#অনপেখিত
#পর্ব_২০
লিখা: Sidratul Muntaz
দীর্ঘসময় ফারদিন মেহেকের ছোট্ট শরীরটা তার সুঠাম বুকের মাঝখানে রেখে মধুর আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখল। আর মেহেক? সে তো কেঁদেই যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন! তার চোখের টলটলে জলে ফারদিনের টি-শার্ট ভিজে একাকার। বুকের মধ্যে উষ্ণ অশ্রুর স্পর্শ ফারদিনের হৃদয়ে যে আন্দোলনের সৃষ্টি করছে তা সহ্য করা দায়। ফারদিন ধৈর্য্য হারিয়ে প্রশ্ন করল,
” আমি অনুরোধ করছি মেহেক, প্লিজ বলো তোমার কেন এতো দুঃখ? কেন এভাবে কাঁদছো তুমি? তোমার এই কান্নার পেছনে কি আমি দায়ী? আমার আচরণে কষ্ট পেয়েই কি তুমি এমন পাথর বনে গেছো? গত এক সপ্তাহ ধরে তোমার মুখে আমি কোনো হাসি দেখিনি। এর পেছনে কারণ কি? তোমার কি এমন হয়েছে মেহেক? আমাকে বলবে না?”
ফারদিনের কৌতুহলী প্রশ্নে মেহেকের কান্নার জোর আরও বেড়ে গেল। চেহারায় ছড়িয়ে পড়ল রক্তিম আভা। লজ্জা,ভয়, আড়ষ্টতায় সে ক্রমে ক্রমে মিইয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই ফারদিনকে নিজ মুখে বলতে পারবে না সে এই লজ্জাজনক ঘটনা। এর আগে তার মৃত্যু হলেও ভালো! কিন্তু ফারদিন তাকে যেভাবে জেঁকে ধরেছে, তার থেকে ছাড়া পাওয়া বড্ড মুশকিল। ফারদিন মেহেকের নতজানু চেহারাটা একহাতে উপরে তুলে জিজ্ঞেস করল,” চুপ করে থেকে আমার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিও না মেহেক। প্লিজ আমাকে জানতে দাও আমার ভুল কোথায়? আমি এসব আর সহ্য করতে পারছি না। এইভাবে আর কত শাস্তি দিবে আমাকে? বলো!”
ফারদিন যেনো রেগেই গেল। মেহেকের ভেতরটা বড্ড কাঁপছে। বিধাতা এ কেমন কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন তাকে? সে কি জবাব দিবে? ফারদিন আবারও প্রশ্ন করল,” তুমি কি বলবে না?”
মেহেক চোখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠলো,” জীবনে কখনও ধর্ষিতা দেখেছেন আপনি?”
মেহেকের আচমকা প্রশ্নে ফারদিন কিছুটা বিস্মিত হলো। ভ্রু কুচকে তাকালো। মেহেক শব্দ করে বলল,” না দেখে থাকলে দেখে নিন। ধর্ষিতা আপনার সামনেই বসে আছে।”
কথা শেষ করে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছে মেহেক।ফারদিনের হৃৎপিন্ড যেন এক মুহুর্তের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। দুইহাতে জড়িয়ে রাখা মেহেকের শরীর আপনা-আপনি ছেড়ে দিল সে। কানগরম হয়ে উঠলো। চোখ দু’টি স্তব্ধ,অনুভূতিশূন্য! মেহেক কান্নার দমক সামলে বলল,” কি ব্যাপার? এখন কথা বলছেন না কেন? খুব তো জানতে চাইছিলেন। এখন কি সহ্য করতে পারছেন না?”
ফারদিনের মনে হলো বাতাসে অক্সিজেনের বদলে বিষ প্রবেশ করছে নাক দিয়ে। চারদিকে দমবন্ধকর অনুভূতি। শুধু ঠোঁট দু’টি নাড়িয়ে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করল একবার,” কে করেছে এমন?”
” কে না। জিজ্ঞেস করুন কারা!”
মেহেকের কণ্ঠে লুটিয়ে পড়ল আর্তনাদের হাহাকার।ফারদিনের এই কথাটুকু সহ্য করতে বেশ বেগ পেতে হলো। হৃদয় কেঁপে উঠলো নিদারুণ যন্ত্রণায়। হাতের রগ আপনা-আপনি ফুলে উঠলো তীব্র আক্রোশে, ভয়ানক হিংস্রতায়। মেহেক দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুজে গুমরে কাঁদতে শুরু করল।
২০১৮ সাল। মাত্র শীত পড়তে শুরু করেছে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ শীতের পোশাক গাঁয়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাঁড়ে করে খেঁজুরের গুঁড় নিয়ে ছুটছে বিক্রেতারা। সন্ধ্যা হলেই কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে চারপাশ। ঘন অভয়ারণ্যেটিতে তখন মনে হয় গভীর রাত। মেহেকদের জমিদার বাড়ির সবকয়টি আলো প্রজ্জ্বলিত হয় সন্ধ্যা নামলেই। সদ্য কৈশোরে পা রাখা তেরো বছর বয়সী মেহেক তখন ভীষণ চঞ্চল। তার দস্যিপনার যেন অন্ত নেই। একবার রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের বকুনি খেয়ে এসে বইয়ে মুখ গুঁজে। তো পরক্ষণেই আবার ছোট ভাই-বোনদের ডাকে ছুটে যায় কানামাছি খেলতে। চোখে পট্টি বেঁধে অঘটন ঘটায় একের পর এক। কেউ কিছু বললেই খিলখিল করে হেসে পালানো তার স্বভাব। যেন তার জন্মই হয়েছে হাসার জন্য। হেসে,খেলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব যেন তার একার কাঁধেই অর্পিত। মেঝ চাচী বিরক্ত হয়ে বলেন,” এই মেয়েকে এবার বিয়ে দিন বাসন্তী আপা”
মেহেকের মা বাসন্তী হাসেন। জাঁয়ের কথা দুষ্টমি ভেবে উড়িয়ে দেন। কিন্তু মেহেক জানে, মেঝো চাচি আসলে দুষ্টমি করেন না। তিনি প্রায়ই মেহেকের আব্বার কান ভাঙেন বিয়ের কথা বলে বলে। মেহেক আড়ালে দাঁড়িয়ে অনেকবার শুনেছে। কোনো এক বিচিত্র কারণে মেহেক তার মেঝো চাচীর দুই চোখের দুশমন। কারণটা হতে পারে মেহেকের বাবার টাকা-পয়সা। হ্যাঁ, মেহেকের বাবার যে পরিমাণ টাকা আছে তাতে এই গ্রামের মতো আরও দশটা গ্রাম অনায়াসে লালন-পালন করা যাবে। মেহেকের আব্বা খুব ছোটকাল থেকেই পরিশ্রমী ছিলেন। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। কিন্তু তাঁর ভাইগুলো একেকটা অকর্মার ঢেঁকী। তিনবোনের বিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভাইদের সংসার পালার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন মোজাম্মেল শাহ্। একটা ছেলের খুব শখ ছিল মোজাম্মেল সাহেবের। কিন্তু পরপর তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম হলো। দু’জন জন্মের পরপরই মারা গেছে। মেহেকই একমাত্র টিকে ছিল। তাই সে মায়ের বড় আদরের। মেহেক জন্মানোর আগে মোজাম্মেলকে জানানো হয়েছিল এইবার ছেলে আসছে। তিনিও ছেলের আশা নিয়ে মেহেককে হসপিটালে দেখতে গেছিলেন। কিন্তু যখন জানতে পারলেন মেয়ে তখন একবার ছুঁয়েও দেখলেন না। মোজাম্মেলের চোখের মণি ছিল মেহেকের মেঝোচাচার দুই ছেলে শাফায়েত ও শাফিন। এদের দুইজনকে নিয়ে মেতে থাকতেন সারাক্ষণ। আর মেহেকের মেঝোচাচীও চান ভাসুরের সমস্ত সম্পত্তি যেন তার এই দুই ছেলের মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া হয়। মেহেক যেন কানাকড়িটিও না পায়। মূলত এই হিংসা থেকেই তিনি মেহেককে সহ্য করতে পারতেন না। মেহেক ছোটবেলায় তো এতোকিছু বুঝতো না। বড় হওয়ার পর আস্তে আস্তে বুঝেছে। মেহেকের ছোটচাচী বিয়ের অনেকবছর পরেও কোনো সন্তান জন্ম দিতে পারেননি। তাই তিনি মেহেককে একটু বেশিই স্নেহ করেন। আর মেহেকও বাড়িতে তার ছোটচাচী আর আম্মাকে সবচেয়ে পছন্দ করে। দাদীমার কাছেও মেহেক চোখের মণি। এছাড়া মেহেকের নানু,মামা,খালা, সবাই মেহেককে অনেক ভালোবাসেন। মেহেক বলতে পাগল তারা। মেহেক ছিল অত্যাধিক রূপবতী একটি মেয়ে৷ তার ঘন রেশমি চুল, ফরসা, কোমল, ছিপছিপে দেহ, বড় বড় চোখ, ছোট্ট নাক, পাতলা ঠোঁট সব মিলিয়ে যেন একটা জ্যান্ত পুতুল। সে আচমকা যখন খিলখিল করে হেসে ফেলে তখন তার দিক থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। ঐশ্বরিক সৌন্দর্য্যের এই মেয়েটি ছিল ভীষণ নিষ্পাপ,সহজ সরল আর চঞ্চলাবতী। তার সুন্দর ফুলের মতো জীবনে একদিন অন্ধকার নামাতে কালো হাত নিয়ে আচমকা প্রবেশ করল এক অসুর। একদিন স্কুল থেকে মেহেক বাড়ি ফিরে দেখল মেহমান এসেছে। আম্মা,চাচীরা ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটোছুটি করছে। ঘরদোর সাজিয়ে হুলুস্থুল অবস্থা৷ খাওয়া-দাওয়ারও হয়েছে ব্যাপক আয়োজন। বোঝা গেল মেহমান কোনো সাধারণ মানুষ নয়। রাজা-বাদশার বংশধর হবে বোধহয়। ছোটভাই শাফায়েতের কাছ থেকে জানা গেল ঢাকা থেকে অনেক বড়নেতা এসেছেন। গাঁয়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, শরীরে আঁতরের সুগন্ধ, দেখতেও নাকি রাজপুত্রের মতো সুন্দর! আঠাশ বছরের সুদর্শন যুবক। মেহেক খুব আগ্রহী হয়ে দেখতে গেল বিশেষ মেহমানটিকে। তিনি বসেছিলেন মেহেকদের বৈঠকঘরের সোফায়। প্রথম দর্শনেই মেহেকের অরুচি এসে গেল মানুষটির প্রতি। মেহেকের আব্বার সামনে পায়ের উপর পা তুলে লোকটা বেয়াদবের মতো উচ্চস্বরে কথা বলছে। মুরব্বিদের সাথে কথা বলার ধরণ বুঝি এমন হয়? কিসের শিক্ষিত এরা? কিসের আবার নেতা? যার নিজেরই আদব-কায়দার অভাব সে আবার কন্ট্রোল করবে জনগণকে? নিতান্তই হাস্যকর ব্যাপার! মোজাম্মেল শাহ মেহেককে দেখেই হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন,” স্কুল থেকে কখন এসেছো মামনি?”
মেহেক পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার কণ্ঠ শুনেই পর্দা ছেড়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। আব্বাকে সে ভয় পায়। মোজাম্মেল সবসময় কঠিন ভঙ্গিতে মেহেকের সাথে কথা বলেন। কিন্তু আজকে খুব নরম সুরে গান গাইছেন। কারণটা হয়তো এই বিশেষ অতিথি। মোজাম্মেল শাহ হাত বাড়িয়ে বললেন,
” এদিকে এসো মা। ভেতরে আঙ্কেল আছে একটা সালাম দিয়ে যাও।”
মেহেক মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকল। নতুন অতিথিকে বিনীত স্বরে সালাম দিল। ঠিক সেই সময় শকুনি দৃষ্টিটা নিক্ষিপ্ত হলো মেহেকের উপর। দুধে আলতা ফরসা গাঁয়ে নেভী ব্লু রাউন্ড শেপের ইউনিফর্ম পড়া রেশমি চুলের পুতুলের মতো সুন্দর মেয়েটিকে দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য সম্বিৎ হারালো উপজেলা পরিষদের তরুণ চেয়ারম্যান রাজ আহমেদ খান। তেরো বছর বয়সী কিশোরীর রূপে বোধজ্ঞান হারিয়ে সে এতোটাই মগ্ন হলো যে দ্বিতীয়বার ডেকে তার সম্বিত ফেরাতে হলো। মোজাম্মেল ডাকলেন,” রাজ ভাই, আমার মেয়ে মেহেক। ক্লাস এইটে উঠলো এবার।”
রাজ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত মেহেককে একবার দেখে সালামের জবাব নিল। মেহেকের খুব অস্বস্তি লাগছিল লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। যেন চোখ দিয়েই লোকটি গিলে খাচ্ছিল তাকে। শাফায়েতের বর্ণনায় এই লোকটি নাকি সুন্দর। হ্যাঁ, বলা যায় সুন্দর। কিন্তু মেহেকের এই সৌন্দর্য্য ভালো লাগলো না। লোকটার চেহারাতেই কেমন একটা শয়তানি ভাব। দেখলে মন চায় জোরে একটা ঘুষি মেরে থুতনি ফাটিয়ে দিতে। হঠাৎ অপরিচিত লোকটির প্রতি কেন পিচ্চি মেহেকের এতো ক্ষোভ জন্মালো সেটা মেহেক তৎক্ষণাৎ বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছিল। লোকটার অমার্জিত নজরই ছিল তার প্রতি বিতৃষ্ণার কারণ। এরপরদিনই মেহেক জানতে পারল রাজ আহমেদ তার আব্বাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। মেহেককে সে বিয়ে করতে চায়।
চলবে।