাতেই।ক্যালিস জড়িয়ে ধরে ইলিয়ানাকে।বলে,
—কাম ডাউন।কাম ডাউন বেভ।উই অল আর হেয়ার ফর ইউ ডন্ট ওয়ারি।
ইলিয়ানা চোখ ঘুরিয়ে অশ্রু সিক্ত নয়নে এখনো আহান স্যার যেদিক গিয়েছেন সেদিকে তাকিয়ে। ভালোবাসা বড্ড পোড়ায়।সবার মাথার উপর দিয়ে ঘটনাগুলো গেলেও ইলিয়ানাদের সময়কার প্রিন্সিপাল স্যার বেশ বুঝেছেন ইলিয়ানা আহান স্যার বলতে কেন পাগল ছিল তার মানে।তবে তার যে কিছুই করার নেই!আহান স্যার আর ইলিয়ানার বয়সের পার্থক্য যে অনেকটাই বেশি।বারো বছর!
★
ক্যালিসের বুকে কিছুক্ষণ মাথা রেখে চোখ তুলে তাকায় ইলিয়ানা।ক্যালিস ইলিয়ানার তাকানোর মানে বুঝতে না পারলেও নোয়া বুঝতে পারে।ক্যালিসের থেকে ইলিয়ানাকে নিজের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে বলে,
—তোকে সারপ্রাইজ দিতেই আসা।জ্যাক বলেছিলো তুই কোথায় আছিস ও জানে।তাই চলে আসলাম।তবে এসে হয়তো ভালোই করেছি।
চারজন বিদেশীর ইলিয়ানার সাথে এতো গভীর সম্পর্ক দেখে ইলিয়ানার কিশোর কালের বন্ধুগুলো সত্যিই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মেহের,সাঈদা এগিয়ে আসে ইলিয়ানাকে ধরতে।নোয়া চোখ তুলে ওদের দেখে।আবার ইলিয়ানার দিকে তাকায়।ইলিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। চারজন বিদেশীর দিকে একবার তাকিয়ে জ্যাককে বলে,
—ওদের থাকার ব্যবস্থা করো।এখান থেকেই মিনিট কয়েক দূরে রিসোর্ট আছে।সেখানে কথা বলে দেখো।
ইলিয়ানা আর দাঁড়ায় না।এনা পেছন যেতে চাইলেও নোয়া আর ম্যারিও আটকে দেয় তাকে।ম্যারিও এর চোখে জল।বেচারা গত সাত বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবাসে ইলিয়ানাকে।ইলিয়ানা বলেই দিয়েছে বন্ধু হিসেবে ভালোবাসা গ্রহণযোগ্য হলেও এই ভালোবাসা সে একজন জীবনসঙ্গী হিসেবে কখনই চায় না ম্যারিও এর কাছে।আজ ম্যারিও বুঝেছে কেন তাকে মেয়েটা বারবার রিজেক্ট করেছে। ম্যারিও বিড়বিড় করে বলে,
—কোথায় সে তো আমার মতো এতো সুন্দর না,না সে আমার মতো লম্বা,সিক্স প্যাক্সের অধিকারী!তবুও কেন ইলিয়ানা আমায় ফেলে এই লোকটাকেই এতো ভালোবাসে!..
★
ইলিয়ানা তাঁবুতে এসে বসে পড়ে।কান্না পাচ্ছে তার আরো।সে জানতো এমন কিছুই হবে তার প্রফেশন বেরিয়ে আসলে। তাই তো খুব গোপনে এড়িয়ে যেতো।তবে আজ বিশ্বাস অবিশ্বাসের দাড়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো তার বলা কথাগুলো।তাইতো গোপনীয়তা আজ বজায় না রেখেই প্রকাশ্যে এনেছে তার প্রফেশন।তবে বিশ্বাস না ভাঙলেও প্রিয় মানুষটার মনে জমেছে অনেক বেশি অভিমান।
ইলিয়ানা উঠে দাঁড়ায়।বসে থাকলে আরো বিগড়ে যাবে ব্যাপারটা।ইলিয়ানা বোঝে সময় যতো গড়ায় বিষয় তত জটিল হয়।তাইতো হাঁটা দেয় আহান স্যারের তাঁবুর দিকে।তবে বেশিদূর আর যায় না।পাগুলো থেমে যায়।আহান স্যার একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে।এই মেয়েটাকে ইলিয়ানা চেনে।এই মেয়েটার কথা সে আহান স্যারের কাছেই শুনেছিলো।মেয়েটা স্যারকে অনেক ভালোবাসতো।স্যার তাকে সেটা বলেছিলো।ইলিয়ানার যে কত কষ্ট হতো তা করে বোঝাতো সে!এমনকি আহান স্যার তো এও বলেছিলো যে আগামী মাসে এই মেয়েটার সাথে তার বিয়ে!হাহ,সবাই সুখেই আছে।শুধু ইলিয়ানার ভালোবাসাই একজনের অপেক্ষায় আমৃত্যু রয়েছে গেছে।
ইলিয়ানা উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। বিড়বিড় করে বলে,
—মেয়ে তোমার প্রতি আমার একদম হিংসে নেই।তবে তোমাকে আমি সহ্যও করতে পারবো না। তুমি খুব ভাগ্যবতী যে আমার প্রিয় মানুষটির বুকে তুমি।আমি আর ফিরবো না এদেশে।তুমি সুখে রেখো আমার প্রিয় মানুষটিকে।আমার সহ্য হচ্ছে না তোমায় হে মেয়ে।আমি পারবো না তোমায় তার বুকে সহ্য করতে।কেন আমি এতো ভাগ্যবতী হলাম না!কেন আমি পেলাম না তাকে!
ইলিয়ানা স্কুল মাঠ ত্যাগ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। অজান্তেই কখন সে রাস্তার মাঝামাঝি এসে পড়েছে তা সে জানে না।তবুও সে হেঁটেই চলেছে।কোথায় যাচ্ছে আদৌ জানা নেই।একহাতে শক্ত করে ফোন চেপে ধরা। পায়ে জুতো নেই। রক্তাক্ত পা।সামনেই কতগুলো মানুষের অবয়ব।দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে এদিকেই।হিংস্র পশুর মতো মনুষ্য নাকি মানুষরূপী জন্তু!
ইলিয়ানার হাতে টান পড়ে।আছড়ে পড়ে কারো বুকে।চোখ তুলে তাকাতেই মুখে হাসি ফোটে।জ্ঞান হারায় সে। সাঁই সাঁই করে ট্রাকটা চলে যায় সেখান দিয়ে!কে বাঁচালো ইলিয়ানাকে যার জন্য জ্ঞাত হওয়ার পূর্বেই ভয়ের দেখা মেলেনি তার মুখে!কে সেই বিশ্বস্ত!
★
মেহের, আফরোজা, অন্তরা সবাই অবাকের শেষ সীমায়।এখনও তারা চুপচাপ। তাদের মুখে একটা রা অব্দি নেই।তবে শেষমেশ অন্তরা নিশ্চুপতা ভেঙে বললো,
—আমি সত্যিই ভেবেছিলাম ইলিয়ানা মুভ অন করেছে।এই তিনদিনে আহান স্যারের প্রতিও ওর কোনো দূর্বলতা নজরে আসেনি তেমন করে।তবে আমি ভুল প্রমাণিত হলাম!
মেহের অন্তরার কথায় নিরবতা আর পালন করেনা।বলে,
—স্যারের মাথার পাশটায় একটা ঘাতের দাগ দেখেছিস?ইলিয়ানা স্যারের মাথায় ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছিলো। আমাদের এখানে আসার দ্বিতীয়তম রাতে। এছাড়া দ্বিতীয়তম দিনে ওরা সারাদিন নিরুদ্দেশ ছিলো।আর তৃতীয়তম রাতে তো ট্রুথ,ডেয়ার খেললাম।আজ তো তৃতীয়তম দিন আর চতুর্থতম রাত।
মেহের কথায় তাসনিম আর সাঈদা রাগ দেখিয়ে বলে,
—আমাদের আগে জানাসনি কেন এগুলো?
—জানালে কি-ই বা করতি?(অনন্যা)
চলবে?