অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১৫+১৬

0
568

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৫
#বর্ষা
সন্ধ্যা ছয়টা কি সাতটা!ইলিয়ানা ডক্টর জোবেদার নতুন ফ্লাটে এসেছে।সাথে আছে আরো কয়েকজন ডক্টর।ওনারাও ইনভাইটেট। অবশ্য ইলিয়ানার সাথে সবার পরিচয় নেই।আর ইলিয়ানা এতোটা আগ্রহও দেখায়নি নিজেকে সকলের সাথে পরিচিত করতে।অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের গুটিয়ে চলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে আর তাদের একজনই ইলিয়ানা।এই অভ্যাসটা শুধুই অপরিচিতদের জন্য। কাছের মানুষদের কাছে তো চঞ্চল সে।

—মিস ওর মিসেস?

অচেনা কারো কন্ঠ কানে আসতেই ভ্রু কুঁচকে উপরের দিকে তাকায় ইলিয়ানা। শক্তপোক্ত গড়নের শ্যাম এক পুরুষ।ইলিয়ানাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

—আপনাকেই জিজ্ঞেস করেছি মিস বলবো নাকি মিসেস?না মানে আপনার পাশে তো জায়গা আছে বসতাম আরকি।

ইলিয়ানা উত্তর না দিয়ে নিজের পাশের দিকটায় চোখ বুলায়।সে তো এককোণে বসেছে যাতে গল্পের আসর বসাতে সমস্যা না হয়।তবুও এলোকের এই জায়গাটাই নজরে আসলো!ইলিয়ানা বলে ওঠে,

—দেখুন ভাইয়া,এখানে আপনার বসার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই।কান্ডলি ডক্টর মোতালেব সাহেবের কাছে গিয়ে নাহয় বসুন।

ইলিয়ানা কথাটা বলেই মাথা নুইয়ে নেয়।শ্যাম পুরুষটি আবারো জিজ্ঞেস করে,

—তা আপনাকে কি মিস বলবো নাকি মিসেস বলবো?

—আমাকে ডক্টর চৌধুরী নামে সম্বোধন করলেই চলবে।

—আমি মেহতাব রাহাত। বর্তমানে তানহার একজন গাইনোকলজিস্ট।

ইলিয়ানা মুচকি হাসে মাথা তুলে।বুঝতে পারে ছেলেটা প্রচন্ড চিপকু টাইপের।তবে কোনো মেয়েরই এরকম ছেলে একদম পছন্দের না। তাদের তো এমন ছেলে পছন্দ যারা তাদের প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে মন-প্রাণ উজাড় করে আগলে রাখতে জানবে।ইলিয়ানাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখে রাহাতের ইগো হার্ট হয়। ওখান থেকে সরে এসে সিনিয়র এক ডক্টরের পাশে বসে। অবশ্য তাকে পাশে বসানোটা অন্যান্য ডক্টরদের জন্য লাভজনক। কেননা বাংলাদেশের টপ টেন অভিনেতার একজন মেহতাবের পিতা।তবে কেউই বুঝতে পারে না এই ছেলে অভিনয় জগৎ ছেড়ে ডক্টরী লাইনে কি করছে!!

ডক্টর জোবেদা কিচেন ক্লোথেই ড্রয়িংরুমে আসেন।সবাই অবাক হয়।বর্তমান যুগে একটু টাকা হলেই যেখানে বাড়ির নারীরা রান্না ঘরে ঢোকা বন্ধ করে সেখানে এতোবড় একজন চিকিৎসক হয়ে তিনি রান্না করছেন অতিথিদের জন্য।ইমপ্রেসিভ!ডক্টর জোবেদা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আবারো। পরিচয় পর্ব শেষে ইলিয়ানাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

—ডক্টর চৌধুরী যদি কিছু মনে না করেন তবে আমার সাথে একটু লাইব্রেরি রুমে আসুন।

ইলিয়ানা বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ায়। এখানে বসে থাকতে তারও বিরক্তই লাগছিলো।ডক্টর জোবেদা কিচেন ক্লোথ লাইব্রেরী রুমে এসেই খুলে ফেলেন।ইলিয়ানাকে চেয়ারা বসতে ইশারা করেন।ইলিয়ানা বসতেই তিনিও বসে পড়েন এবং বলেন,

—ডক্টর চৌধুরী আপনি বয়সে আমার অনেক ছোট।তবে নামডাকের দিক থেকে বহুৎ বিখ্যাত‌।তবে তোমায় কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি। শুনবে?

