অনপেখিত পর্ব-১৭ + extra part

0
1741

#অনপেখিত
#পর্ব_১৭
লিখা: Sidratul Muntaz

ফারদিন তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। ঠান্ডা গলায় বলল,” তার মানে তুমি বলতে চাইছো তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোমার সাথে থাকা শয়তানের৷ তাইতো?”
মেহেকও উঠে দাঁড়ালো। ধীরে-সুস্থে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ফারদিন বলল,” আমার সাথেও কিন্তু একটা শয়তান আছে৷ তোমার চেয়ে আরও বড় শয়তান সেটা। সেই শয়তানটা এখন কি বলছে জানো?”
” কি বলছে?” ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল মেহেক। ফারদিন কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

প্রায় পৌনে একঘণ্টা ধরে মেহেক লিখছে। একই লাইন বার-বার লিখছে। লাইনটি হলো,” আমি আর জীবনেও শয়তানী করবো না।” এই লাইনটি তাকে পাঁচশোবার লিখে জমা দিতে হবে ফারদিনের কাছে। এতোক্ষণে মাত্র একশো চুরাশি পর্যন্ত লেখা হয়েছে। এইটুকুতেই হাত অবশ হয়ে আসছে। আর লেখা সম্ভব না। আঙুল ধরে গেছে। কতদিন ধরে মেহেক লেখা প্র্যাকটিস করে না। লেখার অভ্যাসও নষ্ট হয়ে গেছে। পিঠ ব্যথা করছে। একবার বিছানার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো মেহেক। ফারদিন বিছানায় শুয়ে আরাম করে একের পর এক সিগারেটে সুখটান দিয়ে যাচ্ছে। যেন তার চেয়ে সুখী মানুষ এই দুনিয়ায় নেই। মেহেককে লেখা থামাতে দেখে ফারদিন জিজ্ঞেস করল,” কি ব্যাপার? শেষ হয়েছে?”
মেহেক অসহায় কণ্ঠে বলল, ” না।”
” কয়লাইন লিখেছো দেখি।”
মেহেক যে খাতায় লিখছিল সেই খাতাটা নিয়ে ফারদিনের কাছে এলো। ফারদিন হাতের লেখা দেখেই চোখ-মুখ কুচকে বলল,” হাতের লেখার এমন দুরবস্থা কেন? এইচএসসি পাশ একটা মেয়ের লেখা বুঝি এমন হয়? ছি,ছি,ছি!”
ফারদিনের টিপ্পনী কাটা শুনে মেহেকের কোনো ভাবান্তর হলো না৷ কারণ মনে মনে সে জানে, সে এইচএসসি তো পাশ দূর,জেএসসি পাশও করেনি। ফারদিন মনোযোগ দিয়ে লাইনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল,” এতো বানান ভুল কেন? শয়তান বানান কি দন্ত্য ‘স’ দিয়ে হয় নাকি তালব্য ‘শ’ দিয়ে? হুম? এখন কি তোমার বানানের ক্লাস নিতে হবে?”
মেহেক নিচু গলায় বলল,” স্যরি। দিন ঠিক করে নিচ্ছি।”
” থাক লাগবে না। কয় লাইন বাকি আছে আর?”
” জ্বী?”
” কয়লাইন বাকি আছে?”
” জানি না।”
” কেন জানবে না? ছোটবেলায় সাবস্ট্রাকশন শিখোনি? পাঁচশো থেকে একশো চুরাশি বাদ দিলে কত হয়? বলো।”
মেহেক হাতের কড় গুণে হিসাব শুরু করল। ফারদিন বলল,” তিনশো ষোল হয় না?”
মেহেক হিসাব না করেই বলল,” হ্যাঁ হয়।”
” তাহলে এখন তিনশো ষোলবার কান ধরে উঠ-বস করো।”
” কি?” মেহেক যেন আকাশ থেকে পড়ল।
” আমি তো বাংলাতেই কথা বলেছি নাকি? না বোঝার তো কিছু নেই। কান ধরে উঠ-বস করো আর বলো ‘আমি আর জীবনেও শয়তানি করবো না।'”
মেহেক কাঁদো কাঁদো চেহারায় কান ধরল। উঠ-বস করতে করতে বলল,” আমি আর জীবনেও শয়তানি করবো না।”
এইভাবে ত্রিশবার উঠ-বস করার পর মেহেক হাঁপিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। ফারদিন চোখ রাঙানি দিয়ে বলল,” কি ব্যাপার? বসলে কেন? এখনও তো একশোবারও হয়নি। উঠো। গেটআপ।”
” আমি একটু পানি খাবো।”
” আগে একশো শেষ করো। তারপর পানি পাবে। এর আগে না।”
” এমন করছেন কেন? কেউ পানি চাইলে দিতে হয়। নাহলে মরার আগে পানি পাবেন না।”
” আমি মরার আগে পানি পাবো কি পাবো না সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি আগে নিজের চিন্তা করো। উঠো।”
” আমার হাঁটুতে ব্যথা করছে৷ আমি আর পারছি না।”
” শয়তানি করার আগে এটা মনে ছিল না? এরপর থেকে যখন শয়তান আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে তখন যেন এই হাঁটুর ব্যথার কথা মনে থাকে।”
” মনে থাকবে।”
ফারদিন খাতা আর কলম মেহেকের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,” যাও ভাগো।”
মেহেক এগুলো তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো,” তাহলে কি আমার শাস্তি শেষ? ”
” আপাতত হুম।”
মেহেক এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খুব বাঁচা বেঁচেছে সে। এতোক্ষণ নিজেকে জেলখানার আসামী মনে হচ্ছিল। মেহেক এবার উর্মিদের ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কানো শুরু করল। আজরাতে তার উর্মির সঙ্গেই থাকার কথা। ফারদিন বলেছে সকালে উঠে তার প্রথম কাজ হলো সুজির কাছে ক্ষমা চাওয়া। সুজি যদি তাকে ক্ষমা করে তাহলে ফারদিনও ক্ষমা করবে। পরদিন সকালে মেহেক সত্যিই সুজির কাছে ক্ষমা চাইতে গেল। কিন্তু সুজির ব্যবহার দেখে সে হতভম্ব! সুজি ওর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল,” আরে মেয়ে, এইটা কোনো ব্যাপারই না৷ তোমার বয়সে থাকতে এমন দুষ্টুমি আমরাও কত করেছি! তাছাড়া তুমি চুলে আঠা না লাগালেও কিন্তু আমি চুল কাটতাম। কারণ আমার বরের ছোট চুলই বেশি পছন্দ। তুমি যে তোমার ভুলটা বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। আমি কিছু মনে রাখিনি। আর তুমিও মনে রেখো না।”
মেহেক সত্যিই খুব অবাক হয়েছিল। বিয়ের পর সুজির এতো পরিবর্তন? না, না, আজকে থেকে আর সে সুজিকে ঘৃণা করবে না। সুজি আপু অনেক ভালো! সুজি আপু বেস্ট!
বিয়ে উপলক্ষে সুজি আর আনজীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কক্সবাজার ঘুরতে যাবে। সেখান থেকে ইনানী বিচ, হিমছড়ি ঝরণা আরও অনেক জায়গায় ঘুরবে। আমেরিকা ফিরে গেলে আবার কবে না কবে তাদের বাংলাদেশে আসা হয় তার ঠিক নেই৷ তাই তারা সব সুন্দর জায়গা একবারে ঘুরে যেতে চাইছে। ঠিক হলো সকাল নয়টা নাগাদ বেরিয়ে সারাদিন সবাই ঘুরবে৷ এরপরদিন সবাই একসাথে ঢাকা রওনা হবে।

কক্সবাজারে মানুষের উপচে পড়া ভীর। সবসময়ই এইরকম ভীর থাকে তবে এখন যেহেতু বর্ষাকাল, সমুদ্র দেখার উপযুক্ত সময়। তাই ভীরের পরিমাণটাও একটু বেশি। চারদিকে মানুষ ছুটোছুটি করছে, ছবি তুলছে। আর সুজি যখনই সুযোগ পাচ্ছে ফারদিনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছে। এমনিতেই সারাদিন আনজীরের সাথে চুইংগামের আঠার মতো লেগে আছে। তার উপর যখনই ফারদিনকে দেখছে, তখনই এমন কাজ করছে যেন ফারদিন রেগে ঢোল হয়ে যায়। এইতো কিছুক্ষণ আগে ফারদিনের সামনে সুজি আনজীরের পায়ের উপর পা রেখে ঠোঁটে চুমু দিল। ফারদিন ওই দৃশ্য দেখে হাঁটা থামিয়ে দিয়েছিল। তারপর আর সেদিকে যায়নি। সুজি যে তাকে জ্বালানোর জন্যই এসব করছে সেটাও সে ভালোমতো বুঝতে পারছে। আর সত্যি বলতে সে জ্বলছেও। ভেতরে ভেতরে জ্বলে খাঁক হচ্ছে। শুধু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। কারণ সুজি আর আনজীর তো তার সঙ্গে কথাই বলে না! সবাই যখন সমুদ্রের পানিতে ইচ্ছেমতো দাপাদাপি করছে ফারদিন তখন বিচের এক কোণায় চুপ করে বসে সিগারেট টানছিল। সে সাতার কাটতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু আজকে তার পানিতেই নামতে ইচ্ছে করছিল না। কারণ পানিতে নামলেই সুজি আর আনজীরের আদিখ্যেতা দেখতে হবে। যেটা সে এই মুহুর্তে একদম সহ্য করতে পারছে না। সকাল থেকেই সে দু’জনকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। ওয়াসীম ফারদিনকে একা বসে থাকতে দেখে তার পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করল,” কিরে দোস্ত, বসে আছিস কেন? পানিতে নামবি না? সমুদ্রে কি বিড়ি টানতে এসেছিস?”
ফারদিন কাঠখোট্টা স্বরে বলল,” মানুষের ন্যাকামি দেখার চেয়ে বিড়ি টানা ভালো।”
” কে ন্যাকামি করছে?”
” সুজিকে দেখিসনি? কি শুরু করেছে ও? বিয়ে কি শুধু এ পৃথিবীতে ও একাই করেছে? বর কি শুধু ওরই আছে? মানে এমন ভাব করছে যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে! আজাইরা!”
” তুই ওদের সুখ সহ্য করতে পারছিস না কেন? এখনও কি সুজির মধ্যেই আটকে আছিস?”
” আমার বয়েই গেছে ওর মধ্যে আটকে থাকতে। কি আছে ওর মধ্যে যে আমি আটকে থাকবো?”
” তোর চাল-চলন তো সুবিধার না দোস্ত। আচ্ছা, তুই মেহেকের সাথে ঘুরছিস না কেন? বেচারি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুই ওকে সঙ্গ দিলেই তো পারিস। সুজি যেমন তার জামাই নিয়ে মেতে আছে তুইও তোর বউ নিয়ে মেতে থাক! শোধবোধ! ”
” বউ? আচ্ছা সত্যি করে একটা কথা বলতো ওয়াসীম। মেহেককে তোর বউ বলে মনে হয়?”
” এটা আবার কেমন প্রশ্ন? বউ মনে হতে হবে কেন? ও কত সুইট একটা মেয়ে! দেখলেই তো আদর আসে।”
” আমার আদর আসে না। ইনফ্যাক্ট ওকে বউ বলেই মনে হয় না। মনে হচ্ছে যেন একটা বাচ্চা দত্তক নিয়ে এসেছি আমি এতিমখানা থেকে। বিয়ে যে করেছি সেটাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই বাল!”
ওয়াসীম হো হো করে হেসে উঠল। ফারদিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” বুঝেছি তোর সমস্যা কোথায়। আরে ঠিক হয়ে যাবে। এইটা কোনো ব্যাপারই না। আর এই বয়সের মেয়েরা হলো মাটির পুতুলের মতো। যেভাবে গড়বি সেভাবেই থাকবে। দেখবি একটা সময় তোকে ছাড়া কিছুই বুঝবে না।”
” ও এমনিতেই আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না। আর এখানেই আমার সবচেয়ে বেশি প্রবলেম। আমি জানি না ওকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবো। কিন্তু আমি জাস্ট পারছি না। আমার পক্ষে সম্ভব না এইরকম একটা মেয়ের সঙ্গে থাকা। ওকে আমি ডানে বললে ও বামে বুঝে৷ পেছনে বললে সামনে বুঝে। মানে এক কথায় ইম্পসিবল! আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং জীবনেও সম্ভব না।”
” বলিস কি? তাহলে তুই ওকে বিয়ে করলি কেন?”
” যখন বিয়ে করেছি তখন বুঝিনি যে এই ঝামেলা হবে। তাছাড়া বিয়ের আগে আমি জেনেছিলাম ওর বয়স আঠারো। বিয়ের পর দেখি ষোল। আর যে ছবি দেখেছিলাম সেখানে ভালোই ম্যাচিউরড লেগেছিল। অথচ বাস্তবে দেখি পুরাই বাচ্চা। ওর চেয়ে একটা আটবছরের মেয়েও অনেক ভালো বোঝে।”
ওয়াসীম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
” তাহলে তুই এখন কি করবি?”
” আমি ঠিক করেছি মেহেককে ডিভোর্স দিবো।”
” হায়হায়, ডিভোর্স কেন দিবি? যাহ! মেয়েটার লাইফ শেষ হয়ে যাবে।”
” ফার্স্টে আমিও এটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে আরও ভেবে দেখলাম, ডিভোর্স নিলে কারো লাইফ শেষ হয় না। বরং আমার সঙ্গে থাকলেই ওর ক্ষতি। আমি ওকে কখনও সুখে রাখতে পারবো না। আর না পারবো নিজে সুখে থাকতে৷ সো আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। ”
” না ফারদিন, এমন করিস না। মেয়েটা খুব কষ্ট পাবে।”
” সারাজীবন কষ্ট করার চেয়ে ক্ষণিকের এই কষ্টটাই ভালো নয় কি? আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।এটাই ফাইনাল।”

মেহেক খুব সুন্দর একটা ঝিনুকের মালা কিনেছে। এই মালায় তাকে দেখতে কেমন লাগছে সেটা জানার জন্য অনেকক্ষণ ধরে সে ফারদিনকে খুঁজছিল। কিন্তু কোথাও পাচ্ছিল না। মানুষটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল হঠাৎ করে? একটু পরেই তার নজরে পড়ল ফারদিনকে। মেহেক দৌড়ে ছুটে যাচ্ছিল। কিন্তু থেমে গেল তার পাশে সুজিকে দেখে। সুজি হাত ধরে টেনে ফারদিনকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। মেহেকও তাদের পেছন পেছন গেল তারা কি করে দেখার আশায়। সুজি ফারদিনকে ঝাউবনের কাছে নিরিবিলি একটা জায়গায় এনে দাঁড় করাল। মেহেক ওদের থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়াল। ওদের কথা শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে। ফারদিন ধমকের সুরে বলল,” আমাকে এখানে কেন এনেছিস?”
” কথা আছে তাই।”
” আমি তোর সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।”
” না চাইলেও তোকে কথা বলতে হবে। ”
” কেন? আমি কি তোর হুকুমের গোলাম?”
” হ্যাঁ তাই৷ কথা শোন।”
” হাত ছাড়।”
” ছাড়বো না।”
” ছাড় বলছি!”
ফারদিন জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল। সুজি বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল,” ওকে ফাইন। হাত ছাড়লাম। এখন অন্তত শোন!”
ফারদিন কোনো জবাব না দিয়ে অন্যদিকে ফিরে রইল। সুজি নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ওয়াসীমের থেকে শুনলাম তুই নাকি মেহেককে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছিস?”
” ঠিক শুনেছিস।”
” কেন?”
” সেই কৈফিয়ৎ তোকে কেন দিবো?”
” ফারদিন খুব খারাপ হবে কিন্তু। তুই মেহেককে ডিভোর্স দিতে পারিস না।”
” কেন পারি না? আর তোর সমস্যা কি? আমার লাইফ, আমি যা ইচ্ছা তাই করবো। তুই ইন্টারফেয়ার করার কে? আর আমি তোর কথা শুনবোই বা কেন? তুই কি আমার বস লাগিস?”
” আমি জানি তুই এটা আমার উপর রাগ থেকে করছিস। ফারদিন দ্যাখ, আমি যা করেছি সেটা সবার ভালোর জন্যই করেছি৷ তোর, আমার, মেহেকের, সবার ভালোর কথা চিন্তা করেই করেছি। তুই এখন প্লিজ মেহেককে কষ্ট দিস না।”
” আমার ভালো-মন্দ ডিসাইড করার রাইট তো তোকে আমি দেইনি। আমি লাইফে কি করবো না করবো সেটা তুই আমাকে শিখিয়ে দিবি না। নো ওয়ে!”
সুজি ফারদিনের গালে হাত রেখে বলল,” ফারদিন, তুই আমার কথাটা একটু শোন দোস্ত। মেহেক তোকে অনেক ভালোবাসে।”
ওইটুকু দৃশ্য দেখেই মেহেকের বোঝা হয়ে গেল তাদের মধ্যে কি ধরণের ককথোপকথন হচ্ছে। যদিও তার কিশোরী মনের অবান্তর ধারণাটুকু নিতান্তই ভুল ছিল। মেহেক আর সেখানে দাঁড়ালো না। চোখের জল নিয়ে ফিরে এলো। তার জন্মটা কি আসলেই শুধু কাঁদার জন্য হয়েছিল? এজন্যই তো কপালে এতো দুর্গতি। দূর্ভাগ্য কেন তার পিছু কিছুতেই ছাড়ে না?

#অনপেখিত
পর্ব ১৭( অতিরিক্ত)
লিখা: Sidratul Muntaz

মেহেক হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলো। তখন শেষ গোধূলির সময়৷ সূর্য পশ্চিমাকাশ ঘেঁষে সমুদ্রের কোলে ডুবে যাচ্ছে। সেই মনোমুগ্ধকর আকর্ষণীয় দৃশ্যটি দেখার জন্য অধিকাংশ পর্যটক ভীর জমিয়েছে সমুদ্র তীরে। তাই আশেপাশে এখন মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। প্রায় সব মানুষ ব্যস্ত সূর্যোদয় উপভোগ করতে। সেই সময় চোখে পানি নিয়ে, ধীর পায়ে, অর্ধভেজা জামা-কাপড়ে, চোখ জুড়ানো সুন্দর এক ফুটফুটে কিশোরী হেঁটে যাচ্ছিল নিরুদ্দেশভাবে। শকুনি কুনজরটা পড়লো তখনি। ছেলেটি কখন যেন মেহেককে পেছন থেকে অনুসরণ করতে শুরু করেছে মেহেক তা টেরও পায়নি। অনেক দূর চলে আসার পর যখন তার সম্বিৎ ফিরলো, সে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো জায়গাটা কই? তখনি খেয়াল করল এই নীরব, অচেনা জায়গায় তার সাথে আরও একজন আছে। যাকে সে চেনে না, কোনোদিন দেখেনি, কিন্তু তার নজর ভয়ংকর, নোংরা! ব্যাপারটি উপলব্ধি হতেই মেহেকের অন্তরাত্মা ভয়ে শিউরে উঠলো। সে দ্রুত হাঁটা ধরলো। কিন্তু কালো বর্ণের, লাল চোখের উশকোখুশকো চুলওয়ালা ছেলেটি তার পিছু ছাড়লো না।বরং মেহেকের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই হাঁটতে লাগল। এই আগন্তুকের উদ্দেশ্য যে মোটেও শুভ নয় সেটুকু বোঝার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি মেহেকের আছে। সে মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করল। এইরকম ভয়ংকর নিস্তব্ধ জায়গায় তার চিৎকার শোনার জন্য আল্লাহ ছাড়া আর আছেই বা কে? মেহেক কোনো জায়গা পাচ্ছিল না লুকোনোর জন্য। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় আগন্তুকটি তার উপর হামলে পড়বে! মেহেক নিজেকে বাঁচানোর পথ খুঁজতে লাগল। আরও কিছুদূর সামনে যেতেই একটি পাবলিক টয়লেটের দালান দেখতে পেল। কোনোকিছু চিন্তা না করেই ঢুকে গেল সেখানে। আর দূর্ভাগ্যবশত সেখানেও মানুষের উপস্থিতি অত্যন্ত ক্ষীণ। মেহেক দুরু দুরু আত্মা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। বাথরুমে ঢোকার আগে সে এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোককে বাহিরে দাঁড়ানো দেখেছিল। মেহেক যদি সেই লোকটির কাছে এখন সাহায্য চায়, তিনি কি মেহেককে বাঁচাবেন? বিপদে পড়লে শুধু খারাপ আশংকাই মাথায় আসে। মেহেকের মনে হচ্ছে এখন কেউ তাকে সাহায্য করবে না। সবাই শুধু তার একাকিত্বের সুযোগ নিতে চাইবে। মেহেক আল্লাহকে ডাকতে লাগল এক মনে। অতিরিক্ত চিন্তায় তার প্রস্রাবের বেগ পাচ্ছিল। বাথরুমেই যেহেতু আছে আর এখানেই তাকে থাকতে হবে যতক্ষণ না ওই আগন্তুকটি চলে যায়, তাই মেহেক নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে নিচ্ছিল। তখনি হঠাৎ দ্রিম দ্রিম শব্দে কেউ দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। মেহেকের কলিজা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। সে মুখে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখল। কিছুতেই দরজা খুলবে না সে। দরজা খুললেই তার বিপদ। ভয়ংকর বিপদ! এইভাবে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেল। মেহেক দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে থরথর করে কাঁপছিল৷ এই পৃথিবীতে নিজেকে বড় একা মনে হচ্ছে। কেউ কি নেই যে তাকে একটু সাহায্য করতে পারে? মেহেক আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করল। যেন আল্লাহ তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করে। যেন কাউকে পাঠায়। মেহেক আরও কিছুক্ষণ বাথরুমেই বসে রইল। বের হওয়ার সাহস তার মধ্যে নেই। হঠাৎ খুব বিকট একটা শব্দ করে বাথরুমের দরজাটা ভেঙে গেল। মেহেক ভয়ে গুঙিয়ে উঠলো। লাল চোখের, কালো বর্ণের ছেলেটা ভেতরে প্রবেশ করেছে৷ তার চেহারাটা কি সীমাহীন ভয়ংকর! মেহেক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, উপস্থিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল! দ্রুত হাতে নিজের কাপড় ঠিক করতে লাগল। ছেলেটা বীভৎস হাসি দিয়ে কাছে এসেই মেহেকের কোমড় খামচে ধরলো। মেহেক ডুঁকরে কেঁদে উঠতে চাইলেই ছেলেটা তার মুখ শক্ত করে চেপে ধরল। মেহেকের যেন শ্বাস আটকে গেল। নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না, শব্দ করার ক্ষমতা ছিল না, শুধু নিষ্পাপ চোখ দু’টি থেকে অবিরাম অশ্রুপাত হচ্ছিল!

সুজির সাথে কথা কাটাকাটির পর ফারদিন যখন ঝাউবন থেকে ফিরে আসছিল তখন পূর্বিতা হন্তদন্ত হয়ে ফারদিনের কাছে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল,” দোস্ত, মেহেক কোথায়? মেহেককে দেখেছিস?”
ফারদিনের মেজাজ আগে থেকেই কড়া ছিল। এই প্রশ্ন শুনে আরও রেগে বলল,” আমি কি জানি? আমি কি ওকে পকেটে নিয়ে ঘুরি?”
এই উত্তর দিয়েই ফারদিন পূর্বিতাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পূর্বিতা সুজির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,” এর আবার কি হয়েছে?”
সুজি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” বাদ দে। ও তো এমনি।”
পূর্বি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” দোস্ত, মেহেককে তো কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”
” বলিস কি? ভালো করে খুঁজেছিস?”
” অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছি। কোথাও নেই।”
” ও কি সাতার জানে? ঢেউয়ের সাথে ভেসে গেল না তো আবার?”
” ধূর, নেগেটিভ কথা বলিস না। এমনিতেই ভয়ে আছি।”
” ফারদিনকে জানিয়েছিস?”
” জানাতেই তো গেছিলাম। দিল তো এক ঝারি।”
” চল, আমি বলছি।”
সুজি পূর্বিকে নিয়ে ফারদিনের কাছে গেল।
” এই ফারদিন, মেহেককে দেখেছিস?” সুজির প্রশ্ন শুনে ফারদিন রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল,” তোদের কি মনে হয়? ওকে দেখা ছাড়া আমার অন্যকোনো কাজ নেই? আমি কি সারাক্ষণ শুধু ওকেই দেখি?”
পূর্বি বুঝানোর চেষ্টায় বলল,” মেহেককে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দোস্ত। সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম তুই দেখেছিস কি না।”
ফারদিন নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিয়ে বলল,” দ্যাখ আশেপাশেই আছে। যাবে আর কোথায়? এতো সহজে চলে গেলে তো বেঁচেই যেতাম।”
এই কথা শুনে সুজি আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তেড়ে এসে ফারদিনের গালে একটা চড় লাগিয়ে দিল৷ ফারদিন হতভম্ব! বিস্মিত দৃষ্টিতে অবাক হয়ে তাকাল। সুজি কটমট করে বলল,” ভাবতেই ঘৃণা লাগছে তোর মতো একটা মানুষকে আমি ভালোবেসেছিলাম!”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পূর্বিতা সুজির হাত ধরে টানতে লাগল।
” থাক বাদ দে দোস্ত। ও তো এমনি।”
” কি কথাটা বলল শুনলি? এতোটা ফালতু ও কিভাবে হয়ে গেলরে? আমার অবাক লাগে!”
” এখন মাথা ঠান্ডা কর। মেহেককে খুঁজতে হবে!”
চার বন্ধু মিলে সারা সমুদ্র সৈকত খুঁজেও মেহেকের কোনো হদিশ পেল না।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে