অনির পর্ব-০৪

0
24

চতুর্থ পর্ব

নাসিম হল ছেড়ে দিয়েছে। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস নিয়ে গেছে শুধু কতগুলো চিঠির খাম আমার টেবিলের উপর ফেলে গেছে।এর কারণ আমি সেদিন বুঝতে পারিনি তবে চিঠিগুলো পেয়ে মনে হয়েছিল অমূল্য কিছু পেয়েছি॥ আমি চিঠিগুলো যত্ন করে একটা বাক্সে তুলে রাখলাম। আমি অনিমার রুম নাম্বার জানিনা কোন বিল্ডিংয়ে থাকে সেটাও জানি না শুধু জানিও বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছে, এমনকি কোন ইয়ারে পড়ে সেটাও জানিনা। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোন উপায় আমার ছিল না। খামের উপর প্রেরকের ঠিকানা দেখে খুব নিশ্চিন্ত লাগছিল যদিও জানি ওকে চিঠি লেখার কোন অধিকার আমার নেই।

ওকে আবারো চিঠি লিখতে শুরু করার একটা উপায় করে দেবার জন্যই বোধ হয় পরদিন সোহানা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সোহানা নাসিমের প্রাক্তন প্রেমিকা। বছর খানের আগে যখন নাসিম আমাকে অনুরোধ করেছিল অনিমা কে চিঠি লিখে দেবার জন্য আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সোহানা এসব জানে কিনা তৎক্ষণাৎ ও কোন উত্তর দিতে পারিনি তার দু চারদিন পরে আমার কাছে জানিয়েছিল যে ওদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। ব্রেকআপের পর একটা মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল বলে আমি চিঠি লেখার ব্যাপারটাকে ওকে সাহায্য করেছিলাম।অতীত ভুলতে যদি একটা সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে জড়ায় তাহলে ক্ষতি কি। আশ্চর্যজনকভাবে সোহানার কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে ওদের আদৌ ব্রেকআপ হয়নি। তবে আরও আশ্চর্য হলাম যখন ওর এখানে আসার কারণটা জানতে পারলাম। ও বলল
আমি আসলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি
আমার সঙ্গে?
হ্যাঁ তোমার সঙ্গে। তোমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছি
অভিনন্দন? কি বিষয়ে বলো তো
শুধু অভিনন্দন বললে ভুল হবে। তোমাকে ধন্যবাদ জানাতেও এসেছি। আমি নাসিমকে ভুল বুঝেছিলাম। আমাকে একজন বলেছিল নাসিম কোন এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে তার সঙ্গে নাকি চিঠি লেখালেখি চলছে।
কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম। ও আবারো শুরু করল বলল
শুনেছিলাম নাসিমের সঙ্গে নিউ ইয়ারের দিন ওই মেয়ের দেখা হবে। ভেবেছিলাম ওকে হাতেনাতে ধরে একটা উচিত শিক্ষা দেব। ওখানে গিয়ে ওকে পেয়েছিলাম তারপর নিজের ভুলটা বুঝতে পারি
কি ভুল
নাসিমি আমাকে দেখালো মেয়েটা আসলে তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দারুন মানিয়েছে কিন্তু তোমাদের দুজনকে

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না একবার শুধু অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলাম
নাসিম কেমন আছে
ভালো আমাকে বলল
এখানে আর ভালো লাগছে না তাই বাড়ি চলে গেছে

সেদিন রাতে আমি প্রথমবারের মতো নিজে থেকে অনিমাকে চিঠি লিখলাম আমি লিখলাম
অনিমা অনিমা
তুমি কি আমার উপর অনেক রেগে আছো? তোমার রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি কিন্তু তোমাকে একটাও মিথ্যা কথা বলিনি। আমি সত্যিই নাসিম না। তবে তোমাকে চিঠি গুলি আমি পাঠাতাম।যদি তুমি সত্যিই আমার উপর রাগ না করে থাকো তাহলে এই চিঠিটা জবাব দিও।

অনিমার চিঠির জবাব এলো তিন দিনের মাথায়। ক্লাস ফাইভ ট্যলেন্টপুলে এ বৃত্তি পাওয়ার পর যেরকম আনন্দ হয়েছিল সেই রকম একটা শিশুসুলভ আনন্দ আমার মন ছেয়ে গেল। অনিমা একটা লম্বা চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে রাগ অনুরাগের কোন কথা নেই। অনেক কথা লিখেছেতার মধ্যে আমার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা মনে হয়েছে সেটা হলো ও লিখেছে “সেদিন তোমার সঙ্গে আমার কোন কথাই হয়নি। আমি শুধু তোমার আঙুলে আঙ্গুল জড়িয়ে রিকশায় বসে ছিলাম; তবে কি জানো, মানুষের মুখের ভাষার মতন প্রতিটা অঙ্গেরও বোধহয় নিজস্ব একটা ভাষা থাকে। সেদিন তোমার সঙ্গে আমার আঙুলে আঙ্গুল জড়িয়ে অনেক কথা হয়ে গেছে। সব কথা বোধহয় মুখ ফুটে বলা যায় না। বলার প্রয়োজনও পড়ে না

আবার শুরু হলো আমাদের পত্র বিনিময়, যদিও ওকে একবার সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা আমি কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। বারবার ইচ্ছা করছিল আবার ওর কাছে যাই একবার একটু ছুঁয়ে দেখি ওকে কিন্তু উপায় ছিল না। নতুন বছরে পড়াশোনার চাপ বেড়েছিল প্রচুর। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালের রেজাল্ট ভালো হওয়াতে চেয়ারম্যান স্যার আমাকে সিনিয়র একজনের সঙ্গে রিসার্চ এর যুক্ত করে দিয়েছিলেন। এই কাজ শেষে যে পাবলিকেশন হবে সেখানে আমার নাম ও যাবে। চেয়ারম্যান স্যারের আমাকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা আছে।

আমি উদয়ন্ত পরিশ্রম করা শুরু করলাম। সকালে ক্লাস, দুপুরে ল্যব ওয়ার্ক আর রিসার্চ এর জন্য কাজ বিকেলে সেমিনারে বসে রেফারেন্স কালেকশন করতে হতো, আবার রাতে ক্লাসের জন্য পড়তে হতো। তখন এখনকার মতন ওয়াইফাই কানেকশন ছিল না, সেমিনার রুমে দুটো কম্পিউটারে ইন্টারনেট কানেকশন ছিল সেখানে রেফারেন্স কালেকশনের কাজ করতে হতো।
এতো ব্যস্ততার মধ্যে যদি কোন কিছু আমাকে প্রশান্তি দিত তবে সে ছিল আনিমার চিঠি গুলো। ওর এক একটা চিঠি আমি হাজার হাজার বার করে পড়তাম। সামনাসামনি কথা বলার ইচ্ছা যে কি করে দমন করেছি সে একমাত্র আমি জানি।
সময় গড়িয়ে গেল আমাদের সম্পর্কের গভীরতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। আমরা ঠিক করলাম সামনের ছুটিতে আমি ঢাকায় এলে তখন দেখা করব।
এরমধ্যে আমার ক্যাম্পাস একদিন নাসিমের সঙ্গে দেখা হলো। আমি ওকে দূর থেকে দেখে একটু হাসলাম। ও জবাবে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে না চেনার ভান করল। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ও আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ওর আর সোহানার সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য সম্ভবত এটাই উত্তম পন্থা। আমি আর কোন ঝামেলায় গেলাম না। ও যদি আমাকে এড়িয়ে গিয়ে ভালো থাকতে পারে তাহলে থাকুক।

দেখতে দেখতে শীত বসন্ত গড়িয়ে গ্রীষ্ম এসে গেল। জুন মাস থেকে আমার মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হবে এরপর আর হয়তো যাওয়া হবে না। একবার ওকে দেখার জন্য আমি ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম তাই এপ্রিলের শেষ নাগাদ আমি ট্রেনের টিকেট বুক করে ফেললাম। সেভাবে দেখতে গেলে এটাই আমাদের প্রথম দেখা। এর আগে যখন দেখা হয়েছিল আমরা একে অপরের কাছে অচেনা ছিলাম। ঠিক হলো যেদিন আমি পৌঁছাব তার পরের দিন সকালবেলা ওর সঙ্গে দেখা করব। সারাদিন একসঙ্গে ঘুরব। আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে ও সবকিছু প্ল্যান করে রেখেছে। আমি ছোটবেলা থেকে ঢাকাতেই বড় হয়েছি বরং ঢাকা ওর কাছেই নতুন। ও বেড়ে উঠেছে সিলেটে।তবু আমি কিছু বলছি না ওর উত্তেজনা ভালো লাগছে।
এর আগে এবং পরে ও আমি অনেকবার ঢাকায় গেছি। তবে এবারের ঢাকা ভ্রমণটা আমার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে