অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
653

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#সমাপ্ত
#বর্ষা
দশদিন অতিক্রম হয়েছে।আজ ইলিয়ানার গায়ে হলুদ।একসাথেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।অনেক বন্ধু-বান্ধব ছুটি পায়নি।তাইতো ইলিয়াস চৌধুরী নিজে অনুরোধ করেছে ইলিয়ানার কাছের ফ্রেন্ডদের হাজব্যান্ডদের ছুটির জন্য।যাতে তারা আসতে পারে।

ইলিয়ানা এখন মোটামুটি সুস্থ।দেশেই তার বিয়ের আয়োজন হয়েছে। অবশ্য ইলিয়ানার সিঙ্গাপুরের সহকর্মীরাও‌ এসেছে ওর বিয়েতে।ডক্টর জোবেদা আসতে পারেননি। আমেরিকায় ছেলের কাছে গিয়েছেন দিন দুয়েক।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা জাঁকজমকপূর্ণ।লাইটিং করা হয়েছে।ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রিসোর্টটা।সাঈদা,মেহের ইলিয়ানাকে হলুদ শাড়িতে সাজিয়েছে।সাঈদা তো জড়িয়ে ধরে বলেই ফেললো,

—দেখলি‌ তো আমি বলেছিলাম না আল্লাহ চাইলে তুই স্যারকে পাবি।তুই স্যারকে পাচ্ছিস ইলিয়ানা।

সাঈদাকে ধরেই ইলিয়ানা ঘুরতে থাকে।আজকে যেন সেই ছোট্ট বেলার কথাটা মনে পড়ে গেলো। ছোট্ট বেলায় একবার সে বলেছিলো যে যদি ভালোবাসার মানুষটিকে পাই তবে সবার আগে তোর হাত ধরেই আমি ঘুরবো।ইচ্ছে পূরণ করলো।

স্টেজে বসে গায়ে হলুদ লাগানো হচ্ছে।ইলিয়ানার পাশেই আহান স্যার বসে। দুজনের একইসাথে হলুদ সন্ধ্যা হচ্ছে।আহান স্যারের কলিগরাও এসেছেন আজ।তবে অনেকে কানাঘুষা করছে। কেননা এত সাকসেসফুল, সুন্দরী মেয়ের সাথে সুদর্শন একজন প্রফেসরের বিয়ে হচ্ছে বলে কথা!তবে তাদের সমালোচনার মুখ্য বিষয় হচ্ছে নিশ্চয়ই চক্কর চলছিলো এদের।আবার অনেকে বলছে বয়সের কি তফাৎ,দেখবি কয়দিন বাদেই ডিভোর্স,বয়সের তো একটা মিল আছে নাকি!সবকথাই ইলিয়ানার কানে আসছে। প্রচন্ড রাগ লাগছে তার।

নুকতা ইলিয়ানার পাশে এসে বসতেই দেখে তার মাম রাগছে।চারপাশে নজর দিয়ে বিষয়টা বুঝতে সময় লাগে না নুকতার। স্পেনে বড় হওয়া ছেলেটা খুব অবুঝ কিন্তু নয়।যেহেতু মাতৃভাষা বাংলা জানে তাই বেশ বুঝেছে আত্মীয়দের কথার মানে।

—মাম মানুষের কাজই কথা বলা,মতবাদ দেওয়া। এ নিয়ে কষ্ট পেয়ো না,আর রাগও করোনা।এতে ওদের নয় বরং তোমারই ক্ষতি।গায়ে হলুদ ইঞ্জয় করো।জীবনে একবারই পাবে।

কথাটা বলেই নুকতা চোখ টিপ দেয়।ছেলেটা ইলিয়ানার সাথে পুরোপুরি মিশে গেছে।জোয়া ও রায়দা ছুটি এসে ইলিয়ানার পাশে বসে।নুকতাকে উঠিয়ে দেয়।নুকতা উঠে ইলিয়ানাকে একটু হলুদ ছুঁইয়ে নিচে নেমে আসে।নাচ,গান সোর-সারাবা চলতে থাকে।আর এদিকে টুকুর টুকুর চোখে চোখে প্রেম প্রেম খেলা খেলছি ইলিয়ানা-আহান!

ভোর থেকেই আয়োজনের শেষ নেই। একপাশে রান্নার কাজ চলছে।আরেকপাশে সুন্দর স্টেজে গান বাজনা চলছে।রিসোর্ট দুভাগে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।একপাশে মেয়েপক্ষ তো আরেকপাশে ছেলেপক্ষ। ছেলে পক্ষের ওখানে উঠেছে ইলমা আপু ,রায়হান ভাইয়েরা।তবে বাচ্চা-কাচ্চাগুলো ইলিয়ানার দিকে।

লাল বেনারসীতে অপরূপা লাগছে ইলিয়ানাকে।গায়ে ভারী গহনা।ভারী মেকআপ।পুরো সাজটাই এমেলি সাজিয়েছে।ফরেনে পার্লারে ট্রেনিং নিয়েছিলো সে।পরে পার্লারে জব না করে স্টেশনারিতে জব করেছিলো।আর সেখানেই তো প্রথম দেখা হয়েছিলো ইলিয়াসের সাথে তার।ধীরে ধীরে আলাপ।তারপর বন্ধুত্ব,প্রেম এবং বিয়ে।

গ্র্যান্ড ভাবে এন্ট্রি নেয় ইলিয়ানা।স্টেজে উঠতে হাত বারিয়ে দেয় আহান স্যার।দুজনকেই পাশাপাশি অপূর্ব লাগছে।যেন মেড ফর ইচ আদার!

বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরপরই পুলিশের আগমন হয় সেখানে। তুরহাম খন্দকার ইলিয়াস চৌধুরীর সাথে কথা বলতে চান একান্তে। ইলিয়াস হয়তো বিষয়টা বুঝতে পারে তাই একান্তে যায়।

—মি.চৌধুরী এতো রিস্কি কাজ কেন করেন?আপনার কাজে যে আপনার পরিবারের লোকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভয় পান না?

—কি বিষয়ে বলছেন আপনি?

—আপনি কি সত্যিই জানেন না?

—না!

—আচ্ছা,শুনেন আমরা ক্রিমিনাল আটক করেছি।

—আপনারা করেছেন না কেউ সাহায্য করেছে!

ইলিয়াস চৌধুরীর কথায় চতুর তুরহাম খন্দকার যা বোঝার বুঝে ফেলে।তবে উপদেশ দিয়ে বলে,

—ডক্টর মেহতাব রাহাত কিন্তু প্রতিশোধ পরায়ণতা থেকেই ইলিয়ানার ওপর আক্রমণ করেছিলো।আমরা চেষ্টা করবো তার সর্বশাস্তির ব্যবস্থা করতে।তবে…নিজের শত্রুদের স্বীকার পরিবারকে বানাবেন না।যার পরিবার নেই সেই বোঝে পরিবারের মানে!

শেষের কথাটায় যে দুঃখ প্রকাশিত হয়েছে তা বেশ বোঝে ইলিয়াস।কারণটা তার জানা। অবশ্য তার কাছে তার কাছের মানুষদের সাথে জড়িত সব মানুষদের খবরাখবর আছে কিংবা জোগাড় হয়ে যায়।তুরহাম খন্দকার পেছন ফিরে চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে ইলিয়ানার দিকে দৃষ্টি রেখে ইলিয়াসকে বলে,

—আপনার থেকেও কয়েক কদম এগিয়ে মিস. ইলিয়ানা জেহের চৌধুরী।বিপর্যয়ী রমনী!

তুরহাম চলে যান। ইলিয়াস গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বোনের পাশে বসে।কয়েকটা ছবি তুলে নেয় স্মৃতির পাতায় জুড়ে দেয়।ইলিয়াস সবাইকে খেতে পাঠিয়ে দেয় লোক দিয়ে।ইলিয়ানা আর আহান স্যার কথোপকথনের সময় পায়।

—তো মিশন শুরু করবো আজ থেকেই।কি বলো?

—কিসের মিশন?

—দ্রুত বেবির মিশন।

—নির্লজ্জ

—তোমারই জামাই

_________________ছয়বছর পর________________

”বাবাই,বাবাই আজ তো মাম্মাম ফিরবে তাই না?”

পুচকি একটা মেয়ে‌ আহানের কাছে ছুটে এসে প্রশ্ন করে।আহান মেয়েটার কপালে চুম্বন করে।আদর করে বলে,

—হুম মাম্মাম।আজই তোমার মাম্মাম আসবে।

—চলো না আমরা কোনো সারপ্রাইজ প্ল্যান করি মাম্মামের জন্য। প্লিজ

একদম ইলিয়ানার মতো করেই আবদার করে ইরহা বিনতে আহান।আহান যেন মেয়ের মাঝে নিজের প্রিয়তমাকে খুঁজে পায়।মেয়েটা কত দ্রুতই বড় হয়ে গেছে।চার বছরে পা দিয়েছে।কি ট্যাটনা ট্যাটনা কথা বলে!

বিকেলের দিকে কলিংবেল বাজতেই আহান স্যার দরজা খুলে দেন।ইলিয়ানা লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে। ইমার্জেন্সি অপারেশনের জন্য দুই দিনের জন্য দিল্লিতে গিয়েছিলো সে।মেয়েটার জন্য যেন প্রাণটা যায় যায় অবস্থা।বাসায় এসেই আহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

”আজ আপনার স্কুল নেই?বাসায় কেন আপনি?আর আমার ইরহা কোথায়?

”সারপ্রাইজ,মাম্মাম”

আহানের পেছন থেকে ইরহা বলে ওঠে। তিনজনের ছোট্ট পরিবার ওদের।বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছে ইলিয়ানা।স্বামী,সন্তান নিয়ে তিন-চার সিঙ্গাপুর গেলেও স্থায়ী ভাবে থাকতে চায়নি আহান কেননা মাতৃভূমিতেই তার সব।আর ইলিয়ানাও জোর করেনি কেননা স্বামী যেখানে সম্মানবোধ নিয়ে থাকতে পারবে সেখানে সে নিজেও সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে!

ইলিয়ানা ইরহাকে জড়িয়ে ধরে। আহান কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।ইলিয়ানা মেয়ে,স্বামী দুজনকে পুরো আড়াইদিন পর একত্রে জড়িয়ে ধরে।কিছু সময় পর আহান বলে,

—ইলিয়ানা আমার না তোমার ওপর মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়….

—মানে?কি বললেন আপনি?

—আরে বাবা অন্যদিকে যেও না।আগে শুনো তো

—বলুন..শুনতাছি

—এতো লম্বা ট্রেভেল করে আসলে..আর সাওয়ার না নিয়েই মেয়েসহ আমাকে জড়িয়ে ধরলে।ডাক্তার রা তো সচেতন থাকে এইসব বিষয়ে।তাই..

—হি হি হি মাম্মাম।বাবাই তোমার ডাক্তারী নিয়ে সন্দেহ করছে!

ইলিয়ানা চোখ কাচুমাচু করে লাগেজের ওপর রাখা হ্যান্ডব্যাগ ছুঁড়ে মারে আহানের দিকে।রাগ দেখিয়ে ওয়াসরুমের দিকে চলে যায়।আহান বলে,

—তোমার পোশাক রাখা আছে।গোসল করেই বের হয়ো।

ছয় বছরের এই খুনসুটিময় জীবনটা কতশতই না ঝগড়া হয়েছে ইলিয়ানা আর আহানের।তবে ভালোবাসা কমেনি কিঞ্চিত পরিমাণ।দুজনই দুজনের প্রফেশনকে সমান সম্মান দেয়। দুজনকে সাপোর্ট করে। ওদের সম্পর্কে দুজনের ইফোর্টই সমান।শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিন নিজেদের সাথে সময় স্পেন্ড করতে ভুল হয়না ওদের।বেবির সময়টা তো আলাদাই।

সব ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েও অনেকসময় পায় না।তবে আহান-ইলিয়ানার ভালোবাসার পূর্ণতার প্রমাণ ইরহা।আর সুন্দর বেড়ে ওঠাই ওদের সম্পর্কের সুন্দর ভীতির মাঝে লুকিয়ে। পিতা-মাতার সম্পর্ক যতটা সুন্দর হয়, সন্তানদের বেড়ে ওঠার ওপর ততটাই ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।দোয়া রইলো এভাবে পূর্ণতা পাক সকল ভালোবাসার মানুষগুলো।তবে সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না।দুইজন সুখী হলেও অজান্তেই তৃতীয় কোনো ব্যক্তি চরমভাবে আহত হয়।যেমন ইলিয়ানা আর আহানের মিল হলেও ইলিয়ানার জন্য এখনো কাতরাচ্ছে ম্যারিও!তবে এনির জীবনে এসেছে নতুন কেউ।সুখী সেও হয়েছে তবে কয়েকদিন আগ পিছে।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে