অনপেখিত পর্ব-২৯

0
1860

#অনপেখিত
#পর্ব_২৯
লিখা: Sidratul Muntaz

ফারদিন তড়িৎ গতিতে লিফটে উঠলো ছাদে যাওয়ার জন্য। আজকে লিফটটাও খুলতে লেইট হচ্ছিল। আর লিফট খোলার পরেই ফারদিন দেখল ভেতরে সাত তলার প্রিয়ন্তী দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিনের চেহারা আপনা-আপনি ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্বস্তিকর মুহুর্তে অস্বস্তিকর মানুষের সাথে যদি দেখা হয়, বিরক্তি তো আসবেই। প্রিয়ন্তী হেসে বলল,” কেমন আছেন ফারদিন?”
” ভালো। তোমার কি অবস্থা?”
” জ্বী এইতো, ভালোই।”
এরপর আর কারো মুখে কোনো কথা নেই। প্রিয়ন্তী নিশ্চয়ই কথা বলার জন্য হাঁসফাঁস করছে। আর ফারদিন হাঁসফাঁস করছে কিভাবে দ্রুত এই জায়গা থেকে বের হওয়া যায়। এই মেয়ের সামনে যত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ততই অস্বস্তি। প্রিয়ন্তী হঠাৎ বলল,” আপনার বউয়ের সাথে তো দেখা করালেন না। বিয়েতে দাওয়াত দেননি মানলাম৷ তাই বলে কি বউকেও লুকিয়ে রাখবেন?”
ফারদিন লজ্জায় হেসে ফেলল,” আরে না, লুকিয়ে কোথায় রাখলাম? বিয়েতে আসলে কাউকেই দাওয়াত করার সুযোগ হয়নি। তুমি বাসায় এসো। দেখা করে যেও ভাবীর সাথে।”
” ও হ্যাঁ, আপনার বউ তো আমার ভাবীই হবে।”
ফারদিন হাসার চেষ্টা করল। লিফট থেমে গেছে। প্রিয়ন্তী বলল,” আসছি ফারদিন। আপনি কি ছাদে যাচ্ছেন?”
” হ্যাঁ। একটু কাজ ছিল।”
” ঠিকাছে। আল্লাহ হাফেজ। দেখা হবে।”
” আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।”
প্রিয়ন্তী বেরিয়ে যেতেই লিফটের দরজা আটকে গেল। ফারদিন বুক ভরে স্বস্তিময় শ্বাস নিল।ছাদে উঠেও সে মেহেককে পেল না। তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কোথাও নেই মেহেক। হতাশ হয়ে আবারও নিচে নামলো। এবার একদম নিচে চলে গেল।কারণ বাড়িতে মেহেক কোথাও নেই সে আগেই দেখে এসেছিল। পুরো বাড়ি খোঁজার পরেই ছাদে উঠেছে। তাদের বাড়ির গ্যারেজের পেছনে একটা ছোট্ট পার্কের মতো জায়গা আছে। সেখানে বাগানের মতো গাছপালা লাগানো আছে। একটা দোলনা আছে, স্লিপার’স আছে। বাচ্চারা বিকালে এখানে খেলতে আসে। ভালোই ভীড় হয়। এখন সকাল এগারোটা বাজে। তেমন কেউ নেই জায়গাটায়। ফারদিন মেহেককে পুরো রাস্তা খুঁজেও যখন পেল না তখন হতাশ হয়ে পার্কে এসে দোলনায় বসল। একটা সিগারেট ধরালো। টেনশন তার খুব বেশি বেড়ে গেলে সিগারেট লাগে। ফারদিন সিগারেটে টান দিতে দিতে চিন্তা করছিল মেহেক কোথায় থাকতে পারে। একটু পরেই শুনতে পেল মেহেক চিৎকার করছে। ফারদিন উঠে দাঁড়ালো। অস্থির হয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। তার চোখ দু’টো পাগলের মতো সেই একটি চেহারা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কান আকুল হয়ে শুনে চাইছে সেই বাচ্চাসুলভ হাসিমাখা কণ্ঠস্বর! কোথায় মেয়েটি? মিষ্টি চেহারার ছোট্ট মেয়েটি যে ফারদিনের প্রাণ! কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই ফারদিন দেখল নারকেল গাছের নিচে কয়েকটা বাচ্চার সাথে দাঁড়িয়ে আছে মেহেক৷ তার চেহারায় চাঞ্চল্য হাসি। দুনিয়ার কোনো কিছুর হুশ নেই। একটা মানুষ যে তাকে খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দিব্যি নিজের মতো বাচ্চাদের নিয়ে লাফ-ঝাপ করছে, হাসছে,খেলছে, চেঁচাচ্ছে। তার চেহারা কি অদ্ভুত নিষ্পাপ! ফারদিনের মন এতোক্ষণে শান্ত হলো। সে যা আশঙ্কা করেছিল সেরকম কিছুই হয়নি। মেহেক ভালো আছে, সুস্থ আছে, হাসছে, এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। ফারদিন এগিয়ে গেল মেহেকের কাছে। দশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর মেহেকের নজর পড়লো ফারদিনের উপর। তাকে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই মেহেক ঘাবড়ে গেল। বুঝে নিল তার কপালে এখন দুঃখ আছে। ফারদিন আবার বাচ্চাগুলোর সামনে ধমকিয়ে তার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিবে না তো? মেহেক অভিমান করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। রাস্তায় যেতে ভয় লাগছিল তাই গ্যারেজের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সেখানে বাচ্চারা লুকোচুরি খেলছিল। ওদের খেলা দেখতে দেখতে মেহেকের মন কেন জানি ভালো হয়ে গেল। বাচ্চারাও ওকে খেলতে ডাকছিল। মেহেক তখন সবকিছু ভুলে ওদের সাথে খেলতে চলে এলো। এখন ফারদিনকে দেখে ভয়ে তার শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত-পা জমে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে ধীরপায়ে এগিয়ে আসলো ফারদিনের কাছে। অপরাধী কণ্ঠে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো বলল,”স্যরি। আমি বাসা থেকে বের হতে চাইনি..”
মেহেক আর কিছু বলার আগেই ফারদিন কাছে এসে আলতো করে তার গালে একটা চুমু দিল৷ মেহেক হতবিহ্বল হয়ে গেল। বড় বড চোখ করে গালে হাত রেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। অবশেষে খুব কষ্টে ঢোক গিলে লজ্জিত কণ্ঠে বলল,” এটা কি করলেন আপনি? কেউ যদি দেখে ফেলতো?”
” করার আগে এতো কিছু মাথায় আসেনি। ইচ্ছে হয়েছে তাই করে ফেলেছি, শেষ। আর কেউ দেখলেও কি? আমার কি ফাঁসি হবে এজন্য?”
” না.. তবুও। ”
মেহেকের আশেপাশে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। তার ধারণা বাচ্চারা পেছন থেকে তাদের দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ইশশ! সত্যিই কি কেউ দেখে ফেলেছে? ফারদিন অন্যদিকে তাকিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে বলল,
” এভাবে হুটহাট আর কখনও বাসা থেকে বের হবে না। মনে থাকবে?”
ফারদিনের কোমল কণ্ঠ শুনে মেহেক আরও বিস্মিত হয়ে যাচ্ছিল। ওর হাতের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে বলল,” এটা তাহলে এখনি ফেলে দিন। আমি আর বাসা থেকে বের হবো না।”
ফারদিন সাথে সাথে সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল,” ফেলে দিলাম।”
মেহেক খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিল। এবার ফারদিন হতভম্ব। কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল,” একটা সিগারেট ফেললে যদি এতো দামী উপহার পাওয়া যায় তাহলে আমি প্রতিদিন হাজারটা সিগারেট ফেলতে রাজি।”
মেহেক লজ্জায় মুখ গুটিয়ে ফেলল। ফারদিন মেহেককে জড়িয়ে ধরে বলল,” এবার বাসায় চলো।”
” এক মিনিট, আপনার জন্য আমার খরগোশটা হারিয়ে গেল যে!”
” খরগোশ মানে? ”
” আমরা একটা খরগোশ ধরার চেষ্টা করছিলাম। আপনি না আসলে এতোক্ষণে ধরেও ফেলতাম।”
” খরগোশ ধরে কি করবে?”
” আমার ভালো লাগে। খেলবো।”
” কয়টা খরগোশ নিয়ে খেলতে চাও বলো? প্রয়োজনে খরগোশ কিনে ঘর ভরিয়ে ফেলবো।”
” সত্যি? আপনি আমাকে খরগোশ কিনে দিবেন?”
” অবশ্যই। কেন দিবো না?”
” তাহলে চলুন এখনি?”
” এখনি যেতে হবে? আচ্ছা চলো!”
মেহেক খুশিতে মুখে হাত দিয়ে নাচতে লাগল। সে ভাবেনি ফারদিনও তার ছেলেমানুষী আবদারে এতো গুরুত্ব দিবে। মানুষটাকে রসকষহীন ভেবেছিল সে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই সে বুঝতে পারছে তার ধারণা কতটা ভুল!
ফারদিন-মেহেকের জন্য বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করল বন্ধুরা। কিন্তু ফারদিনের আসার নাম নেই। ওয়াসীম কয়েকবার ফোন করেছে ফারদিনকে। কিন্তু ফারদিন জানিয়েছে সে মেহেককে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। ফিরতে দেরি হবে। ওয়াসীম আর আনজীর তখন ফারদিনকে বার-বার ফোন করে ঠাট্টা-মশকরা শুরু করল। ফারদিন তাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে ফোন বন্ধ করে রাখল। এদিকে ফয়জুন্নিসা চিন্তিত হয়ে ফারদিনকে ফোন করলেন। কিন্তু মোবাইল বন্ধ পেলেন। সবকিছুই তাঁর কাছে এখন অনেক বেশি বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। তাঁর ছেলে দেখা যায় রীতিমতো বউয়ের প্রতি আসক্ত! বন্ধুরা তার জন্য অপেক্ষা করছে, মা এতোদিন পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে, এর মধ্যে ফারদিন কিভাবে পারে বউকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে চলে যেতে? আবার মোবাইলটাও বন্ধ করে রেখেছে। মানে কমন সেন্সও কি নেই? এতোদিন তো চট্টগ্রামে সে মেহেকের সাথেই ছিল। তখন কি তারা একাকী সময় কাটায়নি? এখন কেন সবাইকে উপেক্ষা করে তাদের বাহিরে ঘুরতে যেতে হবে? সবকিছু মানতে পারলেও এইটা কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। বউয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকা ভালো, কিন্তু এমন ভালোবাসা ভালো না যে বন্ধুত্ব, মা-বাবা, পরিবার-পরিজন সবকিছু একদম ভুলে যেতে হবে। না, এইভাবে কিছুতেই চলতে দেওয়া যায় না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ফয়জুন্নিসা খুব দ্রুত একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে