অনির পর্ব-১২+১৩

0
10

দ্বাদশ পর্ব

বিয়ে করবে মানে?
বাবা-মা দুজনেই খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন এর চেয়ে আশ্চর্যজনক কোন কথাই এর আগে জীবনে কখনো শোনেননি। এইরকম কিছু একটা যে হবে আমি আগেই আঁচ করেছিলাম। আমি চাইলে অন্য কাউকে দিয়ে কথাটা বলাতে পারতাম, ইচ্ছে করেই সেটা করিনি। আজ যদি বাবা মায়ের মুখোমুখি হতে না পারি তাহলে আর কোনদিনও পারবো না

আমি ঢাকায় এসে পৌঁছেছি গভীর রাতে। আমাকে দেখে বাবা-মা দুজনেই চমকে গেছেন। সে সময় আর কথা বলার কোন সুযোগ পাইনি, সকালে খাবার টেবিলে কথাটা তুললাম। প্রথমে আমার কথা শুনে বোধহয় তারা কিছুই বুঝতেই পারেননি কারণ আমি কখনও এ ধরনের কোনো অভ্যাস তাদেরকে দেইনি, দেবার অবশ্য প্রয়োজনও বোধ করিনি। মা হরবর করে বললেন
কাকে বিয়ে করতে চাস? কোথায় থাকে, ঢাকায় না চট্টগ্রামে? বিয়ে আবার করে ফেলিস নি তো?
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি থামত। বল, মুনির কি বলছিলে তুমি?
বাবা সাধারণত আমাদের তুমি বলেন না, আজ বলছেন,স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আমার উপর যথেষ্ট রেগে আছেন।
আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে কিছু বললাম না, স্পষ্ট গলায় বললাম
বাবা, আমি একজনকে পছন্দ করি। এখনই তোমাদের জানানোর ইচ্ছা ছিল না কিন্তু ওর বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উনি চাইছেন এই জানুয়ারি মাসেই ওর বিয়ে হয়ে যাক।

বাবা গম্ভীর গলায় বললেন “উনি চাইলেই তো হবে না, আমাদেরকেও তো পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হবে। এখনো তোমার পড়াশোনা শেষ হয় নাই
মা আবারও আগ বাড়িয়ে বললেন
মেয়ে কোথায় থাকে, মেয়ের বাবা কি করে?
বাবা মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন কিন্তু লাভ হলো না। মায়ের কৌতূহল যেন বাঁধ ভেঙেছে
বাবা সেটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
ওই মেয়ের সাথে তোমার কিভাবে পরিচয়?
ওর নাম অনিমা বাবা, এখানেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, হলে থাকে। আমি জানি কথাটা তোমাদের জন্য খুব শকিং কিন্তু আমার আসলে আর কোন উপায় নেই। ওর বাবার স্ট্রোক করেছে। উনি চান এই জানুয়ারিতে ওর বিয়ে হয়ে যাক। বিয়ের পর আমরা যেরকম হলে আছি সেরকমই থাকবো প্রয়োজন হলে পড়াশোনা শেষ হলে তখন না হয়ে দেখা যাবে।
এইভাবে চুপে চাপে তো বিয়া করা সম্ভব না। আত্মীয়-স্বজনদের তো জানাতে হবে তোমার চাচা ফুফুদের খবর দিতে হবে। কি করা যায় আগে তোমার ছোট চাচার সঙ্গে একটু বুঝ পরামর্শ করে নেই।
বাবা উঠে গেলেন, পিছন পিছন মাও গজগজ করতে করতে বলতে বলতে গেলেন

তোমার মামাদের খবর দেওয়া লাগবে। মেয়ের বাবা কি করে তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে। মেয়ের হলে লোক পাঠাতে হবে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নাজমা কলেজে গেছে। আমার করার মতন তেমন কিছুই নেই। আমি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অনিমা এখানে থাকতে ভালো হতো আজকের দিনটা ওর সঙ্গে কাটানো যেত। গতকালই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে অথচ মনে হচ্ছে কতদিন ওকে দেখি না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আমি নারিন্দা ছোটফুপুর কাছে চলে গেলাম। ছোট ফুপুর সাথে কথা বলে অবাক হলাম। অনিমার ব্যাপারে সবই জানেন। বুঝলাম নাজমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ছোট ফুফু সব শুনে আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে আমার সঙ্গেই থাকবেন। আমি একটু ভরসা পেলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। আমার মনের অস্থিরতা টের পেয়ে ফুপু আমাকে চট করে ছাড়লেন না, দুপুরে ভাত খাইয়ে তবে ছাড়লেন।

ছোট ফুপুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসে এলোমেলো হাঁটলাম। ভালো লাগছে না, ভীষণ অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে ওর হলের সামনে গিয়ে কল দিলে এখনই ও নেমে আসবে। একটুখানি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে আমি হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত চলে গেলাম। পুরনো বইয়ের মাঝে গেলে আমি সব সময়ই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি। বই দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল আমার কাছে তো ওদের সিলেটের নাম্বার আছে, একবার কি ফোন করে দেখব।
বেশি চিন্তা করলে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়না, তাই ঝটপটি একটা দোকান থেকে ফোন করে ফেললাম। ভাগ্য অত্যাধিক সুপ্রসন্ন হলে যা হয়, ফোনটা ওই ধরল। আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম
অনিমা
ও সঙ্গে সঙ্গে আমার কন্ঠ চিনতে পেরে বলল
তুমি কোথায়? ঢাকায় না চট্টগ্রামে ফিরে গেছো।
ঢাকায়। কাল পরশুর মধ্যেই ফিরে যাব। তুমি কেমন আছো বলো তো
ভালো
সত্যিই ভালো? আমার কেন মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ
মন তো খারাপই। আমার জন্য কত ঝামেলা হচ্ছে তোমার বলতো।পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। এটা আমি চাইনি কখনো।
ও হঠাৎ করে চুপ করে গেল। আমি টের পাচ্ছি ওর নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ, কোন কথা বলছে না, কাঁদছে নিঃশব্দে। আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আমি নরম গলায় বললাম
অনি, কি হয়েছে বলোতো
কিছু না আমি রাখি
আমার কথাটা একবার শোনো
বল
তুমি এত চিন্তা করো না। আমি বাসায় কথা বলেছি, একদিন দুই দিনের মধ্যেই আমি সব জানাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছো
ও কথার জবাব দিল না, শুধু বলল
কেউ একজন আসছে, রাখছি

ও ফোন রেখে দিল। আমার মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এসেছে। আমি পরপর কয়েকবার ফোন দিলাম, কেউ ধরলো না। ওখান থেকে বেরিয়ে কতক্ষণ এলোমেলো হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের ভেতর চলে গেলাম। বাইরে ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন কিন্তু আমার বুকের ভেতর বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনলাম আসরের আযান দিচ্ছে। নিউ মার্কেটের ভেতর একটা মসজিদ আছে আমি আগে জানতাম না। অনেকদিন পর আসরের নামাজ পড়লাম। সাধারণত এই সময় ল্যবে থাকি বলে মসজিদে যাওয়া হয় না। মনের অস্থিরতা অনেকটা কমেল। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম। হঠাত একটা শাড়ির দোকানে চোখ আটকে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে অনভ্যস্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। দোকানে তেমন ভিড় নেই, অল্প বয়সী একজন সেলসম্যান আগ্রহ নিয়ে অনেক শাড়ি দেখালো। একটা টুকটুকে লাল তাঁতের শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল। ওকে আমি কখনো শাড়িতে দেখিনি ভীষণ শখ ছিল দেখার, একবার ওকে বলেও ছিলাম। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আমি হলুদ পাড়ের লাল শাড়িটা কিনে ফেললাম। সত্যি সত্যি যদি আমাদের বিয়ে হয় তাহলে এটা ওকে উপহার দেব।

দোকান থেকে বের হতে হতে মাগরিবের আজান হয়ে গেল। আবারও মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারছি না। এতক্ষণ যে অস্থিরতা ছিল মনের মধ্যে হঠাৎ করেই সেটা কেটে গেল। এখানে বসে থেকে যেটা মনে হল যদি পরম করুনাময় চান তাহলে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন।

আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে আবার ওদের বাড়িতে ফোন দিলাম, এবার ফোনটা ধরলে অন্য একজন। আমি তার কণ্ঠস্বর চিনতে পারলাম না, তবে বুঝলাম এটা ওর বাবা কিংবা জাহেদ সাহেব নন। এর বাইরে আর কে হতে পারে। খুব সম্ভবত রাতুল।আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস না করেই বললাম
অনিমা কি আছে
আপু তো ঘুমাচ্ছে। আপনি কে বলছেন?
আমি সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম
তুমি কি রাতুল?
জি। আপনি কি মুনির ভাই
হ্য। কি অবস্থা বলো তো একটু
অবস্থা ভালো নয় ভাইয়া। আপনার আসা নিয়ে বাড়িতে যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছে। মা আর জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে মামার অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। মামা সম্ভবত আপনাকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন, তাই না?
হ্যাঁ
মা সেটা চাইছে না। তারা চাইছে এখনই বিয়েটা করিয়ে ফেলতে। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠান হবে।
এক মুহূর্তের জন্য আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। আমি কোনমতে বললাম
তারপর কি হয়েছে
মামা ওদের কথায় রাজি হয়নি। আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি মুনির ভাই। এবার যখন মামা অসুস্থ হয়েছিল আমি তার সঙ্গে হাসপাতালে ছিলাম। মামার শরীর ভালো নেই। এই মুহূর্তে যদি মামার কিছু হয়ে যায় তাহলে জাহিদ ভাই আর মাই কিন্তু আপুর লিগ্যাল গার্ডিয়ান। আপনার হাতে বেশি সময় নেই মনে হয়।
আমি হঠাৎ করে কোথা থেকে এতটা মনবল আর আত্মবিশ্বাস পেলাম জানি না, ওকে বললাম
তুমি আমার ফোন নাম্বারটা রাখো রাতুল। কোন কিছু হলে আমাকে জানিয়ো। আমি আগামীকালই একটা ব্যবস্থা করছি। আর ওকে বলো যেন দুশ্চিন্তা না করে আর নিজের খেয়াল রাখে।

রাতুল ছেলেটাকে আমার ভালো লাগলো। ছেলেটা বুদ্ধিমান এবং যথেষ্ট কেয়ারিং। আমি আমার চট্টগ্রামের ফোন নাম্বার আর আমাদের বাড়ির ল্যান্ডলাইনের নাম্বার দিয়ে ফোন রাখলাম। হাতে একেবারেই সময় নেই। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে খুবই দ্রুত।

চলবে…..

অনির

১৩

আমি বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যা পার করে। বাসায় ঢুকে রীতিমতো ধাক্কা লাগলো। ড্রয়িং রুমে অনেক লোকের সমাগম দেখা যাচ্ছে। ছোট চাচা এসেছেন। রাজশাহী থেকে এত দ্রুত কি করে এলেন সেটা একটা বিস্ময়। উনার উল্টো দিকে সোফায় কামাল ভাইকে দেখা যাচ্ছে। মামা বোধহয় কেবলই এসেছেন পাশেই লাগেজ রাখা। আমাকে ঢুকতে দেখে বাবা থমথম কন্ঠে বললেন
– কোথায় ছিলে সারাদিন? সকালবেলা অর্ধেক কথা বলে চলে গেলে । আমরা তো ভাবলাম আমার বউ নিয়ে ফিরবে নাকি

আমি জবাব না দিয়ে কোনার দিকে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসলাম। বোঝা যাচ্ছে আমি আসার আগে সবার মধ্যেই বেশ আলোচনা হয়ে গেছে। ছোটচাচা বয়সে সবার চেয়ে ছোট হলেও সাধারণত শেষ সিদ্ধান্তটা তিনিই নেন বা বলা ভালো তার পরামর্শই শেষ সিদ্ধান্তটা হয়। এই মুহূর্তে তার ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন। সম্ভবত সবাই তাকে নানান রকমের তথ্য দিয়েছে এখন সেই সবকিছুকেই একত্র করে আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। ছটচাচা শুরুটা করলেন এইভাবে
– তোমার কাছ থেকে কিন্তু আমরা এটা আশা করি নাই মুনির। বিয়ে করবে ভালো কথা, তাই বলে পড়াশোনাটা তো শেষ করবা, নাকি ওই মেয়ের বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে?

আমার মেজাজটা খারাপ হল। এরা নিজেদের মত করে গল্প বানিয়ে নিয়েছে এবং সেটাই সবাইকে বলছে। আমি সাধারণত কারো সঙ্গে রাগারাগি করিনা। এটা আমার স্বভাবেই নেই। আমি বললাম

– আমি জানিনা তুমি ঠিক কি শুনেছ, অনিমার সঙ্গে আমার পরিচয় এক বছর আগে। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে, আমার এক ব্যচ জুনিয়র। এই মুহূর্তে তোমাদের জানানোর আমার কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু রিসেন্টলি ওর বাবা স্ট্রোক করেছেন। ওরা …
মা আমার শেষ না হওয়া কথা কেড়ে নিয়ে বলল
তাই ওরা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, বুঝেছ কবির
এবার আমার মেজেজ সত্যি সত্যিই খারাপ হল। আমি বিরক্ত কণ্ঠে বললাম
– কেউ আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়নি। ওরা তো আমাকে চেনেই না। ওর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে ওরা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। ওর ফুপাতো ভাই বিসিএস ক্যডার। মার্চে বিয়ে। আমি ওর বাবাকে অনুরোধ করেছি যেন আমার ব্যপারটা কনসিডার করে। কাজেই বুঝতেই পারছ এখানে চাপ দেয়ার কিছু নাই।

ছোট চাচাকে এবার বেশ চিন্তিত দেখাল। বললেন
তা ওর বাবা কি বলল?
বললেন আমি এখন এত দায়িত্ব নেবার জন্য প্রস্তুত নই। তাঁর মতে আমাদের উচিত সবটা এখেনেই শেষ করে ফেলা।
কামাল ভাই অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলার জন্য ছটফট করছিল এবার আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল
আমার তো মনে হয় উনি ঠিক কথাই বলসে। এখন বিয়া করলে বউকে খাওয়াবে কি?

আমার মেজাজটা এবার প্রচন্ড খারাপ হল। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই ছোট ফুপু বললেন
এই কথা বলা তো তোমার মানায় না কামাল। তুমি তো মেট্রিক ফেল করে পালায়া বিয়া করসিলা। এখন তিন বাচ্চার বাপ, এখনো তো কিছু করো না, বাড়িতে বইসা খাও।
ছোট ফুপু যেন জোকের মুখে লবন দিয়ে দিলেন। কামাল ভাই তিলবিলিয়ে উঠলেন

বাড়িতে বইসা খাই মানে কি? এত বড় বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করা কি কোন কাজ না?
ছোট ফুপুও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়, তেড়ে উঠে বললেন
স্বীকার করো তাহলে যে এত বড় সম্পত্তি। সারাক্ষণ তো খালি গলা শুকাও বলো তোমাদের নাকি যা দেওয়া হয়েছে তাতে চলে না। তা নিজের সম্পত্তি দেখাশোনা করো অন্যেরটার উপর চোখ দিতে যাও কেন?
দেখলেন দেখলেন মামা, কথায় কথায় কথায় খালি আমারে খোটা দেয়। আজকে আপনারা এর একটা বিহিত করবেন।
রেহানা ফুপু এবা্র তেতে উঠে বললেন
ওনারা কি বিহিত করবেন, তারা তো নিজের নিজের অংশ নিয়ে সড়ে পরেছেন। এই কথাটা বোধহয় ছোট চাচার গায়ে লাগলো। উনি বললেন
সড়ে পড়েছি এটা কি ধরনের কথা রানু? তোমাদেরকে বসতবাড়ি ছেড়ে দিয়েছি কয়জন ভাই এমন করে? এখন তোমরা দুজন একটু মানিয়ে নিতে পারছ না এটা কি আমাদের দোষ?

