অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১৭+১৮

0
555

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৭
#বর্ষা
জুনায়েদ চৌধুরীর সামনে মাথা নুইয়ে ইলিয়ানা দাঁড়িয়ে।বাবার হঠাৎ আগমনে যতটা আনন্দিত ঠিক ততটাই ভীত সে। অবশ্য জুনায়েদ চৌধুরীর কাছে আজ অব্দি সে কখনোই বকাঝকার শিকার হয়নি।তবে সে অফিস কর্মচারী এবং বাইরের জগৎ থেকে জেনেছে, জুনায়েদ চৌধুরী প্রচন্ড রাগী স্বভাবের মানুষ।

—ডেড ডেড

ইলিয়ানা শুধু ডেড ডেড সম্বোধনেই আটকে আছে।ইলিয়াস তাদের থেকে অনেকটা দূরে সোফায় বসে জেনির সাথে খেলছে। প্রায় দিন ছয়েক পর পাপাইকে কাছে পেয়ে বুকে লেপ্টে আছে।বাবা-মেয়ের সম্পর্ক তো মা-সন্তানের মতো।বাবা হয় সন্তান আর মেয়ে হয় মা।বাচ্চা মেয়েটাও কি মিষ্টি মিষ্টি শাসন করে!

এমেলি এসে পাশে দাঁড়ায় ইলিয়ানার। জুনায়েদ চৌধুরীর দৃষ্টি এখনো নিচের দিকেই।একবারও মেয়ের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন না।ইলিয়ানাও মাথা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।বলে না যে আমায় শাসন করে কম তাকে আমি ভয় পাই বেশি,এমন ঘটনাই ঘটছে ইলিয়ানার সাথেও।এমেলি ইলিয়ানার হাতটা শক্ত করে ধরে জুনায়েদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—ডেড তুমি তো জানতে ইলিয়ানা বাংলাদেশে এসেছে।তখন যখন তুমি ওকো ক্ষমা করেছো এখনও করে দেও..

এমেলি ভাবী আর কিছুই বলতে পারেন না। জুনায়েদ চৌধুরী ফিক করে হেসে সামনে তাকান।এমেলি ভাবী বোকা বনে দাঁড়িয়ে থাকে। জুনায়েদ চৌধুরী ইলিয়ানার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

—গতকাল রাতে যখন শুনলাম ইলিয়ানার বিয়ে ঠিক হয়েছে প্রচন্ড কষ্ট পেলাম।আমি আমার মায়ের সাথে একদম রাগ করিনি।কিভাবে করি?ইলিয়ানা যে আমার মেয়ে নয় মা।আর মায়েরা তো সঠিক সিদ্ধান্তই নেয় সবসময়।তবে কষ্টটা ছিলো তীব্রতর।তাইতো মায়ের থেকে জানতে এতদূর থেকে আসলাম কেন আমার মা আমায় না জানিয়ে নিজের বিয়েটাও ঠিক করে ফেললো!

জুনায়েদ চৌধুরীর চোখে অশ্রুকণা ঝলঝল করছে।চোখ পিটপিট করলেই হয়তো গড়িয়ে পড়বে।ইলিয়ানার কষ্ট হয় নিজের ডেডের জন্য।তবে প্রাউড ফিল করে সে তার ডেডকে নিয়ে।আজ যদি তার স্থানে অন্য কোনো পিতা হতো তবে এতক্ষণে ইলিয়ানার শরীর থাকতো রক্তাক্ত, মানসিক চাপে আত্মার মৃত্যু হতো।

অবশ্য একজন সাইকোলজির স্টুডেন্টের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা।হ্যা, জুনায়েদ চৌধুরী একজন সাইকোলজিস্ট।তবে এই বিষয়ে পড়াশোনা করলেও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ব্যবসায়িক পেশা। সাইকোলজিস্ট হওয়ার সুবিধার্থে ক্লাইন্টকে ইমপ্রেস করতে ক্লাইন্টদের খুব সুক্ষ্ণ জিনিসকেও লক্ষ করে খুবই দুর্লভ সব প্রেজেন্টেশন তৈরি করতেন।তাইতো তার আজ এতো উন্নতি।তার দেখানো পথেই তো ইলিয়াস চলছে।

—ডেড আ’ম সরি।বাট ট্রাস্ট মি আই লাভ হিম ঠু মাচ।

ইলিয়ানার কথায় জুনায়েদ চৌধুরী মুচকি হেসে বললেন,

—আমাদের থেকেও বেশিই ভালোবাসো মনে হয় নয়তো গার্ডবিহীন শত্রুর মুখে পড়তে না তার সাথে বিয়ে করার জন্য এদেশে থেকে।

ইলিয়ানা মাথা নামিয়ে দেয়। জুনায়েদ চৌধুরীকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়।চিৎকার করে কান্না করা যাকে বলে।এখন তারা সেই রিসোর্টে যেখানে জ্যাক ইলিয়ানার বন্ধুদের রেখেছিলো।ইলিয়ানার বন্ধুরা নিজ দেশে ফিরে গেলেও এখন রিসোর্টে আছে ইলিয়ানার পরিবার। চারপাশে অনেক গার্ড যেন দেশের কোনো বড়সর মানুষ এসেছেন এখানে।আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে স্থানীয়রা গেট থেকেই দৃষ্টিপাত করছে।তবে ততটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ইলিয়ানা জুনায়েদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথেই কেউ গুলি করে। অবশ্য গুলিটা জুনায়েদ চৌধুরীর লাগার কথা হলেও লাগে ইলিয়ানার গায়ে।পেটের কাছে লাগে।ইলিয়ানা ভর ছেড়ে দেয় জুনায়েদ চৌধুরীর ওপরে। কয়েকজন গার্ড গুলি চালানো লোকটার পেছনে ছোটে।আর কয়েকজন ওদের সেফটি দিতে এগিয়ে আসে।ইলিয়াস ছুটে এসে জেনিকে এমেলির কোলে দিয়ে বোনকে কোলে তুলে নেয়।গার্ডকে গাড়ি বের করার আদেশ দেয়।

সকাল থেকেই ইলিয়ানার খোঁজ না পেয়ে কিছুটা হলেও চিন্তিত রায়হান ভিলার মানুষেরা।নুকতা তো একটু পরপর এসেই খোঁজ নিচ্ছে তার মাম ফিরেছে কিনা এটা।আর রাহিদ পেছনে পেছনে কিছুটা দূর থেকেই শুনছে তার পিপির খোঁজ।তবে আশানুরূপ কোনো খবরই এখনো অব্দি নেই।

ইলমা আপু চিন্তায় পাগল।এই দু’টো দিন বোনকে সে একদমই সময় দিতে পারেনি। কেননা ভিসা শেষ হওয়ায় ভিসা রিনিউ করতে দেশে আসা এনাদের। পাশাপাশি পাসপোর্টের মেয়াদও তো বাড়াতে হবে নাকি।

—হ্যা,রায়হান ইলিয়ানার খোঁজ পেয়েছো?

ইলমা আপু ফোনে চিন্তিত কন্ঠে বলেন।রায়হান ভাইয়ের বলা কথাটায় হয়তো সন্তুষ্ট হতে পারেননি ইলমা আপু।ফোন রেখে যেন আরো অস্থির হয়ে উঠেছেন।আহান স্যার ফোনের ওপর ফোন দিয়েই চলেছেন।পাগল প্রায় লোকটা। একঘন্টার লম্বা সফরে গাজীপুর এসেছেন। উদ্দেশ্য ইলিয়ানা।এখন বিকাল।

আহান স্যারের উপস্থিতিতে যেন ইলমা আপু আরো বেশি অস্থিরতা বোধ করছেন।তারিফ দুলাভাইয়ের সাথে আহান বেরিয়েছেন। আহানের অবস্থাটাও বেশি বোধগম্য নয়।মেয়েটার চিন্তায় একদম ছন্নছাড়া। চুলগুলো এলোমেলো।শার্টের হাতাও দু’টো দুরকম উচ্চতায়।

—আহান এতো চিন্তা করবেন না।ইলিয়ানা তো আর বাচ্চা নেই।

তারিফ দুলাভাইয়ের কথায় আহান স্যার সেদিকে তাকান।শক্তিহীন কন্ঠে বলেন,

—ভাই ইলিয়ানা বাচ্চা না হলেও মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের মতোই আচরণ করে।ওর কিছু হয়ে গেলে যে আমি ঠিক থাকতে পারবো না।

আহানের কন্ঠে ছিলো ইলিয়ানার প্রতি অগাধ প্রেম।বেচারা জানতেও পারছে না যে তার প্রিয়তমা কোন মুসিবতে পতিত হয়েছে। টানাহেঁচড়া হচ্ছে তাকে নিয়ে হসপিটালে। আহানের ধ্যান ভাঙে তারিফ দুলাভাইয়ের কথায়।

—আহান ইলিয়ানা হসপিটালে…

—মানে?

চিৎকার করে আহান ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।তারিফ দুলাভাই আহানের দিকে একটু তাকিয়ে সরে আসে সেখান থেকে।ইলমা আপুকে আর রায়হান ভাইকে ফোন দেয়।জানিয়ে দেয় মাত্র খবরে দেখা বিষয়টা। ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে ই.জি.সি গ্রুপের চেয়ারম্যানের মেয়ে এবং সিইও এর বোন গুলিবিদ্ধ।

হসপিটাল করিডোরে অপারেশন থিয়েটারের সাথে ঠেকনা দিয়ে বসে আছে আহান।চোখ মুখ ফোলা ফোলা।কে বলবে এই পুরুষের বয়স আটত্রিশ!

—আহান উঠে দাঁড়াও।নিজেকে শক্ত রাখো।আমি চাইনা আমার বোনের সামনে কেউ দুর্বল হয়ে দেখা করতে যাক।আমি চাইনা কারো দূর্বলতা দেখে আমার বোন আরো দুর্বল হয়ে যাক।বুঝলে?

ইলিয়াসের গম্ভীর গলায় বলা কথাগুলো শুনে আহানের মনে হলো লোকটা হয়তো এক পাষন্ড।তবে ইলিয়াসের চোখ দেখে আঁতকে উঠলো সে। রক্ত লাল! রক্ত কি চোখে উঠেছে?না উঠলে এতো লাল হলো কিভাবে!

অপারেশন থিয়েটার থেকে একটু পরেই কয়েকজন ডাক্তার বেরিয়ে আসেন।ডাক্তার জানায়,

—অপারেশন সাকসেসফুল…তবে আন্ডার অবজারভেশনে আইসিইউতেই রাখতে হবে দুই ঘন্টা।যেহেতু গুলিটা একটু জন্য কিডনি স্পর্শ করেনি।তাই জানে বাঁচলেও‌ রিস্কটা থেকেই যায়।

তানহা হাসপাতালেই আনা হয়েছে ইলিয়ানাকে।যেহেতু গত পরশুরাতে ডক্টরসদের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করেছে সেহেতু সিনিয়র অনেক ডক্টররাই গাজীপুরে ছিলো।তাই তারা দ্রুত ছুটে এসেছে তানহা হসপিটালে!

আহান এশার আযান দিতেই সাততলায় ছুটেছে।নামাজ পড়ে মোনাজাতে বসেছে।বলছে,

”হে আমার আল্লাহ,,,দশবছর পর ফিরিয়ে দিয়েও অনুগ্রহ করে কেড়ে নিবেন না।আমি যে ইলিয়ানার সাথেই ঘর বাঁধতে চাই।একসাথে জান্নাতের পথে হাঁটতে চাই। আখিরাতের জন্য একটু একটু করে গোছাতে চাই।প্লিজ আল্লাহ ইলিয়ানাকে সুস্থ করে দিন।প্লিজ আল্লাহ প্লিজ”

আহানকে প্রেয়ার করতে বাইরে থেকে একজন সাদা অ্যাপ্রোনধারী শোনে।তবে বাঁকা হাসে।বিড়বিড় করে বলে,

