#অনির্বাণ (পর্ব ৩)
আজ তিনদিন হয়ে গেল দীপশিখা মাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছে। মা এখন অনেকটাই ভালো। বাবাকে ও বলেছে কালই যেন সকালের ট্রেনের টিকেট কেটে রাখে। একটা ব্যাপার মনে মনে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে দীপশিখাকে, সুমন এর মাঝে আর একবার এসেছিল, তাও ওই ফোন করে আসতে বলেছিল। অথচ এতদিন পর ও ঢাকায়, সুমনের যেন দেখা করার আগ্রহটাই কমে গেছে। সেদিনের সেই হোটেল রুমে না যাওয়া নিয়ে ও যে এতদিন রাগ পুষে রাখবে তা ভাবেনি। দীপশিখা ভাবে, ওকে দ্রুতই ঢাকায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতে হবে। তা না হলে সুমন এভাবে আরো দূরে চলে যাবে। আর তাছাড়া বাবা মাও একা ঢাকায় থাকেন। কিন্তু এমন ভালো ক্যারিয়ার ছেড়ে ঢাকায় খুব বেশি হলে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে হয়ত পড়াতে পারবে, তার বেশি কিছু না। বাবাকে কথাটা বলতেই বাবা গম্ভীরমুখে বলেন, “দেখ মা, তুমি এমন ভালো একটা ইইউনিভার্সিটি ছেড়ে ছোট একটা কিছুতে জয়েন করবা এটা আমি সাপোর্ট করি না। প্রয়োজনে আমরা তোর ওখানে যেয়ে থাকব। তুই এসব ভুলভাল ভাবিস না, বরং বুয়েটে কিভাবে আসা যায় সেটা চেষ্টা কর।”
বাবার কথায় দীপশিখার মনের দ্বিধাটুকু কেটে যায়। এখন সুমনকে একটু বোঝাতে হবে, ছেলেটা এত অধৈর্য। এবার হাতে সময় নেই, কদিন পর লম্বা ছুটি আছে তখন ওকে চেপে ধরতে হবে।
পরদিন সকালে দীপশিখা যখন সুন্দরবন ট্রেনে ওঠে তখন সকাল সাতটা বেজে গেছে। ও ওঠার কিছুক্ষণের মাঝেই ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। সকালেই অনির্বাণ ফোন করেছিল ও ঠিকাঠাক ট্রেনে ওঠেছে কি না। বিকেলে খুলনা স্টেশনে ও থাকবে। দীপশিখা ভেবে পায় না সেই প্রথম পরিচয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত ছেলেটা ওকে যেন ঘিরে রেখেছে। আচ্ছা, ও তো ভালো করেই জানে সুমনের সাথে ওর রিলেশন, বিয়েও হয়ে যাবে। তাও কেন এমন করে? শুধুই ভদ্রতা? ভাবতে ভাবতে দীপশিখা ঘুমিয়ে পড়ে। এই কদিনের ধকলটা এখনো কাটেনি, মুহুর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। একটা অদ্ভুত স্বপ্নও দেখে দীপশিখা, ও লাল একটা বেনারসি শাড়ি পড়ে ট্রেনে ওঠেছে, কেউ একজন হাত বাড়িয়ে ওকে ট্রেনে টেনে তুলছে।
ঘুমটা ভাঙতেই দীপশিখা হেসে ফেলে, ট্রেনে এতবার যেতে যেতে সবকিছু ওর এখন ট্রেন কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে দুপুরের খাবারটা বের করতে যেয়েও বের করে না। যমুনা সেতু আসতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না, লাঞ্চটা না হয় তখনই করা যাবে। দেখাই যাক অনির্বাণের মতো টেমস নদীর অনুভূতি পাওয়া যায় কিনা। সেই প্রথম দিনের কথা মনে করে মুচকি একটু হাসে দীপশিখা।
সুন্দরবন ট্রেনটা যখন খুলনা স্টেশনে এসে পৌঁছে অনির্বাণ তখন লম্বা পা ফেলে দীপশিখা যে বগিটায় এসেছে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরেই দীপশিখাকে দেখতে পায়, সেই কালো ফ্রেমের চশমা, পেছনে জ্ঞানী জ্ঞানী চোখ,আদুরে বোচা নাক। অনির্বাণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত থেকে লাগেজটা নিয়ে বলে, “Welcome, আজ যেন খুলনার আঁধার কেটে গেল দীপশিখার আগমনে।”
দীপশিখা একটা প্রাণখোলা হাসি দেয়, “শুরু হয়ে গেল আপনার সেই বিখ্যাত দুষ্টুমি। কেমন ছিলেন?”
অটোরিকশায় উঠতে উঠতে অনির্বাণ বলে, “একদম ভালো ছিলাম না, আপনার সাথে দুষ্টুমি না করলে তো আমি ভালো থাকি না। আচ্ছা, আন্টি কেমন আছে তাই বলুন।”
দীপশিখা মাথা নেড়ে বলে, “মা ভালো আছে, আপনার কথা অনেক বলেছে। এরপর ঢাকা গেলে আপনি অবশ্যই আমাদের বাসায় থাকবেন। বাবাও খুব বলল আপনার কথা।”
অনির্বাণ দুষ্ট হাসি হেসে বলে, “আর আপনি বুঝি আমার কথা কিছু বলেননি?”
দীপশিখা কিছু বলে না, হাসে শুধু।
এরপর কটা দিন দীপশিখার ভীষণ ব্যস্ততায় কেটে যায়, অনেকগুলো ক্লাশ জমা হয়ে ছিল। অফিসের কাজগুলোও বাকি ছিল। সেদিন বিকেলে দীপশিখা অনির্বাণকে ফোন করে একটু ডিপার্টমেন্টে আসতে বলে।
অনির্বাণ আসতেই দীপশিখা রহস্যময় গলায় বলে, “আজ ছুটির পর আপনাদের বাসায় যাব, আমাকে একটু পৌঁছে দিতে পারবেন?”
অনির্বাণ হেসে বলে, “আমাদের বাসায় আপনাকে পৌঁছে দিতে হবে? কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম, আপনি শুধু আমার হাত ধরে থাকবেন, ঠিক পৌঁছে যাবেন।”
দীপশিখা একটু অপ্রস্তুত হয়, বলে, “আসলে আন্টির জন্য একটা চাদর নিয়ে এসেছি। আমি তো উনার চাদর সেদিন ব্যবহার করে পুরনো করে দিয়েছি। আর আন্টিকে দেখাও হলো যিনি আপনার মতো একটা দুষ্ট মেধাবী ছেলে বড় করেছেন।”
অনির্বাণ মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, “প্লিজ, আম্মুকে কোনো নালিশ করবেন না।”
দীপশিখা ওর মুখচোখ দেখেই হেসে ফেলে।
সেদিন বিকেলে দীপশিখা অনির্বাণ এর বাসায় যান। ওর মা ওকে ভীষণ আদরে বুকে টেনে নেন। চাদরটা বের করে হাতে দিতেই বলেন, “আহা, এটা আবার আনতে গেলে কেন। তুমি আমার চাদর গায়ে দিয়েছ তাতে তো কোনো সমস্যা ছিল না। তুমি বসো মা, আমি চা নিয়ে আসছি।”
দীপশিখা অনির্বাণদের পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে। ছোট্ট একতলা বাসা, সামনে অনেকখানি জায়গা খালি। সেখানে সুন্দর ফুল ফুটে আছে। একটা বাগানবিলাস গাছ বাসার গেটের উপর দিয়ে জড়িয়ে আছে। অনির্বাণ ওকে নিয়ে ছাদে যায়। ছাদের একপাশে বাঁধানো বসার জায়গা, চারপাশে গাছ। দীপশিখার মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যায়। একটু পর অনির্বাণ নিচে থেকে নাস্তা, চা নিয়ে ছাদে চলে আসে, সাথে ওর মা। নাস্তা খেতে খেতে দীপশিখা বলে, “আন্টি, আপনাদের বাসাটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর, নিরিবিলি।”
অনির্বাণের মা হেসে বলেন, “হ্যাঁ মা, বাসাটা সুন্দর। কিন্তু এত নিরিবিলি আমার ভালো লাগে না। ওকে কতদিন ধরে বিয়ের কথা বলছি, রাজিই হচ্ছে না। মাসখানিক আগে একটা মেয়ে পছন্দ হলো, ওকে রাজিও করালাম, এখন বলছে বিয়ে করবে না। তুমি একটু বোঝাও ওকে।”
দীপশিখা মনে মনে একটু থমকায়, অনির্বাণ বিয়েতে রাজি হয়েও এখন না করছে কেন? নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি, আমি ঠিক মেয়ে খুঁজে বের করব।”
অনির্বাণ শুধু মৃদু হাসে, কিছু বলে না।
সেদিন অনির্বাণের ওখান থেকে ফিরে এসে দীপশিখা ভাবে নাহ অনির্বাণকে একদিন ভালো করে সব খুলে বলতে হবে। কিন্তু তার আগে সুমনকে ওর ঠিক করা দরকার। ইদানীং ফোনই দিতে চায় না, কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। আর কটা দিন পরেই ছুটি, আবার সুমনের জন্মদিনটাও এর মাঝে। হঠাৎ করেই একটা বুদ্ধি মাথায় আসে ওর। ওকে না জানিয়ে সোজা ওর নতুন বাসায় চলে যাবে জন্মদিনের সকালে, ফুল নিয়ে। সারাদিন ঘুরবে ওকে নিয়ে, বিয়ের দিনটাও ফাইনাল করে ফেলতে হবে। ভাবতেই মনে একটা উত্তেজনা টের পায় দীপশিখা।
এর কিছুদিন পর একদিন ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের কাছে অনির্বাণের সাথে দেখা হতেই দীপশিখা ওর প্ল্যানটা জানায়, বলে, “দারুণ হবে না ব্যাপারটা? এর আগে তো ও খুলনা এসে আমাকে চমকে দিয়েছিল, এবার আমি শোধ নেব।”
অনির্বাণের মুখটা কেমন যেন একটু বিষন্ন হয়ে ওঠে, শুকনো গলায় বলে, “বাহ, ভালো তো।”
দীপশিখা ওর এই মন খারাপ ভাবটা খেয়াল করে, তারপর বলে, “কিন্তু সামনের এই সাতদিনের ছুটিতে আপনি কোথাও যাবেন না?”
অনির্বাণ একটু চিন্তা করে বলে, “উম, নাহ। আমার কোথাও যাওয়া হবে না।”
এরপর কথা আর এগোয় না। দীপশিখা চলে যেতেই অনির্বাণ শহীদ মিনারের এককোণে বসে থাকে। এই জায়গাটা খুব সুন্দর, অনির্বাণের মন খারাপ হলে এখানেই বসে থাকে। অনির্বাণ বুঝতে পারে না কেন ওর এত খারাপ লাগছে, দীপশিখা তো তার প্রিয় মানুষকে জন্মদিনে চমকে দিতেই পারে।
দেখতে দেখতে ভার্সিটি ছুটির দিনটা চলে আসে। দীপশিখা ভার্সিটি ছুটির পরদিন যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সেদিন অনির্বাণ ওকে বিদায় দিতে স্টেশনে আসেনি, একটু অবাক লাগে দীপশিখার। কয়েকবার ফোনও দিয়েছিল, বলল একটু ব্যস্ত। ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবে, কোথাও একটা কিছু টের পায় দীপশিখা।
ঢাকায় এসে এবার দীপশিখা আর সুমনকে ফোন দেয়নি। ও ঘুরেঘুরে সুমনের জন্য একটা সুন্দর হাতঘড়ি কেনে, একটা ফুলে বাকেট অর্ডার করে রাখে।
আজ সুমনের জন্মদিন, দীপশিখা সুন্দর করে শাড়ি পরে, চোখে কাজল দেয়। তারপর ফুলটা আর হাত ঘড়িটা নিয়ে সকালেই বেরিয়ে পড়ে সুমনের বাসার উদ্দেশ্যে। কিছুদিন আগেই নতুন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে সুমন, মূলত বিয়ের পর ওরা এখানেই থাকবে। তখম সুমনের বাবা মাও গ্রাম থেকে চলে আসবেন, এমনই কথা হয়েছিল।
দীপশিখা যখন ফ্ল্যাট এর নিচে এসে পৌঁছে ততক্ষণে সকাল আটটা বেজে গেছে। অবশ্য সুমন নয়টার আগে বের হবে না অফিসে, এটা ও জানে। গেট দিয়ে ঢুকতেই দারোয়ান জানতে চায়, ও সুমনের নাম বলতেই লোকটা বিড়বিড় করে কি যেন বলে। দীপশিখা পাত্তা দেয় না, উপরে উঠে যায়। সুমনের ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেলটা বাজায়, কি মনে হতে ফুলের বাকেটা কি হোলের সামনে রাখে, যাতে ভেতর থেকে ওকে দেখতে না পায়। সুমন নিশ্চয়ই অনেক চমকে যাবে। দীপশিখার মনটা উত্তেজনায় ছটফট করছে।
দুইমিনিট পার হয়ে যায়, দরজা খোলে না। দীপশিখা আবার বেল দিতেই ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো একটা কন্ঠ শোনা যায়, সুমনের। কিন্তু দীপশিখা কথা না বলে দুষ্ট হাসি হেসে চুপ করে থাকে। এরপর দরজাটা আস্তে করে খুলে যেতেই দীপশিখা মিষ্টি একটা হাসি হেসে সুর করে বলে উঠে, “happy birthday to you, happy birthday সুমন।”
সুমন যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে, তোতলানো গলায় বলে, “তুমি এখানে? কই আমাকে আগে তো কিছু জানাওনি?”
দীপশিখা অভিমানের গলায় বলে, “আমাকে ভেতরে আসতে বলবে না?”
এমন সময় ভেতর থেকে একটা মেয়ে সুমনের পেছনে এসে ওর হাত ধরে দাঁড়ায়, বলে, “কে এটা সুমন?”
দীপশিখার হঠাৎ করে মনে হয় ও বুঝি ভুল কোথাও চলে এসেছে, মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, বুকটা কেমন ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটা কে, কেনই বা ও সুমনের হাত ধরে আছে? শুনতে পায়, সুমন বলছে, “সিলভিয়া, এই সেই আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড, বেচারা আমাকে আসলে ভুলতে পারেনি।”
মেয়েটা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “বিদেয় করে আসো, সকালের মজাটাই মাটি করে দিল।”
দীপশিখা আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না, ছুটে বেরিয়ে আসে সুমনের ওখান থেকে। কোনোমতে একটা রিক্সা ডেকে ওঠে পড়ে। সারাটা পথ কাঁদতে কাঁদতে দীপশিখা বাড়িতে ফিরে। নিজেকে ভীষণ প্রতারিত, অসহায় মনে হচ্ছে। বাসায় ঢোকার আগে ভালো করে চোখ মোছে, নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে। সেদিন দুপুরে দীপশিখা কিছু খায় না, মা বার বার খাওয়া নিয়ে জোর করে। কিন্তু দীপশিখা সারাটাদিন শুয়েই কাটায়। ওর শুধু একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে, কেন সুমন এমন করল। কি ভেবে ও একটা মেসেজ লিখে সুমনকে, “তুমি কেন এমন করলে?”
কিছুক্ষণ পরেই সুমনের রিপ্লাই আসে, “তোমার মতো পিউরিটান মেয়ে আমার পছন্দ না। তোমার জন্য অনির্বাণ ঠিক আছে, আর আমার জন্য এই সিলভিয়া।”
দীপশিখা মেসেজটা দেখে, বার বার বোঝার চেষ্টা করে মেসেজটা। শুধু এই? এই জন্য ও এমন করল? নাকি ও আসলে ওর শরীরটাই চেয়েছিল? সুমন হয়ত ওকে কখনো বিয়ে করার কথা ভাবেওনি, নিছক উপভোগ করার জন্যই। তা না হলে এই জন্য কেউ এত দ্রুত আরেকটা মেয়েকে নিয়ে ফ্ল্যাটে রাত কাটায় না। হায় রে ছেলে মানুষ!
বিকেলের দিকে একটা কথা ভেবে দীপশিখা স্বস্তি পায়, সেদিন হোটেল রয়ালে ও সুমনের রুমে না যেয়ে খুব ভালো করেছে। তা না হলে আজ ও নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারত না। ভাবনাটা ওকে স্বস্তি দেয়, মাকে ডেকে বলে, “মা, ঝাল করে শুকনা মরিচ আর পিয়াঁজ ভর্তা করো। আর দুপুরের ভাত তরকারি দাও, আমি খাব।”
মা খুশি মনে খাবার রেডি করে দিতেই দীপশিখা খেতে বসে। খেতে খেতে চোখ দিয়ে জল পড়তেই মা বলেন, “কি রে ঝাল বেশি হয়েছে?”
দীপশিখা মাথা নাড়ে, বলে, “সব ঠিক আছে মা।”
সেদিন রাতে অনির্বাণের ফোন আসে, দীপশিখা ফোন ধরেই বলে, “কি ব্যাপার আপনার, সেদিন যে এলেন না আমাকে স্টেশনে ছাড়তে, হুম?”
অনির্বাণ একটু থতমত খেয়ে বলে, “আসলে সেদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখি অনেক বেলা হয়ে গেছে, সরি। আচ্ছা বাদ দিন, কিন্তু আপনার আজ জন্মদিন মিশন কেমন হলো, সুমন বাবু সারপ্রাইজড?”
দীপশিখার বুকে কেউ যেন ছুরি মারে, “হ্যাঁ, উনি তো উনি, আমিও সারপ্রাইজড। অনির্বাণ আপনাকে একটা অনুরোধ করি, আপনি আজকের পর থেকে আর কোনোদিন সুমনের ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আর, আমি কাল দিন পর খুলনায় চলে আসব। আমার একাডেমিক কিছু কাজ পড়ে গেছে।”
ফোনটা রেখেই দীপশিখা কান্নায় ভেঙে পড়ে, এই ঢাকা শহর ওকে যেন গলা চেপে ধরে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। ভেবেছিল এই ছুটির সাতটা দিন সুমনের সাথে ঘুরে বেড়াবে, বিয়ের প্ল্যান করবে। ঘুণাক্ষরেও ও ভাবেনি এমন কিছু হবে। মাকে চলে যাবার কথা বলতেই খুব অবাক হোন, কিন্তু কিছু বলেন না।
*********************************
অনির্বাণ চিন্তিত মুখে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে, দীপশিখার এই হঠাৎ ফিরে আসা, সুমন সম্পর্কে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে মানা করা, সব মিলিয়ে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে ওর কাছে। দীপশিখা যখন ট্রেন থেকে নামে অনির্বাণ চমকে যায়, এ কোন দীপশিখাকে দেখছে ও। একেবারে বাসি ফুলের মতো, সেই তাজা ভাবটা যেন নেই। চোখটা কেমন নির্জীব হয়ে আছে। অনির্বাণ কিছু বলে না, ব্যাগটা নিয়ে ওকে খালার বাসায় পৌঁছে দেয়। পথে বিশেষ কোনো কথা হয় না, কেমন আনমনা হয়ে আছে আজ দীপশিখা।
এর মাঝে ভার্সিটি খুলে যায়, আবার ক্লাশ শুরু হয়। এর পাশাপাশি ভার্সিটির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া চলছে। অনির্বাণ পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্বে আছে। একদিন দীপশিখার ডিপার্টমেন্টে আসে, ওর কবিতা আবৃত্তি করার কথা। অনির্বাণ দেখে দীপশিখা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, ভালো করে চেয়ে দেখে জীবনানন্দ দাশের “মৃত্যুর আগে” কবিতাটা খোলা। বুকের কোথায় যেন একটা ধাক্কা লাগে অনির্বাণের, কি হয়েছে দীপশিখার!
মুখটা ভালো করে খেয়াল করে, দীপশিখাকে কেমন ভীষণ ক্লান্ত মনে হয়, শুকিয়েও গেছে অনেক, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। অনির্বাণ এর আগে বার বার জানতে চেয়েও কোনো উত্তর পায়নি। আজ ওকে এমন দেখে আর পারে না, অনির্বাণ নরম গলায় বলে, “দীপশিখা, প্লিজ আমাকে বলেন কি হয়েছে আপনার। আপনি দিন দিন নিজেকে শেষ করে ফেলছেন।”
হঠাৎ করেই দীপশিখার মেজাজটা চড়ে যায়, উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তাতে আপনার কি? আপনাকে কেন সব বলতে হবে, কে আপনি আমার। আপনারা ছেলেরা সব এক, প্রথমে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবেন তারপর….. ”
বলতে বলতে দীপশিখার চোখটা অন্ধকার হয়ে আসে, মাথাটা ঘুরে ওঠে পড়ে যেতে নেয়। অনির্বাণ এক লাফে সামনে এসে এক হাত দিয়ে ধরে ফেলে দীপশিখাকে। কোনোমতে ধরে ওকে চেয়ারে বসিয়ে আরেকজন ফিমেল কলিগকে ডাক দেয়। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়েছে দীপশিখা। অল্প কিছুক্ষনের মাঝেই ওকে নিয়ে এম্বুলেন্স করে কাছেই একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার সাহেব একটা আইভি স্যালাইন দেয় দীপশিখাকে। তারপর বলেন, “মনে হচ্ছে উনি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন না, প্রেশার তো একদম লো। উনার বাসার লোকদের বলবেন খাওয়া দয়াওয়াটা ঠিকঠাক করতে।”
দীপশিখা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, খুব ধীরে শ্বাস বইছে। অনির্বাণের ভীষণ খারাপ লাগে, এই মেয়েটাকে ও ভীষণ পছন্দ করে অথচ এখন কেমন অসহায় হয়ে শুয়ে আছে, মেনে নিতে পারে না অনির্বাণ। নাহ, আজকের পর থেকে দীপশিখাকে ও আর একা ছেড়ে দেবে না, আরো বেশি করে ঘিরে রাখবে।
একটু পরই দীপশিখা হালকা করে চোখটা মেলে, দেখে অনির্বাণ ভীষণ চিন্তিত মুখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটা এত মায়া করে কেন ওকে? চোখ মেলতে দেখেই অনির্বাণ কাছে এসে ভীষণ নরম গলায় বলে, “এখন কেমন লাগছে দীপশিখা?”
দীপশিখা হালকা করে মাথা নাড়ে, দূর্বল গলায় বলে, “আপনি থাকতে দীপশিখা কি নিভে যেতে পারে?”
অনির্বাণ বুকের কোথায় যেন একটা গভীর ভালোবাসা টের পায় এই মেয়েটার জন্য।
এর মাঝে দীপশিখার খালা খালু চলে আসে, অনির্বাণ ডাক্তারের কথাগুলো বলতেই খালা বলেন, “আর বলো না, ইদানীং ও একদম খেতে চায় না। কি যে হলো মেয়েটার, আমি ওর বাবা মাকে খবর দিয়েছি। উনারা আজ রাতের ট্রেনেই আসছেন।”
পরদিন রাতে দীপশিখার খালার বাসায় বিচার বসে, আসামি হলো দীপশিখা। বাবা মা দু’জনেই খুব করে বকুনি দেন। সেদিন অনির্বাণও এসেছে, বলে, “আন্টি, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি খেয়াল রাখব ক্যাম্পাসে আর আপনারা বাসায়। না খেলেই ঢাকা হেডকোয়ার্টারে ফোন চলে যাবে।”
ওর বলার ভংগীতে দীপশিখা হেসে ফেলে, তারপর বলে, “আমার তো খেতেই ইচ্ছে করে না।”
মা পাশ থেকে বলে, “জোর করে খাবি। কি হয়েছে শরীরের অবস্থা।”
সেদিন রাতে দীপশিখার সাথে মা যখন শুতে আসেন তখন দীপশিখা মাকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে শুয়ে থাকে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, “হ্যাঁ রে দীপ, অনির্বাণ ছেলেটা কি ভালো! তোর বাবারও খুব পছন্দ ওকে। আমরা যখন এসেইছি, ওর মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।”
দীপশিখা কিছু বলে না, ছোট্ট করে বলে, “উম”।
দীপশিখার আজ অনির্বাণের সাথে দেখা হবার প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই প্রথম থেকেই ছেলেটা নানান ছুতোয় ওকে ঘিরে আছে। ওর ছোট ছোট ব্যাপারেও ওর তীক্ষ্ণ নজর। ওর কষ্ট, সুখ সব যেন ও ভাগ করে নিতে চায়। যদিও মুখে কখনো ভালোবাসি শব্দটা বলেনি কিন্তু ওর কাজগুলো থেকে বোঝাই যায় অনির্বাণ ওকে ভালোবাসে। হঠাৎ করেই খুব খারাপ লাগে দীপশিখার, গতকাল জ্ঞান হারানোর আগে ও খুব পচা কথা বলেছে অনির্বাণকে। কাল দেখা হলে সরি বলে নিতে হবে।
*******************
খুলনা শহরের একপাশে রূপসা ব্রিজ, অনেকেই সন্ধ্যার পর এখানে আসে ব্রিজটা দেখতে। কিছু রেস্টুরেন্টও আছে। আজ সন্ধ্যায় নদী থেকে বেশ একটা ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে, অনির্বাণ আর দীপশিখা বসে আছে। অনির্বাণ আলতো করে বলে, ” দীপশিখা, আমাদের বাসায় তোমার বাবা মা এসেছিল কাল। তারা যে দীপশিখাকে নিভিয়ে দিতে চায়।”
দীপশিখা মিষ্টি হেসে বলে, “সমস্যা কি, অনির্বাণ তো আছে যে দীপশিখাকে নিভে যেতে দেবে না।”
******-*-****
আজ দীপশিখার বিয়ে, খুলনা থেকে অনির্বাণের অনেকেই এসেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা দুপুরেই করতে হয়েছে। রাতেই ওরা ফিরে যাবে খুলনাতে। দীপশিখার ইচ্ছেমতো চিত্রা ট্রেনের কয়েকটা বাথ রিজার্ভ করা হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিরাও সবাই যাবে ট্রেনে।
কমলাপুর রেলস্টেশনে আজ একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। একটা লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পরা বউ, সাথে বরযাত্রী খুলনাগামী চিত্রা ট্রেনের দিকে এগিয়ে চলছে। ট্রেনের কাছে এসে দীপশিখা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে পুরো ট্রেনটা বিয়ে বাড়ির মতো লাল, নীল ছোটো ছোটো বাতি দিয়ে সাজানো। কি যে সুন্দর লাগছে ট্রেনটা! অনির্বাণের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই অনির্বাণ হেসে বলে, “বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে এই ব্যবস্থা। আমার বাসর রাত হবে এই ট্রেনে, সেটা যদি লাল, নীল বাতি দিয়ে না সাজাই তা হয়? অনির্বাণ দীপশিখার বিয়েতে আলো জ্বলবে না তো কার বিয়েতে জ্বলবে?”
দীপশিখা মিষ্টি একটা হাসি হাসে, তারপর কিছুদিন আগে স্বপ্নে দেখা দৃশ্যটার মতো অনির্বাণ ওকে হাত ধরে ট্রেনে ওঠায়। আশেপাশে অনেকে এসে অবাক চোখে ওদের দেখতে থাকে।
সেদিন রাতে ঢাকা থেকে খুলনার পুরো পথটা জুড়ে একটা রঙিন আলোক উজ্জ্বল ট্রেন ছুটে চলে, সবাই অবাক হয়ে এই স্বপ্নের ট্রেনটা দেখতে থাকে যেখানে এই পৃথিবীর দুটো সুখী মানুষ হাত ধরে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। দীপশিখা অনির্বাণের বুকে মুখ রেখে বলে, “আমাকে এমন করেই ঘিরে রাখবে তো? তোমার দীপশিখাকে কখনো নিভে যেতে দেবে না তো?”
অনির্বাণ গভীর মমতায় দীপশিখাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বলে, “অনির্বাণ কখনোই দীপশিখাকে নিভে যেতে দেবে না।”
(সমাপ্ত)