নিজেরা তো ঠিকই আলাদা আলাদা করে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিয়েছ আমাদেরটা এরকম প্যাচ লাগানোর কি দরকার ছিল?
বাবা বেশ বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন
আহ! রানু, কামাল কি শুরু করলি তোরা
কামাল ভাই ও সুযোগ পেয়ে বলল
মামা আমি কিন্তু কিছু শুরু করি নাই। খালা সবসময় এই কামটা করে। বড় মামা আপনি এইটার আজকে একটা বিহিত করেন, সব সময় এই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। কাজও করি আবার কথাও শুনি
ফুপুর গলা এক পাল্লা চড়ল
ও তাই নাকি কাজ করিস? তা কি কাজ করিস শুনি? যা না কাজ করিস তার থেকে তো অন্যের সম্পত্তি ভোগ করতে সময় চলে যায়

ছোটখালা আপনে বড় তাই কিছু বলতেসি না। আম্মা থাকলে বুঝায়া দিত……
কি বুঝায়া দিত শুনি? তোর মাকে ভয় পাই নাকি আমি?

কেমন একটা হট্টগোল বেঁধে গেছে। আমি দিশেহারা বোধ করছি। কোথাকার কথা কোথায় চলে যাচ্ছে। বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা বাজছে। নাজমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরল। তারপর রিসিভার ফোনের পাশে রেখে আমাকে এসে বলল
ভাইয়া তোমার ফোন
কে?
জানিনা
আমার এই মুহূর্তে ফোন ধরে কথা বলে সময় নষ্ট করার এতোটুকুও ইচ্ছা নেই। এই পরিস্থিতি কি করে সামলাবো সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি নাজমা কে বললাম
নাম, ফোন নাম্বার লিখে রাখ, আমি পরে ফোন দিবো
নাম বলেছে রাতুল, বলল আর্জেন্ট
আমি ভীষণভাবে চমকে গেলাম। রাতুলের সঙ্গে আমার বিকেল বেলা কথা হয়েছে তখনই আমি ওকে নাম্বার দিয়ে বলেছি যে, কোন ইমার্জেন্সি হলে যেন আমাকে ফোন করে। তারমানে নিশ্চই কোন সমস্যা হয়েছে? খারাপ কিছু হয়নি তো? আমি ছুটে গিয়ে ফোন ধরলাম। রাতুল আমাকে সালাম দিল বলল
মুনির ভাই
কি অবস্থা রাতুল, সব ঠিক আছে?
না
কি হয়েছে?
যেটা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। মামার শরীরটা খারাপ করেছে। ব্লাড প্রেসার হাই
হাসপাতালে নিতে হবে?
বুঝতে পারছি না ভাইয়া।
রাতুল স্বগোতোক্তির মতন বলল
মা আর ভাইয়া যে কেন এমন শুরু করেছে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না

আমি সামনের দিকে তাকালাম। আমার সামনে মঞ্চস্থ নাটকের দৃশ দেখতে দেখতে ওইদিককার পরিস্থিতি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। জাগতিক বিষয় সম্পত্তির কাছে মানুষের আবেগ, বিবেক, অনুভূতি এমনকি প্রয়োজনও হার মানে॥ জাহিদের সঙ্গে এখন অনিমা্র বিয়েটা হলে ওদের পুরো সম্পত্তি জাহিদের হাতে চলে যাবে। এই কারণে তারা কোনভাবেই অনিমাকে হাতছাড়া করতে চাইছে না

মুনির ভাই আপনি শুনতে পাচ্ছেন? রাতুল তাড়া দিল
আমি ধীরে ধীরে বললাম

আমি বুঝতে পারছি। তুমি চিন্তা করো না আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফোন করব।
আমি ফোন রেখে এগিয়ে গেলাম। তখনো সবার মধ্যে উচ্চস্বরে বাক-বিতণ্ডা চলছে। আমি সাধারণত উচু গলায় কথা বলি না। আজ বলতে বাধ্য হলাম॥ বাবা কে উদ্দেশ্য করে বললাম
বাবা আমি একটু আপনার সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই, এখানে মনে হচ্ছে অন্য কোন কিছু নিয়ে আলোচনা চলছে
কথায় কাজ হল কামাল ভাইয়ের তেমন কোন ভাবান্তর না হলেও রানু ফুপু খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন। সকাল থেকে আমি তার ওখানেই ছিলাম। আমি কতটা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি তা উনি খুব ভালো করেই জানেন। রানু ফুপু উঠে এসে আমাকে হাত ধরে টেনে সোফায় বসালেন। বললেন
এসব নিয়ে পরে কথা হবে, আপাতত ওর বিয়ের কথাটা ঠিক হয়ে যাক
ছোট চাচা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন
হ্যাঁ সেটাই ভালো। আমাকে সকালের বাসও ধরতে হবে। তোমার কি বলার আছে বল মুনির।
আমি দম নিয়ে বললাম
অনিমার বাবার শরীর ভালো নেই॥ ওর বড় ফুপু বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। এই মুহূর্তে উনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না
ওর কি আর কোন ভাই বোন নেই? ছোট চাচা জানতে চাইলেন
না, ও একমাত্র সন্তান
আর ওর এই বড় ফুপু কোথায় থাকে?
একই বিল্ডিঙই থেকে, দোতালায়
বাবা মা দুজনেই এই কথা শুনে বেশ অবাক হলেন
আসলে, বাড়িটা অনিমার দাদার দুটো ফ্লোর ওদের আর বাকি দুটো দুই ফুপুর।

একথা শুনে বাবা আর মায়ের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় আমার চোখ এড়ালো না।
বাবা বললেন বাড়িটা যেন কোন এলাকায় বলছিলে
আমি এলাকার নাম বললাম। জায়গাটা সিলেটের শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বাবার মুখভঙ্গি দেখলাম একটু শিথিল হল, তবু কথা শোনাতে ছাড়লেন না। বললেন
তা এখন কি করতে হবে আমাদের?
আপনি ফোনে ওর বাবার সঙ্গে একবার কথা বলুন॥ উনাকে জানান যে আমরা সামনে সপ্তাহে আসতে চাই
সামনের সপ্তাহে?
জি আমরা সিলেটে গিয়ে ওনাদের বাসায় কথা বলব। ছোটচাচা আপনি কি আমাদের সঙ্গে যাবেন?
যেতে তো চাই কিন্তু মনে হয় না এবার পারব। রানু তুমি চলে যাও
রানু ফুপু বলবেন
ঠিক আছে আমি চলে যাব
কামাল ভাই ফট করে বলে বসলেন
আম্মা হয়তো যাইতে পারবে না তবে আমার যাইতে কোন সমস্যা নাই
জবাবটা আমিই দিতাম তবে তার দরকার পড়লো না ফুপু বললেন
– এত মানুষের যাওয়ার দরকার নাই। বেশি মানুষ গেলে বিয়ায় ভাঙানি পরে। ভাইজান আপনি ভাবি আর আমার সঙ্গে আলিফের আব্বা যাক। আপনারা কি বলেন?
প্রস্তাবটা আমার পছন্দ হলো। আলিফের আব্বা মানে ছোট ফুপা। উনি বেশ গোছানো মানুষ, কথাবার্তায় যথেষ্ট সংযত। কামাল ভাই গেলে যে একটা ঝামেলা হত এতে কোন সন্দেহের কোন অবকাশ নেই
সকলেই সম্মত হল। বাবা অনিমার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। দুই পক্ষই জানে যে তাদের মতামতের এখানে বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। পরস্পরের সম্মান রক্ষা করে কথাবার্তা শেষ করাটাই যেন প্রধান লক্ষ্য ছিল। আমার পরীক্ষা এসে গেছে, সামনে সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেকটা সময় নষ্ট হবে এই ব্যাপারটা আমার বাড়ির কেউ না বুঝলেও আশ্চর্যজনকভাবে অনিমার বাবা বুঝলেন, কিংবা হয়ত তার দিক থেকেই কোনরকম তাড়া ছিল॥ উনি আমাদের পরের দিনই আসতে বললেন।

আমাদেরকে ওদের বাড়িতে থাকতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিন্তু বাবা রাজি হলেন না। আমরা হোটেলে উঠলাম। পরদিন তাদের আতিথিয়তা গ্রহণ করে সন্ধ্যা বেলা কথাবার্তা ফাইনাল করেই ফিরে এলাম। বলতে দ্বিধা নেই রানু ফুপু আর ফুপা থাকায় সবকিছু অনেক সহজ হয়েছে, তা না হলে বাবা-মা তাদের অসন্তোষটা লুকিয়ে রাখার কোনরকম চেষ্টাই করেননি বরং বলা ভালো প্রকাশ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন॥

ওদের বাড়িতে মেয়ে বলতে শুধুমাত্র অনিমা আর ওর বড় ফুপু। যেহেতু তাদের সঙ্গে একটা ঝামেলা চলছে কাজেই তাকে আশেপাশে খুব একটা দেখা গেল না। একবার আমাদের সঙ্গে এসে বসলেন তারপর খাওয়া দাওয়ার কথা বলে উঠে চলে গেলেন।

অনিমা ঘরে এলো আরো কিছুক্ষণ পরে, মজার ব্যাপার ওকে ঘরে নিয়ে এলো রাতুল। সেদিন আমি প্রথম ওকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলাম। কমলা রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। মা নেই তাই কেউ একটু সুন্দর করে কুচিগুলো ধরে দেয়নি। যত্ন করে চুল আছড়ে, ঘোমটায় একটা পিন আটকে দেবার কথাও হয়তো কারো মাথায় আসেনি। বারবার মাথা থেকে আঁচল পড়ে যাচ্ছে॥ ওকে দেখে আমার অদ্ভুত রকমের মায়া হল। কোন সাজসজ্জা ছাড়াই ওকে অসম্ভব স্নিগ্ধ লাগে। আজ হয়ত ইচ্ছে করেই একটু সেজেছে। ঠোঁটে লিপস্টিকের ছোঁয়া, চোখে কাজল সাড়ির সঙ্গে পুরনো দিনের সোনার গয়না॥ বোঝা যায় ওর মায়ের॥ হয়তো মায়ের স্পর্শটুকু কিছুক্ষণের জন্য ধরে রাখতে চাইছিল। হাসান সাহেব মেয়েকে পাশে বসিয়ে বললেন
ও আমার একমাত্র সন্তান আমার যা কিছু আছে সবই ওর। ভাই সাহেব আমরা শুধু চাই ওর পড়াশোনাটা যেন কমপ্লিট হয়
বাবা বললেন
জ্বী ভাই কোন চিন্তা করবেন না। আমরা শিক্ষিত পরিবার।
মা শুধু একবার জিজ্ঞেস করল কি সাবজেক্টে পড়ো
অনিমা মাথা নিচু করেই বলল
জি বাংলায় অনার্স করছি
মা জবাবে কিছু বলল না, তবে তার মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা গেল যে তিনি রীতিমতন অসন্তুষ্ট

সামনের সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক হল। আমার পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু উনি পারছেন না এ কথা বলে অনিবার বাবা বেশ আফসোস করলেন। বললেন তার শরীরের অবস্থা ভালো না॥ কবে কি হয় উনি কিছুই বলতে পারেন না তাই যা করার দ্রুত করে ফেলাই ভালো॥

আমি জানি ঢাকায় ওদের তেমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই, এত অল্প সময়ে কোন সেন্টার খুঁজে পাওয়াটা খুবই মুশকিল এই নিয়ে রাতুলের সঙ্গে আমার আলাদা একটু আলোচনা হলো ॥ রাতুল আসলেই খুব বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী ছেলে।ঠিক হল অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে ও আর অনিমা ঢাকায় চলে যাবে১। ওর বাবা আসবে বিয়ের একদিন আগে। আমি আর রাতুল মিলে সেন্টার ঠিক করলাম।

এই পর্যায়ে এসে একটা ব্যাপার দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি করে সামাজিকতার সামনে সম্পর্ক এমনকি সাধারণ চক্ষু লজ্জাও তুচ্ছ হয়ে যায়। বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন এই মুহূর্তে কোন অনুষ্ঠান করা, মানে বৌভাত করা তার পক্ষে সম্ভব না। আত্মীয়-স্বজনদের উনি এখন কিছুই বলতে পারবেন না। তাছাড়া প্রস্তুতি দেওয়ার মতন যথেষ্ট সময়ও নেই। শুধুমাত্র বিয়ের অনুষ্ঠানটাই হবে সে ক্ষেত্রেও মেয়েকে আমাদের পক্ষ থেকে কিছুই দেয়া হবে না। মা ও সে কথায় সম্মতি দিলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সারা জীবন মায়ের কাছে শুনে এসেছি আমার বউকে জন্য তার কত কি দেবার আছে। কত বিশেষ উপহার তোলা আছে, অথচ মা ও এখন বাবার সঙ্গে একমত। জীবনে প্রথমবারের মতন আমি উপার্জনক্ষম নই বলে বড্ড অনুশোচনা হল।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে