অনপেখিত পর্ব-২৩

0
1715

#অনপেখিত
#পর্ব_২৩
লিখা: Sidratul Muntaz

রান্না করতে গিয়ে আবার হাত পুড়ে ফেলবে না তো ফারদিন? মেহেকের তো পা পুড়েছে৷ ফারদিনের যদি হাত পুড়ে যায়? না, না, মেহেক আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারছে না। এতোক্ষণ ধরে রান্নাঘরে মানুষটা কি করছে? মেহেক শুধু শুধুই ফারদিনকে রান্না করার মতো কঠিন শর্তটা দিল। এখন যদি কোনো বিপদ হয়? পায়ের যন্ত্রণায় মেহেক টিকতে পারছে না। আগুনে পোড়ার ব্যথা যে এতো তীক্ষ্ণ হয় তা সে আগে জানতো না। মেহেকের কিন্তু একদম ক্ষুধা পায়নি। কিন্তু ফারদিন বলেছে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে সে যেকোনো কঠিন কাজ করতে রাজি। মেহেকও তখন আবদার করল এমন সুস্বাদু কিছু বানাতে হবে যেটা মুখে দেওয়া মাত্রই ফারদিনের ভালোবাসার বিশুদ্ধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ অবশ্যই কোনো পারফেক্ট রেসিপি হতে হবে। যে মানুষটা রান্নার ‘র’ অবধি জানে না, সে কি করে মেহেকের জন্য পারফেক্ট রেসিপি তৈরী করবে? এটা তো নিতান্তই অসম্ভব। কিন্তু ফারদিনের মতে, ভালোবাসায় অসম্ভব বলে কিছু নেই। একমাত্র ভালোবাসাই পৃথিবীর সবচেয়ে অসম্ভব কাজ। যে একবার এই অসাধ্য সাধন করতে পারে তার জন্য পৃথিবীর অন্য যেকোনো কাজ অত্যন্ত তুচ্ছ ও নগন্য হয়ে যস্য। পৃথিবীর সকল অসম্ভব নিমেষেই জয় করে ফেলার শক্তি চলে আসে। ভালোবাসার কাছে সবকিছু সম্ভব হতে বাধ্য। জনৈক মনীষী বোধহয় এজন্যই বলেছিলেন, ‘ Everything is fair in love।’ আর ফারদিন মনীষী বলেছেন,’ Nothing is impossible in love।’
মেহেকের হাসি পেল। সত্যিই কি ফারদিন তাকে এতো বেশি ভালোবাসে? আচ্ছা, এটা কোনো স্বপ্ন নয়তো? যদি হুট করে ঘুমটা ভেঙে যায় আর মেহেক জানতে পারে সবকিছু স্বপ্ন ছিল। তার জীবনটা নিকষিত অন্ধকারে এখনও আচ্ছন্ন! এখানে ফারদিন নামের আলো’র কোনো অস্তিত্বই নেই! না,না, এমন হলে মেহেক আর কোনোদিন ঘুমাতে চায় না। অথবা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠতে চায় না।
ব্যাথাযুক্ত পা নিয়েই ধীরে ধীরে হেঁটে বহু কষ্টে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছালো মেহেক। পাঁয়ে যে কি অসহ্য যন্ত্রণা লাগছে! ঔষধ দেওয়ার কারণে যন্ত্রণাটা হয়তো তুলনামূলক কম। এটুকুও মেহেক সহ্য করতে পারছে না। অথচ যখন তার শরীরে আগুন দিয়েছিল তখন এতটুকুও যন্ত্রণা অনুভব হয়নি। কেন? এতোটা সাহস তার মধ্যে কি করে এসেছিল? এই সাহসের উৎসটা কি অতীতের বীভৎস স্মৃতিতে দগ্ধ হওয়ার কষ্ট? নাকি ওই মুহুর্তে ফারদিনের হঠাৎ প্রত্যাখ্যান পেয়ে বিষাক্ত দহনে ছাড়খাড় হওয়ার কষ্ট?
মেহেক রান্নাঘরের দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ফারদিন কি করছে? একটা বাটিতে অনেকগুলো টুকরো পাউরুটি রাখা। আচ্ছা, পাউরুটি কোথা থেকে এল? বাড়িতে কি আগেই ছিল? দুইটা ডিম ভেঙে সেই পাউরুটির মধ্যে ছেড়ে চামচ দিয়ে মেশানো হচ্ছে। এইটা আবার কেমন রেসিপি? মেহেক তো আগে কখনও এমন রান্না দেখেনি। আহারে, মাত্র কিছুক্ষণ রান্নাঘরে থেকেই তার সুদর্শন স্বামীটা কেমন ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। মেহেকের বড্ড মায়া লাগছে। সে কি এগিয়ে যাবে একটু? পোড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে ফারদিনের কপালের ঘাম মুছে দিবে? উহুম, লজ্জা করছে। এই কাজ করা কিছুতেই সম্ভব না। তার চেয়ে ভালো মেহেক আড়ালেই লুকিয়ে দেখুক। মানুষটার সবকিছুই মেহেকের ভালো লাগে। এইযে সে আনমনে কপালের ঘাম মুছে কলের জলে হাত ধুঁয়ে নিচ্ছে, এটাও মেহেকের দেখতে ভালো লাগছে৷ সে হঠাৎ হাচি দিয়ে কপাল কুচকালেও মেহেকের দেখতে ভালো লাগে। সে ধমকালে ভালো লাগে, রাগলে ভালো লাগে,শাসন করলেও ভালো লাগে আর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন তৃষ্ণার্তের মতো তাকিয়ে প্রশ্ন করে,” তোমার কি হয়েছে মেহেক? আমাকে বলবে না?”
মেহেক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেয়াল খামচে ধরে যখন কথাগুলো চিন্তা করছিল, তার পাঁয়ের যন্ত্রণাটা যেন ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে আসছিল। বরং মনে হলো পাঁয়ে কোনো যন্ত্রণাই নেই। অন্যরকম একটা শিহরণ অনুভব হচ্ছিল। সেই শিহরণের রঙ লাল। ফারদিন পেঁয়াজ হাতে নিয়েছে। রান্নাঘরটা কিন্তু বেশ বড়। দরজার মুখ চুলার পেছনদিকে থাকায় যে রান্না করছে সে মুখ ঘুরিয়ে না তাকালে কোনোভাবেই বুঝবে না যে রান্নাঘরে কেউ ঢুকেছে৷ তাই এই কয়েক মিনিটেও ফারদিন মেহেককে একবারও দেখতে পায়নি। বেচারা এখন পেঁয়াজ হাতে নিয়েছে। সে গোল পেঁয়াজটা ঠোঁট বাঁকা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। হয়তো চিন্তা করছে কোনদিক থেকে কাটা শুরু করবে। মেহেকের যে কি হাসি পেল! হ্যাঁ মেহেকও রান্না জানে না। কিন্তু অন্তত সবজি কাটা-কুটির মতো সাধারণ বিষয় তো জানে! মাকে রান্নাঘরে কতবার কাটাকুটি করতে দেখেছে সে। সাধারণ জ্ঞান থেকেও তো এইসব বোঝা যায়। ফারদিন ছুড়ি হাতে নিয়ে পেঁয়াজের মধ্যে খুব জোরে এক কোপ দিল। কিন্তু সেই কোপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ল তার আঙুলে। সাথে সাথেই আর্তনাদে কঁকিয়ে উঠলো সে। মেহেকের যেন হৃৎপিন্ডটা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল। কিসের পাঁয়ে ব্যথা? কিসের যন্ত্রণা? সবকিছু ভুলে সে এক দৌড়ে ফারদিনের কাছে ছুটে গেল। ফারদিনের লম্বাটে আঙুল থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। খুব বেশি যে কেটে গেছে তা কিন্তু না। তবে রক্ত বের হচ্ছে প্রচুর। তাই দেখে মেহেকের ভয়ে আত্মা কাঁপা-কাঁপি অবস্থা। চোখে পানি চলে এলো। মুখ ভেঙে কেঁদেও ফেলল খানিকটা। ফারদিন ব্যথার দিকে পাত্তা না দিয়ে হাসার চেষ্টা করল। মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” আরে, কিছু হয়নি! আই এম ফাইন!”
” চুপ করুন আপনি। এখনি ঘরে চলুন। কিচ্ছু করতে হবে না। রান্নার গুষ্টি মারি। আল্লাহ, কতটা রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। এভাবে তো আপনার হাতের সব রক্ত শেষ হয়ে যাবে!”
ফারদিন এই কথায় মজা পেয়ে আরও জোরে খিক করে হেসে ফেলল। মেহেক ফারদিনের আঙুলটা নিজের মুখে পুরে নিল। ফারদিন অবাক হয়ে বলল,” এই, এই, কি করছো? ছি!”
মেহেক রক্ত চুষে নিতে নিতে বলল,” ছি এর কিছু নেই। আম্মা বলেছে, রক্ত বের হলে এমনি করে চুষে নিতে হয়। নাহলে শরীরের রক্ত কমে যায়। কারণ রক্ত পড়তে দিলে তো কমবেই। চুষে নিলে সেটা আবার শরীরেই ফেরত আসবে।”
ফারদিন এই কথা শুনে আরও হাসছিল। মেহেক রেগে আগুন হয়ে বলল,” আশ্চর্য! আপনি হাসছেন কেন? এতোবড় কান্ড ঘটিয়ে আবার হাসতে ইচ্ছে করছে আপনার?”
ফারদিন ভ্রু কুচকে বলল,
” কেন? আঙুল কেটে গেলে হাসা নিষেধ নাকি? ”
” জানি না আমি। কিন্তু খবরদার হাসবেন না।”
” কেন হাসছি সেটা আগে বলি, তুমি এইভাবে রক্ত চুষে নিলে তো আমার শরীরের রক্ত সব তোমার কাছেই চলে যাবে মেহেক। এতে তো আমার কোনো লাভ নেই তাই না? ”
মেহেক হুশ ফিরে পাওয়ার মতো বলল,
” ও, হ্যাঁ তাইতো! তাহলে এই নিন।”
মেহেক এই কথা বলেই আঙুলটা নিজের মুখ থেকে বের করে ফারদিনের মুখে পুরে দিল। ফারদিন হতভম্ব! মেহেক অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,” স্যরি, স্যরি, দাঁড়ান আপনার আঙুলটা আমি ধুঁয়ে দিচ্ছি।”
মেহেক উল্টোদিকে ঘুরে বেসিনের কল থেকে পানি ছাঁড়তে নিচ্ছিল। ফারদিন বলল,” এক মিনিট।”
” হুম?”
মেহেক ঘুরে তাকালো। ফারদিন একদৃষ্টে চেয়ে থেকে তার ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বলল,
” তোমার ঠোঁটে কিছু একটা লেগে আছে।”
” কি লেগে আছে?”
মেহেক ঠোঁটে হাত দিতে নিলেই ফারদিন বাঁধ সাধল। ঠান্ডা গলায় বলল,
” আমার রক্ত লেগে আছে।”
” ও।”
মেহেক হাত দিয়ে রক্ত মুছে ফেলতে নিচ্ছিল তখন ফারদিন আবারও বাঁধ সাধলো।
” উহুম। এভাবে মুছলে হবে না। তুমিই তো বলেছো, রক্ত চুষে নিতে হয়৷ ”
মেহেক থতমত খেয়ে বলল,” মানে?”
” মানে আমি চুষে নিতে চাই!”
ফারদিনের কণ্ঠে যেন তীব্র বেহায়পনার প্রকাশ। মেহেক তার আরক্তিম দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
” ছি, কি বলছেন এসব?”
ফারদিন মেহেকের মুখটা আবার নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,” কেন? ছি এর কি আছে? আমি করতে পারি না এটা? আমি তোমার কে হই বলো?”
মেহেক ভয়ংকর লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,
” জানি না।”
ফারদিন নাছোড়বান্দা হয়ে গেল। মেহেকের মুখ দিয়ে স্বীকার করিয়েই ছাঁড়বে এমন দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে বলল,
” জানি না বলতে তো হবে না। জানতেই হবে। বলো কে হই?”
ইশশ, ফারদিন ইচ্ছে করে তাকে এভাবে খোচাচ্ছে।আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো! দৌড়ে পালানোরও উপায় নেই। ফারদিন দুইপাশ দিয়ে দেয়ালে হাত ঠেঁকিয়ে তাকে আটকে রেখেছে। মেহেকের উত্তর না পেয়ে ফারদিন আবার প্রশ্ন করল,” কথা বলছো না কেন?”
মেহেক স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় একটু গলা ঝেরে নিল। তারপর পরিষ্কার কণ্ঠে বলল,” হাসব্যান্ড হোন।”
” কি হই? শুনিনি, আরেকবার!”
মেহেকের মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। তাও মাথা নিচু করে জোরে শ্বাস ফেলে আবারও বলল,” হাসব্যান্ড!”
ফারদিন এইবার সুন্দর করে হাসি দিয়ে বলল,” তাহলে তো আমি এটা করতেই পারি, তাই না?”
” হুম। অধিকার খাঁটাতে চাইলে করতেই পারেন।”
মেহেকের কণ্ঠে কেমন যেন অভিমানের ঝংকার। ফারদিন ভ্রু কুচকে একটু দূরে সরে দাঁড়াল। দুষ্টুমি বাদ দিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,” অধিকার না মেহেক। আমি তো সম্মতি চেয়েছিলাম৷ তোমার পছন্দ না হলে আর কখনও এসব বলবো না। স্যরি।”
ফারদিন কথা শেষ করে হাতের কাটা আঙুলের দিকে নজর দিল। মেহেক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ফারদিনের গম্ভীর মুখটার দিকে চেয়ে কি মনে করে যেন বলেই ফেলল,” আচ্ছা ঠিকাছে।”
ফারদিন উদাদীন চোখে তাকালো,” কি ঠিকাছে?”
মেহেক লজ্জা কাটিয়ে বলল,” ঠিকাছে মানে আপনি করতে পারেম।”
সম্মতি পেয়ে ফারদিনের চেহারায় সুক্ষ্ম হাসির রেশ দেখা গেল। মেহেক সেই মুখ দেখে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে কাঁপছে। এই মুহুর্তে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্যকিছুই শোনা যাচ্ছে না। ফারদিন খুব কাছে এসে আলতো করে মেহেকের কোমড় জড়িয়ে ধরল। মেহেকের শ্বাস আটকে আসতে চাইছে। ফারদিনের তপ্ত নিঃশ্বাস মেহেক অনুভব করতে পারছিল। প্রতিটি প্রশ্বাসের সাথে একটা পরিচিত সুগন্ধ লুটিয়ে পড়ছে। এই সুগন্ধই তাকে মনে করিয়ে দেয়, প্রথম দেখাতেই তার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন সেই পুরুষটির কথা, রাগান্বিত স্বরে ধমক দেওয়া সেই রাগী মানুষটির কথা,যার হাসি দেখতে মেহেক ভালোবাসে, যার ব্যক্তিত্ব মেহেককে মুগ্ধ করে, যার তীক্ষ্ণ নাকের ডগায় জমে থাকা তুখোড় মেজাজটাও মেহেকের অত্যন্ত পছন্দ। মেহেক চোখ বন্ধ করে আকুল অপেক্ষায় মগ্ন ছিল। এই অপেক্ষা জীবনের প্রথম ভালোবাসার অতুল স্পর্শ অনুভবের অপেক্ষা। কিন্তু অপেক্ষা যেন শেষই হচ্ছে না। ফারদিন এতো দেরি করছে কেন? এখন আর ফারদিনকে অনুভবও করতে পারছে না সে। ফারদিন তার আশেপাশে আছে এটাও মনে হচ্ছে না। আশ্চর্য! কি হচ্ছে? মেহেক কি চোখ খুলে তাকাবে? তাকানোর আগেই ফারদিন হালকা কেশে পরিষ্কার গলায় বলল,
” তুমি তাহলে বিছানায় গিয়ে রেস্ট নাও মেহেক। আমি তোমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসছি।”
মেহেক চোখ খুলতেই দেখতে পেল ফারদিন তার থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে এবং তার পেছনেই উর্মি এসে দাঁড়িয়েছে। মেহেক হতভাগ্য অনুভব করল। এই মেয়েটা কি আসার আর সময় পেল না? ধ্যাত!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে