সপ্তম পর্ব
ভেবেছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করে ফিরলে মনের অস্থিরতা কমবে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারব কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টোটা। পড়ায় মন বসে না, ল্যবওয়ার্কের সময় আনমনা হয়ে যাই। চোখ মেলে ওকে দেখতে ইচ্ছে করে আর চোখ বন্ধ করলে ওর নিটোল মুখটা ভেসে ওঠে।
এইভাবে আর কতদিন চলবে জানি না। যেদিন ওর চিঠি আসে সেদিন অসহ্য রকম ভালো লাগার মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে যেদিন আসে না তীব্র অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসে। আমি চিঠিতে ওকে লিখেছিলাম সেকথা। ও বারবার বলেছে লম্বা চিঠি লিখে সময় নষ্ট না করতে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে। প্রয়োজন হলে ও প্রতিদিন চিঠি পাঠাবে। আমি চেষ্টা করেও সেটা করতে পারছি না। চিঠি লিখতে বসলে রাজ্যের কথা মাথায় এসে ভিড় জমায়। আমি চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারি না।
আমার অবস্থা দেখেই কিনা জানিনা ও প্রতিদিন চিঠি পাঠানো শুরু করল। আমার মন তবু শান্ত হলো না, ইচ্ছা করে ও পাশে এসে বসু্ক, অবিরাম কথা বলুক, হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ুক। আমিও সেই হাসি দেখি দুচোখ ভরে।
এর মধ্যে দুটো ঘটনা ঘটলো। দুটো পাবলিকেশনে আমার নাম গেল। চেয়ারম্যান স্যার আমাকে আরো কিছু নতুন কাজে্র দায়িত্ব দিলেন। সবমিলিয়ে ব্যস্ততা এত বেশি যে নিজেকে দেবার মতন সময় টুকুও পাই না।
দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস চলে এলো। ভাবলাম ওর জন্মদিনের একদিন আগেই চলে যাব। ওকে চমকে দেবো, কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা যে কত বড় ভুল ছিল সেটা ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।
এবার আমাকে আসতে দেখে বাড়ির লোকেরা খুব অবাক হলেন। প্রথমত, কদিন আগেই ঘুরে গেছি, তার উপর আবার খবর দিয়ে আসিনি। আমি অবশ্য ইচ্ছা করেই জানিয়ে আসিনি, জানালে হয়তো সবাই আসতে নিষেধ করত। আমি আসার কোন বিশ্বাসযোগ্য কারণ তাদেরকে বলতে পারতাম না। প্রচুর কাজ ফেলে এসেছি তাই বেশি দিন থাকবো না। ওর সঙ্গে একটা সুন্দর দিন কাটানোর আশাতেই চলে এসেছি।
তখন আমার কোন সেল ফোন ছিল না, বাড়িতে একটা ল্যান্ডলাইন ছিল সেটা থেকেই চেষ্টা করলাম অনিমার সঙ্গে যোগাযোগ করার। ফোনে কেউ ওকে দিতে পারল না, বাধ্য হয়ে বিকেল বেলা আমাকে ওর হলে চলে যেতে হল।
চারটা নাগাদ ওর হল এর কাছে পৌঁছে ভিতরে কল পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে করতে মনে হচ্ছিল কি জানি কত হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছি। আমি ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে চারটা বেজে গেছে। আসলেই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। এর আরো অনেকক্ষন পরে ছোটখাটো একটা মেয়ে বেরিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনি কি অনিমা আপুর কাছে এসেছেন?
– হ্যাঁ ওর কাছেই এসেছি, ও কোথায়?
মেয়েটা এমন জুলজুলে চোখে তাকিয়ে রইল যে আমার নিজেরই অস্বস্তি লাগতে লাগলো। খানিক সময় পর ও বলল
– আপনি কি মুনির ভাই?
– হ্যাঁ আমিই মুনির
– আপনাকে দেখার আমার খুব শখ ছিল। আপনি তাহলে সেই, যার জন্য আপু রাত জেগে জেগে চিঠি লেখে
আমি একটু লজ্জা পেলাম, বললাম
– ও কোথায়, ওকে একটু ডেকে দেবেন প্লিজ
মেয়েটা মন খারাপ করা গলায় বলল
– আপু তো আজ সকালের ট্রেনে সিলেট চলে গেছে। আপনি কি খবর দিয়ে আসেন নি?
– না আসলে ওকে জানিয়ে আসা হয়নি, তবে সিলেটে যাওয়ার ব্যাপারটা জানতাম না। আপনার কাছে কি ওখানকার ফোন নাম্বার আছে কিংবা ঠিকানা?
মেয়েটা মন খারাপ করা গলায় বলল
– না ভাইয়া, থাকলে অবশ্যই দিতাম
– আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ
আমি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলাম। বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল আমি ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে আসার কথাটা জানাইনি ও নিশ্চয়ই আমাকে ওর সিলেট যাওয়ার কথাটা জানিয়েছে চিঠিতে। সেইসব চিঠি নিশ্চয়ই এখন আমার ঘরে টেবিলের উপর পড়ে আছে একা একা। কি জানি কেন হঠাৎ করে চিঠিগুলোর জন্য আমার মন কেমন করে উঠলো, ইচ্ছে হলো এক ছুটে চলে যাই।
আমি আসায় বাড়ির লোকেরা যতটা না অবাক হয়েছিল এত দ্রুত ফিরে যাচ্ছি শুনে অবাক হলে তার থেকেও বেশি।সত্যি বলতে আমার আর থাকতে ইচ্ছা করছিল না। আমি পরদিন সকালেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিলাম। যেদিনটা আমাদের একসঙ্গে স্মরণীয় করে রাখার কথা ছিল সেই পুরো দিনটাই কাটলো আমার ট্রেনে।
আমি হলে পৌঁছালাম সন্ধ্যা পার হয়ে যাবার পর। যা ভেবেছিলাম তাই ওর দুটো চিঠি আমার টেবিলের উপর নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে।
চিঠিগুলো পড়ে আমার ভারাক্রান্ত মন আরো ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। প্রথম চিঠিটা অনেক বড়। চিঠি ভর্তি নানান মন খারাপের কথা লেখা। ও লিখেছে ওর বাবার শরীর ভালো নেই। আরো লিখেছে পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি। পরের চিঠিটা লিখেছে সিলেট থেকে। ওখানকার ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়েছে তবে নিষেধ করেছে চিঠি পাঠাতে কিংবা ফোন করতে। আমি ওর নিষেধ অগ্রাহ্য করেই ফোন করলাম। ঠিক করলাম ও ছাড়া অন্য কেউ যদি ফোন ধরে তাহলে রেখে দেবো। প্রতিবারই ফোন ধরল অন্য কেউ। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমি বাধ্য হয়ে হিয়ার শরণাপন্ন হলাম।
হিয়া আমার ক্লাসমেট। আমাদের ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবে যে কজন আছে তাদের মধ্যে হিয়া অসম্ভব আন্তরিক একটা মেয়ে। আন্তরিক বললে কম বলা হবে, ওর মতো উপস্থিত বুদ্ধি আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। মজার মজার কথা বলে মানুষকে চমকে দিতে ও ভীষণ ভালোবাসে। প্রথম দিকে এই কারণে ওকে সবাই ভুল বুঝলেও পরে সবাই বুঝতে পেরেছে ওর মনটা আসলে খুবই ভালো। হিয়ার বাড়িও ঢাকায়। আমার মত ও এখানে হলে থাকে। আমি কল দিলে ও নেমে এসে ভুরু নাচিয়ে বলল
– কি ব্যাপার? প্রফেসর সাহেব আজকে এখানে যে
প্রফেসর উপাধি আমি পেয়েছিলাম সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরপরই। থার্ড ইয়ারে উঠার পর আরো উন্নতি হয়েছে। এখন সবাই প্রফেসর মুনির না বলে আমাকে ডঃ মুনির বলে ডাকা শুরু করেছে। আমি রাগ করি না, হাসি। মনে মনে ভাবি ওদের এই রসিকতা যেন একদিন সত্যি হয়।
হিয়াকে সবটা বলার পর ওর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কাটতে একটু সময় লাগলো। তারপর ও যথাসাধ্য চেষ্টা করল আমাকে সাহায্য করতে। বার ফোন করার পরও লাভ হলো না। ওকে পাওয়া গেল না। এরপর হিয়া অন্য পথ ধরল। ওর বান্ধবী সুমি নাম করে যে ফোন ধরল তাঁর কাছ থেকে নানান কথা বের করে নিয়ে আসলো। বেশ কিছু অজানা তথ্য জানলাম যার কোনটাই ভালো লাগলো না। ওর বাবার স্ট্রোক করেছে। এর আগেও একবার মাইল্ড স্ট্রোক করেছিল, এটা দ্বিতীয়বার। বুঝলাম কেন ও ফোন ধরছে না কিংবা চিঠি লিখতে পারছে না। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, এরকম একটা সময়ে আমি ওর পাশে থাকতে পারছি না। ও আমাকে সবসময়ই বলত, ওর মন খারাপ হলে কিংবা কষ্ট হলেও ওর আমার কথা ভীষণ মনে পড়ে। আমার ইচ্ছা হল ছুটে চলে যাই ওর কাছে। ওর হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকি কতক্ষণ। আমার সেই ইচ্ছাটা যে এমন ভাবে পূরণ হবে সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি।
চলবে………