অনির পর্ব-০৫

0
22

পঞ্চম পর্ব

আমি ঢাকা পৌছালাম শুক্রবার সকালে। ছুটির দিন বলে সবাই বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে বাবা-মা দুজনেই ভীষণ খুশি হলেন। এভাবে কোন খবর না দিয়ে আমি আগে কখনো আসিনি। বাবার প্রথম কথাই হল এসেছি যখন বেশ কয়েকদিন থেকে যেতে। আমি কিছু বললাম না। সত্যি কথা বলতে আমি শুধু ওর সঙ্গে দেখা করতেই এসেছি। পড়াশুনা এবং রিসার্চ ওয়ার্কের প্রচুর চাপ, তাই বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে ফিরে যাব।

চিঠিতে ওর সঙ্গে সব ঠিক হয়ে আছে। শনিবার সকালে আমরা দেখা করব। প্রথমে ঠিক হয়েছিল আগের জায়গাতেই দেখা করব, পরে আমার মনে হল যে হল থেকে ওই পর্যন্ত আসতে ওর অনেকটা সময় নষ্ট হবে। আমি এতটুকু সময় ও নষ্ট করতে চাই না। এরপর আবার কবে দেখা হয় ঠিক নেই, তাই আমি বললাম সকাল সকাল ওর হলে চলে যাব; কল দিলে যেন নেমে আসে।

প্রথমবার ওর সঙ্গে এভাবে দেখা করছি, মনে হলো কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাই কিন্তু কি কিনব কিছুই বুঝতে পারছি না। এর আগে আমি কখনো কোন মেয়ের জন্য উপহার কিনিনি। নাজমার জন্য অবশ্য কিনেছি তবে সেটা ও আমার ঘাড় ধরে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দে কিনেছে। ওর সঙ্গে একবার এই নিয়ে কথা বলব কিনা ভাবছিলাম ঠিক তখনই ও চায়ের কাপ দিয়ে ঘরে এলো। অন্যান্য বারের মত ও এবার ঝগড়া করল না বরং লক্ষ্য করলাম এবার ওর গলার স্বর অন্যরকম। চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো।

নাজমা আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। ছোট বেলা থেকেই ও অনেক বুদ্ধিমতী তবে এতটা ধুরন্ধর সেটা সেদিনই টের পেলাম। কথা বলতে বলতে একটা সময় যখন আমার মনে হল ও অনেকটা স্বাভাবিক তখন আমি বললাম
– উপহার কেনার জন্য কোন দোকানটা সবচেয়ে ভালো হবে বলতো
– কোন অকেশনের জন্য?
– কোন বিশেষ অকেশন না, এমনি দেখা করতে যাব
– সেভিং জেল দিতে পারো
– ধুর! সেভিং জেল কেন দেব?
– তাহলে মানিব্যাগ
– আরে না, অন্য কিছু বল
– যাকে দেবে তার হাইট কেমন?
আমি একটু সাবধান হলাম। বললাম
এভারেজ
– আড়ং এ অনেক সুন্দর সুন্দর আয়না পাওয়া যায়। আমার মনে হয় দিলে খুশি হবে
– এটা ভালো বলেছিস, আড়ং থেকে একটা আয়না কিনি বরং
– ওকে কি দেখতে অনেক সুন্দর ভাইয়া?
– অনেক
– কি নাম?
– অনিমা
– আমার সঙ্গে কবে পরিচয় করিয়ে দেবে?
এ কথা বলে ও মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আমার নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করলো। আমি বললাম
– কি বললি তুই?
– এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই ভাইয়া। তুমি যখন গতবার ছটফট করে ফিরে গেলে তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কোথায় থাকে চট্টগ্রামে?
– না এখানে ঢাকায়
নাজমা আনন্দে হাততালি দিয়ে দিয়ে উঠল, বলল
– কাল দেখা করবে?
– হ্যাঁ কাল সকালে
– চলো তাহলে তোমাকে গিফট কিনতে হেল্প করি, আমারও কয়েকটা জিনিস কেনার আছে
আমি দীর্ঘশ্বাস কেললাম। এই তাহলে আসল ঘটনা।

আমি আড়ং এ এর আগে ও গেছি তবে এত ঘুরাঘুরি করিনি। ঈদের সময় মেইল সেকশন থেকে পাঞ্জাবি কিনেছি, আজ ঘুরতে গিয়ে ভালই লাগলো। আমি টুকটাক করে অনেক জিনিস কিনে ফেললাম ওর জন্য। ও খুব রুচিশীল এবং সৌখিন ধরনের মেয়ে। নাজমা অবশ্য এটা নাও ওটা নাও করে আমার কানের পোকা মেরে দিতে লাগলো। ঘ্যান ঘ্যান করে নিজের জন্য অনেক কিছু আদায় করল; শুধু কেনাকাটা নয়, কেনাকাটা শেষ হয়ে যাবার পর উপরে নিয়ে গিয়ে ওকে খাওয়াতেও হল। অবশ্য উপরের ফুড কোর্টে গিয়ে খুব ভালো লাগলো। জায়গাটা বেশ সুন্দর, ছিমছাম নিরিবিলি।আমি ঠিক করলাম ওকে নিয়ে এখানেই আসব। নাজমা এক প্লেট ফুচকা শেষ করে লাচ্ছির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো
– ভাইয়া ওকে নিয়ে কিন্তু এখানে এসো। খাওয়া শেষ করে তারপর একেবারে সংসদ ভবনে চলে যাবে।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম
– তুই এত সব খবর কি করে জানিস?
নাজমা গাল ফুলিয়ে বলল
– যা বাবা! যার জন্য করি সেই আমাকে কথা শোনাচ্ছে। এই যে এতগুলো সময় দিলাম তোমাকে, গিফট খুঁজতে হেল্প করলাম আর তুমি এখন আমাকে এগুলো বলছো? এজন্যই কারো জন্য কিছু করতে হয় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হল আমার।

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এত টাকার শপিং করে দিলাম, এখন গপ গপ করে ফুচকা গিলছে তারপরও এত তেজ
আমারে অবস্থা দেখে নাজমা ফিক করে হেসে ফেলল, তারপর বলল
– ওর একটা ছবি দেখাও না ভাইয়া

ঠিক তখনই আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম আমার কাছে ওর কোন ছবি নেই এবং আমি ওকে সেই প্রথমবার ছাড়া আর কখনোই দেখিনি। ওকে আরেকবার দেখার একটা অদম্য ইচ্ছা আমার মধ্যে সারাদিন বিচরণ করলেও ছবি চাইবার ব্যাপারটা কখনো মাথায় আসেনি। এখন মাঝে মাঝে ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে, ভালোবাসা ব্যাপারটা কত হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, এখন প্রিয়জনকে চাইলেই দেখা যায়, ফোন করে কথা বলা যায়। ম্যসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস এপ, আরো কত কি আছে। তখন এতসব ছিল না। আমি জানি না এখন এসব ভালবাসার গভীরতা আরো বাড়িয়েছে কিনা তবে এই যোগাযোগের দূরত্ব আমাদের ভালবাসাকে কমাতে পারেনি এতটুকুও।

কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি উত্তেজনায় সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম এসেছিল ফজরের আগেই ঘুম ভেঙে গেল। অনেকদিন পর বাড়ির কাছের মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম।

আমি ওর হলের কাছে পৌঁছালাম সকাল সাতটারও একটু পরে। এত সকালে কল দেয়া বোধহয় ঠিক হবে না এইভাবে একটু অপেক্ষা করলাম। এর সকালে যায়গাটা বেশ ফাকা, একটা দুইটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে গেট থেকে বের হতে; সম্ভবত এরা আটটার ক্লাস ধরতে যাচ্ছে। আমি হলের পাশে্র কালভার্টটার উপরে বসে রইলাম। আমার মাথার উপর একটা হলুদ কৃষ্ণচূড়া গাছ। সকাল বলে গরম কম।এপ্রিলের শেষ তাই চারিদিকে ঝেপে কৃষ্ণচূড়া আর জারুল ফুটেছে। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। রিকশার সংখ্যা খুবই কম। মাঝে মাঝে লাল রঙের বাসগুলোকে আসতে দেখা যাচ্ছে।

রোদের তীব্রতা এখনো বাড়নি। চারিদিকে এখনো মিষ্টি রোদ। আমি আবারো ঘড়ি দেখলাম। আটটার একটু বেশি বাজে। না, এখনো কল দেবার মতন সময় হয়নি। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। উল্টোদিকে ভাষা ইনস্টিটিউটের বিল্ডিং। অপেক্ষা করতে করতে যখন মনে হল যে এবার উঠে কল দেয়া যায় তখনি লক্ষ্য করলাম কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মুখ তুলে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ওর মুখ ভর্তি হাসি। আগের দিন ওকে দেখেছি বাসন্তী ফুলের মতন আজ পরেছে সাদা আর কমলার মিশেলে সুতির জামা। ওকে দেখতে ভোরের শিউলি ফুলের মতন লাগছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ও আর একটু কাছে এসে বলল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছো?
না ঘন্টাখানেক
ইস! আগে জানলে আরো আগে নেমে আসতাম।
আমি কিছু বললাম না, ওর হাতে উপহারের ব্যগটা তুলে দিয়ে বললাম
এটা তোমার জন্য।
ওর মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো, ও ব্যাগ খুলে দেখলো না। বলল
এটা ভেতরে রেখে আসি, তাহলে আর সারাদিন বয়ে বেড়াতে হবে না।
আচ্ছা
অনিমা ফিরে এলো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। এসেই বলল
খেয়েছো কিছু সকালে
না, চলো একসঙ্গে খাই

আমরা হাঁটতে হাঁটতে কার্জন হলে চলে গেলাম, ওখানেই নাস্তা করলাম , চা খেলাম। এখনকার মতন তখন এত বড় বড় রেস্টুরেন্ট ছিল না, থাকলেও সেগুলো আমাদের মতন স্টুডেন্টদের জন্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল, তাছাড়া তখন আমাদের হাতে হাতে টাকাও থাকতো না॥ অনিমা আমাকে ওর ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরী ঘুরিয়ে দেখালো। আমি কার্জন হল, সাইন্স লাইব্রেরী সবই ঘুরে দেখলাম। একটা সময় এখানে ভর্তি হতে পারিনি বলে আমার খুব আফসোস ছিল, এখন আর নেই। এখন আমি আমার নিজের ক্যম্পাস অসম্ভব ভালোবাসি।

আমরা সারাদিন রিকশা করে ঘুরলাম। ও যে এত কথা বলতে পারে আগে আমার কোন ধারণাই ছিল না। চিঠি পড়ে আমার মনে হতো ও খুব চুপচাপ শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সারাদিন কত গল্প যে করল।একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় আমার মন ছেয়ে যাচ্ছিল। রিক্সায় বসেই আমি ওকে বললাম
আমি কি তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি
ও সঙ্গেসঙ্গে হাত এগিয়ে দিল। কি দ্বিধাহীন নিঃসঙ্কোচ সেই ভঙ্গি। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। বললাম
কাল আবার দেখা করাবে?
করব
অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। হাতের সঙ্গে হাত জড়িয়ে রিক্সায় বসে রইলাম
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। যখন ওকে হলে নামিয়ে দেবার জন্য ফেরার পথ ধরলাম তখন ও খুব আস্তে করে আমাকে ডাকলো
মুনির
হুম
আবার কবে আসবে?
তুমি বলো কবে আসব
ও মাথা নিচু করে খুব আস্তে আস্তে বলল
শীতের ছুটিতে আসবে?
মুখে কিছু না বললেও ওর কন্ঠস্বরে ঝরে পড়া অভিমান আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। বললাম
না, শীতের ছুটির আগেই আসবো
ও মুখ তুলে তাকালো, তারপর বলল
কবে
সেপ্টেম্বারে, তোমার জন্মদিনের সময়
মুহূর্তেও মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল ও চোখ বড় বড় করে বলল
সত্যি!
ওর বলার ধরণ দেখে আমি হেসে ফেললাম
একটা স্বপ্নের মতন দিন কাটিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম। ওর জন্মদিনের দিন যখন আসব তখন এর চেয়েও আরো চমৎকার একটা দিন কাটাবো ভেবেছিলাম কিন্তু সেই দিনটাকে যে এত ভয়ানক হবে সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে