অনিন্দিতা
লেখিকা__আনিকা_রাইশা_হৃদি
#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
২০০৬ সাল। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি একমাস হলো।ছোট থেকেই স্বপ্ন ডাক্তার হবো।ময়মনসিংহ শহরের ছোট একটি গ্রামে বসবাস আমার।এখানে থাকলে আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে বলে মনে হয় না।তাই বাবা পাঠিয়ে দিলেন ঢাকা।ছোট একটি গ্রামের মেয়ে আমি।আমাদের গ্রামের পরিবেশ ছিলো শান্ত, নির্জন।পাশদিয়ে বয়ে চলতো অবিরাম ব্রাহ্মপুত্র নদ।চারপাশে ধানক্ষেত, পাখির কলকাকলি। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যেতাম দূর, বহুদূর।রাতে ঝিঁঝিপোকার ডাক একটানা ভাঙা রেকর্ডারের মতো বাজতো।মাঝে আবার একটা কোলাব্যাঙও তাদের তাল দিতো।বলতো তোরা একা নেইরে আমিও আছি।নদীর পাড়ে বসে থাকতাম। যখন বক আসতো দৌড়ে যেতাম।তবে সাদা সাদা বকের দল উড়ে যেতো প্রাণপণে। শাপলা ফুল,কলমি ফুলের প্রতি লোভটা ছিল বরাবরই বেশি।সবার উঠার আগে সকালে উঠে গিয়ে নিয়ে আসতাম।ঐ যে নয়তো ওরা বেশি নিয়ে নিতো তো!
সেই আমি ঢাকা এসে যেন অকুল পাথারে পড়লাম।চারপাশে কোলাহল,ধূঁয়া, কাকের ডাক।এযেন পুরোই বিপরীত চিত্র। নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।মেসে থাকতাম।মেস থেকে কোচিং।কোচিং থেকে মেস আর পড়াশোনা এই আমার জীবন। মেসের মেয়েদের সাথে আমার তেমন সখ্যতা ছিলনা।মেয়েগুলো অতি আধুনিক ছিল। একদিন কোচিং থেকে এসে শুনলাম আমার রুমমেট চলে গেছে।নতুন একজন এসেছে।আমি আর রুমানা থাকতাম এক রুমে।মেয়েটা হ্যাংলাপাতলা রোগা গড়নের ছিল।তবে অতি আধুনিক। নতুন যে মেয়েটা এসেছে তার নাম অনিন্দিতা। হলদে সাদা গায়ের রং, মাঝারি উচ্চতা।আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়েছিল মেয়েটি।আমিও একটা হাসি ফেরত দিয়েছিলাম। আমার মতোই মেয়েটি কোচিং করতে ঢাকা এসেছে। অবাক হলাম তার বাড়িও নাকি ময়মনসিংহের মগটুলা।মানে আমরা একই গ্রামের।যাই হোক মেয়েটি খুব ভালো।তবে মেয়েটিকে আমার কেমন জানি রহস্যময়ী লাগতো।তার কিছু কার্যকলাপ এমন ছিল হাসতে হাসতে হঠাৎ নিরব হয়ে যেত।মাঝরাতে উঠে কান্না করতো।আমি ভাবতাম তার হয়তো অনেক দুঃখ। ইতিমধ্যে একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখি অনি আমার পাশে নেই।ও আমি তাকে অনি বলে ডাকতাম।আর ও আমাকে তিলোত্তমা না ডেকে তিলো ডাকতো।অনি দেখি উদাসমনে জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালাম।তার দৃষ্টি বাইরে।তবে বাইরে কুটকুটে আঁধার ছাড়া আমি আর কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না।থেকে থেকে হুতুম পেঁচা ডাকছে।অনেকটা অবাক হয়েছিলাম ঢাকার মতো শহরে হুতুম পেঁচার ডাক শুনে। অনি হঠাৎই বলে উঠলো,
-জীবনের মায়া বড়ো মায়া।এই মায়া কাটানো বড়ই মুশকিল। জীবন এক বড় জটলা। যতো এর রহস্য কাটাতে চাই ততো জড়িয়ে যাই।
এটা বলে হাসতে হাসতে আবার নিরব হয়ে গেল অনি।তার এই অদ্ভুত রূপ আমি যতোবার দেখতাম ততোবারই অবাক হতাম।এর মধ্যে এইচএসসির রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। তুলনামূলক ভালোই হয়েছে রেজাল্ট। ভাবলাম একবার বাড়ি যাবো কতদিন বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়না।এর মধ্যে একটা জিনিস কিছুদিন যাবত খেয়াল করলাম বিশেষ করে অনি আসার পর মেসের সবাই আমার দিকে কেমন করে তাকায়।আমাকে দেখলে কানাঘুষা করে।আমি অবশ্য বিশেষ পাত্তা দিতাম না।বাড়ি যাওয়ার দিন তো মেসের ইনচার্জ বলেই বসলেন আমি নাকি একা একাই কথা বলি।আমি যেন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাই নয়তো কোনো হুজুর। আমি অনেকটা হতভম্বের ন্যায় বাড়ি ফিরে আসলাম।চিরচেনা গ্রাম আমার।বাতাসে একটা চেনা গন্ধ। নদীর ছলছল আওয়াজ,সাদা বকের সারি।আহা সে কি দৃশ্য!সবুজ ধানক্ষেত গুলো দেখে চোখটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল।নিজের মাটির গন্ধ পেয়ে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এসেছে চোখ থেকে।বাড়িতে যাওয়ার পর বিকালে আম্মা যা বললো তা শোনার জন্য মোটেও আমি প্রস্তুত ছিলাম না।মগটুলা গ্রামের এক মেয়েকে নাকি কিছুদিন আগে দুইটা ছেলে মিলে ধর্ষণ করে জঙ্গলে ফেলে রেখে গিয়েছিল মৃত অবস্থায় । মেয়েটার নাম অনিন্দিতা। ছেলে গুলো আমাদের পাশের বাড়ির। তবে তাদের কোনো শাস্তি হয়নি।ঐ যে টাকা,ক্ষমতা। কেমন জানি ভয়,কষ্ট,রাগ মিলিত এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। মাঝরাত। চারিদিকে আজ ঝিঁঝিপোকারা ডাকছেনা। তারাও কি শোক পালন করছে?কুলো ব্যাঙটাও চুপ। আমি জানালার পাশে শুয়ে আছি।দুচোখে ঘুম নেই আমার।বাইরে চাঁদ উঠেছে। আলো ছড়াচ্ছে সর্বত্র। এমন সময় একটা দমকা হাওয়া কাঠের জানালাটাকে নাড়িয়ে দিলো।আমি অনেকটা হকচকিয়ে উঠলাম।এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে।আমি দরজাটা খুলে দিলাম।দেখি অনি দাড়িয়ে আছে।পড়নে তার সাদা শাড়ি।চাঁদের আলোয় খুবই স্নিগ্ধ লাগছে তাকে।সে এগিয়ে চললো সামনে।আমিও তার পিছনে যেতে লাগলাম।কখন যেন আমাদের পুকুর পেরিয়ে বাঁশবাগানে ঢুকে পরেছি নিজেই খেয়াল করিনি।আমি ছিলাম নির্বিকার। না কোনো ভয় না কোনো শঙ্কা। অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিলাম। বাঁশবাগানের শেষ মাথায় গিয়ে দেখি দুইটা লাশ পড়ে আছে।ঐ ছেলে দুইটার লাশ।কি বিভৎস! আমি ভয়ে ভয়ে অনির দিকে তাকালাম। অনি বললো,
-আমার সাথে যা হয়েছে তা আর কারো সাথে যেন না হয় সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।এদের নজরে তুই ছিলি পরবর্তী শিকার।ঢাকাও গিয়েছিল। এখন তুই নিরাপদ। আমি এদের শেষ করে দিয়েছি।
এই বলে সে চলে গেল আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। এক সময় মিলিয়ে গেল।আর আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। খুন কে করেছিল? অনি না আমি।
(সমাপ্ত)