—অপারেশন সাকসেসফুল হোক বা না হোক।ইলিয়ানা জেহের চৌধুরীকে যে মরতেই হবে।খুব পাখা গজিয়েছে তার,এবার পাখাটা ছেঁটে ফেলতে হবে। মরতে হবে।হা হা হা

হসপিটালে পুলিশ তুরহাম খন্দকার ইনভিস্টেগেশন করছে। জুনায়েদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাঁসি হাসে।তারপর আবারো গার্ডসদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। জুনায়েদ চৌধুরীর দিকে আবারো চোড়াচোখে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে বলে,

”কে মারতে চাইলো ওই মেয়েকে?কার এতো সাহস যে ইলিয়াস চৌধুরীর বোনকে মারতে চাইছে!তবে সাহস আছে ক্রিমিনালের, খোঁজ তো লাগাতেই হচ্ছে ”

চলবে?

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৮
#বর্ষা
”পুলিশি পাহারায় আবারো আক্রমণ ”এমনই শিরোনাম প্রত্যেকটি সংবাদ পত্রের।তানহা হাসপাতালে আইসিইউতে থাকা অবস্থাতেই হামলা হয়েছে ইলিয়ানার ওপর।স্টিচ খুলে গেছে টানাহেঁচড়ায়।ব্লিডিং হওয়ায় জ্ঞান হারিয়েছে ইলিয়ানা।তবে আক্রমণ কারীকে অজ্ঞান করেই অজ্ঞাত সে।

পুলিশ অফিসার তুরহাম খন্দকার যেন নিজের ব্যর্থতা মানতেই পারছেন না।সব রাগ ঝাড়ছেন সামনের চেয়ারা বাঁধা লোকটার ওপর। ইচ্ছে মতো পিটিয়ে ঠান্ডা পানি ঢালছে কনস্টেবল নোমান। হুকুম তুরহামের।লোকটার চুলের মুঠি ধরে তুরহাম উঁচু করে ওনার মাথা।লোকটা পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে।

—কু**বাচ্চা তাড়াতাড়ি বল,কে পাঠিয়েছে তোকে এখানে?

লোকটা কিছু বলতে চায় তবে মুখ দিয়ে শব্দগুলো আটকে আটকে বের হয়।তুরহাম আরো খেপে ওঠে।কলার ধরে লোকটার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করে,

—তোর নাম কি?

—আ আ আমার…

—তোকে যা জিজ্ঞেস করছি তা শুধু বল।পুরো বাক্য বলতে বলা হয় নাই তোকে‌

—মা..মাহিম

—এখন বল কে তোকে এইসব করতে বলছে। তাড়াতাড়ি বলবি।

তুরহামের ধমকে আর শরীরের যন্ত্রণায় আবারো জ্ঞান হারায় মাহিম।তুরহাম দাঁতে দাঁত চেপে চেয়ারে সজরে আঘাত করে।কাঠে হালকা ফাটল ধরলেও তেমন কিছু হয়নি।তবে আঘাতটা সেই পেয়েছে।

—এই কু**বাচ্চার জ্ঞান ফেরাও।

তুরহামের গালাগালিতে যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে থানার পুলিশ গুলো।তাইতো আর কেউ তার গালাগালিতে অস্বস্তিতে ভুগছে না।থানার বড়কর্তা বলে কথা।চৌত্রিশ বছরের তুরহাম খন্দকার পুরান ঢাকার মানুষ।এখনো বিয়ে সাদীতে নিজেকে জড়ায়নি।না কথা বলেছে নিজ পরিবার নিয়ে কারো সামনে।খুব সামলে চলে পরিবারের বিষয় আসলেই।তবে এছাড়া তার আচরণ ছন্নছাড়া মেঘের মতো।

তুরহাম সিগারেট ধরিয়ে জ্যাকেট কাঁধে বেরিয়ে পড়ে সেল থেকে। উদ্দেশ্য হসপিটালে যাওয়া। আজকে সকালে আক্রমণের পর আর যাওয়া হয়নি।কেস নিয়েই দিনটা ব্যস্ততায় কেটেছে। খোঁজ লাগিয়েছে সে এই মাহিমের।সোর্স আইডি কার্ড। তুরহামের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ক্রিমিনালগুলোকে থাপ্পড়াতে।মাঝে মাঝে নিজেই বিরবির করে বলে,”ভাই তুই ক্রিমিনাল, তুই ক্রাইম করবি।তোর কেন আইডি কার্ড সাথে নিয়ে ঘুরতে হবে?কেন তুই খালি হাতে চাকু ধরে খুন করে সেই চাকু ফেলে যাবি?কেন তুই পার্সোনাল গান দিয়ে খুন করবি?এমন আরো কতকিছু।”

তানহা হসপিটালের নিচে রিপোর্টাররা নিউজ করছে।ই,জি,সি গ্রুপের মতো বিশাল কোম্পানির সিইও এবং চেয়ারম্যান যে এই ছোট্ট শহরে তার নিউজ করতেই এতো ভীর। বর্তমান নিউজ রিপোর্টাররা ট্রেনিং নিউজই খোঁজে। তাইতো বিখ্যাত প্রায় নিউজ চ্যানেলের দুই একজন এখানে ক্যামেরা হাতে ঘুরছে।

—ওইতো কেস তদন্তকারী কর্মকর্তা…

একজন রিপোর্টারের কথায় সবাই ছুটে আসে তুরহামের দিকে।তুরহাম চোখের সানগ্লাস খুলে প্যান্টের পকেটে রাখে।আর হাতের লাঠিঠা ঘোরাতে ঘোরাতে হসপিটালে ঢুকতে নেয়।তবে মাঝপথে বাঁধা পেয়ে রাগান্বিত হলেও রাগ প্রকাশ করে না। কেননা এই প্রেসের লোকদের সাথে ঝামেলা জড়ানো মানে নিজের হাতে লাইফ হেল করা। এদের সাথে হয় এক,এরা বানায় আরেক।

তুরহাম কোনো মতে এড়িয়ে ওপরে চলে আসে। তবে দোতলায় ধাক্কা খায় একজন রমনীর সাথে।সরি বলতে গিয়েও থেমে যায়।সেই ঠোঁট,সেই চোখ,সেই মুখায়ব সবটাই যেন সেই পুরনো ক্ষতকে বিক্ষত করে জাগিয়ে দেয় ব্যথাটাকে।সামনের রমনীও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।বুকের ডান’পাশে আইডি কার্ড ঝোলানো।তন্মি আরা জান্নাত‌।তুরহাম কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়েই ওপরের দিকে উঠতে থাকে।স্মৃতি গুলো সামনে আসতে থাকে।

—তুরহাম ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আই ডন্ট লাভ ইউ।আমি তোমাকে ভালোবাসি না।আর তোমার এতটাও যোগ্যতা নেই যে তুমি আমার আব্বুর কাছে আমাদের বিয়ের কথা বলবে।আমি আব্বুকে কসম দিয়েছি যে আমি আমার আব্বুর পছন্দে বিয়ে করবো।তাই ফারদার আমার সামনে আসবে না তুমি।

সেইদিন কফিশপে এই কথাটা বলেই উঠে চলে যায় জান্নাত।পেছনে ফিরে আর তাকায় না সে।হয়তো পেছনে ফিরলে সেদিন দেখতে পারতো ক্ষত-বিক্ষত তুরহামকে।সেই ঘটনার পেরিয়েছে বহু লগ্নক। প্রায় একযুগ।জান্নাত কি এখন বিবাহিত?প্রশ্ন জাগলেও নিজ মনেই তুরহাম উত্তর দেয় যে জান্নাত বিবাহিত।বয়স তো আর কম হয়নি ঊনত্রিশ হবে তার জানুয়ারীর পঁচিশ তারিখে।তারিখটা এখনো স্মরণে আছে তুরহামের।প্রিয় মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ দিন কি চাইলেও ভোলা যায়?হয়তো যায় ‌তবে সবাই ভুলতে পারে না।

—স্যার ইলিয়ানাকে মারতে আসা লোকটা কিছু বলেছে?

আহান চটজলদি প্রশ্ন করে তুরহামকে‌।সিড়ির পাশেই বসে ছিলো সে।তাইতো তুরহামকে দেখা‌।তুরহাম ভাবনা থেকে বেরিয়ে উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে। জিজ্ঞেস করে,

—মি.আহান ডক্টর চৌধুরীর অবস্থা কেমন এখন?

—আগের চেয়ে বেটার।খুনি?

—মি.আহান ধৈর্য ধরুন।খুনিকে ধরুন বললেই দু’মিনিটের মাঝে ধরা যায় না।সময় লাগে।

—আপনাদের সময় দিতে গিয়েই আমার বোনের এঅবস্থা আজ।আপনারা না পারলে আমাদের বলে দিন।আমরা নিজেরাই খুনিকে ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবো।

ইলিয়াস চৌধুরী গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠেন।তুরহাম সেদিকে তাকায়।শুস্ক মুখশ্রী।হয়তো বোনের দুশ্চিন্তায় খাওয়া নাওয়া বাঁধ পড়েছে।তুরহাম কোনো ত্যাড়া জবাব দেয় না। অবশ্য ত্যাড়া জবাব দিলেও সে মনের শান্তি করতে পারতো না।তাইতো ইলিয়াস চৌধুরীকে কিছু প্রশ্নাদি করে বেরিয়ে পড়ে হসপিটাল থেকে।থানা থেকে ফোন এসেছে মাহিম স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

ইলিয়ানা এখন আগের তুলনায় সুস্থ আছে।চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়েছে।চব্বিশ ঘন্টায় ব্যথা অনেকটাই কমে আসে আর কথাও বলার পরিস্থিতি থাকে। অবশ্য অপারেশন চব্বিশ ঘন্টা আগে হলেও আবারো বারো ঘন্টার মাথায় স্টিচ ফিক্সড করতে আরেকটা ছোট অপারেশন করতে হয়। পাশাপাশি রক্তও দিতে হয়।এ পজেটিভ রক্ত।ব্লাড ব্যাংক থেকেই পাওয়া গিয়েছে।

একে একে সবাই দেখা করলেও আহান ঠাঁয় বাইরে দাঁড়িয়ে।ইলিয়ানা জুনায়েদ চৌধুরীকে আহানের কথা জিজ্ঞেস করতেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাইরে এসে আহানকে ইশারা করেন ভেতরে যেতে। প্রথমে যেতে না চাইলেও জুনায়েদ চৌধুরীর কথা রাখতে ভেতরে আসে সে।

—রা..রাগ করে থাকবেন?

আহান স্যার চুপ করেই থাকে।ইলিয়ানা আহান স্যারের চুপটি দেখে হাত দুটো কানের কাছে আনতে নিলেই হাতে টান লাগে।ক্যানেলার সুচে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠে সে।

—এই মেয়ে ঠিক আছো তুমি?এই শরীর নিয়েও এতো নড়চড় করতে হবে কেন তোমায়?

—আপনিই তো ফিরছিলেন না।তাই কান ধরতে নিয়েছিলাম।দেখুন না হাতে লাগলো।

মাসুম চেহারা করে ইলিয়ানা বলে।আহান স্যার চোখে অশ্রু নিয়েই হাসেন।ইলিয়ানা বায়নার সুরে বলে,

—ভাই আর ডেডকে একটু ভেতরে আসতে বলবেন?

আহানের মুখশ্রী চুপসে আসে।সে তো ভেবেছিল ইলিয়ানা তার সাথে কিছুক্ষণ থাকতে চাইবে।তবে না সে তো তার ভাই আর ডেডকেই চায়।আহান স্যার মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই ইলিয়ানা আরো বলে,

—ওনাদের সাথে আপনিও আসবেন।

আহানের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটে।ইলিয়াস বোনের তলব শুনে কাল বিলম্ব না করেই উপস্থিত হয়।সাথে জুনায়েদ চৌধুরী এবং আহান।ইলিয়ানা নার্সকে বলে পিঠের সাইডের বেডটুকু উঁচু করে নেয়।অনুরোধ করে তাদের একা ছাড়তে কিছুক্ষণের জন্যে।নার্স যেতেই ইলিয়ানা বলে,

—ভাই ,ডেড ইনি হলেও আহান তালুকদার।
আর আহান স্যার ব্লাক ব্লেজার আমার ডেড জুনায়েদ চৌধুরী এবং ব্রাউন ব্লেজার আমার ভাই ইলিয়াস চৌধুরী।

—জেহের আমার তোমার অসুস্থতার প্রহর কাজে লাগিয়ে আগেই পরিচিত হয়ে গিয়েছি।বুঝলে?

ইলিয়াস বোনকে হাসাতে মুখটা হাসি হাসি করে বলে। ইলিয়ানা ভাইয়ের উদ্দেশ্য বুঝে কিঞ্চিত হাসে। তাদের কথার মাঝেই নুকতা আর রাহিদ ছুটে আসে।ইলিয়াস আটকাতে গেলেও নুকতা এক ছুটে চলে আসে ইলিয়ানার কাছে।বাচ্চাটার চোখমুখ ফোলা ফোলা।হয়তো কেঁদেছে। চোখের চশমাটা খুলে চোখ মুছে আবারো চশমা চোখে দেয় নুকতা।

—মাম তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?দেখো পুলিশ আংকেলরা কাউকে ছাড়বে না।তোমাকে যারা কষ্ট দিয়েছে সবাই শাস্তি পাবে।

ইলিয়ানা বামদিক দিয়ে নুকতাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।স্বল্পদিনের দীর্ঘপরিচিত মামকে আগলে যেন নুকতাও শান্তি অনুভব করে।রাহিদকে ছাড়ার ইশারা দিতেই ইলিয়াস রাহিদকে ছেড়ে দেয়।রাহিদ দৌড়ে যায় ডানদিকে।ইলিয়ানার হাতে ক্যানোলা থাকলেও সে হাতেই জড়িয়ে ধরে রাহিদকে।ব্যথাটা যেন আর উপলব্ধি হয় না। ভাগ্নে আর ভাতিজার ভালোবাসা দেখেই যেন ব্যথাগুলো আর ব্যথা লাগে না।ইলমা আপুরা দেখা করে গেলেও ওদেরকে পাঠায়নি কেননা ওরা যদি ছোটাছুটি করে ব্যথা দেয় তাই।তাইতো ইলিয়ানাই পড়ন্ত বিকেলে ওদের সাথে দেখা করার আর্জি জানালো।

পুরো রুম পিনপিন নিরবতায় ভরে যায় ইলিয়াস চৌধুরী আর জুনায়েদ চৌধুরী বাচ্চাদের নিয়ে চলে যেতেই।আহান স্যার বামপাশ দিয়ে ইলিয়ানার পাশে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,

—বাচ্চা তোমার খুব পছন্দের তাই না?

—অনেক।

—বিয়ের পর তাহলে তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে নিবো।কি বলো?

আহান স্যারের নির্লজ্জ মার্কা কথায় প্রচন্ড লজ্জা পায় ইলিয়ানা।মুখ ফুটে বলেই ফেলে,

—এতো নির্লজ্জ হলেন কবে?

—অনেক আগে।তা তুমি কি আমার বাবুর আম্মু হবে না?

ইলিয়ানা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। অবশ্য লাল হওয়াটা তো কথার কথা।তবে ইলিয়ানার মুখায়ব দেখে পরিলক্ষিত যে সে লজ্জা পাচ্ছে।ভয়ানক লজ্জা যাকে বলে। আচ্ছা, ডাক্তারদের নাকি লজ্জা থাকে না।তবে ইলিয়ানা ডাক্তার হয়েও লজ্জা পাচ্ছে..। অদ্ভুত বলার অবশ্য কিছুই নেই কেননা প্রফেশনের ক্ষেত্রে পেশেন্টের জীবন বাঁচাতে নির্লজ্জ হলেও নিজ জীবনে ডাক্তাররাও প্রচন্ড লজ্জা পায়।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে