#অনপেখিত
#পর্ব_১৬
লিখা: Sidratul Muntaz
ফারদিনের মেজাজ বর্তমানে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের রূপ ধারণ করেছে। সে মেহেকের কাছে এসে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ” এই মেয়ে, উঠো৷ সমস্যা কি তোমার?”
রাগের দমকে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছিল।কিন্তু মেহেক চোখ বুজে পড়ে আছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। ফারদিন এভাবে আরও কয়েক বার ডাকার পরেও যখন কোনো রেসপন্স পেল না তখন কিছুটা শান্ত হলো। মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে মেহেকের নাকের সামনে আঙুল দিয়ে দেখল শ্বাস আছে কি-না। অনেক সময় উঁচু জায়গা থেকে পড়ে মানুষ দম আটকে ফেলে। ফারদিন মেহেককে পাঁজাকোলায় নিয়ে বিছানায় শোয়াল। মেহেকের শ্বাস আছে। এর মানে শুধু অজ্ঞান হয়েছে সে। ফারদিন উর্মিকে ডাকল। সেকেন্ড না গড়াতেই উর্মি প্রায় দৌড়ে এলো। সে আপাতত ফারদিনকে খুবই ভয় পাচ্ছে। ফারদিনের কণ্ঠে নিজের নামে ডাক শুনলেই জড়োসড়ো হয়ে পড়ছে। যেহেতু সুজির মাথায় আঠা সে ঢেলেছিল অর্থাৎ মেহেকের কুকীর্তির অর্ধেক অংশীদার সে নিজেও। তাই ফারদিন মেহেককে যা শাস্তি দিবে উর্মিকেও সেই একই শাস্তি দিবে। এই ভয়েই উর্মি সদা তটস্থ। ভীত ভীত কণ্ঠে বলল,” জ্বী ভাইয়া,ডাকসেন?”
ফারদিন চিন্তিত হয়ে বলল,
” দেখো তো কি হয়েছে? মেহেক চোখ খুলছে না।”
উর্মি মাথায় দুইহাত চেপে আর্তনাদের সুরে বলল,” হায়হায়, আপায় কি মইরা গেল নাকি?”
” আরে ধূর, মরবে কেন? সেন্সলেস হয়ে গেছে। কিভাবে কি হলো বুঝলাম না। তুমি এক কাজ করো। বাথরুম থেকে পানি এনে ওর নাকে-মুখে স্প্রে করতে থাকো। আমি এক মিনিটে আসছি।”
” আচ্ছা, ঠিকাছে।”
ফারদিন চলে যেতেই মেহেক খিকখিক করে হেসে উঠল। উর্মি অবাক হয়ে বলল,” আপা, আপনের কি হইসিল?”
” কিছুই হয়নি। বরকে বুদ্ধু বানালাম। এটা হচ্ছে বিপদের সময় বকা থেকে বাঁচার এবং ইন্সট্যান্ট বরের কোলে উঠার নিঞ্জা টেকনিক। বুঝেছিস?”
” কি যে করেন না আপনি৷ আমি তো সত্য ভাবসিলাম। মনে করসিলাম ফারদিন ভাই আপনেরে আসলেই তুইল্লা আছাড় মারসে আর আপনে ফিট হয়া গেসেন।”
মেহেক মুখে হাত দিয়ে কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। হঠাৎ দেখল ফারদিন দরজার বাহিরে থেকে রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেকের হাসি মুহুর্তেই বন্ধ হয়ে গেল৷ উর্মি কথা বলেই যাচ্ছিল।
” জানেন আপা, ভাই যখন আমারে ডাকসিল আমি যেই ভয় পাইসি। আমি তো ভাবসি এখন আমারেও তুইলা আছাড় মারবো আপনের মতো। কারণ সুজি আপার চুলে আঠা ফেলার ব্যাপারে তো আমিই আপনারে সাহায্য.. ”
মেহেক চট করে উর্মির মুখ চেপে ধরল। উর্মি থতমত খেয়ে মেহেকের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। ফারদিন ওদের কিছুই বলল না আপাতত। চুপচাপ হেঁটে চলে গেল। উর্মি নেতিয়ে পড়া কণ্ঠে বলল,” এখন কি হইবো আপা?”
মেহেক ঠোঁট উল্টে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,” জানি না।”
” আপা, আপনি আরেকবার লুকান। এইবার আমিও আপনার সাথে লুকামু।”
সুজি আর আনজীরকে ঘিরে বসে আছে সবাই। পূর্বি আর ওয়াসীম তো হাত তালি বাজিয়ে গান গাইছে। উজান মাঝখানে বসে বাহিরে থেকে কিনে আনা ফাস্ট ফুড খাচ্ছে আরাম করে। ওয়াসীম চাইছে এই বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে একটা জমজমাট পার্টি দিতে। পূর্বি বলল,” অবশ্যই হবে। বড় একটা অনুষ্ঠান তো মাস্ট। কিন্তু সুজিতা, তোরা যে এতোরাতে বিয়ে করেছিস সাক্ষী কিভাবে যোগাড় করলি? আর আমাদের জানাসনি কেন?”
আনজীর বলল,” আমি তো জানাতেই চেয়েছিলাম তোদের। সুজিতা দেয়নি। আর সাক্ষী নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। কাজী অফিসে আরও একজোড়া দম্পতি গেছিল বিয়ে করতে। তাদের কাছেও সাক্ষীর অভাব। পরে আমরা বদলাবদলি করে সাক্ষী হয়েছি৷ আমাদের বিয়ের সময় ওরা ছিল সাক্ষী আর ওদের বিয়ের সময় আমরা ছিলাম সাক্ষী।”
ওয়াসীম বলল,” দারুণ তো। কিন্তু হঠাৎ এতো তাড়াহুড়া কেন করলি বুঝলাম না।”
সুজিতা বলল,” শুভকাজে দেরি করতে নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব কাজ সেরে ফেলেছি৷ তোরা চিন্তা করিস না। আমেরিকা গিয়ে বড় করে পার্টি দিবো।”
” সেটা তো এমনিতেই দিতে হবে। পার্টি না দিলে কি আমরা তোদের শান্তিতে থাকতে দিবো? ফারদিন তো আমাদের ঠকিয়েছে। তোরা কিন্তু সেটা পারবি না।”
সবাই হাসছিল খুব। ফারদিন যে পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কারো হুশ নেই। হঠাৎ ফারদিন এগিয়ে এসে মুখ-চোখ কুচকে হুংকার ছাড়ল,” এই তোরা কি ফাজলামি শুরু করেছিস? এসব কি হচ্ছে?”
তার মেজাজে কারো কোনো ভাবান্তর হলো না। সুজি তো কোনো পাত্তাই দিল না। ওয়াসীম মুখ কালো করে জবাব দিল,” ফাজলামি হবে কেন? ওরা তো বিয়ে করেছে দোস্ত। একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। এইখানে তুই ফাজলামির কি দেখলি?”
” সুজি, ওঠ। আমার তোর সঙ্গে কথা আছে।”
চোয়াল শক্ত করে প্রায় আদেশের মতো বলল ফারদিন।
সুজি আনজীরের হাত চেপে ধরে বলল,” উহুম। তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই৷ তাছাড়া আমি আমার বরকে ফেলে তোর সাথে কেন কথা বলবো? আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে না? তাই আগামী এক সপ্তাহ আমি শুধু আমার বরের সঙ্গেই কথা বলবো। অন্যকারো সঙ্গে না।”
পূর্বিতা বুড়ো আঙুল উঁচু করে লাইক দেওয়ার মতো বলল,” ইটস আ গ্রেইট ডিসিশন। ভেরি রোমান্টিক!”
ফারদিন বহু কষ্টে রাগ সংবরণ করল। আনজীরের দিকে চেয়ে বলল,” আনজু, তুই এদিকে আয়। কথা আছে।”
আনজীর উঠতে নিচ্ছিল। সুজি হাত ধরে টেনে ওকে বসিয়ে বলল,” এই, তুমি কোথায় যাচ্ছো? চুপচাপ বসে থাকো। আগামী এক সপ্তাহ শুধু তুমি আমার পাশে বসে থাকবে এবং আমার কথাই শুনবে। অন্যকারো কথা শুনতে পারবে না। গট ইট?”
আনজীর বাধ্যের মতো বলল,” ওকে। স্যরি ফারদিন।”
সুজি আনন্দে আনজীরের কাঁধে মাথা রেখে গান গাইতে শুরু করল,” আরে ও প্রাণের রাজা, তুমি যে আমার.. পাশে পাশে থেকো মোর, চাই না কিছু আর..”
আনজীরও সুর মিলিয়ে গাইল,”আরে ও আমার রানী, আমি যে তোমার… তুমি ছাড়া জীবনে, নেইতো কিছু আর!”
ফারদিন রাগে শুধু বোমার মতো ফুলছিল। তাকে যেন কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না! বন্ধুরা হাত তালি বাজিয়ে সুজি আর আনজিরের গানে সুর মিলাচ্ছে। সবার আজকে কত আনন্দ! যেন ঈদ চলে এসেছে। অথচ ফারদিনের ইচ্ছে করছিল সেন্টার টেবিলটা লাথি মেরে ভেঙে ফেলতে। সে খুব দ্রুত ওই জায়গা থেকে চলে এলো। পেয়ারা গাছের নিচে এসে বসল। আজ অনেকদিন পর, ফারদিনের চোখ দু’টো অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে আসছে। তার একে একে সব স্মৃতি মনে পড়ছিল। সুজির সাথে প্রথম দেখা, প্রথম ভালো লাগার মুহুর্ত, সুজির জন্য সাজিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো, সবকিছু বিষাক্ত সুচের মতো হৃদয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। ফারদিন পাঞ্জাবীর পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার আর সুজির পুরনো ছবিগুলো দেখতে লাগলো। আহারে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো! আর কখনও ফিরে আসবে না। সুজি আর কখনও তার দিকে তাকিয়ে হাসবে না, লজ্জায় লাল হয়ে বলবে না, ” ফারদিন স্টপ ইট!” আর কখনও সুজির কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখা হবে না। সবকিছু যেন দুঃস্বপ্নের মতো পাল্টে গেল। আর ফারদিনের ঘুম ভাঙল এখন! সবটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল, সে আসলে কতটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। সুজি আজকে পুরোপুরি অন্যকারো। ফারদিন এটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ফারদিন এখন সুজির যন্ত্রণাগুলো হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছে৷ সে মেহেককে বিয়ে করে সুজিকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছিল সুজি যেন সবটুকুর শোধ কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে নিল৷ ফারদিনের গলার কাছে দলা পাকানো একটা কষ্ট কাঁটার মতো আটকে আছে৷ সে না পারছে উগড়ে ফেলতে আর না পারছে নিগড়ে নিতে। মেহেক নীরবে ফারদিনের পেছনে এসে দাঁড়ালো। ফারদিন মোবাইলে সুজির ছবি দেখছে। এইটা দেখে মেহেকের ছোট্ট মন ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল যেন। তার বর এখনও অন্য একটি মেয়ের প্রতি আসক্ত। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও তার ছবি দেখছে। আড়ালে কাঁদছে!এতো ভালোবাসা! তার জন্য কেন এই ভালোবাসা নেই? সে কি একটুও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? ফারদিন হঠাৎ কি মনে করে যেন পেছনে তাকালো। মেহেককে দেখতে পেয়েই অপ্রস্তুতভাবে চোখের জল মুছল। গলা পরিষ্কার করতে কাশি দিল। মোবাইলটা পকেটে পুরে অস্বস্তি নিয়ে বলল,” তুমি কখন এলে?”
” মাত্র। বসতে পারি?”
” বসো।”
মেহেক ফারদিনের পাশে বসলো। ফারদিন রুক্ষ কণ্ঠে বলল,” সুজির চুলে আঠা তুমি লাগিয়েছো? সত্যি কথা বলো।”
মেহেক মাথা নিচু করে উত্তর দিল,” হুম।”
” কেন?”
মেহেক অপরাধী কণ্ঠে বলল,” বিশ্বাস করুন। আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমার সাথে যে শয়তানটা আছে সে আমাকে বাধ্য করেছে এই কাজ করতে।”
” শয়তান মানে?”
” শয়তান মানে শয়তান! আমাদের সবার সাথেই তো মনে মনে একটা শয়তান থাকে তাই না? ওই শয়তান আমাদের দিয়ে জোর করে ভুলভাল কাজ করায়। আমিও শয়তানের প্ররোচনার স্বীকার। প্লিজ মাফ করে দিন।”
মেহেক দুইহাতে কান ধরল। ওই সময় তাকে সম্পূর্ণ একটা অবুঝ শিশুর মতো দেখাল। বাচ্চারা ভুল করলে তাদের নিষ্পাপ চেহারায় যেমন ভীতি আর অপরাধবোধের এক স্পষ্ট সংমিশ্রণ থাকে মেহেকের চেহারাতেও ঠিক তেমন সংমিশ্রণ দেখা যাচ্ছে। ফারদিন ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল তার ভেতর থেকে। নাহ, সম্ভব না। এই মেয়ের সাথে সংসার করা কিছুতেই সম্ভব না! এই মেয়ে বউ মেটেরিয়াল না, এখনও বাচ্চা মেটেরিয়াল।
চলবে