ইলিয়ানা নিজেও জানে বাস্তব অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে সে অন্যান্য মানুষদের মতো নয়। তাছাড়া একেকজনের অভিজ্ঞতা একেক রকম।যেমন ইলিয়ানার অভিজ্ঞতার সাথে ডক্টর জোবেদার অভিজ্ঞতা মিলবে না। তাইতো ইলিয়ানা নতুন জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হয়ে বসে।ডক্টর জোবেদা বলতে শুরু করেন,

—আমার শুরুটা তোমায় নাই বললাম।তবে আমার সফল হওয়ার পরের ঘটনা বলছি তোমায়। সাধারণ মানুষ তথা বাঙালি ঠুনকো কারণে লাফায়।তখন সারাদেশে হরতাল।জনগণ নাকি ঠিকঠাক বেতন পাচ্ছে না।তখন কি হলো। শুরু হলো ভাঙচুর যেন বেতন বাড়ায়। আচ্ছা বলতো তো ভাঙচুর করে কি লাভ হলো?বেতন কি বাড়লো? বরং ক্ষতি হলো গার্মেন্টস মালিকদের। শেষমেশ বেতন বাড়লেও তা ছিলো স্বল্প।যেই লাউ সেই কদুই রইলো।তবে মালিক পক্ষের চোখে নিজেদের নোংরা প্রতিচ্ছবি আঁকলো।

ডক্টর জোবেদা কিছুক্ষণ থামলেন।নিঃশ্বাস নিলেন।ঠগঠগ করে একগ্লাস পানি খেলেন।তিনি আবারো বলতে শুরু করলেন যে,

—হসপিটালে সেদিন অনেক রোগী।তার মাঝেই গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন‌ করে। হসপিটালে ভাংচুর করে।নিচতলা আর দোতলা ভাঙচুর করে সব শেষ করে দেয়।কারেন্টস সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেটর সাপ্লাই চালু করতে যে যাবে তারও ইয়াত্তা নেই। মানুষগুলো নির্মম রুপ ধারণ করেছিলো। অবশ্য তাদের মাঝে কতগুলো মানুষ জেনারেটর সাপ্লাই চালু করতে আমাদের লোকদের সাহায্য করেছিলো।পুলিশের লোক লুকিয়ে ছিলো হসপিটালে। তখন তারা নিজেদের সমর্পন করে যাতে রোগীরা বাঁচতে পারে।এখন বলুন তো এখানে শিক্ষণীয় কি?

ইলিয়ানা ঘটনা আগে থেকেই জানে তবুও এর মাঝে থেকে শিক্ষণীয় কিছু জানতে জিজ্ঞেস করে,

—কি?

—সব প্রফেশনের মানুষ যেমন ভালো হয় না ঠিক তেমনি সেসকল প্রফেশনের অধিকাংশ খারাপও হয় না!আর যখন তোমাদের হৃদয়ে অন্যদের জন্য বাঁচার মনোভাব আসবে তখন তুমি নিজের দিকটা নয় বরং তোমার আশেপাশের মানুষদের কথা ভাববে। দুঃখিত আপনাকে তুমি করেই বলে ফেলায়।

—নো ম্যাম,আপনি তো আমার সিনিয়র।আপনি আমায় তুমি করেই সম্বোধন করতে পারেন!

—আচ্ছা ডক্টর চৌধুরী তোমায় একটা প্রশ্ন করি?

—জ্বী বলুন

—তুমি তো সিঙ্গাপুরের সন্তান। সিঙ্গাপুর তো তোমার মাতৃভূমি অর্থাৎ সেখানেই বসবাস করো। তাহলে এতো ভালো বাংলা কিভাবে বলো তুমি?

—সিঙ্গাপুর আমার মাতৃভূমি নয়, সিঙ্গাপুর আমার পিতৃভূমি।আর মাতৃভূমি বাংলাদেশ! আচ্ছা ম্যাম একটা প্রশ্ন করি?

—করো

—আমার সাথেই কেন শেয়ার করলেন আপনার অভিজ্ঞতা?

—তোমার মাঝে ভবিষ্যৎ দেখি তাই।কোনো ভুল সিদ্ধান্ত জীবনে নিয়ে নিলেও সেটাকে সঠিক সিদ্ধান্তে রুপান্তরিত করো যাতে আফসোস করতে না হয়।আর সবসময় আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা রাখবে।তবে এখন চলো ড্রয়িংরুমে যাই।মিতা মনে হয় ডাইনিং এ খাবার দিয়েছে।

ইলিয়ানা এবারো পিছুপিছু বেরিয়ে আসে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলে।সবাই আরো কিছুক্ষণ থাকবে জানালেও ইলিয়ানা একটু তাড়া দেখায়।আড়ালে ডক্টর জোবেদাকে ডেকে বলে,

—ম্যাম এখানে আমি আমার এক রিলিটিভস এর বাসায় উঠেছি। এখনই যেতে হবে।নয়তো ক্যাচাল হতে পারে।বুঝতেই পারছেন।

ডক্টর জোবেদা ইলিয়ানাকে যাওয়ার দিকটায় নজর দেন। যেতে বিদায়ও দেন। তবে একটু ওয়েট করার কথা বলে ভেতরে যান।হাতে করে মাঝারী সাইজের একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্স নিয়ে বেরিয়ে আসেন। সকলের অগোচরে ইলিয়ানার হাতে দিয়ে বলেন,

—যখন জীবনের মানে খুঁজে পাবে না তখন খুলবে এই গিফট বক্সটা।আগামী দেখা হোক বা না হোক।আশা করি বক্সটা তোমায় সাহায্য করবে।আমাকেও সাহায্য করেছে এর ভেতরের জিনিসটা।আজ যোগ্য কারো হাতে তুলে দিতে পেরে আমি ধন্য।ভালো থেকো।

ইলিয়ানা বিদায় জানিয়ে বাইরে আসে। ইচ্ছে হয় বক্সটা খুলে দেখার।তবে ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখে রিক্সায় চড়ে রায়হান ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।রায়হান ভিলা দিয়েই পরিচিত এই ভিলা।প্রায় নাকডাক আছে এলাকায়।থাকবেই না কেন ফ্রিল্যান্সিং করে যেমন নিজে স্বচ্ছল হয়েছে ঠিক তেমনি অন্যদেরকে ট্রেনিং দিয়ে একটা নিজের গ্রুপ বানিয়ে নিয়েছে এলাকায়।সফল ব্যক্তিদের সফল সব কারবার।

আহান স্যারকে কল দেয় ইলিয়ানা।লোকটা কালকে রাতের পর আর কল দেয়নি।আগেই বলেছিলো আজ কল দিতে পারবে না।কলেজে কি কাজ পড়েছে। ছুটি নিয়েছিলো।ছুটিও শেষ তাই নাকি কাজের চাপটা একটু বেশিই। ময়মনসিংহের দিকে থাকেন।ইলিয়ানা কল দিতেই দুইবার রিং হতেই কল রিসিভ করেন।

—সাহেব কি ব্যস্ত নাকি?

—মাত্রই রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসলাম।তুমি কি করছো?

—রিক্সায়।

—কোথায় গিয়েছিলে?

—ডিনারে।তা মহাশয় আমায় কি আজ ভুলে গিয়েছিলেন?

—কার সাথে গিয়েছিলে?

—ডক্টর জোবেদার বাসায়।অনেকজন ডক্টরসরা একসাথে।

—ওহ

—হুম।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইলিয়ানা প্রশ্ন করে,

—কবে আসছেন আমাকে আপনার করে নিয়ে যেতে?

—যেদিন তুমি বলবে।

—তা আপনার পছন্দের রমনীর কি হলো?আমাকে কবে ভালোবেসে ফেললেন?

—যেদিন তোমার বোকা বোকা কথাগুলো মনে করে দিওয়ানা হয়ে যাচ্ছিলাম,তোমাকে মিস করছিলাম সেদিন।যেদিন তুমি প্রথমবারের মতো আমায় দেখেও দেখোনি সেদিন।যেদিন তুমি আমায় রেখে অন্যজনকে বেশি মাহাত্ম্য দিয়েছিলে সেদিন বুঝেছিলাম ভালোবাসি তোমাকে।

—এটা তো জেলাসি..আর ভালোবাসলে জানাননি কেন?

—যদি জানাতাম,তবে কি ডাক্তার বউ পেতাম!আর জেলাসি তো ভালোবাসায় থাকেই তাই নয় কি।

—হুম জনাব বুঝলাম।

—কি বুঝলে?

—অনেক কিছু।

—আমাকেও‌ বলো,আমিও শুনি।

এভাবেই খুনসুটি চলতে থাকে এই ভবিষ্যৎ দম্পতির।ইলিয়ানার মুখের হাসি সরছেই না।পাশের বাইক থেকে একজন নজর রাখছে ইলিয়ানার ওপর।কাউকে ফোন করে ওই বাইকের পেছনে বসা লোকটা বলে,

—কনফর্ম,ইলিয়াস চৌধুরীর বোন গার্ডবিহীন বাংলার ভূখণ্ডে।স্যার খাল্লাস করে দিবো?

ইলিয়ানা খাল্লাস শব্দটা শুনে সেদিকে তাকায়।তবে সব বুঝেও সে যেন কিছুই বোঝেনি এমন অভিনয় করে ফোনে কথা কান্টিনিও করতে থাকে।ইলিয়ানা কি আজ শিকার হবে এই বদলোকদের?যদিও বা শিকার না হয় তবে কি ঘটবে তার সাথে?আর এরাই বা কারা যারা ইলিয়াস চৌধুরীর পরিবারের ক্ষতি করতে চাইছে?প্রশ্ন অনেক তবে উত্তর সময়ে লুকিয়ে!

চলবে?

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৬
#বর্ষা
গাজীপুরে দুটো খুন!পুলিশের চৌকিদারীতে মৌচাক এলাকাবাসী ভীত।মৌচাকেই আছে পুলিশ ফেরি আর সেই স্থানেই নাকি লাশ ভাবা যায়! পুলিশেরা আশে পাশে নজরদারি চালাচ্ছে। পাশাপাশি লোক দুটোর খোঁজও লাগিয়েছে। তবে দু’ঘন্টা পেরলেও কোনো খোঁজই এখনো অব্দি আসেনি।আদৌ আসবে কিনা তারও ঠিকঠিকানা নেই। আধুনিক মাধ্যমগুলোর ব্যবহার করা হয়েছে পরিচয় পেতে কেননা লোক দুটো এখানকার নাও হতে পারে।

অফিসার তুরহাম খন্দকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ললাটে স্লাইড করছে।ছোট দুটো ছোট ছোট করে রেখেছে।হয়তো কিছু ভাবছে!নিউ পোস্টিং পেয়েই এতো দ্রুত কেস পাবে তাও খুনের কেস তা সে ভাবেনি। অবশ্য খুনের কেস সলভ করার পেছনের ট্রাডেজি আলাদা।

—স্যার কি ভাবছেন?

কনস্টেবল খালিদের কথায় তুরহাম খন্দকার একচোখ ছোট করে মুখটা একটু বেঁকিয়ে তার দিকে তাকায়।খালিদ ভয় পায়। কেননা সে তো ভুলেই গিয়েছিলো ইন্সপেক্টর তুরহাম খন্দকার প্রশ্নচ্যুত হতে নয় বরং করতে পছন্দ করে।খালিদ মুখ কাচুমাচু করে বলেন,

—সরি স্যার

তুরহাম খন্দকার বাঁকা হেঁসে কিঞ্চিত হা করে বলেন,

—ওপস খালিদ জি আমার ডান পাশের মস্তিষ্ক কি ভাবছে তা আমার বাম পাশের মস্তিষ্ক জানে না সেখানে আমি আপনাকে কি করে বলি!

খালিদ পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ান।এই কয়দিনে বেশ বুঝতে পেরেছেন তুরহাম খন্দকার একজন সাইকো পেশেন্টের নাম যে সুস্থবেশধারী হলেও গুরুতর অসুস্থ।বিড়ালের ডাক পছন্দ না হওয়ায় গুলি করে হত্যা করেছে এই লোক। অবশ্য বলা তো যায় না,আজ ওই বিড়ালের স্থানে কোনো মানুষও তো হতে পারে তাই নয়কি!

ইলিয়ানা টিভি নিউজ দেখছে।তার মাঝে এতোটুকুও আশ্চর্যচাকিতা নেই যে কালকে তাকে খাল্লাস করতে চাওয়া ব্যক্তিদের লাশ পড়ে আছে!নুকতার আগমনে নিউজ চ্যানেল চেঞ্জ করে অ্যাবাকাস নিয়ে কথা বলা একটা চ্যানেলে যায় ইলিয়ানা।সে নিজে অ্যাবাকাস না পারলেও নুকতা যে বেশ অ্যাবাকাস পারে তা সে জানে।

—মাম তোমায় মিমি ডাকছে

নুকতা আর জোয়া তাদের মামিকে মিমি বলে ডাকে।ইলিয়ানা খুঁজে পায় না কেন তমা ভাবী তাকে ডাকছে।তাই খোশগল্প না করে তমা ভাবীর রুমের দিকে যায় ইলিয়ানা।সেকেন্ড দুয়েকের মাঝেই ভাবীর রুমে সে।

—ভাবী আসতে পারি?

তমা ভাবী মাথা উঁচিয়ে একবার দেখেন।ভেতরে আসার অনুমতি দেন।ইলিয়ানা ভেতরে আসতেই দরজা লাগিয়ে খাটে বসেন তিনি।বলেন,

—আমায় ক্ষমা করেছো?

—কোনো অন্যায় করেছিলেন আপনি?

—তোমায় সেই কিশোরী বয়সে বিয়ে দিতে চাওয়ার,তোমার সাথে দূর্ব্যবহার করার…

—আমি অতীত ভুলে ভালো আছি।আপনিও অতীত ভুলে থাকার চেষ্টা করুন।

ইলিয়ানার কথায় তমা ভাবী মাথা নুইয়ে ফেলে।ইলিয়ানা বুঝতে পারে সে ধাঁচ নিয়ে কথা বলে ফেলেছে।হয়তো তমা ভাবী কষ্ট পেয়েছে।ইলিয়ানাও তো তখন কষ্ট পেতো।তবে ইলিয়ানা পরিস্থিতি নরমাল করতে আবারো বলে,

—ভাবী রুমে বসে দম বন্ধ বন্ধ লাগে।চলুন না আশেপাশে কোথাও থেকে আমরা ঘুরে আসি।

ইলিয়ানার কথায় তমা ভাবী নরমাল না হলেও কৃত্রিম হাসি হেসে বলে,

—তোমার ভাইয়া আসুক তারপর দেখছি।

তমার মন খারাপের জায়গা নেই। কেননা সে তার কৃতকর্মের হালনাগাদই করছে। মানুষ তার কর্মের জন্য সামনের ব্যক্তির কাছে ব্যবহারের আশা রাখে।তমার তো আশাই ছিলো না ইলিয়ানা তার সাথে কথা বলবে। সেখানে ইলিয়ানা যেভাবে কথা বলছে তা আল্লাহর বহুত রহমত তার ওপর।তবে কষ্ট তো লাগবেই। মানুষ যখন অনুশোচনায় ভোগে তখন নিজের কর্মগুলোর কথা আরো বেশি বেশি মাথায় আসে, ঘুরঘুর করে। অনুশোচনা প্রবল করে দেয়।

ইলিয়ানা রুম থেকে বেরতেই দেখতে পায় রাহিদ খাবার টেবিলে বসে বসে খাবার খাওয়ার পরিবর্তে খাবার সামনে রেখে কার্টুন দেখছে।আর রায়দা এখনো ঘুমাচ্ছে।জোয়া তাদের রুমে বসে তারিফ দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলছে।মেয়েটা বাপ পাগলী।

ইলিয়ানা ডাইনিং টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।রাহিদ ভয় পায়।কোনো এক অজানা কারণে ছেলেটা ইলিয়ানাকে বেশ ভয় পায়।নুকতার মতো এতোটা ঘেঁষেও না।যেন পালিয়ে পালিয়ে থাকে।ইলিয়ানার সন্দেহ হয় তবে কিছু বলে না।তবে আজ ভাতিজাকে একটু আদর করার ইচ্ছা হওয়ায় ভাতিজার সাথে কথা বলতে এগিয়ে যায়।

—রাহিদ?

ইলিয়ানার ডাকে যেন থতমত খায়।মোবাইলটা টেবিলে উল্টো করে রেখে দ্রুত খেতে থাকে।খাবার তালুতে ওঠে।ইলিয়ানা পানি এগিয়ে দিয়ে শান্ত হতে বলে রাহিদকে।পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।

—আমায় ভয় পাও কেন তুমি?

—আ আমি ভয় পাই না।

—তাহলে আমাকে দেখলেই এতোটা কাপাকাপি করো কেন তুমি?আমি কি পঁচা নাকি যে আমায় দেখলেই পালাই পালাই করো।

রাহিদ নিশ্চুপ থাকে।ইলিয়ানা আরেকটু জোর দেয় কি হয়েছে তা জানতে। কেননা বাচ্চাটা প্রথম দেখায় যতটা প্রাণচাঞ্চল্য দেখাচ্ছিলো ততটা এই তিনদিনে ইলিয়ানা দেখেনি।নিশ্চিত কিছু না কিছু একটা হয়েছে।

—আমি কি হই তোমার তা কি জানো তুমি?

ইলিয়ানার প্রশ্নে না বোধক মাথা নাড়ায় রাহিদ।ইলিয়ানা অবাক হলেও তা প্রকাশ করে না।ইলিয়ানা বলে,

—ইলমা আপুকে তুমি কি বলো?

—পিপি ..

—আমাকেও পিপি বলবে।আমি তোমার ইলমা আপুর বোন।বলবে তো?

—আচ্ছা।

—শোনো?

—হুম

—কেউ কিছু বললে আমায় বলো।আমি তাকে আচ্ছা মতো পিট্টি দিয়ে দিবো যাতে তোমায় কেউ কিছু না বলে।কেউ কিছু বলেছে?

রাহিদের চোখ জলজল করে ওঠে।যেন পলক ফেললেই কেঁদে দেবে।তবে না বাচ্চাটা কাঁদে না।ইলিয়ানা অবাক হয় আটবছরের শিশুর নিকট অদ্ভুত আচরণ পেয়ে।রাহিদ কিছু না বলে প্লেট হাতে সরে পড়ে।ইলিয়ানার ফোন বেজে ওঠায় সেদিকটায় আর নজর দিতে পারে না সে।রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।

বিকেল চারটা কি তারও বেশি।এলাকা জুড়ে মেলা হচ্ছে।আজ এখানে তো কাল ওখানে।ইলিয়ানা রেডি হয়ে নেয়।বাচ্চাগুলো নিয়ে মেলায় যাবে সে।নুকতা প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে মজা হবে শুনে যেতে রাজি হয়েছে।তবে মেলার স্থানটা এখান থেকে বেশ অনেকটাই দূরে।আজ বৃহস্পতিবার নয়তো আহান স্যার আসতো।বেচারা আসতে পারবে না দেখেই তো ভিডিও কলে কথা বলছে প্রিয়তমার সাথে।

—কেমন‌ লাগছে আমায়?

—দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মতো।

—দশম শ্রেণীতে থাকতে লাগছে পঞ্চম শ্রেণীর বাচ্চাদের মতো।আর এখন লাগছে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মতো।সিরিয়াসলি!

আহান স্যার হাসেন।হাসিতে হয়তো কিছু একটা ছিলো।ইলিয়ানা আবারো মায়ায় জড়ায়।মানুষটা হাসলে গালে টোল পড়ে বেশ লাগে।ইলিয়ানা হাসলেও তার গালে টোল পড়ে।তবে তা লক্ষণীয় বা বোঝা যায় এমন না।ইলিয়ানার কোনো আফসোস নেই নিজের টোল পড়া নিয়ে।তার তো চিন্তা অন্য কিছু নিয়ে।

—ভাবুক রানী কি ভাবতে হারালেন?

—কিছু না।

—কে জেনো বলতো মেয়েদের কিছু না শব্দের মাঝেই অনেক কিছু লুকানো!

—কে বলতো?

—আমার বউ!

—আপনার বউ কিভাবে? আপনি কি এখনো আমায় বিয়ে করেছেন নাকি?

—করিনি তো কি হয়েছে।করবো।

—করার পর বইলেন তাহলে।

—আমি তো এখনই বলবো আমার বউ।

—ধূর..থাকেন রাখছি।

—কই যাবেন বউউউউ

—আপনি আমায় আপনি করে বলছেন কেন?

—সম্মান দিতে।

—আপনার কাছে আপনি শব্দটা শুনলে পরপর লাগে।তুমি শব্দেই আপন আপন লাগে।

—স্বার্থপর..

—স্বার্থপর হওয়ার মতো কি করলাম?

—নিজের কাছে তো আপন আপন ফিল আনো।আমার ক্ষেত্রে?আমাকে যখন আপনি করে বলো তখন আমার কাছে যে দূরের মত মানুষ লাগে তখন।আমাকে তুমি করে বলবে।

—আপনি আমার অনেক সিনিয়র। কিভাবে বলি তুমি করে?

—তাহলে এতো সিনিয়রকে ভালোবাসলে কেন?যখন তুমি করেই বলতে পারবে না।

—আপনাকে কে বললো যে আপনি ডাকে ভালোবাসা নেই?ভালোবাসতে হলে তুমি করেই ডাকতে হবে!কে বলেছে আপনাকে?

—তুমিই না বললা?

—আমি?কখন?

—আমি তোমায় আপনি করে বলায় তুমিই না বললা এই সম্বোধনে দূরের দূরের লাগে।

ইলিয়ানার নিজের কপাল চাপড়াতে মন চায়।এই লোকটা যখন কম বোঝার তখন অনেক বেশিই বোঝে।আর যখন পুরোটা ভালো মতো বোঝার তখন বুঝতেই চায় না।ইলিয়ানা যেমন সর্ট টেম্পারের ঠিক তার বিপরীত চরিত্র আহান স্যারের ছিলো দশ বছর পূর্বে।তবে এখন পরিবর্তন হয়েছে।আহান স্যার হয়েছে স্বল্প ধৈর্যের রাগান্বিত পুরুষ আর ইলিয়ানা সে হয়েছে প্রশস্ত ধৈর্য্যের শান্তি পরায়ন নারী।হয়তো বয়স বদলানোর পাশাপাশি সবকিছুই বদলায়। শুধু অনুভূতিরা আগের মতোই কোথাও থেকে যায়। তাইতো এতো বছরেও‌ ভালোবাসায় গ্রহণ লাগেনি।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে