অনপেখিত পর্ব-১৯

0
1749

#অনপেখিত
#পর্ব_১৯
লিখা: Sidratul Muntaz

পুরো ছয়দিন কেটে গেল। মেহেক সেদিন সারারাত জ্বরে কাতরালো। দিনেরবেলা কিছুক্ষণের জন্য তার জ্বর ভালো হয়। রাত হলেই আবার এক অবস্থা! উর্মি সারাক্ষণ মেহেকের সাথে সাথেই থাকছে। ফারদিন মাঝে মাঝে দুয়েকবার খোঁজ নিতে মেহেকের কাছে আসছে। এভাবেই কাটছে দিন। ওয়াসীম,সুজিতা,আনজীর,পূর্বিতা সবাই ঢাকায় ফিরে গেছে। শুধু ফারদিন মেহেককে নিয়ে চট্টগ্রামেই থেকে গেছে। তার বাবা-মায়ের আমেরিকা থেকে ফিরতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে৷ তাই ফারদিন ঠিক করেছে যতদিন বাবা-মা না ফিরছে ততদিন এখানেই থাকবে। কিন্তু ইদানীং ফারদিন একটা ব্যাপার খুব ভালোভাবে আবিষ্কার করেছে। সে আসলে ভালো থাকতে পারছে না। তার কি যেন একটা নেই! কিছু একটা’র বড্ড অভাব। আর অভাবটা ফারদিনের সহ্য হচ্ছে না। পৃথিবীর সবকিছু অর্থহীন লাগছে, অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। শুধু সেই জিনিসটির অভাবে নিজেকেও নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে। মেহেক কথা বলে না তার সাথে। শুধু তার সাথে কেন? কারো সাথেই কথা বলে না মেহেক৷ সারাক্ষণ দরজা আটকে একটা ঘরে বসে থাকে। ফারদিন তাকে যে পাখি কিনে দিয়েছিল সেই পাখিগুলো কিছুদিন আগে বাগানে ছেড়ে এসেছে মেহেক। সে কেমন যেন হয়ে গেছে। তার এই পরিবর্তনটা বড় অদ্ভুত। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার পর মেহেক অসুস্থ হলো, জ্বর আসলো, জ্বরে কাবু হয়ে কাটিয়ে দিল ছয় ছয়টি দিন। কিছুটা সুস্থ হলেও স্বাভাবিক আর হয়ে উঠল না। কিন্তু কেন? মেয়েটার কি হয়েছে? তার এই পরিবর্তন ফারদিনকেই বা কেন এতো বিচলিত করছে? কেন ফারদিনের দম আটকে আসছে সীমাহীন ব্যথায়! সে কি আগের মেহেককে মিস করছে? মেহেকের উচ্ছলতা, চাঞ্চল্য, বাচ্চাদের মতো বোকা-বোকা কথাবার্তা,সবকিছু হারিয়ে গেছে৷ ফারদিনের মনে হচ্ছে তার জীবনের ছন্দটাও যেন এগুলোর সাথে হারিয়ে গেছে। প্রায়রাতেই সে স্বপ্ন দেখে মেহেক আবার আগের মতো একদম সুস্থ হয়ে গেছে। আবার আগের মতো হাসছে, খেলছে, ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিচ্ছে। ফারদিন কণ্ঠে আনন্দ ধ্বনি মিশিয়ে বলল,” তুমি ঠিক হয়ে গেছো মেহেক? আর কখনও গোমরা মুখে থাকবে না প্লিজ। তোমার চেহারায় গুমট ভাব মানায় না। তোমার জন্ম হয়েছে হাসার জন্য। তুমি শুধু হাসবে। বাচ্চাদের মতো পাগলামি করবে, খেলবে, দৌড়াবে আর সবসময় আমাকে বিরক্ত করবে, এটাই তোমার কাজ। মনে থাকবে?”
মেহেক মুখ ভার করে বলল,” কিন্তু বিরক্ত করলে তো আপনি আমাকে ধমকান।”
ফারদিন বেদনাসিক্ত কণ্ঠে বলল,” প্রমিস করছি আর ধমকাবো না। তাও তুমি সবসময় এমনই থেকো মেহেক।”
মেহেক ফারদিনের হাত ধরে বায়না করে,
” আমি তাহলে আবার ঘোড়ায় চড়তে চাই।”
ফারদিন চোখ গরম করে বলল,” একদম না। তুমি ঘোড়ায় চড়তে পারবে না।”
অভিমানী মেয়েটা ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলল,” কেন পারবো না? আমার ঘোড়ায় চড়তে ইচ্ছে করছে। আমি নিশ্চয়ই চড়বো।”
ফারদিন শক্ত করে মেহেকের হাত ধরে বলল,” না মেহেক। কক্ষনো না। ঘোড়ায় উঠলে তুমি ঘোড়া থেকে পড়ে যাবে।”
” আপনি কি আমাকে ভেলকা মনে করেন? আমি ঘোড়া থেকে কেন পড়বো? আমি খুব ভালো ঘোড়া চালাতে পারি। দেখবেন আপনি?”
মেহেক ফারদিনের হাত ছেড়ে দৌড়ে চলে যায় ঘোড়ায় উঠতে। একটা বিশাল লম্বা ঘোড়া চিঁহিহি করে ডাকে। ফারদিনের বুক ধড়ফড় করে সেই ডাক শুনলে। মনে হয় এই ঘোড়াটি তার কাছ থেকে মেহেককে ছিনিয়ে নিতে এসেছে৷ ফারদিন ঘোড়াটিকে তাড়ানোর জন্য ধাওয়া করে। কিন্তু পারে না। শেষমেষ মেহেক ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। তারপর সত্যি সত্যি ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে যায়। ফারদিন আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে ডাকে,” মেহেক!”
ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা বাজে। ফারদিন এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে নেয়। কি ভয়ংকর স্বপ্ন! এই বাজে স্বপ্নটা সে রোজ দেখে! কিন্তু প্রতিদিন তার স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে সকালে। আজকে মাঝরাতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। মেহেককে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মেহেক তার পাশে নেই। বুকটা ধ্বক করে উঠল। কোথায় গেল মেয়েটা?

পেয়ারা গাছের নিচে একাকি বসে মেহেক আকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছে, সে মরে গেলে কয়জন কষ্ট পাবে। আম্মা তো নিশ্চয়ই খুব কাঁদবেন। আব্বা কি কাঁদবেন? মেহেক কখনও তার আব্বাকে কাঁদতে দেখেনি। মেহেকের মৃত্যুর পরেও হয়তো তিনি কাঁদবেন না। কে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে মেহেকের মৃত্যুতে? সুজি আপু কি কষ্ট পাবে? এই সময় হঠাৎ করে সুজির কথা কেন মনে পড়ল মেহেক জানে না। কিন্তু যেদিন সুজি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল তখন মেহেকের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,” ভালো থেকো মেহেক।”
মেহেকের ওই মুহুর্তে কি যে ভালো লেগেছিল! সুজি মেহেকের থুতনি স্পর্শ করে বলেছে,” একদম মনখারাপ করবে না ঠিকাছে? ফারদিন দেখবে তোমাকে অনেক ভালোবাসবে৷ কারণ তোমার মতো একটা মেয়েকে ভালো না বেসে থাকাই যায় না। আর ফারদিনকে আমি রগে রগে চিনি। মাথাগরম হলে ও পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হয়ে যায়। কিন্তু মাথা ঠান্ডা থাকলে ও হয় সবচেয়ে ভালো মানুষ। রাগী হলেও ওর মনটা খুব নরম। তুমি ওর কাছে ভালোই থাকবে। আর ভুলেও এই কথা ভেবো না যে ফারদিন আমাকে ভালোবাসে। কারণ সে যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসতো তাহলে তোমাকে বিয়ে করতে পারতো না।”
সবশেষে সুজি আরও একটা কথা বলেছিল,” আমেরিকা থেকে আমি আমার এই ছোট্ট বোনের জন্য একটা সুন্দর উপহার পাঠাবো।”
মেহেক বলেছিল,” আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
সেই অপেক্ষা আর করা হলো না। মেহেকের স্বল্প পরিসরের জীবনটা হয়তো ফুরিয়ে এসেছে। বাঁচার আশা তার মধ্যে আর বিন্দুমাত্র নেই। বন্দী খাঁচার পাখি হয়ে সে বাঁচতে চায় না! তার এখন ভীষণভাবে মুক্তি চাই৷ সেই মুক্তির নাম মৃত্যু। ফারদিনের ঘুমের সুযোগ নিয়ে মেহেক তার পকেট থেকে লাইটার চুরি করে এনেছে। ফারদিন তা টের পায়নি। উর্মিদের ঘর থেকে মেহেক কেরোসিন আর ইঁদুর মারার বিষ এনেছে। ইঁদুর মারার বিষ বেকাপ হিসেবে কাজ করবে। যদি শরীরে আগুন লাগাতে ভয় লাগে তাহলে মেহেক বিষ খেয়ে নিজের আত্মা জলাঞ্জলি দিবে। এই যন্ত্রণাময় জীবনের বোঝা তার পক্ষে বয়ে বেড়ানো আর সম্ভব না। সে একটু শান্তি চায়। মৃত্যু কি তাকে দিতে পারবে সেই শান্তি?
ফারদিন পেয়ারা গাছের নিচে মেহেককে বসে থাকতে দেখেই ছুটে আসল। অবাক হয়ে বলল, ” এইখানে তুমি কি করছো মেহেক? তোমার কি ভয়ও লাগে না?”
মেহেক মনে মনে হাসলো। আর ভয়! এখন মেহেক শুধু একটা জিনিসকেই ভয় পায়। তা হলো বেঁচে থাকা। এই লানিত, গ্লানিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে দূর্বিষহ ব্যপার আর কি হতে পারে? ফারদিন মেহেকের পাশে বসলো। তার বুক এখনও ধড়ফড় করছে। ভয়টা কিছুতেই কাটছে না। অদৃশ্য একটা ঘোড়ার ডাক ক্ষণে ক্ষণেই ফারদিনের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলছে। তার ধারণা ঘোড়াটি মেহেককে তার থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়। ফারদিন হঠাৎ বলল,
” আমি কি তোমার হাতটা একবার ধরতে পারি মেহেক?”
মেহেক বিস্মিত হলো। এতোটা আকুতি নিয়ে কেউ কখনও তার হাত ধরতে চায়নি তো আগে! এই মানুষটার আজ কি হয়েছে? কেন তার কণ্ঠ এতো মায়াবী, আদুরে শোনাচ্ছে? মৃত্যুর আগে কি পৃথিবীর সবকিছুকেই এমন আদুরে মনে হয়? আচ্ছা, মেহেক যদি মরে যায় তাহলে এই মানুষটা কি কাঁদবে তার জন্য? ফারদিন অনুমতির আশায় পুনরায় ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল। মেহেক বিভ্রমে ডুবে থেকেই বলল,” হুম।”
ফারদিন মেহেকের ফরসা, কোমল হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। তার চেহারায় ঝলমল করছে অন্যরকম একটা স্বস্তি। মেহেক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছুতেই সে তার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। মরার আগে দুনিয়া তাকে মায়ার বাঁধনে জড়াতে চাইছে। কিন্তু মেহেক কিছুতেই এই মিথ্যে মায়ায় ভুলবে না। সে চিরবিদায় গ্রহণ করবে পৃথিবী থেকে। তার বাঁচার অধিকার নেই। ফারদিন কি মনে করে যেন আচমকা মেহেকের হাতের উল্টোপিঠে একটা চুমু দিল। মেহেক কেঁপে উঠলো, সংকুচিত হলো, থেমে গেল তার শ্বাস-প্রশ্বাস, শরীরের রক্ত চলাচলেও যেন এক মুহুর্তের জন্য বিঘ্ন ঘটল। ফারদিন তাকিয়ে দেখল মেহেকের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে৷ তার বুকের ভেতরটা সুচালো এক তীক্ষ্ণ ব্যথায় হাহাকার করে উঠলো। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হলো। যেন তার জন্যই মেহেকের এই করুণ দশা। নিজের মনের এই অনুভূতির কারণ ফারদিনের কাছে স্পষ্ট নয়। হয়তো সে মেহেককে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল বলেই সৃষ্টিকর্তা তাকে এইভাবে শাস্তি দিচ্ছে। সে মেহেককে ভালোবাসতে না পারলেও মেহেক তো তাকে ঠিকই ভালোবেসেছিল। তবুও সে কি করে ভাবল সেই ভালোবাসার আহ্বান উপেক্ষা করে মেহেককে দূরে ঠেলে দেওয়ার কথা। এখন যে মেহেক সত্যিই দূরে সরে গেছে৷ এতোটা দূরত্ব তো ফারদিন কখনও চায়নি৷ এই দূরত্ব তার সহ্য হচ্ছে না। একদম না। ফারদিন মেহেকের আরও কাছে আসল৷ তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রুদ্ধ কণ্ঠে আর্তনাদের সুরে বলল,” আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না মেহেক। বলো তোমার কি হয়েছে? কেন কাঁদছো তুমি? প্লিজ বলো না মেহেক।”
মেহেক শব্দ করে কেঁদে ফেলল। হাউমাউ করে কেঁদে বলল,” আমারও কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আপনি আমাকে আরও কিছুক্ষণ এভাবে জড়িয়ে ধরে রাখবেন প্লিজ? তাহলে বোধ হয় আমার একটু ভালো লাগবে।”
ফারদিন আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মেহেককে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল উষ্ণতা। মেহেকের আবেশে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসছিল। বহুদিন পর সে কারো বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদার আশ্রয় খুঁজে পেল। এতো শান্তি লাগছিল! এভাবে কেউ তাকে কখনও জড়িয়ে ধরেনি তো! মেহেকের মনে হচ্ছে, ঠিক এই মুহুর্তে সে মরে গেলে বেশ হতো। এমন সীমাহীন সুখের মুহুর্ত নিয়ে মরে যাওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে