#অনির্বাণ (পর্ব১)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
দীপশিখা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে, রাত ৭.১৫, আর সতের মিনিট পরেই ট্রেনটা ছাড়ার কথা। ঢাকা থেকে খুলনাগামী চিত্রা ট্রেনের এই এসি চেয়ার কোচটা খুব আরামদায়ক। বেশ খোলামেলা, অন্যান্য ট্রেনগুলার মতো চাপা না। ভাগ্যক্রমে দীপশিখা সামনে টেবিল ওয়ালা সিটটা পেয়েছে। একটাই অস্বস্তি, পাশাপাশি দুটো সিট, একটা না হয় ওর, কিন্তু অন্যটা? দীপশিখা মনে মনে দোয়া করতে থাকে পাশের মানুষটা যেন একটা মেয়ে হয়। আর কেউ না আসলে আরো ভালো হয়। দীপশিখা চোখের চশমাটা ঠিক করে আড়চোখে আরেকবার ঘড়িটা দেখে, ৭.৩০ টা বেজে গেছে, এখন পর্যন্ত পাশের সিটে কেউ আসেনি। মনে মনে একটা হালকা আনন্দ টের পায়, আহ, কেউ মনে হয় আসবে না, ও আরাম করেই যেতে পারবে। বাবা এসেছিল ওকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে, যেহেতু ও সিট পেয়ে গিয়েছিল ঠিকঠাক তাই ও বাবাকে জোর করেই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
কিছুদিন আগেই দীপশিখা খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেক্ট বিভাগে লেকচারার হিসেবে ঢুকেছে। সাধারণত ও বাসেই যাতায়াত করে, কিন্তু একজন বলল রাতে ট্রেনের জার্নি নাকি অসাধারণ, একটা অদ্ভুত দুলুনিতে ঘুম চলে আসে। কিন্তু এখন যদি পাশে একটা বদলোক এসে বসে আর সারাক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে তাহলে ট্রেনের দুলুনিটা আর ভালো লাগবে না। এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই ট্রেন ছাড়ার হুইশেল শোনা যায়, দীপশিখা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে এবার জানালার কাছের সিটটায় বসে। মৃদুগতিতে ট্রেন চলা শুরু করেছে। ঠিক এমন সময় পেছনে দরজার কাছ থেকে একটা চেচামেচি শোনা যায়, কেউ একজন বলছে, “ভাই, এমন করে কেউ শেষ মুহূর্তে ট্রেনে ওঠে, আরেকটু হলেই তো দূর্ঘটনা ঘটত।”
যাকে এই কথা বলা হলো সেই ছেলেটা একটু বোকা হেসে বলে, “আসলেই ভুল হয়ে গেছে। ধন্যবাদ ভাই, আপনি হাত ধরে না উঠালে উঠতেই পারতাম না।”
ধন্যবাদ দিয়ে ছেলেটা এবার টিকেটে লেখা সিট নম্বর মিলিয়ে খুঁজতে খুঁজতে দীপশিখার সিটের কাছে এসে ব্যাগপ্যাকটা উপরের র্যাকে রাখে। দীপশিখা সরু চোখে তাকিয়ে দেখে, ওর বয়সী বা ওর চেয়ে হয়ত কয়েক বছরের বড় হবে ছেলেটা। কিন্তু ছেলেটা কি এখানে বসবে নাকি? দীপশিখা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ছেলেটা এক গাল হেসে নিতান্ত পরিচিত মানুষের মতো বলে, “বেশ বাঁচা বেঁচে গেছি আজ, আরেকটু হলেই ট্রেনটা মিস হয়ে যেত।”
দীপশিখা বিড়বিড় করে বলে, “খুব ভালো হতো।”
ছেলেটা বেশ স্বচ্ছন্দে পাশে বসে পড়তে পড়তে বলে, “কিছু বললেন আপনি? বাই দ্যা ওয়ে আপনি যে সিটটায় বসে আছেন সেটা কিন্তু আমার। অসুবিধে নেই, আমি জানালার পাশে বসে অনেক গিয়েছি। আপনি নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকুন, কিছুক্ষণ পর যখন শহরটা পেরিয়ে যাব তখন বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগবে। ও হ্যাঁ, সেই সময় এক কাপ চা থাকতে হবে হাতে, চিন্তা করবেন না, আমিই ব্যবস্থা করব।”
দীপশিখা ভীষণ বিরক্ত হয়, যা ভয় পাচ্ছিল তাই হয়েছে। এই ছেলে তো সারারাত ওর মাথা খাবে, নানান উছিলায় কথা বলার চেষ্টা করবে। ও কিছুই বলেনি তার আগেই এই ছেলে যেভাবে কথা বলা শুরু করেছে, একটু সুযোগ পেলেই এ মাথায় চড়ে বসবে। আর ওকে জানালার পাশে বসতে দিয়েছে এই বাহানাটা কাজে লাগাবে, নাহ, ও এই সুযোগ দেবে না। দীপশিখা একটা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে মুখচোখ কঠিন করে বলে, “শুনুন, আমি সরি, আমি আগে কখনো ট্রেনে যাইনি তাই ভুল করে আপনার সিটে বসে পড়েছি। আসুন, আমি বদলে নিচ্ছি সিট।”
ছেলেটার মাঝে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, হাত তুলে বলে, “আরে করছেন কি, চুপচাপ বসে পড়ুন। আপনি ছোট মানুষ, প্রথম ট্রেনে করে যাচ্ছেন, জানালার পাশের সিট আপনারই প্রাপ্য।”
দীপশিখা এবার গম্ভীর গলায় বলে, “আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাই আমাকে আপনি ছোট মানুষ ভেবে কথা বলবেন না। ঠিক আছে, আপনার কথাই রইল। কিন্তু সারা পথে আর কোনো কথা বলে বিরক্ত করার চেষ্টা করবেন না।”
ছেলেটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, “আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান? কি বলেন, বোঝায় যায় না, আপনাকে দেখে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোন ডিপার্টমেন্ট?”
দীপশিখা কটমট করে চেয়ে থাকে তারপর বলে, “আমি বলেছি আমার সাথে কথা না বলতে, আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”
ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে চেয়ে থাকে, তারপর বেশ বুঝেছে এমন ভংগীতে বলে, “আচ্ছা, বুঝেছি। আমি না হয় কথা বলব না, কিন্তু আপনার কিছু লাগলে কোনো রকম দ্বিধা করবেন না।”
দীপশিখা মনে মনে আফসোস করে, ইশ, কেন যে ট্রেনে করে আসতে গেল। বাবাও বার বার না করেছিল। কি ভেবে বাবাকে একটা ফোন দেয়, “বাবা, ট্রেন ছেড়েছে একটু আগেই। তুমি কিন্তু আমার জন্য রাত জেগে থেকো না। আর মাকে বলো ট্রেনে কোনো সমস্যাই নেই। তোমরা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ো।”
ওপাশ থেকে এবার মায়ের গলা পাওয়া যায়, মা ঠিকই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন সব। এমনকি পাশের ছেলেটা কি পরে আছে তাও জানতে চান। আরো কি কি বলতেই দীপশিখা বেশ কঠিন সুরে বলে, “মা, আমি নিজেকে সেফ রাখতে জানি। তুমি চিন্তা করো না।”
ফোন রাখতেই ছেলেটা বলে, “আহা, মায়েরা চিন্তা করবেই। আমার মা এখনো আমাকে বার বার ফোন করে খবর নেয়। আমার অবশ্য বাবা নেই আপনার মতো।”
দীপশিখা রাগ করতে যেয়েও রাগে না, ছেলেটার জন্য একটা হালকা খারাপ লাগা ঘিরে ধরে। বাবা একটা ছায়ার মতো, ও বোঝে। একটু মাথা নাড়ে দীপশিখা, তারপর ছোট্ট করে বলে, “হুম।”
ট্রেনটা টাংগাইল স্টেশন পেরিয়ে যেতেই দীপশিখা এবার ব্যাগ থেকে ছোট একটা হটপট বের করে, মা ওর প্রিয় মোরগ পোলাও করে দিয়েছে। খাবারের হটপটটা খুলতে যেতেই ছেলেটা হা হা করে ওঠে, বলে, “আহা, আর আধাঘন্টা পর খাবারটা খান। তখন আমরা যমুনা সেতু পার হব, ট্রেনটা তখন একদম ধীরে ধীরে পার হবে। খুব ভালো লাগবে, অনেকটা লন্ডনের টেমস নদীতে ডিনার করার মতো।”
উফ, এই ছেলেটা এত কথা বলে, দীপশিখা মুখটা ঘুরিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে, “সরি, আমি আপনার মতো এত রোমান্টিক না। আমার এখন ক্ষুধা লেগেছে আমি এখনই খেয়ে ফেলব। আপনি বরং আধাঘন্টা পর টেমস নদীতে মানে যমুনা নদীতে ডিনার করবেন।”
ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকায়, বিরস মুখে বলে, “আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আপনার মোরগ পোলাও যে ঘ্রাণ ছেড়েছে তাতে তো এখনি খেতে ইচ্ছে করছে, নিশ্চয়ই খুব মজা হয়েছে। আপনার মা রান্না করেছে?”
দীপশিখা মাথা নেড়ে খাওয়াতে মনোযোগ দেয়। খুব বেশি খেতে পারে না, যদিও খুব মজা হয়েছে, কিন্তু কেন জানি খেতে ইচ্ছে করছে না। অর্ধেকটুকুও খেতে পারে না। খাবারটা নষ্ট হবে, কি আর করা। দীপশিখা সিট থেকে উঠে ওয়াশরুমের কাছে বেসিনে হাতটা ধুয়ে এসে বসে। দেখে আশেপাশের সবাই খাচ্ছে। ছেলেটা অবশ্য এখনো খাচ্ছে না, হাসে দীপশিখা, বেশি রোমান্টিক। ছেলেটা অবশ্য দেখতে ভালোই, আকাশি রঙের টি শার্টে মানিয়েছে বেশ। সারা মুখে একটা অদ্ভুত সারল্য।
যমুনা সেতুর কাছাকাছি যখন ট্রেনটা আসে ঠিক তখন ছেলেটা ট্রেনের ক্যান্টিনের লোকেদের কি যেন অর্ডার দেয়। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পায় একটা কাটলেট আর একটা শুকনো চিকেন নিয়ে ছেলেটা খেতে বসে। দীপশিখার একটু খারাপ লাগে, ইচ্ছে করলে ওর থেকে মোরগ পোলাওটা শেয়ার করতে পারত। একবার বলতে গিয়েও থেমে যায়, না বাবা থাক, দেখা যাবে এই ছুতোয় সারারাত কথা চলবে।
ছেলেটা বেশ ভাবুক চোখে দীপশিখার পাশ দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, যদিও অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তারপর আয়েশ করে খেতে থাকে। দীপশিখা এবার ফেসবুকটা খুলে স্ক্রল করতে থাকে। মেসেঞ্জারে অনেক মেসেজ জমা হয়ে আছে। বিশেষ করে সুমনের মেসেজ। এক বছর ধরে সুমনের সাথে ওর রিলেশন, ঢাকার একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো জব করে, স্মার্ট, খুব ভালো লাগে দীপশিখার।
মেসেঞ্জারে সুমন অনেকগুলো প্রশ্ন করে রেখেছে। দীপশিখা একে একে সব প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়। উত্তর দেওয়া শেষ হতে না হতেই সুমনের ফোন আসে, দীপশিখা ফোনটা কানে চেপে ধরে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে। আড়চোখে দেখে একবার, নাহ, পাশে বসা ছেলেটা অবশ্য আর তাকিয়ে নেই। হাতে কি একটা উপন্যাসের বই নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে আর চায়ে চুমুক দিচ্ছে। এদিকে যেন মনোযোগই নেই। দীপশিখা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, আরাম করে সুমনের সাথে কথা বলতে থাকে, খুনসুটি করে। ওদিক থেকে কি একটা বলতেই দীপশিখা লজ্জায় লাল হয়ে বলে, “অসভ্য।”
পাশে বসা ছেলেটা ঘুরে তাকিয়ে বললে, “কিছু বললেন?”
দীপশিখার খুব রাগ হয়, কড়া করে কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নেয়, আলতো করে ফোনে বলে, “আচ্ছা, আমি এখন রাখি। কেন জানি ঘুম পাচ্ছে। তুমিও রাত জেগ না।”
ফোনটা শেষ করে দীপশিখা বাসাতেও জানিয়ে দেয় এবার ও ঘুমিয়ে পড়বে, বাবা মা যেন চিন্তা না করে। দীপশিখা ওড়নাটা ভালো করে টেনে নিয়ে চোখটা বন্ধ করে।
পাশ থেকে ছেলেটা বলে, “একটা পাতলা কম্বল নিয়ে নেন, ট্রেনেই ভাড়া পাওয়া যায়, একশ টাকা লাগবে। এসি কোচ তো, রাত যত বাড়বে তখন আরো ঠান্ডা লাগবে।”
আসলেই একটু ঠান্ডা লাগছে দীপশিখার, ছেলেটা ঠিকই বলেছে, রাত বাড়লে আরো ঠান্ডা লাগবে। কিন্তু এই কম্বল না জানি কত মানুষ ব্যবহার করেছে, নাহ, ও কিছুতেই এই কম্বল ব্যবহার করতে পারবে না। ছেলেটা এর মাঝেই একটা কম্বল নিয়ে এসেছে।
দীপশিখা নাক কুঁচকে বলে, “সরি, এটা আমি ব্যবহার করতে পারব না।”
ছেলেটা হেসে বলে, “ওহ বুঝেছি। আচ্ছা দাঁড়ান, আমার ব্যাগে একটা নতুন চাদর আছে, মায়ের জন্য কিনেছি। আপনি আপাতত গায়ে দিন, সমস্যা নেই।”
দীপশিখা জোরে মাথা নাড়ে, কিন্তু ততক্ষণে ছেলেটা চাদরটা বের করে ফেলেছে। খুব লোভ হচ্ছে চাদরটা গায়ে জড়াতে, তাহলে আরাম করে ঘুমাতে পারত।
দীপশিখাকে চুপ করে থাকতে দেখে ছেলেটা বলে, “এই যে রইল চাদরটা আপনার সামনেই। শীত লাগলে গায়ে জড়িয়ে নেবেন।”
দীপশিখা একটু ভাবে, নাহ, ছেলেটা খারাপ না। তারচেয়ে পরিচিতি হওয়া যাক, দীপশিখা এবার সহজ হয়ে বলে, “আমার নাম দীপশিখা, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি কিছুদিন আগে। আপনার নাম কি?”
ছেলেটা অমায়িক হেসে বলে, “আমি অনির্বাণ যে দীপশিখাকে নিভে যেতে দেয় না।”
দীপশিখা রাগ করতে যেয়েও হেসে ফেলে, “আপনি খুব দুষ্ট একটা মানুষ। আসলেই আপনার নাম অনির্বাণ?”
অনির্বাণ মাথা দোলায়, “জ্বি দ্বীপশিখা। এটা সত্য, চাইলে ভোটার কার্ডের ছবি দেখাতে পারি।”
দ্বীপশিখা হেসে বলে, “থাক, লাগবে না। আপনি কি করেন?”
অনির্বাণ রহস্যময় গলায় বলে, “আপনিও যা করেন আমিও তাই করি।”
“মানে? আপনিও শিক্ষক?”, দীপশিখা অবাক গলায় বলে।
অনির্বাণ কৌতুকের গলায় বলে, ” জ্বি, আমি ভাবছি আপনার সাথে আমার দেখা হয়নি কেন। আমিও তো আপনার বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াই।”
এবার দ্বীপশিখা একটু বিরক্ত হয়, “আপনি সব সময় এত মজা করেন কেন। কি করেন তার উত্তর না দিয়ে দুনিয়ার কথা বলছেন।”
অনির্বাণ একটা কান হালকা করে ধরে বলে, “সরি, সরি। আমি কম্পিউটার সাইন্স পড়াই। গতবছরই জয়েন করেছি। আর সেটা কিন্তু আপনার বিশ্ববিদ্যালয়েই, মজা করছি না। ক্লাশ খুললেই যখন আমার দেখা পাবেন ক্যাম্পাসে তখন ঠিক বিশ্বেস করবেন।”
দীপশিখা একটু থমকায়, এতটা আশা করেনি ও। এটা কি কাকতালীয়? ছেলেটাকে তো ও প্রথমে গুরুত্বই দেয়নি, ভেবেছে তেমন কিছু করে না। এখন তো দেখছি ওর চেয়ে এগিয়ে আছে প্রফেশনে।
দীপশিখা একটু গম্ভীরমুখে বলে, “হ্যাঁ, একই ক্যাম্পাসে দেখা হতেই পারে। যাক ভাল লাগল আপনার সাথে পরিচয় হয়ে, আর চাদরটার জন্য ধন্যবাদ। ”
অনির্বাণ মাথা নেড়ে বলে, “আরে, ধন্যবাদের কি আছে। আমরা হলাম কলিগ এখন। এটুকু না করতে পারলে আর কিসের কলিগ।”
দীপশিখা ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে, এই ছেলেটা আসলেই বেশি কথা বলে। একে আর সুযোগ দেওয়া যাবে না। চাদর দিয়ে মাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে ও।
অনির্বাণ একটা মুচকি হাসি দিয়ে ট্রেনের ওই কম্বলটা জড়িয়ে নিয়ে উপন্যাসটা পড়তে থাকে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না, একটা মৃদু ধাক্কায় ঘুমটা ভাংগে দ্বীপশিখার। চোখটা মেলে দেখে অনির্বাণ একটা পানির বোতল দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাংগাচ্ছে। দীপশিখা চোখ মেলতেই অনির্বাণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “বাব্বা, আপনি এত ঘুমাতে পারেন। সেই কখন থেকে ডাকছি, উঠছেনই না। শেষে এই বোতলের আশ্রয় নিলাম।”
দীপশিখা একটু লজ্জা পায়, তারপর বলে, “চলে এসেছি? ও মা, বাইরে তো এখনো অন্ধকার।”
অনির্বান আশ্বাসের ভংগীতে বলে, “অনির্বাণ থাকতে দীপশিখার কোনো চিন্তা নেই। আপনার লাগেজ নামিয়ে ফেলেছি। চলুন দরজার দিকে এগোয়।”
এবার দীপশিখা রাগ করে না, আসলেই এই ছেলেটা না থাকলে তো ও ভালো বিপদে পড়ে যেত। এত ভোরে পৌঁছে যাবে বোঝেনি ও।
দীপশিখা নামতেই দেখে অনির্বাণ ইতিমধ্যে একটা অটোরিকশায় ওর লাগেজটা তুলে ফেলেছে। তারপর ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি তো শহরেই যাবেন?”
দীপশিখা মাথা নাড়ে, বলে, “হ্যাঁ, রয়েলের মোড়ের কাছেই আমি থাকি, আমার খালার বাসা।”
অনির্বাণ শিস বাজায়, “হা হা, আমিও আপনার কাছাকাছিই থাকি। যাক, অনেক কিছুই মিলে যাচ্ছে আপনার সাথে। আচ্ছা, আমার ফোন নম্বর ০১৭…, আপনারটাও কি তাই?”
দীপশিখা হেসে বলে, “থাক, আর ঘুরিয়ে ফোন নম্বর চাইতে হবে না। আপনার নম্বরে কল দিচ্ছি, সেভ করে নিন।”
অনির্বাণের চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে, বলে, “যাক, শেষ পর্যন্ত আপনার আস্থা জন্মাল আমার উপর। ধন্যবাদ দীপশিখা। ”
দীপশিখা হাসে, বোঝে ছেলেটা আসলে একটু দুষ্ট, কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব ভালো।
ওদের পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগে না। অনির্বাণ দীপশিখাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে। ওর খালা খালু অনেক ধন্যবাদ জনায়, একদিন অবশ্যই সময় করে আসতে বলে। দীপশিখাও বার বার অনুরোধ করে একদিন যেন ও আসে।
অনির্বাণ যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন ভোরের নরম আলো ফুটছে, একটা ঠান্ডা বাতাস চোখেমুখে লাগছে। ও গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নেয়, একটু আগেই এটা দীপশিখার গায়ে জড়িয়ে ছিল। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পায়। মেয়েটার চশমার পেছনে জ্ঞানী জ্ঞানী চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে, কোথায় যেন একটা ভীষণ ভালো লাগা কাজ করতে থাকে অনির্বাণের।
(চলবে)