অনির
পর্ব-০১
আমাদের যখন বিয়ে হল তখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র, অবশ্য থার্ড ইয়ার করলে ভুল হবে, কেবল থার্ড ইয়ার থেকে ফাইনাল ইয়ারে উঠেছি। বাবা-মা কেউ আমার বিয়েতে খুশি ছিল না। তাদের খুব স্বপ্ন ছিল আমি অনার্স পাশ করে মাস্টার্স করব, তারপর থিসিস শেষ করে পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাব, সেই সময় তারা দেখে শুনে তাদের পছন্দমত একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন।
ছোটবেলা থেকেই আমি কখনো বাবা-মায়ের অবাধ্য হইনি, কখনো কোনো কিছুতে নিজের মতামত জাহির করিনি। হঠাৎ করেই বিয়ের বেলায় ছাত্র অবস্থানেই তাদের কাছে এসে হুট করে বললাম যে আমি একজনকে বিয়ে করতে চাই, ব্যাপারটা তাদের কাছে রীতিমতো শকিং ছিল। আমি নিজেও কি কোনদিন ভেবেছিলাম যে আমার সঙ্গে এরকম হবে; কিন্তু ওকে দেখার পর সব ওলটপালট হয়ে গেল, অবশ্য দেখার পর বলছি কেন, আমি তো না দেখেই ওর প্রেমে পড়েছিলাম। দেখে প্রেমে পড়েছিল আমার বন্ধু নাসিম। ভিন্ন শহরে থাকার কারণে ওদের প্রেমটা তেমন জমেনি। পরিচিত একজনের বাসায় দেখে ওকে ভালো লেগেছিল নাসিমের তারপর ও ফিরে গেছে ঢাকায় আমি আর নাসিম রয়ে গেছি চট্টগ্রামে। একই হলে একই রুমে থাকতাম।
সময়টা নব্বইয়ের দশক, এখনকার মতন তখন হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকত না। তাই কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। চিঠি লেখাটাই ছিল একমাত্র ভরসা কিন্তু চিঠি লিখতে গেলেই ওর কলম ভেঙ্গে যেত। সে সময়েই চিঠি লেখার জন্য নাসিম আমার শরণাপন্ন হয়েছিল। আমি ওর হয়ে চিঠি লিখে দিতাম নাসিম সেটা কপি করে পাঠাত, আর সেই চিঠি লিখতে লিখতেই কবে যে আমি ওর মধ্যে ডুবে গেলাম নিজেও বুঝতে পারিনি।
ওই দিনটার কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, তখন কেবল শীতের শুরু একদিন রাতে আমি কম্বল গায়ে জড়িয়ে বসে পড়াশোনা করছিলাম এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম নাসিম নিজেও টেবিলে বসে কিছু লেখার চেষ্টা করছে। রাত প্রায় দেড়টার দিকে ও আমার কাছে এসে অনুনয় করে বলল
– দোস্ত একটা হেল্প করবি?
আমি অবাক হয়ে বললাম
– কি?
– একটা প্রেম পত্র লেখসি, একটু চেক কইরা দিবি?
– প্রেমপত্র তো খুব পার্সোনাল জিনিস, এটা তুই আমাকে দিয়ে চেক করাবি? তাছাড়া তোর প্রেমপত্র লেখার দরকার কি? একটু আগেই তো সোহানার সঙ্গে দেখা হলো।
– এইটা সোহানার জন্য না, এইটা অন্য পার্টি
সোহানা নাসিমের গার্ল ফ্রেন্ড। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ওদের প্রেম। যেমন তেমন প্রেম নয় একেবেরে জমজমাট প্রেম। দুজন একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম
– নিজের প্রেম পত্র নিজে চেক কর, আমাকে দেখাতে আসিস না।
এরপর কয়েকদিন নাসিমের সঙ্গে আর কথা হলো না। সপ্তাহখানেক পর নাসিম আমার কাছে এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে জানাল ওর ব্রেকআপ হয়ে গেছে। আরো কয়েকদিন পর নাসিম আবার আমার কাছে এলো প্রেমপত্রের কারেকশন নিয়ে। এবারে আমি আর কিছু বললাম না, মনে হল এমনিতেই বেচারার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। এখন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক, কিন্তু সেই প্রেমপত্র পড়ে আমার কান গরম হয়ে গেল। কানের চেয়েও বেশি গরম হলো মেজাজ। আমি ওকে বললাম
– এই প্রেমপত্র তুই ওই মেয়েকে পাঠাবি?
– হ্যাঁ কেন, কি হইসে? একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?
– একটু না অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে। আমি ওই মেয়ের জায়গায় হলে ট্রেন ভাড়া করে এসে তোকে জুতা দিয়ে পিটাতাম
– এমন তো কিছু লিখিনি। শুধু ব্রে/সি/য়ারের সাইজ জানতে চেয়েছি. এটা কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি ?
– শুধু বাড়াবাড়ি নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এইসব ফালতু বিষয় নিয়ে আমার কাছে আর আসবি না। নিজে যা পারিস কর
এরপর নাসিম দুইদিন আমার পেছনে পড়ে রইল ওর হয়ে চিঠিটা লিখে দেয়ার জন্য। প্রথমে আমি রাজী হলাম না। সময়টা ১৯৯৯ সন, মোবাইলের যুগ তখনো আসেনি তাই চিঠি ছাড়া উপায় নেই। অনেকক্ষণ ঝোলা ঝুলির পর আমি নাসিমের প্রস্তাবে রাজি হলাম।
এভাবে কারো সম্পর্কে কিছু না জেনে তো আর চিঠি লেখা যায় না তাই আমি সেই মেয়ের সম্পর্কে জানতে চাইলাম। নাসিম জানাল ওর নাম অনিমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ে। ওখানেই হলে থাকে। নাসিম আরো জানালো অনিমা ওর এক বন্ধুর খালাতো বোন। বন্ধুর বাড়িতেই দাওয়াতে দেখা হয়েছিল, দেখে ভীষণ ভালো লেগেছে তারপর একদিন ফোনে কথা হয়েছে। তখনই বলেছে চিঠি লেখার কথা। নাসিম চিঠি না লিখে নিউ ইয়ারে ওকে একটা ভিষন দামি কার্ড গিফট করেছে। তারই জবাবস্বরূপ অনিমা ওকে এক বিশাল চিঠি লিখে পাঠিয়েছে। সেই চিঠির জবাব এ নাসিমা একটা চিঠি লেখার চেষ্টা করেছে কিন্তু আমার মতে চিঠিটা অত্যন্ত অশ্লীল।
আমি এই জীবনে কোনদিন প্রেম পত্র লিখিনি। প্রেমপত্র তো দূরে থাক কাউকে কোনদিন চিঠিই লিখিনি। আমার বাবা-মা আর ছোট বোন থাকে ঢাকায়। সপ্তাহে দুদিন ফোনে তাদের সঙ্গে কথা হয়। চিঠি লিখে সময় নষ্ট করতে ওনারাই আমাকে মানা করেছেন। তবে চিঠি না লিখলেও আমি প্রচুর বই পড়েছি। বই পড়া ছাড়া আমার অন্য আর কোন শখ নেই। সাহিত্য বিজ্ঞান, ফিকশন, নন-ফিকশন এমন কোন টপিক নেই যেটা আমি পড়িনি। কাজেই চিঠি লিখতে গিয়ে তেমন কোন সমস্যা হলো না। কলম কামড়ে বসে থাকতে হলো না। একবার লেখা শুরু করার পর কি করে যেন লেখাটা চলতেই থাকলো। প্রথম চিঠিতে আমি খুব বেশি কিছু লিখলাম না। ওর কুশল জানতে চাইলাম। এখানকার জীবনের দু একটা গল্প করলাম, কেমন করে আমরা ট্রেনে করে ইউনিভার্সিটিতে যাই, খানিকটা প্রকৃতির বর্ণনা দিলাম। সবমিলিয়ে খারাপ হলো না। শেষ করে আমি নাসিমকে বললাম, এটা যেন কপি করে পাঠিয়ে দেয়।
একটা মজার ব্যাপার হল চিঠিতে কিন্তু প্রেমের কোন আভাস ছিল না, খানিকটা বন্ধুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল; সম্ভবত এই বিষয়টি ওর খুব ভালো লেগেছিল। এটা বুঝতে পারলাম যখন চিঠির জবাব এলো তিন দিনের মাথায়। এবারেও নাসিম আমার শরণাপন্ন হল। আমার লেখা প্রথম চিঠির জবাবে কি লিখেছে সেই কৌতূহলেই চিঠিটা পড়া হলো এবং পড়ার পর জবাব না লেখা পর্যন্ত নাসিম আমাকে ছাড়লো না।
বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর আমি একদিন নাসিমকে জিজ্ঞেস করলাম এতে কোন ওর কি লাভ হচ্ছে। চিঠি আমি লিখে দিচ্ছি জবাব ও পাঠাচ্ছে। নাসিম জানাল ও প্রতি সপ্তাহে দুইবার ওকে ফোন করে। যদিও বেশিরভাগ সময়ই কথা হয় চিঠি সংক্রান্ত, বেশিরভাগ সময়েই কানেকশন ভাল থাকেনা। অনিমা হলের কয়েন ফোন দিয়ে ফোন করে। ওকে বলেছিল দোকান থেকে ফোন করতে কিন্তু ও বলেছে ওর অসুবিধা হয়। দোকানদার হা করে তাকিয়ে থাকে।
শীত গড়িয়ে গ্রীষ্ম চলে এলো। আমার মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হয়েছে।। আমি পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।এ সময় চিঠি লিখে সময় নষ্ট করার মতন সময় আমার নেই। কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পড়ায় মন বসাতে পারছি না। লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন নাসিমকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে ওর আর চিঠি এসেছে কিনা। নাসিম জানালো ফোনে কথা হয়েছে ওর শরীর খারাপ। জ্বর এসেছে কদিন ধরে তাই চিঠি লিখতে পারছে না। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেচারি জ্বরে পড়ে আছে, এ সময় নাসিমের উচিত একটা বড় করে চিঠি লেখা অথচ ও কিছুই করছে না। তখনই মনে পড়লো, ও তো কিছু করতে পারবে না, যা করার করতে হবে আমাকে। আমি নাসিমকে বললাম
– তুই সুন্দর করে একটা চিঠি লেখ। জ্বরের মধ্যে চিঠি পেলে ওর মন ভালো হয়ে যাবে।
আমি জানতাম নাসিম আবারো আমাকে চেপে ধরবে। এবারে আমি মনে মনে প্রস্তুতই ছিলাম। আমি লিখলাম
অনিমা অনিমা
গত চিঠিতে লিখেছো তোমার শরীর খারাপ কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার শুধু শরীর খারাপ নয়, তোমার মনও খারাপ। আমার ধারনা যদি সত্যি হয় তাহলে এখন তুমি চাদর মুড়ি দিয়ে অন্ধকারে টর্চা লাইট জ্বেলে আমার লেখা পড়ছো। বেশি রাত জেগো না, আর অন্ধকারে পড়তে নেই, মাথা ব্যথা করবে, এমনিতেই তোমার মাইগ্রেনের সমস্যা। বাইরের দেশগুলোতে অডিও বুক নামে একটা জিনিস এখন ভীষণ চলছে। বইগুলো কেউ পড়ে শোনায় তোমার কষ্ট করে পড়তে হবে না। তুমি শুধু অডিও চালু করে গল্পটা শুনবে। মজার না?
আমাদের এখানে ভীষণ গরম পড়েছে ঢাকাতেও নিশ্চয়ই তাই, আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হয়। খুব মেঘ করে যখন বৃষ্টি নামে, আমার তখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে। তুমি লিখেছিলে আকাশ যখন মেঘ করে ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায় তখন তোমার আমার কথা মনে পড়ে। আরো লিখেছিলে ঝকঝকে নীল আকাশে অনেক মেঘের মধ্যে যখন আমরা আমাদের প্রিয়জনের মুখ খুঁজি তুমি সে সময় আমাকে দেখতে পাও। সত্যি করে বলতো তুমি কি সত্যিই আমাকে দেখতে পাও? আমি তো সব সময় মেঘের মধ্যে বিশাল বিশাল সব হাতি আর জলহস্তী দেখি, মাঝে মাঝে অবশ্য হাঙরও দেখতে পাই। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে সেই হোঁতকা পেটুক হাঙরের মতন দেখ না। তবে তোমাকে একটা মজার কথা বলি। আমাদের এখানে একটা পুকুর আছে, সেই স্বচ্ছ পুকুরের জলে আমি যখন তাকাই আমি তোমার মুখ দেখতে পাই। আমি তো কখনো তোমাকে দেখিনি তাই কল্পনায় তোমার মুখ দেখি।
পাশে থেকে নাসিম বলল “এটা কি লিখেছিস? আমি তো ওকে দেখেছি”। আমি লিখতে লিখতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, হঠাৎ করে সম্বিত ফিরে পেয়ে ধাতস্থ হয়ে আবার লিখলাম। তোমাকে অবশ্য অনেক আগে দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় “তোমাকে দেখেছি সেই কবে কোন বৃহস্পতিবার তারপর এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না”।
এলেবেলে কথা বলে আর তোমার মাথা ধরিয়ে দেব না। তোমার জন্য একটা বই পাঠাচ্ছি। এই বইটা পড়ো। আমার ভীষণ প্রিয় একটা বই।
আর একটা কথা বলে শেষ করব। আমি জানি বৃষ্টি তোমার ভীষণ প্রিয় তবে এখন বৃষ্টিতে ভিজে আবার ঠান্ডা বাধিও না।। ভালো থেকো, আর দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাকে আবার চিঠি লিখা শুরু করো। তোমার চিঠি না পেলে নিজেকে খুব অসম্পূর্ণ লাগে।
ইতি তোমার নাসিম
লেখা শেষ করে চিঠিটা নাসিমের হাতে দিয়ে বললাম
– একটু বড় হয়ে গেল দোস্ত। কষ্ট করে কপি করে নিস। নাসিম আমার পিঠ চাপড়ে বলল
– দোস্ত তুই যা লেখস না, একদম সুরসুরি উঠায়ে দেওয়ার মতন।
– মানে?
মানে, এই যে দুইবার নামটা লেখস, আরে দোস! কি কমু একদম অ/র্গা/জম হয়ে যাওয়ার মতন
আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এত চমৎকার একটা মেয়ে অথচ কিসের পাল্লায় পড়েছে। এর জন্য কি আমি দায়ী?
চলবে……