অনপেখিত পর্ব-১৮

0
1812

#অনপেখিত
#পর্ব_১৮
লিখা: Sidratul Muntaz

ওয়াসীম,সুজিতা,পূর্বিতা, আনজীর সবাই মেহেককে শুধু এক জায়গাতেই খুঁজছিল। যেহেতু মেহেক এখানকার কিছু চেনে না তাই সে দূরে কোথাও যেতে পারে বলে কারো ধারণা হয়নি। কিন্তু ফারদিন কি মনে করে যেন ঝাউবন পেরিয়েও সামনের খোলা রাস্তা দিয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে গেল। আর সে আশেপাশের মানুষদের মেহেকের একটা ছবি দেখিয়ে খুঁজছিল। বেশিরভাগ মানুষই মেহেককে চিনতে নাকচ করল। কিন্তু একজন লোক জানাল, তিনি নাকি মেহেককে এই রাস্তায় হাঁটতে দেখছেন। পরে ফারদিন সেই আগন্তুকের অনুসরণকৃত রাস্তা বরাবরই এগিয়ে গেল। ফারদিন অস্থির হয়ে মেহেককে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। মেয়েটা হারিয়ে গেলে তাকেই দাদুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। খুঁজে পাওয়ার পর তাকে কষে একটা চড় লাগাবে বলেও ঠিক করে রাখল ফারদিন৷ এই মেয়েটির জন্যই সুজি জীবনে প্রথমবার তাকে চড় মেরেছে। মেহেকের উপর আপাতত ফারদিন ভীষণ ক্ষীপ্ত এবং একই সাথে বিরক্ত। সে চিৎকার করে মেহেকের নাম ধরে ডাকছিল আর সামনে যাকেই পাচ্ছিল, মোবাইল থেকে মেহেকের ছবিটা বের করে দেখাচ্ছিল। যদি কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারে সেই আশায়।

মেহেকের যখন জ্ঞান ফিরল তখন চারদিকে আঁধার রাত্রী নেমে এসেছে। খোলা আকাশে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রের মেলা। মনে হচ্ছে যেন কালো চাদরে হাজারো হীরের সংমিশ্রণ! মেহেকের নিথর শরীরটা পরিত্যক্তভাবে পড়ে আছে বালুবেলায়। তাৎক্ষণিকভাবে তার কিছু মনে পড়ছিল না। কিন্তু যেই মুহুর্তে সে নিজের অবস্থাটা বুঝতে পারল, তখনি ডুঁকরে কেঁদে ফেলল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তার পুরো পৃথিবী তছনছ করে ফেলতে মন চাইল। এইদিকটা এখনও জনমানবশূন্য। সে কোথায় আছে, কিভাবে আছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে সে ভালো নেই। একদম ভালো নেই! মেহেকের ডুকরে উঠা কান্নার শব্দটা ছাপিয়ে হঠাৎ ভেসে আসতে লাগল ভরাট পুরুষালি কণ্ঠের সেই তীক্ষ্ণ ডাক!,
” মেহেক! মেহেক!”
মেহেকের চিনতে এক মুহুর্ত দেরি হলো না সেই ডাক। সাড়া দিতে মন চাইল সাথে সাথে। কিন্তু পারল না। শোয়া থেকে উঠে বসার শক্তিটুকুও তার নেই। নিথর দেহটা যেন ভূপৃষ্ঠের সাথে লেপ্টে আছে। মেহেক নড়াচড়া করতে পারছে না। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। শুধুই কান্না পাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে বোবা ধরা অবস্থায় মানুষের যেই হাল হয় মেহেকের অবস্থাটাও এখন ঠিক তেমন! ফারদিনের কণ্ঠ আরও স্পষ্ট হয়ে আসছিল। এর মানে সে আশেপাশেই আছে। মেহেক মনে-প্রাণে দোয়া করতে লাগল, ফারদিন যেন তাকে খুঁজে না পায়। সে এই চেহারা নিয়ে ফারদিনের সামনে যেতে পারবে না। ফারদিন তাকে দেখে শিউরে উঠুক এটা সে চায় না! খুব কষ্টে নিজেকে ধাতস্থ করল মেহেক। ফারদিন না হোক, অন্যকেউ এখানে চলে আসলে কি হবে? তাই অন্ধকারে হাতড়েই নিজের পোশাক খুঁজে নিল। গাঁয়ে জড়িয়ে কোনোমতে আড়ষ্ট হয়ে বসল। ভাগ্যিস ফারদিন ঠিক তখনি খুঁজে পেল মেহেককে। ফ্লাশলাইটের মৃদু আলোয় মেহেকের অপূর্ব সুন্দর চোখজোড়া দেখে চিনতে এক মুহুর্তও সময় লাগল না তার। ফারদিন তড়িৎ গতিতে মেহেকের কাছে এগিয়ে এল। মেহেক মাথা নিচু করে গাঁট হয়ে বসে আছে। যেনো কোনো পাথুরে মূর্তি। ফারদিন এক হাঁটু গেঁড়ে মেহেকের পাশে বসে সীমাহীন কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল,” মেহেক, কি হয়েছে তোমার? এখানে বসে আছো কেন?”
ফ্লাশলাইটের নম্র আলোতেও ফারদিন স্পষ্ট দেখতে পেল মেহেকের ঠোঁটের বামপাশ থেকে রক্ত পড়ছে। ফারদিন সেখানে আঙুল রাখতেই মেহেক শিউরে উঠলো। শিউরে উঠলো ফারদিন নিজেও। তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল। মেহেকের সাথে কি হয়েছে? কেন তার এই অবস্থা? ফারদিন প্রশ্ন করার মতো ডাকল,” মেহেক?”
মেহেকের নির্বিকার উত্তর,” ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।”
” ঘোড়া থেকে মানে? তুমি ঘোড়ায় উঠেছো কেন?”
” এমনি। কখনও উঠিনি তো। তাই শখ হয়েছিল।”
” তাহলে একা উঠতে গেলে কেন? কাউকে ডাকোনি কেন?”
” সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত ছিল। আমার দিকে খেয়াল রাখার সময় কই?”
ফারদিন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কথা হারিয়ে ফেলল। আসলেই তো, মেহেক ছোট মানুষ। তার দিকে সবার একটু বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার ছিল। অন্তত ফারদিনের নিজের উচিৎ ছিল মেহেকের সাথে সাথে থাকা। এখন কতবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল। আরও ভয়ানক কিছু হতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছে। ফারদিন একটা গভীর শ্বাস মুক্ত করে বলল,” উঠো এবার৷ সবাই খুঁজছে তোমাকে।”
” ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছি। উঠতে পারছি না।”
ফারদিন মেহেককে পাজাকোলায় তুলে নিল। মেয়েটির ভয়ংকর নিস্তব্ধ চোখ দু’টির দিকে চেয়ে ফারদিন প্রশ্ন করল,” তুমি ঠিকাছো তো মেহেক?”
মেহেকের ভেতর থেকে একটি হাহাকার বেরিয়ে আসতে চাইল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল,” একদম ঠিক নেই আমি। আমার কিছু ঠিক নেই। আমাকে আপনি ছেড়ে দিন দয়া করে। আমি হারিয়ে যেতে চাই৷ সবার মাঝে আমি আর ফিরে যেতে চাই না৷ এই জীবন আমার কাছে বোঝা। পৃথিবীটা আমার কাছে আজ থেকে জাহান্নাম।”
মেহেকের উত্তর না পেয়ে ফারদিন আর কোনো প্রশ্নও করল না। শুধু অনুতপ্ত কণ্ঠে একবার স্বগতোক্তি করল,” স্যরি।”
সেই মৃদু শব্দ মেহেকের কানে গিয়ে পৌঁছালো কিনা বোঝা গেল না। সে রোবটের মতো বলল,” আমি বাড়ি ফিরতে চাই।”
বন্ধুরা মেহেকের পাশাপাশি ফারদিনকেও খুঁজতে শুরু করেছে। প্রায় তিনঘণ্টা ধরেই তারা শুধু খোঁজাখুঁজি করছে। এতোক্ষণ তো ফারদিন আশেপাশেই ছিল। এখন তাকে দেখাই যাচ্ছে না। কি আশ্চর্য! একটু পরেই পূবিতা চেঁচিয়ে উঠলো,” ওইতো ওরা আসছে!”
আনজীর বলল,” কোথায়?”
সবাই দেখল ফারদিন মেহেককে কোলে নিয়ে দূর থেকে হেঁটে আসছে। ওই মুহুর্তে দু’জন দু’জনের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল। অন্ধকার বালুভূমিতে এমন দৃশ্য দেখতে সুন্দর লাগছিল! প্রত্যেকের চেহারাতেই একটা আনন্দের ঝলকানি ফুটে উঠলো। সুজির মনটা ভালোলাগায় ভরে গেল। ওয়াসীম মুচকি হেসে বলল,” তোরা যা-ই বলিস, দে আর ভেরি কিউট।”
সুজি তৃপ্ত কণ্ঠে বলল,” হুম। একদম মেইড ফর ইচ আদার।”
আনজীর পকেট থেকে ফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিল।
বাড়ি ফিরে আসার পথটুকু মেহেক কারো সাথে একদম কথা বলল না। সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে শোনার পর সবাই খুব দুঃখ প্রকাশ করল। তাদের অবহেলার জন্যই এমন একটা দূর্ঘটনা হয়েছে। কিন্তু মেহেক কাউকে জানতেই দিল না, দুর্ঘটনাটি আসলে কতটা নিদারুণ!
বাড়িতে চলে আসার পর মেহেক বারান্দায় গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রইল৷ তার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছিল। মেহেকের খুব ইচ্ছে করল একবার মায়ের কোলে মাথা রাখতে। এ বাড়িতে এতোগুলা মানুষ। কিন্তু তার ব্যথা বোঝার মতো একটা মানুষও নেই। আম্মা যদি এখানে থাকতো তাহলে হয়তো মেহেকের মুখ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু বুঝে নিতো! মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতো। আর মেহেক মায়ের কোলে মাথা রেখে নির্দ্বিধায় কাঁদতো। আজ অনেকদিন পর মেহেকের আবার সেই অভিশপ্ত স্মৃতিগুলি মনে পড়ছে। সে যখন জীবনে প্রথমবার ধর্ষিত হয়েছিল তখন তার বয়স তখন মাত্র তেরো। টানা বাইশদিন জ্বরে ভুগেছিল। কেউ তার খোঁজ নিতে আসেনি। আম্মা সেবা-শুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করেছেন। ওই দূর্ঘটনার পর থেকেই মেহেকের লেখাপড়া একদম বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি থেকে বের হওয়াও যেন তার জন্য পাপ! নিজেকে কারাবন্দী আসামি মনে হতো। কিন্তু সে তো কোনো অপরাধই করেনি। অপরাধ যে করেছিল তার কি এমন শাস্তি হয়েছিল? পায়ে শিকল পড়িয়ে তাকে কি ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল? খুব জানতে ইচ্ছে হয় মেহেকের। কেন তার সাথে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো আবারও! এখন এই সর্বনাশের চিহ্ন নিয়ে সে বাঁচবে কেমন করে? মেহেক দুইহাতে মুখ ঢেকে কেঁপে কেঁপে কাঁদছিল। ফারদিন যে নিঃশব্দে ওর পাশে এসে বসেছে এটা খেয়ালই করেনি মেহেক। হঠাৎ ফারদিন ডেকে উঠলো,” মেহেক! ”
মেহেক আচমকা ডাক শুনে ভয়ে শিউরে উঠলো যেন। মাথা তুলে তাকাল ফারদিনের দিকে। ফারদিন বলল,” শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
মেহেক কোনো জবাব দিতে পারল না। তার এই মুহুর্তে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একা হারিয়ে যেতে মন চাইছে এমন কোথাও যেখানে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না। ফারদিন মেহেকের কপালে হাত দিয়েই আঁতকে উঠলো। মেয়েটার শরীরে মারাত্মক জ্বর!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে