#অনুভবে_তুমি
#পর্বঃ১১
#সানজিদা_আক্তার_সীমা(তিতিপাখি)
ম্যাসেজ টা দেখেই লাজুক চমকে যায়।
স্কুলের পূর্ন মিলনী আয়োজন করা হয়েছে।তার ইনভাইটেশন ম্যাসেজ এসেছে লাজুকের ফোনে।
কিন্তু লাজুক ভাবছে অন্য কথা।স্কুল শেষ করেছে আট বছর হয়ে নয় বছরে পড়েছে ।
এর মধ্যেই আবার কিসের পূর্ন মিলনী?
এসব ভাবা বাদ দিয়ে লাজুক তার মায়ের কাছে গিয়ে মাকে ব্যাপার টা জানায়।
নাহার বেগম বলেন,”হ্যা মা তোর স্কুলের হেডস্যার এসেছিলেন গতকাল।তুই ঘুমিয়েছিলি তাই তোকে ডাকিনি।
উনি ও বলে গেছেন স্কুলে উপস্থিত হতে হবে তোকে।”
লাজুকঃআম্মু তুমি জানোতো আমি স্কুলে যেতে চাইনা আর।তবু কেন বলছো?
আম্মুঃদেখ,স্যার নিজে এসে বলে গেছেন।তুই না চাইলেও তোকে যেতে হবে স্যারের সম্মান রক্ষার্থে।
“ধুর আর ভাল্লাগেনা।আচ্ছা যাবো।”
আম্মুঃএইতো লক্ষ্মী মেয়ে।এখন যা তো চট করে একটা শাড়ি পরে নে।
লাজুকঃশাড়ি! হঠাৎ করে শাড়ি কেন পরবো?কেউ কি আসবে?
আম্মুঃহ্যা,আজ তোকে দেখতে আসবে।আশা করি তোর কোনো আপত্তি নেই!
লাজুক আম্মুর কথা শুনে মন খারাপ করে ফেললো, তবু মুখে অস্পষ্ট ভাবে বলে,”না আমার কোনো আপত্তি নেই।”
লাজুকের মা হাসে।
আর বলেন,”ভালো ছেলে।আমার পরিচিত।আশা করি তোর ও ভালো লাগবে।আর তাছাড়া ছেলেটা তোকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো।”
লাজুক আর কথা বাড়ায়না।রুমে চলে যায় ওখান থেকে।গিয়ে দেখে ফোনে ম্যাসেজ আসছে।
ম্যাসেজ চেক করে দেখে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে তার মধ্যে লেখা, “মিস লাজুকআমাদের খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে।”
লাজুক পাত্তা দেইনা।ভাবে যে হয় হোক পরে যখন দেখা হবে তখন দেখা যাবে ।
লাজুক তখন শুভাকাঙ্ক্ষী কে ফোন করে, তাকে আজ দেখতে আসবে তা জানায়।
শুভাকাঙ্ক্ষীর কোনো ভাবান্তর নেই তাতে।
লাজুকের কেন জানি মনে হলো শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে ইগ্নোর করছে।
“আচ্ছা আপনি কি আমাকে ইগ্নোর করছেন?”
শুভাকাঙ্ক্ষীঃ কই না তো! তোমার এমন কেন মনে হলো যে আমি তোমাকে ইগ্নোর করছি?
লাজুকঃনা আসলে আগের মতো ফোন করেন না।কথাও বলেন না তেমন তাই আর কি!
শুভাকাঙ্ক্ষীঃ আসলে লাজুক আমি একটা মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম।তার আশা করেই বসেছিলাম।ভেবেছিলাম সে ও একদিন আমাকে ভালোবাসবে।
কিন্তু কি জানো তো সবাই ভালোবাসা পায়না।তাই আমার ও পাওয়া হলোনা।
বাবা-মা বেশ ক’দিন যাবত বিয়ে নিয়ে পড়েছে।যখন বুঝলাম আমার আর তাকে পাওয়া হবেনা।তখন বাবা-মা এর কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
আজ বিকালে বাবা-মা মেয়ে দেখতে যাবে।সেজন্য আমি একটু ব্যস্ত।
লাজুকঃআপনি সত্যিই আমাকে ইগ্নোর করছেন।কারন আপনি আজ অবধি কখনো আমাকে আমার নাম ধরে ডাকেননি।
আজ ডাকলেন।
শুভাকাঙ্ক্ষীঃ আমি তোমার নাম ধরে ডেকেছি! ভুলে গেছি।আসলে অন্যমনস্ক ছিলাম তো তাই।
আচ্ছা আমি রাখছি।পরে কথা হবে।
লাজুককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দেয় শুভাকাঙ্ক্ষী।
লাজুক ভাবনায় পড়ে যায়।কী হয়েছে শুভকাঙ্ক্ষির কেনো এমন করতেছে তার সাথে।
লাজুক আর না ভেবে ফ্রেশ হতে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে এসে একটা কাঁতানের কচি কলাপাতা কালারের শাড়ি পরে।
মাথায় ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল, চোখে হালকা কাজল, আর হালকা সাজে লাজুক কে অপরূপ লাগছে।
নাহার বেগম মেয়েকে দেখে মেয়ের চোখ থেকে কাজল নিয়ে কানের পিছে লাগিয়ে নখ কামড়ে দেন।আর বলেন,”কারো যেনো নজর না লাগে আমার রাজকন্যার উপর।”
“মা কি হচ্ছে এসব।এখনো কুসংস্কার নিয়ে পড়ে আছো! তুমি না শিক্ষিত!এসব কেউ মানে?”
নাহার বেগমঃ ও তুই বুঝবিনা।যখন মা হবি তখন বুঝবি।
মা-মেয়ের খুনিশুটির অবসান ঘটে কলিং বেলের শব্দে।
“এইরে একদম ভুলে গেছি।ওনারা বোধ হয় চলে এসেছেন।যা তো মা দরজা টা খুলে দিয়ে আয়।”
হু,যাচ্ছি মা যাচ্ছি, এতো হাইপার হয়ে যাও কেন বুঝিনা ।”
লাজুক কথাগুলা বলতে বলতেই দরজা খুলে অবাক হয়।
লাজুকের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে তার সেই কলেজ লাইফের “সিনিয়র শিক্ষক” মি. নাজিম।
যে সব সময় লাজুক কে সহযোগিতা করতো, তাকে অনুপ্রেরণা দিতো,
লাজুক স্যার কে দেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে,
লাজুকঃ স্যার কেমন আছেন, কোথায় ছিলেন এতো দিন, অনেকদিন পর আপনাকে দেখেছি।আমি কতো খুঁজেছি আপনাকে।
আমার সকল মন খারাপের সময় আমার আপনার কথা মনে হতো শুধু।
অবশেষে আজ আপনার দেখা পেলাম।তাও আবার আমার বাড়িতে।
মি.নাজিম:- এতো প্রশ্ন একসাথে করলে কোনটার উত্তর দিবো,
এতোদিন আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেই বিদেশে ছিলাম।
৪-৫ দিন হলো দেশে এসেছি।
আর যাবোনা।ছেলে ও এসেছে বাড়িতে।ভাবছি ছেলের বিয়ে দিয়ে এখানেই থেকে যাবো।
নাহার বেগমঃ আসসালামু আলাইকুম ভাইজান! কেমন আছেন আপনারা?
মি. নাজিম:- আলহামদুলিল্লাহ ভাবী আমরা ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?
নাহার বেগমঃ এতো দিন ভালো ছিলাম না, এখন আমার মেয়ে এসেছে তাই আমি এখন ভালো আছি, এখন আপনাদের আমানত আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারলেই আমার শান্তি।
মি.নাজিম:- হ্যা ভাবী আমরা আজ লাজুক মা কে আংটি পরাতে এসেছি।
যা কথা ছিলো তা তো আগেই হয়ে গেছে।তবু একবার লাজুক মায়ের মতামত আমরা জানতে চাই।
আমার ছেলের কি জানি একটা কাজ পড়ে গেছে,সেজন্য সে আসতে পারেনি।তবে সে বার বার করে বলে দিয়েছে লাজুকের মতামত যেনে তারপর বিয়ের কথা পাকা করি, লাজুকের মতের বিরুদ্ধে যেনো না যাই।
তা লাজুক মা তোমার কি কোনো আপত্তি আছে? তুমি আমকে নির ভয়ে বলতে পারো, আমি তোমার মতের বিরুদ্ধে যাবো না ।
লাজুক:- আসলে স্যার আম্মু যখন আমাকে বলেছিলেন যে আজ আমাকে দেখতে আসবে,তখন একটু মন খারাপ হয়েছিলো আমার।
কিন্তু এখন আপনাদের দেখে আর মন ভালো হয়েছে গেছে ।
আমার সৌভাগ্য আপনার বাড়িতে আপনারা আমাকে জায়গা দিবেন।
বাবাকে হারিয়ে মাথার উপর যে ছাঁয়া টা আমি পেয়েছিলাম সেই ছাঁয়া আপনি।
তাই আমার কোনো আপত্তি নেই।
মি.নাজিম:- আলহামদুলিল্লাহ।তাহলে তো হয়েই গেলো।আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তোমায় আমার ছেলের বউ করে নয় আমার মেয়ে করে নিয়ে যাবো । তুমি আমার মেয়ের মতো থাকবে, কী পারবে না আমাদের বাবা মা ভাবতে।
লাজুক লজ্জা পেয়ে গেলো স্যারের কথা শুনে।
লাজুক কে তারা আংটি পরিয়ে দিলো, তারপর ওনারা নাস্তা করে বেরিয়ে গেলেন নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
লাজুক রুমে আসার পর এক ধ্যানে আংটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো,”আজ থেকে আমি কারো বাগদত্তা।কিন্তু কার বাগদত্তা আমি?
নাম টা ও জানিনা।স্যারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ সেজন্য কোনো আপত্তিও করলাম না।আমি কি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম?”
লাজুকের ভাবনায় ছেদ ঘটে ম্যাসেজ টোনে।
লাজুক ভীষণ বিরক্ত হয়।কাল থেকে শুধু ম্যাসেজ আসছে লাজুকের ফোনে।
“আজ থেকে তুমি আমার বাগদত্তা।আমার মায়াবতী বউ।”
লাজুক তখন ছোট্ট করে রিপ্লাই দেয়,”তাহলে আপনিই আমার হবু স্বামী! কিন্তু দেখেন কি আজব,আমি আপনাকে দেখিনি আর আপনার নাম ও জানিনা।”
অপরপাশ থেকে কোনো রিপ্লাই নেই।
কিছুক্ষন বাদে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে লাজুকের ফোনে।
লাজুক তখন খুব বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়।
অপরপাশেঃমিস লাজুক আপনি কোথায়? আমি আপনার বাসার সামনে আছি।বাইরে আসুন তো।
একদমে কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দেয় লাজুক কে কিছু বলতে দেয় না।
লাজুক ভাবে এটা আবার কে,কেমন অভদ্র আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিলো! কে হতে পারে এই ভাবে বাহিরে যাওয়ার জন্য বলতেছে?
লাজুক তখনো শাড়ি পরাই ছিলো।সন্ধ্যা সাত টা তখন।লাজুক গেট খুলে গেটের বাইরে গিয়ে দেখে মুনতাসির পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লাজুক কাছে যেতেই মুনিতাসির বলে,”কখন কল দিয়েছি,এখন আসার সময় হলো?”
লাজুক কিছু বলেনা।চুপ করে থাকে।
মুনতাসির লাজুক কে চুপ থাকতে দেখে বলে,”এই আপনার সমস্যা কি বলুন তো!যখনি দেখি তখনি শাড়ি পরে থাকেন।শাড়ি পরতে আপনার এতো ভালো লাগে?”
লাজুক:- আসলে স্যার আজ আমার এনগেজমেন্ট ছিলো।
মুনতাসির চোখ কুঁচকে বলে,”ও আচ্ছা! তা আপনার জামাই কি করেন?”
লাজুক:- জানিনা।আমি তো তাকে দেখিইনি।তার নাম ও জানিনা।
মুনতাসির লাজুকের কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে।
লাজুক:- আজব মানুষ তো আপনি! এতে হাসার কি আছে?
মুনতাসির:- জানেননা,চিনেননা তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন?
লাজুক:- হ্যা রাজি হয়ে গেলাম।কারন তাকে পছন্দ করেছে আমার আম্মু,আর আমাকে যিনি সবসময় সহযোগিতা করতেন অনুপ্রেরণা দিতেন আমার সেই প্রিয় শিক্ষক।
তারা অবশ্যই আমার খারাপ চাইবেনা।
আর আমার হবু স্বামী আর যায় হোক আপনার মতো এমন খচ্চর আর বাঁদর হবেনা।
মুনতাসির লাজুকের হাত ধরে টেনে পাশে নিয়ে এলো,আর বললো,”কি বললেন আমি বাঁদর? দেইখেন এই বাঁদরের গলায় ই না আপনাকে মালা পরাতে হয়।”
এটা বলে বাঁকা হাসি দিয়ে মুনতাসির লাজুক কে বলে,”চলুন তো এখন! টং দোকানের চা খাবো।একা একা ভালো লাগেনা তাই আপনাকে সাথে নিলাম।”
লাজুক আর মুনতাসির যখন চায়ের দোকানে যায় তখন এক ছেলে বলে ওঠে,”কি ভাই সাথে ভাবী নাকি?”
মুনতাসির বলে,”হ্যা তোমাদের ভাবী।”
“আচ্ছা ভাই বসেন ভাবীরে লইয়া যেহেতু আসছেন দু’কাপ গরম গরম চা খাইয়া যান।”
লাজুক মুনতাসিরের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করতে থাকে।
আর আস্তে করে মুনতাসিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”ওই আমি আপনার কোন কালের বউ? সবার কাছে আমাকে বউ বলে পরিচয় দেন কেন? আর তাছাড়া আমি এখন অন্যের বাগদত্তা।সে জানলে কি হবে ভাবুন তো একবার?”
মুনতাসির:- এহ আইছে অন্যের বউ হতে, আমি বলেছিনা আপনাকে আমার করেই ছাড়বো।
কারো বাগদত্তা হলেও আপনি তাকে ভুলে যান।
এখন থেকে শুধু সারাক্ষন আমার কথা ভাববেন।শয়নে,স্বপনে সব জায়গায় থাকবে শুধু মুনতাসির।
লাজুক চোখ মোটা করে তাকায় মুনতাসিরের দিকে।আর বলে,”স্যার আপনি কি জানেন আপনি দিন দিন লুচুর খাতায় নাম লেখাচ্ছেন?”
মুনতাসির কিছু না বলে এক হাতে লাজুককে জড়িয়ে ধরে বলে,”বউ রাগ করে এতো দূরে দূরে কেন দাঁড়িয়ে আছো? এটা তো আমার ই এলাকা।কেউ কিচ্ছু মনে করবেনা।”
লাজুক অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়।
“কি করছেন কি লোকের সামনে এগুলা।বললাম না আপনাকে আমার এনগেজমেন্ট হয়েছে আজ!”
মুনতাসির:- ওটা আমার সাথেই হয়ছে বউ।তুমি অন্য কারো কথা ভুলে যাও কেমন।
তুমি শুধু আমার।আর কারো না।
লাজুক:- ফাজলামির একটা লিমিট থাকে।আপনার গার্লফ্রেন্ড মুনা আছে।তবু কেন আমার সাথে এমন করছেন?
মুনতাসির আর কথা বাড়ায়না।লাজুকের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে বলে চা খান এখানে বসে।
লাজুক ও আর কিছু বলেনা।অনেক টা রাত হয়ে গেছে।লাজুক মুনতাসির কে বলে,”স্যার আমি বাসায় যাবো।আম্মু চিন্তা করবে।আসার সময় বলে আসিনি।ফোন ও আনতে সময় পায়নি।”
“হ্যা চলুন এগিয়ে দিয়ে আসছি আমি।”
লাজুক কে এগিয়ে দিয়ে এসে মুনতাসির নিজের বাড়ি চলে যায়।
লাজুক ভাবে, “স্যার কিসব বললেন আজকে? ওনার সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছে মানে কি?আচ্ছা আম্মুর কাছে জামাইয়ের নাম শুনে আসি।”
“আম্মু! ও আম্মু! আমার জামাইয়ের নাম কি আম্মু?”
নাহার বেগম:- কিরে চেচাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে ?
লাজুক:- তোমার জামাইয়ের নাম কি?
নাহার বেগম:- জানিস না তুই? নাম্বার দিচ্ছি ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে নিস।এখন জ্বালাসনা তো আমাকে।
লাজুক ব্যার্থ মনে নাম্বার নিয়ে রুমে চলে এলো কিন্তু কল দিলোনা।
ঘুমিয়ে পড়লো কারন অনেক রাত হয়েছে।সকালে উঠে তো আবার স্কুলে যেতে হবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে।
চলবে,,,,,