অনির্বাণ পর্ব-০২

0
1098

#অনির্বাণ (পর্ব ২)

বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করার পর কটা দিন বেশ ব্যস্ততায় কেটে যায় দীপশিখার। এর মাঝে কয়েকবারই দেখা হয়েছে অনির্বাণের সাথে। মাঝে মাঝে ভার্সিটির বাসে একসাথে যাওয়া আসা হয়। অনির্বাণ ওদের কাছেই থাকে ওর মায়ের সাথে। এক মা ছাড়া আর কেউ নেই ওর। গল্পে গল্পে ইতিমধ্যে অনেক কিছুই জেনেছে। বিয়ের কথা উঠতেই সেদিন দীপশিখা বলেছে, “আপনার জন্য মেয়ে আমি খুঁজে দেব। আপনার মতো দুষ্ট মানুষের জন্য একটা লক্ষী কিন্তু কড়া মেয়ে দরকার যাতে আপনাকে সামলাতে পারে।”

অনির্বাণ মুখ ফসকে সেদিন বলে ফেলেছিল, “হ্যাঁ, এই যেমন আপনি। ”

মুহুর্তেই দীপশিখার মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। অনির্বাণ ভালো করেই জানে সুমনের সাথে ওর রিলেশনের ব্যাপারটা। আর কিছুদিন পরেই বিয়ে করতে যাচ্ছে ওরা। তাও কথাটা কেন বলল অনির্বাণ, ভেবে পায় না দীপশিখা।

এইসব হাবিজাবি যখন ভাবছে ঠিক তখুনি সুমনের ফোনটা আসে, ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে সুমন বলে উঠে, “কি খবর আমার ডার্লিং এর? তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

দীপশিখা খুশি খুশি গলায় বলে, “কি সারপ্রাইজ জনাব? বাসায় বিয়ের কথা বলেছ?”

সুমন একটু বিরক্ত গলায় বলে, “বলব সময় মতো। কিন্তু আমি এখন কোথায় বলো তো?”

দীপশিখা আন্দাজ করে বলে, “এখন তো রাত নয়টা, তুমি নিশ্চয়ই বাসায় ফিরেছ।”

সুমন রহস্যময় ভংগীতে বলে, “ঠিক বাসায় না, তবে বাসার মতোই। আপনি ইচ্ছে করলেই আমাকে দেখে যেতে পারেন। আমি এখন খুলনায়, হোটেল রয়ালে।”

দীপশিখার বুকটা কেমন করে ওঠে, সুমন খুলনায়। ইশ, একবারও তো বলেনি ওকে। দীপশিখা উত্তেজিত গলায় বলে, “তুমি আমাকে আগে বলনি কেন। ভীষণ ভালো লাগছে।”

সুমন আবদারের সুরে বলে, “এখনি চলে আসো, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার খালা খালু তো আবার এই রাতে তোমাকে বের হতে দেবে না।”

কথাটা ঠিক, ও ঢাকা থেকে খুলনায় এসে থাকছে অবধি খালা খালু ওকে চোখে চোখে রাখে। ঠোঁট কামড়ে একবার ভাবে কি করা যায়, ওরও ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসে, একমাত্র অনির্বাণ আসলে ওকে এই রাতে বের হতে দেবে। দীপশিখা অনির্বাণকে ফোন করে সব খুলে বলে, শেষে বলে, “প্লিজ, আপনি একটা ব্যবস্থা করুন।”

ওপাশ থেকে অনির্বাণের চটুল গলা পাওয়া যায়, “অনির্বাণ থাকতে দীপশিখা নিভে যেতে পারে না।”

দীপশিখা হেসে ফোনটা রাখে। দ্রুত হালকা করে সাজে, চুলটা সেট করে নেয়। দীপশিখা বাসায় খালা খালুকে বলে যে ওদের ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন মিলে রাতে বাইরে খাবে, অনির্বাণও যাবে। খালা খালু অনির্বাণের নাম শুনে আর আপত্তি করে না। কিছুক্ষণ পরেই অনির্বাণ আসতেই ওরা বেরিয়ে পড়ে। দীপশিখার কেমন যেন নিজেকে চোর চোর লাগছে। কেমন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে যাচ্ছে।

অনির্বাণ গুনগুন করে গান গাইছে, “আমার রাই যায় গো অভিসারে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিসারে।”

দীপশিখা ভ্রু কুঁচকে বলে, “এই গান আপনি কোথায় পেলেন, শুনিনি তো কখনো।”

অনির্বাণ মুখটা কপট গম্ভীরমুখে বলে, “শোনার কথা না, এটা অখ্যাত শিল্পী অনির্বাণের রচিত গান যা কি না এইমাত্র সৃষ্টি হইল।”

ওর বলার ভংগীতে হেসে ফেলে দীপশিখা।

কিছুক্ষনের মাঝেই ওরা হোটেল রয়ালে পৌঁছে যায়। দীপশিখা সুমনকে ফোন করে বলে, “আমি লবিতে বসছি, তুমি নামো।”

সুমন আবদারের সুরে বলে, “লবিতে কেন, রুমে চলে আসো। কতদিন পর আমার হবু বউকে দেখব, একটু আদর করব না, তাই কি হয়।”

দীপশিখার গালটা লাল হয়ে যায়, বলে, “আহ, খালি দুষ্টুমি। আমি অনির্বাণকে নিয়ে এসেছি তা না হলে তো খালা বের হতেই দিত না। তুমি নামো প্লিজ।”

পাঁচ মিনিটের মাঝেই সুমন চলে আসে। অনির্বাণের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় দীপশিখা। দু’জনে হাত মেলায়। অনির্বাণ বলে, “আপনারা গল্প করুন, আমি একটু আশেপাশে ঘুরে আসি। আমাকে ফোন করলেই আমি এসে নিয়ে যাব।”

অনির্বাণ বিদায় নিতেই সুমন ওকে নিয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসে। বার বার অনুরোধ করে, চলো রুমে যেয়ে একান্তে আলাপ করি। দীপশিখা সে কথার পাত্তাই দেয় না, বলে “বিয়ে হোক, তারপর। আমার ভীষণ খুশি লাগছে তুমি এসেছ। কাল তোমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াব। দেখি অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়।”

সুমন বিরসমুখে বলে, “আরে বাবা, আমি এত কষ্ট করে এলাম তোমার সাথে একটু একান্তে সময় কাটাতে আর তুমি ঘুরাঘুরি নিয়ে আছ। আর ঐ অনির্বাণ ছেলেটা ছাড়া দেখি তুমি চলতেই পারছ না।”

দীপশিখা আদরের ভংগীতে সুমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “আহা, বাবুর হিংসা হয়েছে। আমার কাছে আপনিই সবার আগে।”

সে রাতে সুমনকে বিদায় জানিয়ে দীপশিখা যখন ফিরছিল তখন ও অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা বলুন তো সুমনকে নিয়ে কাল কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। আমি তো এখানকার তেমন কিছুই চিনি না। ও কাল রাতেই চলে যাবে।”

অনির্বাণ এক মুহুর্ত দেরি না করে বলে, “একটা গাড়ি সারাদিনের জন্য ভাড়া করে দেব। তাতে করে আপনারা রাধা কৃষ্ণ চলে যাবেন বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখতে। খুব সুন্দর। ওখানে বিরাট একটা দীঘি আছে, তার পাড়ে বসে আমার নতুন লেখা গানটা গাইবেন।”

দীপশিখা দুষ্টুমি করে হাত দিয়ে মারের ভংগী করে, তারপর বলে, “খুব ভালো আইডিয়া। কিন্তু সবকিছু আপনি ব্যবস্থা করে দেবেন। আর আপনিও চলুন না।”

অনির্বাণ গম্ভীরমুখে বলে, “আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না, মাংস হতে চাই।”

দীপশিখা প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলে, “আপনি এত্ত দুষ্টুমি করতে পারেন। আচ্ছা শুনুন, আমি কিন্তু বাসায় বলব ভার্সিটি যাচ্ছি, কোনো কারণে আপনাকে ফোন দিলে তাই বলবেন।”

অনির্বাণ মাথা নেড়ে বলে, “জো হুকুম।”

পরদিন সকালে দীপশিখা সুন্দর করে সাজে। কোনোমতে নাস্তাটা সেরেই বেরিয়ে পড়ে। হোটেল রয়ালের সামনেই দেখে অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে। দীপশিখা কাছে আসতেই ও বলে, “আজ দীপশিখার ঔজ্জ্বল্যে আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে, সুমন বাবু তো আজ চোখ নামাবেই না।”

একটু লজ্জার হাসি হাসে দীপশিখা। ওকে সহজ করতে অনির্বাণ বলে, “ওই যে টয়োটা এক্সিও গাড়িটা দেখছেন ওটা আপনাদের। ড্রাইভারকে সব বলা আছে।”

এরপর ড্রাইভারকে ডেকে অনির্বাণ দীপশিখার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দীপশিখা একটু ইতঃস্তত করে বলে, “আচ্ছা, ড্রাইভারকে কত টাকা দিতে হবে?”

অনির্বাণ হাত তুলে বলে, “এটা আমার গিফট, আপনাদের বিয়ের থুক্কু ডেটিং এর।”

দীপশিখা এবার একটু গম্ভীরমুখে বলে, “না, টাকাটা বলুন, আমি দিয়ে দেব।”

অনির্বাণ তাড়াহুড়ো করে বলে, “এই রে, আপনি রাগ করেছেন, সরি। আপনি ঘুরে আসুন, টাকাটা আমাকে পরে দিয়ে দিবেন।”

এবার একটু সহজ হয় দীপশিখা। এর মাঝে সুমন নেমে আসতেই ওরা গাড়িতে উঠে পড়ে। অনির্বাণ হাত নেড়ে বিদায় জানায়, দীপশিখাও মিষ্টি হেসে হাত নাড়ে। হঠাৎ করেই অনির্বাণের মনে হয় দীপশিখাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে, কেন জানি ওর মনটা আজ খারাপ লাগছে। হোটেল থেকে বের হয়ে ও ভাবতে থাকে। আজ ভার্সিটি যেতেই ইচ্ছে করছে না। বাসায় ফিরতেই মা খুব অবাক হয়, বলে, “কি রে আজ ভার্সিটি যাবি না।”

অনির্বাণ আনমনে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, “মা, একটু চা দিবা।”

অনির্বাণের মা চিন্তিত মুখে রান্নাঘরের দিকে যান। কি হলো আবার ছেলেটার।
*************

সুমন চলে যাবার কিছুদিন পর দীপশিখা একদিন ডিপার্টমেন্টে বসে একটা রিপোর্ট লিখছিল আর ভাবছিল সুমন যাবার সময় খুব রাগ করে গেছে। সেদিন ঘুরে আসার পর সুমন ওকে বার বার রুমে যাবার জন্য অনুনয় করেছিল, কিন্তু দীপশিখা রাজি হয়নি। ও এগুলো একদমই পছন্দ করে না, মেনেও নিতে পারে না। ও একটু কঠিন গলায় বলেছিল, বিয়ের পর এগুলো হবে। সেদিনের পর থেকেই সুমনের সাথে কথা কম হচ্ছে। এই যখন ভাবছে ঠিক তখুনি ওর সামনে টেবিলে ঠকঠক আওয়াজে ও মুখ তুলে তাকাতেই দেখে অনির্বাণ, বলে, “কি ব্যাপার, এমন উদাস হয়ে রাধা কার কথা ভাবছে? নিশ্চয়ই সুমন কৃষ্ণের কথা।”

দীপশিখা ভেতরে ভেতরে চমকে যায়, নিজেকে সামলে বলে, “কি ব্যাপার, কটা দিন ধরে আপনার পাত্তাই নেই। আপনার কি হয়েছে, নাকি আপনি কোনো রাধার খপ্পরে পড়েছেন।”

অনির্বাণ মজা করে বলে, “আমার রাধা চুরি হয়ে গেছে। আচ্ছা শুনুন, আমি আপনাদের ডিপার্টমেন্টে একটা কাজে এসেছিলাম। সামনে ভার্সিটির প্রতিষ্ঠা দিবসে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে আপনার মতো ইয়াং ট্যালেন্ট লোকদের খুঁজে বের করা।”

দীপশিখা চোখ বড় বড় করে বলে, “আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন, আমি নাচ, গান কিছুই পারি না।”

অনির্বাণ একগাল হেসে বলে,” তাই? কিন্তু কবিতা আবৃত্তি করেন না সেটা বিশ্বাস করি না। আপনার চেহারাতে একটা কবি কবি ভাব আছে।”

দীপশিখা হেসে ফেলে, বলে,”চেহারাতে কি আছে জানি না, তবে কবিতা আমার ভালো লাগে।”

অনির্বাণ হৈ হৈ করে বলে, “তাতেই হবে। আমার চোখ ঠিকই আবিষ্কার করেছে, আপনার নাম দিয়ে দিচ্ছি। আপনি এখন থেকেই প্রাকটিস শুরু করে দেন।”

দীপশিখা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে, তারপর বলে, “কোন কবিতাটা আবৃত্তি করা যায় বলুন তো।”

অনির্বাণ এক মুহুর্ত দেরি না করেই বলে, “আহা, ওই কবিতাটা আবৃত্তি করবেন,
‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে”

দীপশিখা হাসতে যেয়েও গম্ভীর হয়ে যায়, চকিতে একটা কথা মনে হয়, অনির্বাণ কি ওকে পছন্দ করে? আগেও দু’একবার কথাটা মনে হয়েছে। এই যে এখন কথাটা বলল তা কি নিছক দুষ্টুমি নাকি এটা ওর মনের কথা?

সেদিন রাতে দীপশিখা বাসায় ফিরে জীবনানন্দের কবিতার বইটা বের করে দেখতে থাকে। কয়েকটা কবিতা ওর ভীষণ পছন্দের, তার মধ্যে অনির্বাণের বলা কবিতাটাও। কি ভেবে কবিতাটা ও পড়তে যাবে ঠিক তখুনি বাসা থেকে ফোন আসে, বাবার ফোন। দীপশিখার বুকটা ধক করে উঠে, এত রাতে বাবা ফোন করেছে, কোনো বিপদ না তো। কাঁপা হাতে দীপশিখা ফোনটা ধরে, ওপাশ থেকে বাবার উদ্বিঘ্ন গলা পাওয়া যায়, “দীপ, তুই কাল সকালে ঢাকা চলে আয়, তোর মা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।”

দীপশিখার মাথাটা ঘুরে উঠে, বাবাকে বার বার জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। যা জানা যায় মায়ের হঠাৎ করেই পুরনো শ্বাসকষ্টটা এতটা বেড়ে গেছে যে ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেছে। দীপশিখার খালা খালুও ছুটে আসেন, সব শুনে বলেন, “কাল সকালের ট্রেনেই তুই চলে যা।”

দীপশিখার চোখে জল, ভাবে, কাল টিকেট কি করে পাবে। চোখটা মুছে অনির্বাণকে ফোন দেয়, ও তো সবসময় ট্রেনেই যাতায়াত করে, ও হয়ত ব্যবস্থা করতে পারবে।

অনির্বাণ মশারী করে মাত্রই ঘুমাতে যাবে এমন সময় দীপশিখার ফোন পেয়ে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভাংগা গলায় দীপশিখা বলে, “অনির্বাণ, আপনি আমাকে কাল সকালে ঢাকার একটা টিকেট করে দিতে পারবেন। মা খুব অসুস্থ, আমাকে কালই ঢাকা যেতে হবে।”

অনির্বাণ আশ্বাস দিয়ে বলে, “আপনি একদম টেনশন করবেন না, আন্টি ভালো হয়ে যাবে। আর কাল সকাল ৮টার মধ্যেই স্টেশনে চলে আসবেন।”

সেদিন রাতে দীপশিখা ঘুমোতে পারে না, একটু পর পরই বাবাকে ফোন দেয়। শেষরাতে চোখ লেগে আসে, ঠিক ভোর সাতটায় অনির্বাণ ওকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। দীপশিখা হুড়মুড় করে উঠে পড়ে, ভাগ্যিস অনির্বাণ ফোন দিয়েছিল তা না হলে তো ট্রেন মিস হতো। অবশ্য খালা সকালে উঠেই রান্না করছেন, ওর দুপুরের খাবার দিয়ে দেবে।

আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই দীপশিখা স্টেশনে চলে আসে। অনির্বাণ এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠে। দীপশিখা ওর সিটে বসে পড়ে, চোখমুখ ফোলা ফোলা। বোঝায় যাচ্ছে কান্না করেছে অনেক। কিছুক্ষণ পর দীপশিখা অনির্বাণকে বলে, ” অনেক ধন্যবাদ, আপনি না হলে আমি টিকেটই পেতাম না। ট্রেন তো ছেড়ে দেবে এখন, আপনি নেমে পড়ুন।”

অনির্বাণ এবার দীপশিখার পাশে বসতে বসতে বলে, “আমি যাচ্ছি আপনার সাথে, এ অবস্থায় আপনাকে একা ছাড়তে পারি না।”

দীপশিখা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অনির্বাণের দিকে, মনে মনে একটু সাহস পায়। আসলেই ওর কেমন হাত পা ভেংগে আসছে। যদিও সকালে খবর পেয়েছে যে মা এখন বিপদমুক্ত তাও ওর মনটা একটা অজানা ভয়ে ঘিরে আছে। খালা আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মা যেহেতু এখন অনেকখানি ভালো তাই ওই না করেছে আসতে।

ট্র্ব্বেনটা ছাড়তেই দীপশিখা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়, সারারাত ঘুম হয়নি। দুপুরের দিকে ঘুম ভাঙতেই অনির্বাণ ওর জন্য চা নিয়ে আসে। দীপশিখার মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে, এক কাপ চা আসলেই দরকার ছিল এখন, আড়মোড়া ভেঙে বলে, “আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে এলেন।”

অনির্বাণ নরম গলায় বলে, “কোনো কষ্ট নেই। আমার তো আজ ডে অফ ছিল। আর আপনি এই অবস্থায় একা একা যাবেন তাই কি হয়।”

দীপশিখা অনির্বাণের গলায় একটা মায়া টের পায়। আজ ছেলেটা কোনো দুষ্টুমি করছে না। ওর জন্য চিন্তিত। একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরতে চায় দীপশিখাকে।

ওরা যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছে তখন রাত আটটা বেজে গেছে। দীপশিখা ছুটে যেয়ে মায়ের কেবিনে ঢোকে, পেছনে অনির্বাণ। মা এখন অনেকখানি সুস্থ। দীপশিখা মাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সারাদিনের উৎকন্ঠাটা এখন কান্না হয়ে বের হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে অনির্বাণের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাবা খুব খুশি হন যে ছেলেটা দীপের সাথে এসেছে।

দীপশিখা একটু উশখুশ করে একবার জানতে চায় সুমন এসেছিল কিনা, বাবা না সূচক মাথা নাড়ে। দীপশিখা সকালেই সুমনকে বলেছিল ও আসছে ঢাকায়, মা অসুস্থ। মনটা খারাপ হয়ে যায়। ইদানীং সুমন কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছে।

একটু পরেই অবশ্য সুমন আসে, হাতে একটা ফলের বাস্কেট। দীপশিখার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায়। সুমন মায়ের সাথে একটু কথা বলে। তারপর অনির্বাণের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে দীপশিখাকে বলে, “আমি কাল আবার আসব, আজ একটা কর্পোরেট ডিনার আছে। আমাকে যেতে হচ্ছে, কিছু লাগলে আমাকে ফোন করো।”

দীপশিখার মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়, কিছু বলে না, শুধু ছোট্ট করে বলে, “আচ্ছা।”

সুমন চলে যেতে দীপশিখার বাবা বলে, “দীপ, তুই বরং বাসায় গিয়ে রেস্ট কর। আমি তো আছিই এখানে।”

দীপশিখা জোরে মাথা নাড়ে, বলে, “বাবা, তুমি বরং আজ রেস্ট করো। আর অনির্বাণ, আপনিও বাবার সাথে আমাদের বাসায় যেয়ে একটু রেস্ট করেন।”

অনির্বাণ গম্ভীরমুখে বলে, “আপনি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমার বন্ধুর বাসা কাছেই, ওকে বলে রেখেছি। আমি বরং থাকি, আংকেল আপনি আজ বাসায় রেস্ট নিন।”

দীপশিখার বাবা খুব খুশি হয়, ছেলেটা ভীষণ ভালো। যাবার আগে ওদের বলে যায় ক্যান্টিনে যেন রাতের খাবার খেয়ে নেয়।

সেদিন রাতে অনির্বাণের সাথে অনেক গল্প হয় দীপশিখার, বাবা মারা যাবার পর ওর মা একা কেমন করে ওকে মানুষ করেছেন সেই গল্প। বুয়েটে চান্স পাবার পর মা কত খুশি হয়েছিল সে গল্প শোনে। এরপর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে টিউশনির গল্প শোনে। এক মা ছেলের কঠিন একটা জীবন সংগ্রামের সন্ধান পায় দীপশিখা। অনির্বাণের জন্য মনটা একটা অদ্ভুত মায়ায় ভরে ওঠে। দীপশিখা ভাবে, এবার খুলনা যেয়ে অবশ্যই ওর মায়ের সাথে দেখা করবে ও।

পরদিন সকালে দীপশিখা যখন ঘুম থেকে ওঠে, দেখে অনির্বাণ বাইরের চেয়ারে হেলান দিয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। কেমন শিশুর মতো লাগছে এখন। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় ওর। কাছে এসে একবার ডাকতেই ধড়মড় করে উঠে পড়ে অনির্বাণ, জড়ানো গলায় বলে, “আন্টি, ভালো তো?”

দীপশিখা কোমল গলায় বলে, “হ্যাঁ, মা ভালো আছে। আপনি তো আজ চলে যাবেন, কাল বললেন সকালে ডেকে দিতে।’

অনির্বাণ একটু হাসে, তারপর বলে, ” হ্যাঁ, আপনার সাথে নাস্তাটা করেই বেরিয়ে পড়ব। আন্টি একদম সুস্থ হলেই আপনি আসবেন। আর হ্যাঁ, আপনি যেদিন ফিরবেন আমাকে বলবেন, আমি স্টেশন থেকে নিয়ে যাব।”

সেদিন অনির্বাণ চলে যাবার পর হুট করেই কেমন একা একা লাগতে থাকে দীপশিখার। বার বার মনে হতে থাকে, শুধু ওর জন্যই অনির্বাণ সেই খুলনা থেকে ঢাকা আসল, সারাটা রাত ওর সাথে হাসপাতালে থাকল। আবার আজ চলে যাচ্ছে, কোনো বিশ্রামই নিতে পারল না। কেন জানি অনির্বাণের জন্য ওর মনে একটা কষ্ট হতে থাকে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে