অনির পর্ব-১১

0
11

অনির

একাদশ পর্ব

অনিমার বাবা রাজী হলেন না। আমি এক বছর সময় চেয়েছিলাম উনি নানান যুক্তি দিয়ে আমাকে বোঝালেন যে কেন সেটা সম্ভব নয়। আমি তাঁর কোন যুক্তিই ফেলে দিতে পারলাম না। নাস্তা শেষে ড্রয়িং রুমে বসে চা খেতে খেতে উনি বললেন

দেখো মুনির, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি যদি আরেকটু এডভান্স পজিশনে থাকতে, আমি কখনো তোমাকে মানা করতাম না। একটা কথা তুমি চিন্তা করে দেখো, তোমার এখনো অনার্স কমপ্লিট হয়নি, আরো এক বছর বাকি; এরপর মাস্টার্স এবং থিসিস মিলিয়ে আরও এক থেকে দেড় বছর তারও পরে তুমি পি এইচ ডি করতে যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পিএইচডির ব্যাপারে অভিজ্ঞ তাই বলতে পারি পিএইচডির করতে তুমি তোমার ফ্যামিলি নিয়ে যেতে পারবে না, সে পরিমাণ ফান্ডিং অ্যাপ্রুভ হওয়া খুবই বিরল। ধরে নিচ্ছি তুমি একাই যাবে, সেখানে আরো পাঁচ বছর। এই সাত আট বছর আমার মেয়েটার কি হবে। সেটাও মেনে নিতাম যদি আমি সুস্থ থাকতাম। সব কথা আমি অনিমাকে বলি না। এমনিতেই ওর মা চলে যাবার পর মেয়েটা খুব মনমরা হয়ে থাকে। আমার হাতে এতো সময় নেই। আমি ওকে এরকম একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যেতে পারি না।

আপনি কি চাইছেন এই জানুয়ারি মাসেই বিয়ে হোক?
আমার সেই রকমই পরিকল্পনা
যদি জানুয়ারিতেই আমি বিয়েটা করি তাহলে কি আপনি রাজি হবেন?
টেকনিক্যালি আমার রাজি হওয়া উচিত না, কারণ সমস্যাগুলো কিন্তু জানুয়ারিতে বিয়ে হলেও থেকেই যাচ্ছে
আমার সঙ্গে বিয়ে না হলেও তো মাস্টার্স শেষ হওয়া পর্যন্ত ও হলেই থাকবে, তাই না?
সেটাই তো থাকা উচিত
সেই ক্ষেত্রে তো এখনো দুই বছর সময় আছে আপনি যদি চান বিয়েটা জানুয়ারিতেই হবে। আর পি এইচ ডির ব্যাপারে যেটা বলছেন, আমি যদি ওকে নিয়ে যেতে না পারি তাহলে আমি পিএইচডি করবো না দেশেই ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করব
আমি তাকিয়ে দেখলাম ওনাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। তর্জনী দিয়ে নিজের চিবুক ঘষতে ঘষতে বললেন
এখানেও কিন্তু সমস্যা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
কি সমস্যা
আমি নিশ্চিত তুমি তোমার পরিবারের সঙ্গে এখনও কথা বলোনি। উনাদের রাজি না হওয়ার খুব হাই পসিবিলিটি আছে।
এত বিপদের মধ্যেও আমি হেসে ফেললাম, উনার কথাটা একেবারেই ভুল নয়।
উনি নিজেও হাসলেন, বলেনন
দেখলে তো, আমি ঠিকই ধরেছি। সত্যি কথা বলতে তোমার বাবা-মায়ের জায়গায় আমি হলেও খুব বিরক্ত হতাম। তোমার এত চমৎকার রেজাল্্‌ এত ব্রাইট ফিউচার সামনে, এসব ফেলে এই মুহূর্তে বিয়ে করাটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আমি আপনাকে একটা কথা সত্যি করে বলি?
বল
ভালো রেজাল্ট কিংবা ব্রাইট ফিউচার এর জন্য একটা মিনিমাম মেন্টাল স্ট্যবিলিটির দরকার হয়। এই মুহূর্তে যদি ওর বিয়েটা অন্য জায়গায় হয়ে যায়, আমি হয়তো আর পড়াশোনাই কন্টিনিউ করতে পারবো না।
এবার উনাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। উনি বললেন
তোমরা তো পরস্পরকে চেনো এক বছর ধরে তাই না?
জি
এর মধ্যে কয় বার তোমাদের দেখা হয়েছে?
চার বারের মতন
এত অল্প সময়ে কোন সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমার ধারণা এই সাময়িক আবেগ তোমরা কাটিয়ে উঠতে পারবে

আমি খুব ধীরে ধীরে টের পাচ্ছি যে আমি পরাজিত হচ্ছি, পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে শুধু হাতের তরবারি খসে পড়া বাকি।
আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম
পারতাম, যদি আবেগটা সামরিক হতো।
আমি অনিমার কাছে তোমার ব্যাপারে যতটুকু শুনেছি তুমি খুবই রেস্পন্সিবল এবং প্র্যাকটিকাল একটা ছেলে। আমার মনে হয় একটু চেষ্টা করলেই তুমি তোমার ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে পারবে। সব দিক দিয়ে এটাই ভালো হবে যে তোমরা পরস্পরের সাথে আর যোগাযোগ না করো।

এবার আমার নিজেকে সম্পূর্ণই পরাজিত মনে হল। আক্রমণাত্মক তো দূরে থাক রক্ষণাত্মক অবস্থানেও আমি আর নেই, শুধু শেষ আঘাতটার অপেক্ষা, তারপরে হয়তো হাতের তরবারি খসে পড়ে যাবে আর আমি পুরোপুরিভাবে পরাস্ত হব। এই মুহূর্তে গা ছাড়া দিয়ে ওঠে না দাঁড়ালে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আমি নিজের শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে বললাম
আপনি কিন্তু শুধু আমার কথা ভাবছেন, ওর কথা একবারও ভাবছেন না
হাসান সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত হলো। উনি বললেন
কিরকম
আপনি যদি এখন রাজি না হন তাহলে আমার জীবনে বিশেষ কোন পরিবর্তন আসবে না কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য একজনকে মেনে নেওয়াটা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। আপনি জানেন ও খুব সেনসিটিভ, নরম মনের এবং আবেগপ্রবণ একটা মেয়ে। ওর ফিউচার সিকিউর করতে গিয়ে ওর কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না তো।
উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন
মাত্র চার বার দেখায় ওকে এতখানি জানা, আমাকে বেশ অবাক করছে।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম
আসলে আমরা গত এক বছর ধরে কন্টাক্ট এ আছি। আপনি হয়তো জানেন না আমরা একজন আরেকজনকে চিঠি লিখছি প্রায় বছর খানেক ধরে। মানসিকভাবে আমরা পরস্পরের প্রতি অনেকখানি নির্ভরশীল, এই মুহূর্তে এইরকম একটা পরিস্থিতির জন্য আমাদের দুজনের কেউই প্রস্তুত নই।
হুম
আমি আবারো বললাম
আপনার কাছে আমি একটা অনুরোধ করবো, আমাকে একটু সময় দিন। আমি আমার ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি।

তোমার মনে হয় জানুয়ারিতে বিয়ের ব্যাপারে তোমার ফ্যামিলি রাজী হবে?

জি
তুমি নিশ্চিত? তারা রাজি না হলে কিন্তু আমি কিছুই করতে পারবোনা
আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন, শুধু আমাকে একটা কথা দিন জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত আপনি আমাকে সময় দেবেন। আমি পরীক্ষাটা শেষ করেই আমার ফ্যামিলিকে নিয়ে আসব।
তোমার সামন পরীক্ষা? হাসান সাহেব বেশ অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
জি সামনে্র সপ্তাহ থেকে শুরু হবে
এই অবস্থায় তুমি পড়াশোনা ফেলে এখানে এসেছ?
আমার আর কোন উপায় ছিল না। না এলে আমি পড়াশোনা করতে পারতাম না
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো কিন্তু তারপর আর নয়
ধন্যবাদ আঙ্কেল
আমি উঠে দাঁড়ালাম। উনি অবাক হয়ে বললেন
তুই কোথায় যাচ্ছ ?
আমি আজ আসি। আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। যাবার আগে কি একবার ওর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
হাসান সাহেব হেসে ফেললেন, বললেন
তুমি এত ব্যস্ত কেন, আমি তোমাকে বিকেলের ট্রেনে উঠিয়ে দেবো। তুমি দুপুরে খেয়ে তারপর যাবে।
জি আচ্ছা
তুই তো চা ও খাওনি। বসে, চা টা শেষ কর
আমি কিছু বললাম না তবে বসলামও না। উনি কি ইচ্ছা করেই দেখা করার বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন?
আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন
অনিমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ছাদে চলে যাও। তোমার চা না হয় ওখানে পাঠিয়ে দেবো।
এতটা অবশ্য আমি আশা করিনি। ছাদের সিঁড়িটা আগেই দেখেছিলাম, উঠে গেলাম তবে ছাদের দরজার দাড়িয়ে একটু ধাক্কা লাগলো। অনিমা দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে তার পাশে আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে, শক্তপোক্ত গড়ন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। অনিমা আমার দিকে পিছন ফিরে থাকায় আমাকে দেখতে পায়নি। আমি ওদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছি।
ভদ্রলোক বলছেন
রাতের বাসে ওই ছেলের সঙ্গে এসেছিস শুনে মা একটু আপসেট হয়েছে। তুই একটু কথা বলে নিস
আমি শুধু রাতের বাসে ওর সঙ্গে আসিনি আগের দিন চট্টগ্রামে ওর হলেও গিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাও একসঙ্গে এসেছি
ভদ্রলোক কাধ ঝাকিয়ে বললেন
আমাকে এসব করে কোন লাভ নেই। আমার এই সবে কোন সমস্যা নেই। বিয়ের আগে এমন থাকতেই পারে, আমারও আছে
আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না এ কথা জানার পরও বারবার তুমি একই প্রসঙ্গ কেন তুলছো
কারন তোর আর কোন অপশন নেই। মামা ওই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়েতে কিছুতেই মত দেবে না
বাবা ওর সঙ্গে বিয়েতে মত দেবে কি দেবে না আমি জানিনা তবে আমি তোমার সঙ্গে বিয়েতে মত দেব না
ভদ্রলোক শব্দ করে হাসছেন, তার হাসিটা আমার ভালো লাগছে না, এভাবে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনতেও ভালো লাগছে না। আমি দরজার মৃদু করাঘাত করে বললাম
ভেতরে আসতে পারি?
উনি আমাকে দেখে একটু চমকালেন তবে সেটা সেই ভাবে প্রকাশ করলেন না। কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
আমি জাহিদ। তুমি নিশ্চয়ই মুনির। কিছু মনে করো না তুমি বললাম। তুমি আসলে আমার অনেক জুনিয়র হবে
না কিছু মনে করিনি, ভালো আছেন আপনি?
হ্যাঁ, ভালো আছি। তোমাকে একটা কথা না বলে পারছি না। অনিমার কাছে তোমার কথা শুনেছি তবে তোমাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না যে তুমি এতটা হ্যান্ডসাম। এজন্যই বোধহয় আমিনা তোমার প্রেমে পড়েছে
জাহিদ ভাইয়ের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও হাসছে। আমাদের দৃষ্টি বিনিময়ে কোন কথা না বলেও আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেল। আমাদের এই অব্যক্ত কথোপকথন বোধহয় তার ভালো লাগলো না। তিনি বললেন
তোমরা কথা বলো আমি আসছি।
উনি চলে যাবার পর অনিমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
বাবা কি বললেন
জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন এর মধ্যে আমি বাসায় কথা বলব
তোমার পরীক্ষার আগে অনেক ঝামেলা হয়ে গেল, তাই না
আমি ওর কথার জবাব দিলাম না। ওর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম
সাবধানে থেকো। আমি খুব তাড়াতাড়ি আসবো, তোমাকে নিয়ে যেতে। ততদিন অপেক্ষা কর।
সাড়ে বারোটার বাসে আমি ফিরে এলাম। ওর বাবা নিজেই আমাকে বাসে তুলে দিলেন। ফেরার আগে ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে কেবল একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম। আমি জানতাম ও ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে, বাগান বিলাসের ঝাড়ের আড়ালে একবার দেখলাম ও হাত তুলে চোখ মুছছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যদি ও তখন জানতাম না যে বাড়ি ফেরার পর মন আরো খারাপ হবে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে