#অনপেখিত
#পর্ব_২১
লিখা: Sidratul Muntaz
ড্রেসিংটেবিল থেকে শ্যাম্পুর বোতল, কাঁচের পারফিউমের কৌটা, মাটির ফুলদানি, বিছানার চাদর,বালিশ, পানির জগ,গ্লাস,মোবাইলের চার্জার,আম্মার মোবাইল ফোন,সবকিছু ভেঙে একাকার করে দিতে লাগল মেহেক৷ তার শরীর প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে যাচ্ছিল। গাল দু’টো লাল হয়ে,নাকের ডগা ফুলে থাকা অবস্থায় তাকে রূপকথার সুন্দরী পিশাচিনীর মতো দেখাচ্ছিল। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সে কেঁদে ভাসাচ্ছে আর ইচ্ছেমতো চিৎকার করছে,” আমি বিয়ে করবো না। মরে গেলেও করবো না। ওই বুইড়া ভাম, মোটকা ড্রামের সাহসটা কি? আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়! বেটার তো এতোদিনে আমার মতো একটা মেয়ে পয়দা করার কথা ছিল। শালা খাটাশ জানি কোথাকার!”
এক লাথিতে কাঁঠের চেয়ার ভেঙে ফেলল মেহেক। বাসন্তী ছোটবেলা থেকেই খুব ঠান্ডা স্বভাবের। মেহেক পেয়েছে একদম তার বাবার মেজাজ। রেগে গেলে তিনি মেহেককে মোটেও কিছু বলেন না। নির্বিকারভাবে নিজের কাজ করতে থাকেন। আজও তাই করছেন। রান্নাঘরে রান্না করছেন। মেহেকের দাদীমা অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠে আসতে পারছেন না। খালি ভাঙচুরের আওয়াজ শুনছেন। আর চেঁচিয়ে মেহেকের মায়ের নাম ধরে ডাকছেন।
” ও বাসন্তী! দেইখা যাও তোমার রাজকন্যায় ক্ষেপলো ক্যান?”
ছোট ভাইয়েরা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছে মেহেকের তান্ডব। হঠাৎ মেঝো চাচী তেড়ে আসলেন এবং মেহেকের গালে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন। আচমকা আক্রমণে মেহেক হতবুদ্ধির মত হয়ে গেল। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে দেখল মেঝো চাচীকে। জীবনে আব্বা মেহেককে একটা ফুলের টোকাও দেননি। আম্মা তো জীবনে মেহেকের সাথে উঁচু আওয়াজেও কথা বলেনি। সেখানে কি-না চাচী তাকে চড় মারলেন? মেহেক পুরো বাকশূন্য হয়ে গেল। চাচী খিটমিট করে বললেন,
” কে বুইড়া ভাম? ওই বেটায় বুইড়া ভাম? তোর জন্য কি লন্ডন থেকে প্রিন্স আনতে হবে? কোন দেশের শাহজাদীরে তুই যে বিয়ে করবি না বলিস? এই বিয়েটা না করলে তোর আব্বার মরা মুখ দেখবি। সেটাই কি চাস তুই?”
মেহেক হতবিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” আমার বিয়ের সাথে আব্বার মরার সম্পর্ক কি?”
” এখনও বুঝিস নাই? আরে বেটায় ঢাকার উপজেলা চেয়ারম্যান। তোর আব্বা যদি এই বেটার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় তাহলে জানে বাঁচতে পারবে? আমরা কেউই বাঁচবো না। দুইদিনে আমাদের বাড়িঘর হারিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। ধর, তোর বাপকে একটা বানোয়াট মামলায় ফাঁসিয়ে জেলের আসামি বানিয়ে দিল। নাহলে গভীর রাতে কোথাও নিয়ে খুন টুন করে ফেলল। পুলিশ-টুলিশ তো তার কিছুই করতে পারবে না। তখন কি করবো আমরা? তোর ভাইদের নিয়ে পথে বসবো নাকি তোর জন্য?”
” বিয়েতে নিষেধ করলে উনি এমন করবে?”
” করবে না মানে? আর তুই বিয়েতে নিষেধ করবিই বা কেন? এইটা তো একটা অপমান। ওতোবড় নেতা মানুষ তোর অপমান সহ্য করবে সহজে? আমাদের সংসার শেষ করার জন্য উঠে-পরে লাগবে না? লাইফ শেষ করে দিবে। তখন কি করবি তুই? এজন্যই বলি, অন্তত আমাদের উপর দয়া করে হলেও বিয়েটা তুই কর মা। তোর পাঁয়ে ধরি তুই বিয়ে কর।”
মেহেক ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।
” বাহ, মেঝ চাচী! তোমার কথা শুনে অবাক লাগল! নিজেরা বাঁচার জন্য আমাকে বলির পাঠা বানাতে চাও? আমি বলি হয়ে তোমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিবো? আর আমার কি বাঁচার অধিকার নেই?”
” কপাল! এই মেয়ে কি বলে এইসব? আরে ব্যাক্কল বিয়ে করলে তুই বলির পাঠা হবি কেন? তুই তো হবি রাজরানী।”
মেহেক তীক্ষ্ণ গর্জনে ফেটে উঠলো,” আমি রাজ-রানী হতে চাই না। তোমারও তো অবিবাহিত ছোটবোন আছে৷ তাকে বিয়ে দিতে পারবে ওই রাক্ষসের কাছে?”
” নিশ্চয়ই পারবো৷ কেন পারবো না? রাজ আহমেদ যদি আমার বোনকে বিয়ে করতে চায় তাহলে তো এটা আমাদের সৌভাগ্য! কিন্তু সে তো তোকে বিয়ে করতে চাইছে। তুই এখনও বুঝতে পারছিস না কি জিনিস পেতে যাচ্ছিস।”
মেহেকের ঘৃণায় বমি আসছিল। মেঝো চাচীর চিন্তা-ভাবনা কত কুরুচিপূর্ণ! কত নিচুমনের মানুষ তিনি ছি! দুঃখের বিষয় মেহেকের আব্বা-আম্মাসহ পুরো পরিবার এই বিয়েতে রাজি। শুধু রাজি হয়নি ছোটচাচী। কিন্তু তার কথা কেইবা শুনবে? বন্ধ্যা বলে তাকে এমনিতেও কেউ পাত্তা দেয় না। দিন-রাত বঞ্চনা সহ্য করতে হয়। তার জীবনটা তো আরও কষ্টের! মেহেক শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিল ছোটখালাকে ফোন করবে। তার ছোটখালা তাকে অনেক ভালোবাসে! তিনি ঢাকায় থাকেন। বেশ বুদ্ধিমিতী,সুন্দরী, শিক্ষিত মহিলা। আর তিনি মেহেকের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ। ছোটখালা নিশ্চয়ই মেহেককে বুঝবেন এবং আব্বা-আম্মাকেও বুঝাবেন। মেহেক ছোটখালাকে ফোন করে ঘটনা জানানোর পরদিনই তিনি ঢাকা থেকে চলে আসলেন। মেহেক ছোটখালাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল।
” আমি ওই বুইড়া ভাম,মোটকা ড্রামটাকে জীবনেও বিয়ে করবো না খালামণি। তুমি কিছু করো প্লিজ।”
খালামণি মেহেকের ছন্দ শুনে হেসে ফেললেন।অভয় দিয়ে বললেন,” আরে তুই চিন্তা করিস না। আমি থাকতে তোর বিয়ে হয়ে যাবে এটা তুই ভাবলি কি করে? আচ্ছা, ছেলেটা কি অনেক মোটা?”
প্রশ্নটা খালামণি করলেন মেহেকের মায়ের দিকে তাকিয়ে। বাসন্তী বললেন,” আরে না। মোটা কই? ছেলে অনেক সুন্দর।”
” তাহলে ও মোটকা ড্রাম বলে কেন?”
” শরীরটা লম্বা-চওড়া তো তাই মনে হয় ওর কাছে মোটা লাগে।”
খালামণি মেহেকের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,” সে ছেলে যেখানকারই রাজকুমার হোক, আমার ভাগ্নি না চাইলে কেউ তাকে জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না। দুলাভাইয়ের সাথে আমি কথা বলবো! তার যদি মেহেককে পালতে এতোই কষ্ট হয় তাহলে আমাকে দিয়ে দিক। আমি নিয়ে যাবো ওকে আমার বাসায়।”
মোজাম্মেল শাহ্ বাড়ি ফেরার পর খালামণি রীতিমতো ঝগড়া শুরু করলেন। তিনি বেঁচে থাকতে কিছুতেই এই বিয়ে হতে দিবেন না। শালী-দুলাভাইয়ের ঝগড়া মজা করে দেখছিল মেহেক। পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছিল ছোটখালাই জিতবেন৷ আর তাই হলো। বিয়েটা শেষমেষ আটকানো গেল। মোজাম্মেল শাহ্ ব্যবসায়িক একটি বিষয় নিয়ে রাজ আহমেদের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। সেই দায় কাটাতেই বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু মেহেকের ছোটখালা যখন বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিলেন তখন তিনি ভয়ে বিয়ে ভাঙতে রাজি হলেন। কিন্তু এতে রাজ আহমেদ ভয়ানক ক্ষেপে গেল। প্রথমে কথা দিয়ে পরে আবার কথার বরখেলাপ!সে সহ্য করবে না এই অপমান। তাছাড়া তাজাফুলের মতো মেহেকের সৌন্দর্য্যলিপ্সা উপেক্ষা করাও তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন!
ঘটনাটি ঘটেছিল বিয়ে ভেঙে যাওয়ার মাস দুয়েক পর। বাতাসে তখন ফাগুনের হাতছানি। শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে প্রকৃতি কন্যা একটু একটু করে নিজেকে সাজিয়ে তুলছে বসন্তের অপার মহিমায়। কিন্তু কে জানতো? এটিই ছিল মেহেকের জীবনের শেষ রঙিন বসন্ত!এরপরেও মেহেকের জীবনে আরও একাধিক বসন্ত এসেছে। কিন্তু কোনোটাই আর রঙিন হয়নি।
রাত বারোটা বাজে খবর এলো মেহেকের বাবার মিল কারখানায় আগুন লেগেছে। ছোটচাচা আহত হয়েছেন। তাকে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে। মোজাম্মেল শাহ্ লুঙ্গী পরা অবস্থাতেই খালি গাঁয়ে একটি চাদর জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ছোটচাচী ঘটনা শুনেই কান্না শুরু করলেন। বাড়ির সবাই পাঁচমিনিটের মাথায় জেগে উঠে বৈঠকখানায় জড়ো হয়ে গেল। শাফায়েত আর শাফিনকে নিয়ে মেহেকের অসুস্থ দাদীমা ঘুমিয়ে ছিলেন। বাড়িতে তখন কোনো পুরুষ মানুষ নেই। এদিকে ছোটচাচী পাগলের মতো কাঁদছেন স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য। বাসন্তী মেহেককে দাদীমা’র ঘরে থাকতে বলে ছোটচাচীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। মেঝো চাচীও দুশ্চিন্তায় টিকতে না পেরে তাদের সঙ্গে গেলেন। মেহেক একা একা বাড়িতে রয়ে গেল। যদিও তখন বাড়িতে মাত্র চারজন সদস্য ছিল। কিন্তু তিনজনই ছিল ঘুমন্ত। মেহেক একলাই জাগ্রত। হঠাৎ জানালায় দেখল গাড়ির হেডলাইট জ্বলছে৷ মেহেক ভাবলো আব্বারা হয়তো ছোটচাচাকে নিয়ে ফিরে এসেছে। সে কোনোকিছু না ভেবেই সদর দরজা খুলে দ্রুত বাহিরে বের হলো। গাড়িতে বসে ছিল রাজ আহমেদ। মেহেককে দেখেই সে হাসি মুখে বলে উঠলো,” মেহেক, এসো আমার গাড়িতে উঠো।”
অন্ধকারে বীভৎস চেহারাটি দেখে মেহেক খানিকটা শিউরে উঠলো। এক দৌড়ে ঘরে চলে যেতে মন চাইল৷ কিন্তু পরমুহুর্তেই তার মাথায় চড়ে বসলো সীমাহীন ক্রোধ। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,” আপনার সাহস কিভাবে হলো আমাদের বাড়িতে পা রাখার? এতো অপমানের পরেও শিক্ষা হয়নি? এখনি বের হোন নয়তো পুলিশ ডাকবো।”
রাজ হেসে ফেলল মেহেকের উত্তরে। রসিকতার সুরে বলল,” তুমি তো খুব কিউট করে ধমকাতে পারো মেহেক। এই ধমক শোনার জন্যই তো তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।”
মেহেকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাগ টগবগ করতে লাগল। এই অধমকে অন্তত একটা চড় না মারতে পারলে তার জীবনটাই বৃথা! রাজ বলল,
” তোমাকে নিতে এসেছি মেহেক। তোমার আব্বা আমাকে পাঠিয়েছে তোমাকে কারখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়িতে নাকি তুমি একা থাকতে ভয় পাচ্ছো? ”
মেহেক গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। রাগে গজগজ করে বলল,” আমাকে কি আপনার বোকা মনে হয়? আপনি বলবেন আর আমিও বিশ্বাস করে চলে আসবো।”
রাজ হাসলো। গাঁয়ে আগুন ধরানো হাসি।
” কি যে বলো! তোমার মতো একটা মিষ্টিমেয়ে কি কখনও বোকা হতে পারে?”
” বের হোন আপনি। সাহস থাকে তো এখনি গাড়ি থেকে বের হোন। তারপর দেখাচ্ছি মিষ্টি কত প্রকার ও কি কি।”
এই কথা বলেই মেহেক জোরে লাথি মারলো গাড়ির হেডলাইটে। একটা হেডলাইট ফেটে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল। রাজ যেন এই ঘটনায় দারুণ মজা পেল। হো হা করে হেসে উঠলো। তার হাসি মেহেকের গাঁয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। মেহেককে স্কুলে যাওয়ার পথে অনেকবার বিরক্ত করেছে এই লোক। চামচার মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছে। সেই চিঠি মেহেক থু মেরে পা দিয়ে পাড়িয়ে রেখে চলে গেছে। খুলেও দেখেনি। আজকে আবার এসেছে এই বেলাজ পুরুষ। একে শিক্ষা দিতে না পারলে মেহেকের গাঁয়ের জ্বালা মিটবে না। আজকে মেহেক এর মুখ বরাবর থু মারবেই। এতোদিন চিঠিতে থু মেরেছে। আজকে ডিরেক্ট মুখে মারবে! অথচ মেহেকের বোকা মস্তিষ্ক বুঝতেই পারল না তার পরিবারের এতোবড় বিপদের পেছনে এই লোকটির ষড়যন্ত্রই দায়ী। মেহেককে একা পাওয়ার আশায় কত সুন্দর পরিকল্পনা সাজিয়েছে সে। মেহেকের রাগী গর্জনে সে ভয় পায়না বরং পৈশাচিক আনন্দে শিহরীত হয়। রাজ গাড়ি থেকে বেরিয়েই মেহেকের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। একহাত বাড়িয়ে প্রেমিক পুরুষের ন্যায় ভাব ধরে বলল,” বলো প্রিয়তমা, কি দেখাতে চাও? দেখতেই তো এসেছি!”
মেহেক চোয়াল শক্ত করে একটা থাপ্পড় দিল জোরে। সেই থাপ্পড় অমৃতের মতো গ্রহণ করল রাজ চোখ বন্ধ করে। যেন থাপ্পড় খেয়ে তার জন্ম স্বার্থক হয়েছে। মেহেক ভেবে পায় না এতোটা অসহ্যকর মানুষ কিভাবে হয়? এর মাথাটা পাথর দিয়ে থেতলে দিতে মন চাইছে। মেহেক মুখ থেকে এক দলা থুতু বের করেই রাজের মুখে লেপ্টে দিল৷ রাজ এইবার উঠে দাঁড়িয়ে মেহেকের দুইহাত চেপে ধরে বলল,” শুধু কি চড়-থুতুই দিয়ে যাবে? অন্যকিছু দিবে না? আজকে যে আমার সবটুকু চাই মেহেক!”
মেহেক হিংস্র বাঘিনীর মতো গর্জে উঠলো,” তোকে খুন করে ফেলবো কুত্তা,রাক্ষস,জানোয়ার আমার হাত ছাড়!”
” বলেই যখন দিয়েছো জানোয়ার, তাহলে একটু জানোয়ারগিরি না দেখালে কি হয়?তোমার কথা তো আর মিথ্যে হতে দিতে পারি না।”
মেহেক চিৎকার শরু করল। ধস্তাধস্তির সময় রাজের হাতে চার-পাঁচটা কামড়ও দিয়ে ফেলল। কিন্তু দানবীয় হাতের বন্ধন থেকে নিস্তার পেল না। পাওয়া সম্ভবও না। রাজের কাছে মেহেক তখন নিতান্তই একটা খেলার পুতুল!
রাজ যখন তার মুখ চেপে তাকে পাজাকোলায় করে গাড়িতে তুলছিল তখনি মেহেক বুঝতে পারল নিজের কতবড় বিপদ ডেকে এনেছে সে। কিন্তু বুঝতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। গাড়িতেই ধর্ষিত হতে হলো মেহেককে। কিন্তু বাড়ির সদস্যরা খুব দ্রুত ফিরে এসেছিল যে কারণে মেহেক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। নয়তো পাশবিক শারিরীক নির্যাতনে তার মৃত্যু হতো! হায়াত ছিল বলেই বোধহয় বাঁচতে পেরেছিল সে। তার ভাগ্যটাই হয়তো এমন ছিল। একই সর্বনাশ তার সাথে দ্বিতীয়বার ঘটবে এমনটাই হয়তো বিধাতা লিখে রেখেছিলেন। ফারদিন নামের কেউ তার জীবনে আসবে। নিস্তব্ধ রাতে, খোলা আকাশের নিচে বসে তার সামনে জীবনের অতি লজ্জাজনক ঘটনাগুলো নতমাথায় স্বীকার করতে হবে৷ এমনটাই হয়তো ছিল বিধির লিখন! কি নিষ্ঠুর!কি নিদারূন!
সেদিন ছোটচাচার সাথেই হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছিল মেহেককে। তারপর টানা একমাস সে অসুস্থ ছিল। জেএসসি পরীক্ষা দেওয়া হলো না। সবাই জানল মেহেক অসুস্থ। কিন্তু কেন অসুস্থ সেটা জানানো গেল না। তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ছিল অতিশয় লজ্জার। মেঝো চাচী দিন-রাত খোটা দিতেন। বিয়ে করে নিলে এই ঝামেলা হতো না। কিন্তু বিয়ের পর কি ভয়ানকভাবে তার প্রতিদিন একটু একটু করে মরতে হতো তা ভেবেই মেহেকের গাঁ শিউরে উঠে। সে ট্রমাটাইজ হয়ে যাচ্ছিল। তার উপর সারাক্ষণ চাচীর ঘ্যানঘ্যান। যেন মেহেকের জীবনটাই শেষ। সে পঁচে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে৷ তার মতো মেয়েকে কোনোদিন কেউ বিয়ে করবে না। রাজ আহমেদের বিরুদ্ধে মেহেকের ছোটখালা মামলা দায়ের করেছিলেন। তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। উল্টো মেহেকের পরিবারের সদস্যদের উপর প্রাণনাশের হুমকি এসেছে। রাজ আহমেদ আবারও বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে। এই ঘটনার পর হয়তো মেহেকের ভালো জায়গায় কখনও বিয়ে হবে না। এটা জানার পরেও মেহেকের আম্মা রাজ আহমেদের কাছে তাকে বিয়ে দিতে রাজি হোননি। ওই লোকের কাছে বিয়ে হলে মেহেকের জীবন জাহান্নাম হয়ে যাবে৷ তার কাছে বিয়ে দেওয়া মানেই বৈধ উপায়ে চিরকাল মেয়েকে ধর্ষণ করানোর দলিল তুলে দেওয়া! এই অবিচার অন্তত মেহেকের আব্বা-আম্মা তার সাথে করতে পারলেন না। কিন্তু মেঝ চাচী কুপরামর্শ দিয়েই যাচ্ছিলেন। মেহেকের কিঞ্চিৎ সন্দেহ, তার চাচীর সাথে রাজ আহমেদের কোনো যোগসূত্র আছে। তিনি হয়তো লুকিয়ে চাচীকে ঘুষ দেন। নয়তো কেন মেঝ চাচী মেহেকের জীবনটা নষ্ট করতে উঠে-পরে লাগলেন? মেহেককে একা পেলেই বাজে কথা শুনিয়ে দিতেন। তার মধ্যে প্রধান বক্তব্য ছিল মেহেকের জীবনেও বিয়ে হবে না। তিনিও দেখবেন রিকশাওয়ালা কিংবা দাঁড়োয়ান ছাড়া মেহেককে আর কে বিয়ে করে! শুধুমাত্র ওই চাচীর জন্যই মেহেক লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ চাচীই গ্রামে গ্রামে মেহেকের ধর্ষণের খবর রটিয়েছিলেন। অনেকে তো জানতো, রাজের সাথে মেহেকের অবৈধ সম্পর্ক আছে। ধর্ষণ-টর্ষণ কিছু না। সমবয়সী মেয়েরা মেহেককে দেখলেই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাতো। দূরে চলে যেতো। কথা বলতে চাইতো না। যেন মেহেক কোনো ঘৃণ্য বস্তু! মেহেকের সবচেয়ে কাছের বান্ধুবি রত্না পর্যন্ত মেহেকের সাথে মেলা-মেশা বন্ধ করে দিল। রত্নার মা নাকি নিষেধ করেছেন মেহেকের সাথে মিশতে৷ কারণ মেহেক বাজে মেয়ে! চারদিক থেকে লাঞ্চনা,বঞ্চনা সহ্য করে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল মেহেকের জন্য। মেঝ চাচী মাঝে মাঝে মেহেককে কাপড় ধুতে, ঘর মুছতে বলতেন। ব্যঙ্গ করতেন,” সবকাজ শিখে নে। শেষমেষ তো কপালে রিকশাওয়ালাই জুটবে। রাজরাণী হতে পারতি। কিন্তু সেটা তো তোর ভালো লাগেনি। চাকরাণীই যেহেতু হতে হবে তাহলে এখন থেকেই প্র্যাকটিস শুরু কর!”
মেহেক মুখ বুজে অপমান হজম করতো। কাউকে কিছু বলতো না। মেঝ চাচীর কথা তার খারাপ লাগতো না। জীবনের সবচেয়ে বড় খারাপটা তো হয়েই গেছে। গাঁয়ে এতোবড় কলঙ্কের দাগ লেগেছে যে অন্যকিছু এখন আর গাঁয়ে লাগে না। সব সয়ে যায়। একদিন মেহেকের ছোটখালা এসে ইচ্ছেমতো তার মেঝ চাচীকে অপমান করল। ঝগড়ার এক পর্যায়ে মেঝ চাচী বললেন,” মেহেকের সাথে সাথে তোমাকেও রাজ আহমেদ ধর্ষণ করে দিলে ভালো হতো। এমন চটাং চটাং কথাবার্তা বেরিয়ে যেতো। মেহেকের হয়েছে না? এখন তো মুখে রা পর্যন্ত নেই। সব চটাং চটাং একদম বেরিয়ে গেছে। বেশ হয়েছে!”
মেহেক তখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সেদিনই বুঝতে পেরেছিল ওই মহিলার মাথায় ছিট আছে। মানসিকভাবে অসুস্থ তিনি। ছোটখালা মেহেককে এই জাহান্নামে রাখতে চাইলেন না। তাকে নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। সেখানেও রাজ মেহেককে বিরক্ত করতো। একদিন তো ছোটখালার বাড়ির সামনে এসেই দাঁড়িয়ে রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়, দুপুর গড়িয়ে বিকাল। কিন্তু রাজ আহমেদের গাড়ি জায়গা থেকে সরে না। দলবল নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে৷ মাঝে মাঝে পকেটে হাত দিয়ে আশেপাশে হাঁটে। টংয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খায়। চামচারা তাকে সিগারেট এনে দেয়। সিগারেটের ধোঁয়া ছাঁড়তে ছাঁড়তে মেহেকের অপেক্ষা করে। মেহেক বারান্দায় গাছে পানি দিতে গেছিল। রাজ আহমেদ তাকে দেখেই হাতের ইশারায় ডাকল। মেহেক ছিটকে সরে এলো জায়গাটি থেকে। ভয়ে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শীতল হয়ে আসছিল৷ ছোটখালাকে ঘটনা জানানোর পর তিনি পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশ আসার পর ছোটখাট একটা হট্টগোল বাঁধল। ছোটখালা আর খালুকে থানায় যেতে হলো। অনেক রকমের তর্ক বিতর্কের সৃষ্টি হলো, অযথা হয়রানি হতে হলো, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। রাজ আহমেদ নিস্তার পেয়ে গেলেন অনায়াসে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করাই যেন পাপ। ছোটখালা তওবা কেটে ফিরে এলেন থানা থেকে। ঠিক করলেন এরপর আর পুলিশ নয়। নিজেই রামদা হাতে নিয়ে ছুটবে। খবিশের বাচ্চাটা আসুক আরেকবার! ছোটখালার বাসার কাজের মেয়ে মাইশার সাথে মেহেকের ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক হয়ে গেছিল। ছোটখালা খুব উদার মনের মানুষ। তার বাড়ির কাজের মেয়েটি এতো সুন্দরভাবে চলাফেরা করতো যে কেউ হঠাৎ দেখলে কখনোই বুঝবে না এটা কাজের মেয়ে। ভাববে মেহেকের ছোটখালার আপন ছোটবোন! মাইশা লেখাপড়াও করতো। অনাথ মেয়েটিকে মেহেকের ছোটখালা একদম নিজের মেয়ের মতো রাখতেন। ছোটখালার ছোট্ট একটা ছেলে আছে। নাম শাদীদ। সে আবার মেহেকের খুব ভক্ত। সন্ধ্যা হলেই ছোটখালা মেহেক আর মাইশাকে পড়তে বসাতেন। মেহেককে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা হয়েছিল। কিন্তু মেহেক ভর্তি হয়নি। পুনরায় তাকে এইটে ভর্তি হতে হবে। কারণ সে জেএসসি পরীক্ষা মিস করেছে। ফেইল না করেও একই ক্লাসে আবার ভর্তি হতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু সে এমনি ছোটখালার কাছে পড়তো। তবে একাডেমিকভাবে আর পড়াশোনাটা শুরু করা হয়নি। বাড়ি থেকেও কেউ তাকে চাপ দেয়নি। কারণ সবাই জানতো যত ঘর থেকে কম বের হওয়া যায় ততই মেহেকের জন্য ভালো। নিজেকে একপ্রকার ঘরবন্দীই মনে হতো মেহেকের। আকাশে মুক্ত পাখিগুলোকে উড়তে দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। পাখি হয়ে তাদের যে স্বাধীনতা, মানুষ হয়েও মেহেকের সেই স্বাধীনতা নেই!
ছোটখালামণির বাড়িতে দিনগুলো ভালোই কাটছিল। হঠাৎ গ্রাম থেকে একদিন আব্বা ফোন করে জানালেন, মেহেকের বিয়ে ঠিক করেছেন। ছেলে আমেরিকা থেকে গ্র্যাজুয়েট করা, দেখতে রাজপুত্রের মতো সুন্দর, সম্ভ্রান্ত পরিবারের হীরের টুকরো ছেলে। এইসব কথায় মেহেকের মন ঘুরল না।আব্বা-আম্মার কাছে তো রাজ আহমেদও হীরের টুকরো ছিলেন। কিন্তু শেষমেষ হলো কি? সে বিয়ের জন্য নিষেধ করে দিল। কিন্তু এরপরদিনই আব্বা তাকে নিতে চলে এলেন। অনুরোধ করলেন অন্তত একবার ছেলেটির সঙ্গে দেখা করতে। মেহেকের পছন্দ না হলে তিনি বিয়ে দিবেন না। অবশেষে মেহেক রাজি হলো। ফারদিনকে দেখার আগেই সে নিজের উত্তর প্রস্তুত করে রেখেছিল। বিয়ে সে কিছুতেই করবে না৷ কিন্তু যখন ফারদিনকে প্রথমবার দেখল, তার হৃদয়ে যেন অদৃশ্য হুইস্টেল বেজে উঠলো। পৃথিবীর সব মানুষের জীবন শুরু হয় একটি অর্ধাংশ দিয়ে। তারপর জীবন নামক স্রোতে ভাসতে ভাসতে মানুষ জেনে কিংবা না জেনেই তার দ্বিতীয় অর্ধাংশটিকে খুঁজে বেড়ায়৷ যখন পেয়ে যায়, খাপে খাপ মিলে যায়, সে নিজেকে পরিপূর্ণ উপলব্ধি করে, তখন বুঝতে হবে তার জীবনের আসল অর্ধাংশটি সে পেয়ে গেছে! ফারদিন ছিল মেহেকের জীবনের সেই অর্ধাংশ। যাকে পাওয়ার পর মেহেক নিজেকে পরিপূর্ণ অনুভব করেছিল।
মেহেক নিজে আর ফারদিনকে দেখা দেয়নি। কিন্তু বিয়েতে মত দিয়েছিল। তার ধারণা ছিল, ফারদিন তার ব্যাপারে সব জেনেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। তাই ফারদিনের প্রতি ভালোলাগা আরও বেড়ে গেছিল। কিন্তু বিয়ের রাতে আম্মার কাছে মেহেক জানতে পারল ফারদিন আসলে কিছুই জানে না। তারপর মেহেকও আর জানাতে চায়নি। ভেবেছিল আগে ফারদিন তার উপর একটু দূর্বল হোক তখন আস্তে আস্তে সবকিছু জানানো যাবে। হুট করে সব জানিয়ে মেহেক নিজের ভালোবাসা খোয়াতে চায়নি। ফারদিনের সামনে সে নিজেকে খুব হাসি-খুশি দেখানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার জীবনের আসল হাসি হারিয়ে গেছিল অনেক আগেই। কোনো অভিশপ্ত অন্ধকার রাতে। সবকিছু ভুলে নতুন একটা জীবন চেয়েছিল মেহেক। ফারদিনের সাথে সে মাঝে মাঝে মিথ্যে গল্প করতো। মুহিব ভাই, রুমি ভাই, এ ধরণের আজগুবি মানুষের নাম নিয়ে ফারদিনকে পরীক্ষা করতো। ফারদিনের তার উপর আগ্রহ আছে কি-না এভাবে যাচাই করে দেখতো। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হতো। ফারদিনের তার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না। তারপর সুজি এলো। তার উপস্থিতিটা মেহেকের কাছে অশুভ ইঙ্গিত মনে হলো। তাকে এক মুহুর্তও ফারদিনের পাশে সহ্য হচ্ছিল না। সে কাঁদতো,কষ্ট পেতো তারপর চোখ মুছে আবার সব ভুলে যেতো৷ একবার মনে হয়েছিল, ফারদিনের কাছে বোঝা হয়ে না থেকে সে গ্রামে ফিরে যাবে। তখন মেঝ চাচীর কথাগুলো কানে বেজে উঠতো। ফারদিনের সাথে বিয়ের পর মেঝ চাচীর মুখে উচিৎ জবাব পড়েছিল। তিনি তো ভাবতেন কোনো ভালো ঘরের ছেলে মেহেককে বিয়ে করবে না। কিন্তু ফারদিন যে তাকে বাগানবাড়ি কেনার জন্য বিয়ে করেছিল সেটা মেহেকের আব্বা-আম্মা ছাড়া অন্যকেউ জানে না। মেহেক শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এলে আবার সমাজের কাছে কটূক্তি শুনতে হবে। তাই সবকিছু হাসি মুখে মেনে নেওয়া ছাড়া তার অন্যকোনো উপায় ছিল না। প্রচন্ড কষ্ট হতো, মাঝে মাঝে বুক ফেটে কান্না আসতো। নিজেকে সামলে নিতে হতো। এতোকিছুর পরেও তার জীবনের দ্বিতীয় অঘটনটি ঘটেই গেল৷ কথায় আছে অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। মেহেকের হয়েছে সেই দশা। যখন সবকিছু ভুলে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করল তখনি তার জীবনটা আবারও তছনছ হয়ে গেল। প্রবল ঝড় এসে ভেঙে দিল সবকিছু। এখন যে বাঁচার ইচ্ছেটুকুও নেই!
ফারদিন টলমল দৃষ্টিতে নিচের দিকে চেয়ে আছে। পলক ফেললেই টুপ করে একফোঁটা নোনাজল তার গাল ভিজিয়ে দিবে। মেহেকের অবশ্য কান্না আসছে না এখন। জীবনে সে এতো পরিমাণে কেঁদেছে যে কান্নাগুলো এখন শুকিয়েই গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফারদিনের হাতের উপর নিজের হাতটা রাখল মেহেক। ফারদিন সেই হাতটা আলতো করে সরিয়ে দিল। মেহেক অবাক হয়ে তাকালো। ফারদিন তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো এবং দ্রুতপায়ে চলে গেল জায়গাটি থেকে। মেহেকও ভ্রু কুচকে উঠে দাঁড়িয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে সময় লাগল তার। ফারদিন কি তাহলে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছে? অবশ্য এমনটাই তো হওয়ার ছিল। মেহেক তো কম ধোঁকা দেয়নি তাকে। তার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট অতীতগুলো আড়াল করে সে বিয়ে করেছে ফারদিনকে। এটা তো একপ্রকার ধোঁকা দেওয়াই! ফারদিন কেন তাকে মাফ করবে এতো সহজে? তবে হ্যাঁ, মানুষ হিসেবে হয়তো একটু করুণা দেখাতে আসবে। সহানুভূতির খাতিরে তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। কিন্তু মেহেকের যে করুণাভরা সেই জীবন চাই না! তার এই জঘন্য জীবনটাই আসলে চাই না! তাই হাতে তুলে নিল লাইটার। শরীরে ঢালল কেরোসিন। পৃথিবীর আর অন্যকোনো দিকে মনোযোগ দিল না। চোখ বন্ধ করেই শাড়ির আঁচলে জ্বালিয়ে দিল আগুনের শিখা। ধকধক করে অনল ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস মিশে যাচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়ায়।
ফারদিন দূরে এসে তেতুল গাছের নিচে দাঁড়ালো। নিজেকে ধাতস্থ করার প্রাণপণ চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। হচ্ছিল না! বুক চিঁড়ে কান্না উঠে আসছিল। গলায় কাঁটার মতো আটকে আছে তীব্র যন্ত্রণাটা। মেহেকের সামনে সবসময় নিজেকে খুব কঠিন হৃদয়ের মানুষ দেখিয়েছে সে। তাই হঠাৎ হাউমাউ করে মেয়েটির সামনে কেঁদে ফেলতে লজ্জা করছিল। সেজন্যই ছুটে আসতে হলো অন্যকোথাও। যেখানে শান্তিতে প্রাণ খুলে একটু কাঁদা যাবে! ফারদিন হাঁটু গেঁড়ে সবুজ ঘাসে বসে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। বহুদিন পর, তার এমনিভাবে কান্না পাচ্ছে। নিজের প্রতি করুণা হচ্ছে। ঘৃণায় বুকের ভেতরটা তিক্ত হয়ে আসছে। যে মেয়েটি সারাজীবন শুধু কষ্ট পেয়ে তার কাছে এসেছিল একটু সুখের আশায় তার মুখের শেষ হাসিটুকুও ধরে রাখতে পারল না ফারদিন! এতোটাই হতভাগা সে! পুনরায় কষ্টের সমুদ্রে ডুবে গেল মেহেক। অথচ ফারদিন তা টেরও পেল না। বাচ্চা মেয়েটি কিভাবে সহ্য করল এই বর্বরতা? ফারদিনের তো একটুও সহ্য হচ্ছে না। এক মুহুর্তও সহ্য হচ্ছে না। হাতের মুঠোয় দূর্বা ঘাস নিয়ে সে নিজের প্রতি রাগ সংবরণ করে নিজেকেই প্রতিজ্ঞা করল, আজকের পর থেকে মেহেকের গাঁয়ে একটি সুক্ষ্ম আঁচও লাগতে দিবে না। মেহেককে সে তার সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখবে। সবসময় আগলে রাখবে! কিন্তু কোথায় আছে সেই রাজ আহমেদ? যে মেহেকের জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছে তার তো জীবনে হাসি-আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! যেখানেই থাকুক সে, ফারদিন তাকে নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে। যদি তার স্থান কবরেও হয় ফারদিন সেই কবর খুঁড়ে তাকে উঠিয়ে আনবে। তার শরীরটাকে খঞ্জরের সুচালো আঘাতে ফালা ফালা করে ছাঁড়বে!
চলবে