অনপেখিত পর্ব-২৮

0
1691

#অনপেখিত
পর্ব_২৮
লিখা: Sidratul Muntaz

বিছানায় গাঁ এলিয়ে নবাবের মতো একহাতে সিগারেট অন্যহাতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে ফারদিন। কি আরামের জীবন! আচ্ছা, এই লোক এতো সিগারেট খায় কেন? সিগারেট খেতে খেতে ঠোঁটগুলো যে কালচে বানিয়ে ফেলেছে সেদিকে খেয়াল আছে? কবে জানি সুন্দর মুখটাও কালচে হয়ে যায়। আর সবথেকে বড় কথা সিগারেট খেলে তো মানুষ হৃদরোগেও আক্রান্ত হয়। এইভাবে সিগারেট খেলে ফারদিন অতি দ্রুত মরে যাবে। মেহেক ক্ষীপ্রবেগে গিয়ে ফারদিনের সামনে দাঁড়ালো। হুকুমের মতো বলল,” শুনুন, আপনি আর কোনোদিন সিগারেট খেতে পারবেন না।”
ফারদিন সিগারেটে টান দিতে দিতে ভ্রু কুচকে বলল,” কেন?”
সিগারেটের ধোঁয়া মেহেকের নাকে-মুখে এসে ঢুকে গেল। মেহেক কাশতে কাশতে বলল,” কারণ আমি সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারি না।”
” এতোদিন কিভাবে পেরেছো?”
” জানি না। কিন্তু এখন থেকে আর সহ্য করবো না। যেকোনো একটা বেছে নিন। সিগারেট নাহলে আমি।”
” সিগারেট আমার সাথে আটবছর ধরে আছে। তুমি তো মাত্র আটদিনের মেহমান। তোমার জন্য সিগারেটের সাথে বেঈমানী করবো? কাজটা কি ঠিক হবে?”
খুব দায়সারা জবাব। মেহেক হতভম্ব হয়ে বলল,
” মানে আপনি কি বলতে চাইছেন? আমার থেকে সিগারেট আপনার কাছে দামী?”
” আমি তো সেটা বলিনি। মানে তুমি যখন ছিলে না তখন সিগারেট ছিল। ভবিষ্যতে যখন তুমি থাকবে না তখনও সিগারেট থাকবে। এটা তো আমার চিরকালের সঙ্গী। ছেঁড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
” আমি আপনার সাথে ভবিষ্যতে থাকবো না কেন?”
” ভবিষ্যতের কথা কি বলা যায়? যদি তুমি চলে যাও কোনো কারণে?”
” আমি কেন চলে যাবো?”
” সেটা আমি কি জানি?”
মেহেক কটমট করে বলল,
” আপনি আসলে চানই আমি যেন চলে যাই। তাহলে এখনই চলে যাই। অপেক্ষা করে লাভ কি?”
যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ফারদিন মেহেকের হাত ধরে বলল,” আরে শোনো, বসো এদিকে।”
” আগে সিগারেট ফেলুন। নাহলে বসবো না।”
ফারদিন আগুন নিভিয়ে সিগারেটটা ট্র্যাশক্যানে ফেলে দিল। মেহেক সন্তুষ্ট হয়ে ফারদিনের পাশে বসলো। ফারদিন বলল,” তারপর? কি কি খেলে? আম্মু কি রান্না করেছে?”
” রান্না তো করেছে অনেককিছুই। কিন্তু আমি খেতে পারিনি। ”
” কেন?”
” পেটে জায়গা ছিল না একটুও। আচ্ছা, আপনি গেলেন না কেন?”
” ইচ্ছে করেই যাইনি। ভালো লাগছিল না।”
মেহেক ফারদিনের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
” প্রমিস করুন। এখন থেকে সিগারেট খাওয়া ছেঁড়ে দিবেন।”
” কি আশ্চর্য! তুমি হঠাৎ আমার সিগারেটের পেছনে পড়লে কেন?”
” সিগারেট খেলে মানুষ তাড়াতাড়ি মরে যায়। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”
” ভুঁয়া কথা। আটবছর ধরে সিগারেট খাই৷ তাও আমার স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো। ”
” আপনি তার মানে আমার কথা শুনবেন না?”
” তোমার সব কথা শুনতে হবে?”
মেহেক আহত কণ্ঠে বলল,” শুনতে হবে না?আমার কথা না শুনলে আপনি কার কথা শুনবেন?”
” কেন শুনবো তোমার কথা? তুমি কি আমার কথা শোনো?”
” শুনি না? আপনি যখন যেটা বলেন আমি তো সেটাই করি।”
” তাই? তাহলে প্রমাণ দাও৷ যাও দরজাটা বন্ধ করে আসো।”
মেহেক সাথে সাথে দরজা বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ থেমে বলল,” এক মিনিট, শুধু শুধু দরজা কেন বন্ধ করবো?”
” এইযে, এতো প্রশ্ন করলে কথা শোনার দরকার নেই। থাক।”
মেহেক আর প্রশ্ন না করে গটগট করে হেঁটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আসল। তারপর হাত ভাজ করে বলল,” করেছি। এইবার? ”
ফারদিন একটানে মেহেককে কাছে এনে জড়িয়ে ধরল। ফিসফিস করে বলল,” এইবার শুধু চুপ করে থাকো। আগামী একঘণ্টা কোনো কথা বলবে না।”
মেহেকের ছোট্ট শরীর লজ্জায় কেঁপে উঠলো। আমতা-আমতা করে কিছু বলতে নিবে তখনি ফারদিন ওর ঠোঁট আঙুল দিয়ে চেপে ধরল,” বললাম না চুপ? একদম চুপ।”
ফারদিন মেহেককে তার ডানপাশে শোয়ালো। তারপর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিতেই মেহেক খিলখিল করে হেসে উঠলো। ফারদিন গম্ভীর গলায় বলল,” হাসাও নিষেধ। নো সাউন্ড!”
মেহেক মনে মনে বলল,” ইচ্ছে মতো সুড়সুড়ি দিচ্ছে আবার বলছে হাসাও যাবে না৷ আশ্চর্য মানুষ! হাসি কি চেপে রাখা যায়?”
মেহেকের হঠাৎ মনে পড়ল সে এইখানে কি জন্য এসেছিল। ফারদিন তাকে রান্নার বিষয়ে মিথ্যে বলেছে। এখনি কথাটা জিজ্ঞেস করতে হবে। মেহেক যখন এই বিষয়ে কিছু বলতে নিবে তখনি ফারদিন ক্লান্ত স্বরে বলল,” আমি সারারাত ঘুমাইনি মেহেক। খুব টায়ার্ড লাগছে। এখন তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটু ঘুমাবো। প্লিজ তুমি এভাবেই থেকো। চলে যেও না কিন্তু।”
” সারারাত ঘুমাননি কেন? ঘাস কেটেছেন?”
” উহুম। বউয়ের চুলে বিলি কেটেছি।”
” মানে?”
” মানে বাসে তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে সারারাত ঘুমিয়েছো। আর আমি জেগে ছিলাম। ”
” সেটাই তো। কেন জেগে ছিলেন? আপনিও ঘুমিয়ে যেতেন। জেগে থাকতে কে বলেছে? আমি তো বলিনি!”
” বার-বার তুমি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলে। আমি ধরে না রাখলে সিটের সাথে বারি খেয়ে মাথা ফাটতো। এমন ইনসিকিউরিটির মধ্যে তোমাকে রেখে আমি ঘুমাই কিভাবে?”
” তাহলে আপনার যখন ঘুম পাচ্ছিল তখন আমাকে ডেকে দিলেই পারতেন!”
” এটাই তো প্রবলেম। তুমি ঘুমালে তোমাকে দেখতে এতো সুন্দর লাগে যে ডাকতে খুব মায়া হয়। তখন মন চায় পুরো পৃথিবী থামিয়ে রাখতে। তবুও যেন ওই ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।”
” তাই?”
” হুম।”
” এজন্যই বুঝি সেদিন মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙিয়ে মিথ্যে কথা বলে রান্নাঘরে পাঠিয়েছিলেন?”
ফারদিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে মেহেকের গলা থেকে মুখ সরিয়ে নিল। মাথা তুলে তীব্র বিস্ময় নিয়ে বলে উঠল,” মানে?”
মেহেক খিলখিল করে হাসতে লাগল। ফারদিন তাকিয়ে আছে। হয়তো এখনও বুঝতে পারেনি। মেহেক বলল,” আজকে সুজি আপুর থেকে শুনেছি। আপনি তো খুব ভালো রাঁধুনী। আপনার নাকি ইউটিউবে রান্নার চ্যানেলও আছে! তাহলে আমাকে মিথ্যে বলেছেন কেন?”
” ও। এই ব্যাপার!”
ফারদিনের কণ্ঠে ভারী অবজ্ঞা। মেহেক বলল,” এই ব্যাপার মানে কি? এইটা কোনো ব্যাপার মনে হচ্ছে না আপনার কাছে?”
” ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো। তাই মিথ্যে বলেছিলাম।”
” মিথ্যে বলে সারপ্রাইজের কোনো দরকার নেই আমার। সেদিন আপনি আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে যেভাবে খাবার চাইলেন আমার কত মায়া লেগেছিল জানেন? আর এখন শুধু রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে আপনার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে।”
” তোমার কি সেইরাতের ঘুমের জন্য খুব আফসোস হচ্ছে?”
” ঘুম কোনো বিষয় না। বিষয় হচ্ছে আপনি মিথ্যে কেন বলবেন? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য করেছিলেন এমন তাই না?”
” আরে না পাগল! আমার উঠে রান্না করতে ইচ্ছে করছিল না। সবসময় রান্নার মুড থাকে না। কিন্তু ক্ষিদে পেলে আমি সহ্য করতে পারি না। তোমাকে যদি বলতাম আমি খুব ভালো রান্না পারি তাহলে কি তুমি আমার জন্য রান্নাঘরে যেতে?”
” একবার বলেই দেখতেন! আমি নিশ্চয়ই যেতাম। কিন্তু মিথ্যের আশ্রয় নেওয়া আপনার ঠিক হয়নি।”
” মিথ্যে তো তুমিও বলেছো মেহেক। আমি কি তোমাকে সেজন্য কখনও কিছু বলেছি?”
” আমি কখন মিথ্যে বলেছি আপনাকে?”
” ভেবে দেখো।”
মেহেক মাথা নিচু করে কি যেন চিন্তা করল। তারপর মলিন মুখে বলল,” মিথ্যে বলিনি কখনও। তবে কিছু বিষয় গোপন করেছি। গোপন করা আর মিথ্যে বলা তো এক নয়।”
শেষ কথাটুকু বলার সময় মেহেকের কণ্ঠ কেমন যেন কেঁপে উঠলো। ওই কম্পনটাই ফারদিনের বুক মুচড়ে দিল। সে সাথে সাথে মেহেকের দুই গাল দুইহাতে স্পর্শ করে বলল,” মেহেক, আমি কিন্তু ওইসব মিন করে বলিনি। তুমি কষ্ট পেয়ো না প্লিজ।”
মেহেকের চোখ দিয়ে এতোক্ষণে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে গেছে। ফারদিন রুদ্ধশ্বাস ছেঁড়ে আকুল কণ্ঠে বলল,” এই পিচ্চি, স্যরি! এক্সট্রিমলি স্যরি।”
মেহেক আস্তে করে ফারদিনের হাত দু’টো নিজের গাল থেকে সরিয়ে দিল। শক্ত গলায় বলল,” আমি প্রতারণা করেছি আপনার সাথে। অনেক বড় প্রতারক আমি। প্লিজ মাফ করে দিবেন।”
কথা শেষ করে এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না সে। ফারদিন তাকে ধরার আগেই সে দৌড়ে চলে গেল। ফারদিনের বিছানা থেকে নামতেও দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণে মেহেক দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। ফারদিন রুম থেকে বেরিয়ে মেহেককে আর কোথাও দেখতে পেল না। কি আশ্চর্য! কয়েক সেকেন্ডে মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল? ফারদিন ডানদিকে খুঁজতে যাবে নাকি বামদিকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষমেষ ডানদিকেই গেল। কিন্তু সে জানলো না, মেহেক রুম থেকে বেরিয়ে বামদিকের অন্য একটি রুমের সাথে লাগোয়া ফাঁকা স্থানটিতে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিল।
ফারদিন ডাইনিং রুমে চলে এলো। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষের দিকে। দাদু খেয়ে নিজের রুমে চলে গেছেন। তিশা আর ফয়জুন্নিসা টেবিল গুছাচ্ছিলেন। বন্ধুরা একসাইডে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। এমন একটা পরিবেশে ফারদিনের চোখ দু’টো অস্থির হয়ে মেহেককে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মেয়েটা কোথায়?সে কি আসলেই এখানে নেই নাকি ফারদিনই দেখতে পাচ্ছে না? ফয়জুন্নিসা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,” এতোক্ষণে তুই এসেছিস? সবার তো খাওয়াও শেষ। সমস্যা নেই। আয় এখন বোস।”
ফারদিন মায়ের কথাটা যেন শুনতেই পেল না এমন ভাব করে সুজিদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,” মেহেককে দেখেছিস তোরা?”
সুজি, পূর্বি মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সুজি বলল,” না। একটু আগেই তো তোর ঘরে গিয়েছিল।”
ফারদিন অধৈর্য্যের মতো বলল,” রিসেন্ট দেখেছিস কোথাও?”
ওর অস্থিরতা দেখে সুজি খানিক হকচকিয়ে পূর্বির দিকে তাকালো। পূর্বি বলল,” না। এখানে তো আসেনি।”
ফয়জুন্নিসা পেছন থেকে বললেন,” আচ্ছা কোথাও আছে হয়তো। খুঁজে আনা যাবে। তোর এখন ওকে কেন দরকার? তুই ব্রেকফাস্ট করতে বোস৷ আমি সব রেডি করে রেখেছি তো।”
ফারদিন বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। ফয়জুন্নিসা হেসে বললেন,” সুজি বলছিল আমার বানানো গ্রিল স্যান্ডউইচটা নাকি একদম তোর চিকেন স্যান্ডউইচের মতো হয়েছে৷ তুই একটু টেস্ট করে দ্যাখ তো সত্যি কি-না?”
” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না আম্মু।”
ফারদিনের চেহারায় তুমুল অস্থিরতা। ফয়জুন্নিসা বুঝতে পারছেন না সমস্যা কি? ছেলে দেখা যাচ্ছে পাঁচমিনিটও বউকে চোখের আড়াল করতে রাজি না। এগুলো কি ঠিক? মানুষ কি ভাববে? ফয়জুন্নিসা হাসার চেষ্টা করে বললেন,
” আরে, আগে ওয়ান বাইট খেয়ে দ্যাখ। তারপর শুধু খেতেই ইচ্ছে করবে।”
ফারদিন উচ্চস্বরে বলল,” ধ্যাত, বলছি তো খাবো না। তুমি কি এক কথায় বুঝো না নাকি?”
ফারদিনের রুঢ় প্রত্যাখ্যানে ফয়জুন্নিসার মুখটা থমথমে হয়ে গেল। বন্ধুদের চেহারায় ভেসে উঠলো চাপা অস্বস্তি। ফারদিন চলে যাওয়ার সময় সুজি পেছন থেকে বলে উঠলো,” আশ্চর্য! তুই আন্টির সাথে এইভাবে..”
ফয়জুন্নিসা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন সুজিকে। সুজি আর কিছুই বলতে পারল না। ফয়জুন্নিসা বেশ কয়েক মিনিট ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর ধীরপায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর চোখ দু’টো তখন বিষণ্ণ লাল! এর আগে কখনও ছেলে এভাবে মেজাজ দেখায়নি তো! রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে তিশা আর লিয়ার মা ঘটনা দেখল। ফয়জুন্নিসা রান্নাঘরে ঢুকতেই তিশা নরম স্বরে বলল,
” চাচী আম্মা, আপনি তো ফারদিনের অপেক্ষায় ব্রেকফাস্টও করেননি। এখন করে নিবেন?”
ফয়জুন্নিসা জবাব দিলেন না। তিশা আবার বলল,” চাচী আম্মা?”
ফয়জুন্নিসা লিয়ার মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন,” আমার খুব মাথা ধরেছে লিয়ার মা। চিনি ছাড়া এক কাপ কফি বানিয়ে দিয়েন তো। আমি রুমে গেলাম।”
ফয়জুন্নিসা আর দাঁড়ালেন না। তিশা পিছু ডাকল। কোনো লাভ হলো না। একটু পর লিয়ার মা কফি নিয়ে ফয়জুন্নিসার ঘরে প্রবেশ করলেন। ফয়জুন্নিসা তখন কোলের উপর কুশন চেপে চোখে হাত রেখে বসে আছেন। চেহারায় বিষণ্ণ ভাব। লিয়ার মা খুকখুক করে কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন। ফয়জুন্নিসা মাথা তুলে মলিন মুখে বললেন,” কফি এনেছেন?”
” আনসি আপা। নেন।”
ফয়জুন্নিসা অন্যমনস্কভাবে কফিতে চুমুক দিতে লাগলেন। লিয়ার মা বুকশেলফটা গুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,” একখান কথা কই আপা। মনে কিছু কইরেন না আবার। বিয়ের পর সব পোলাই এমন বদলায় যায়। এডা হইসে চিরাচরিত নিয়ম। মানতেই হইবো।”
ফয়জুন্নিসা ভ্রু কুচকে তাকালেন। লিয়ার মা দীর্ঘশ্বাস ছেঁড়ে বললেন,” কত যে দেখলাম, মা-পোলার মধ্যে মিল-মোহাব্বত, ভালোবাসা। যেই পোলা আগে মা ছাড়া কিছুই বুঝতো না বউ বউ আওনের পর মায়রে সে চিনতেই পারে না। সব শেষ! যত ভালো পোলাই হোক। বউ আইলে ফাটল ধরবোই। তার উপরে বউ যদি হয় সুন্দরী, তাইলে তো কথাই নাই!”
ফয়জুন্নিসার চোখে-মুখে বিরক্তি ভেসে উঠলো।লিয়ার মা একটু চুপ করলেন। তারপর আবার সাহস নিয়ে বললেন,” আমি ফারদিন বাবাজানের দোষ দিমু না। অনেক মাইয়াই আছে জামাইরে কানপড়া দিয়া প্রথমেই বশে আইন্না রাখে। যাতে পরবর্তীতে শাশুড়ীর সেবা করতে না হয়। আজ-কালকের মেয়েদের কাছে তো শাশুড়ী মানেই শত্রু! কত দেখলাম! ”
ফয়জুন্নিসা শব্দ করে টেবিলের উপর কফির মগটা রেখে বললেন,” আপনি চলে যান লিয়ার মা। আমার ঘর আমিই গুছাতে পারি।”
লিয়ার মা কফির মগ নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলেন। ফয়জুন্নিসার বাম চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ছিল। তিনি দরজাটা আটকেই ডুঁকরে কেঁদে ফেললেন। বাড়িতে একসাথে থাকলে ফয়জুন্নিসা কখনোই তার ছেলেকে ছাড়া খেতে বসেন না। ছেলেটা এই কথা কিভাবে ভুলে গেল?
ফারদিনের মনের আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে। মেহেককে সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটা যে ভীষণ ইমোশোনাল! যদি সেদিনের মতো আবার গাঁয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় অথবা উল্টা-পাল্টা কিছু খেয়ে নেয়? দূর্ঘটনার কথা বলা যায় না। অপ্রত্যাশিত কিছু হওয়ার আগেই ফারদিনের মেহেককে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু মেহেক কোথায়? ছাদে চলে গেল না তো? ফারদিনের হৃৎপিন্ডের আর্তচিৎকার শুধু বেড়েই চলেছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে