#অনপেখিত
পর্ব ১৪
লিখা: Sidratul Muntaz
ফারদিন পূর্বিতার সাথে তাদের রুমে এলো। দেখলো সুজি মাথায় হিজাব পড়ে বিছানায় বসে আছে। ওর চেহারাটা থমথম করছে। ফারদিন প্রথমেই বলল,
” এইটার আবার কি হয়েছে? হুজুর আপা সাজলো কেন হঠাৎ?”
পূর্বিতা বলল,” বলছি।”
সুজি আর পূর্বি একবার চোখাচোখি করল। তারপর পূর্বি সুজির মাথা থেকে হিজাবটা আস্তে আস্তে খুলে ফেলল। ফারদিন সুজির ঘাড় পর্যন্ত চুল দেখে বিস্ময়ে তাক লেগে গেল। চট করে বলে উঠলো,” হোয়াট দ্যা ফাক!”
পূর্বি ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল,” ফাক? এইটা গিয়ে তোর বউকে বল।”
” কেন? আমার বউ আবার তোদের কি করল?”
” তোর বউয়ের জন্যই সুজির এই অবস্থা।”
” কি? মানে মেহেকের জন্য? ”
” তাছাড়া আর কে? তোর কয়টা বউ আছে?”
” মেহেক কি করেছে?”
পূর্বি বলতে নিলে সুজি ওকে থামিয়ে বলল,” আমি বলছি।”
সুজি এইবার ফারদিনের ঘুরে তাকালো। শান্ত কণ্ঠে বলল,” তুই আগে মেহেককে ডাক। কোথায় মেহেক?”
” না, মেহেককে পরে ডাকছি। আগে আমাকে বল মেহেক কি করেছে?”
সুজি চুপ করে রইল। রাগে মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। পূর্বিই বলল,” ম্যায়োনিসের মধ্যে আঠা মিশিয়ে উর্মিকে দিয়ে সেই আঠা মাখানো ম্যায়োবিস সুজির চুলে ঢেলেছে তোর বউ। এরপর সেই আঠা আর চুল থেকে ছাড়ানো যায়নি। পার্লারে নিয়ে যাওয়ার পর পার্লারের আপু বলেছে চুল কাটতে হবে। ”
ফারদিন কোনোকিছু না বুঝার মতো সুজির দিকে তাকালো। সুজির চোখ দু’টো রাগে লাল হয়ে গেছে৷ ফারদিন অবিশ্বাস্য গলায় বলল,” মেহেক এই কাজ করতে পারে না। কি বলছিস তোরা?”
সুজি ক্রোধিত স্বরে বলল,” ওহ রিয়েলি? তুই কি ওকে নাদান বাচ্চা মনে করিস? ও আসলে খুব শেয়ানা একটা মেয়ে। আস্তো শয়তান। ”
ফারদিনের মেজাজও খারাপ হয়ে গেল এবার। ধমক দেওয়ার মতো বলল,” সুজি!”
” আমাকে ধমকাচ্ছিস কেন? এই ধমকটা তোর বউকে গিয়ে দে। আমি তার কি ক্ষতি করেছিলাম বল? আমার চুলের উপর ওর কুনজর পড়লো কেন? কিসের এতো ক্ষোভ ওর আমার প্রতি?”
” তুই কাউকে জেলাস করিস মানে এই না যে তার নামে যা ইচ্ছা বানিয়ে বলবি আর আমি বিশ্বাস করবো।”
সুজি হতভম্ব হয়ে বলল,” আমি বানিয়ে বলছি?”
” অফ কোর্স বানিয়ে বলছিস। মেহেক সারাদিন আমার সাথে ছিল। তাহলে ও এইসব কখন করল?”
” তুই এতো কথা না বলে মেহেককে ডাক। তাহলেই তো সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
” মেহেককে আমি ডাকবো না। আগে তুই প্রমাণ কর তুই যা বলছিস সব সত্যি। ”
” আমার কথা বিশ্বাস করতে তোর এখন প্রমাণ লাগবে? বাহ!”
সুজি অবাক! তার এতোবছরের পুরনো বন্ধুকে যেন সে চিনতেই পারছে না। বিয়ের পর বুঝি মানুষ এতো বদলে যায়? পূর্বি বলল,” প্রমাণ আছে। মেহেক উজানের থেকে আঠা নিয়ে এই কাজ করেছিল। পরে উজানই আমাদের কাছে সব স্বীকার করেছে। তুই চাইলে উজানকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারিস।”,
ফারদিন সুজির দিকে চেয়ে কঠিন মুখে বলল,” ডাক উজানকে।”
সুজি আহত কণ্ঠে বলল,” এর মানে তুই আসলেই আমার কথা বিশ্বাস করিসনি?”
” না করিনি।”
পূর্বি উজানকে ডাকার জন্য রুম থেকে বের হচ্ছিল। সুজি ওর হাত ধরে বলল,” দাঁড়া পূর্বি। যাবি না তুই। আগে ওকে বলতে হবে ও আমার মুখের কথা কেন বিশ্বাস করবে না? আমার থেকে দুইদিনের বউ এখন ওর কাছে বেশি বড় হয়ে গেল?”
” বড়-ছোট’র বিষয় না এটা। আমি লজিক খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোর কথায় আমি কোনো লজিক পাচ্ছি না। হ্যাঁ মেহেক দুষ্টমি করে মানলাম। কিন্তু এইরকম অফেন্সিভ কাজ ও জীবনেও করতে পারবে না। ওর মন এতো নোংরা না।”
” তাহলে কি আমার মন নোংরা? আমার পেটে হিংসা? হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। আমিই হিংসুটে, আমিই নোংরা মনের অধিকারী। তাইতো তোকে সেক্রিফাইস করেছি ওর জন্য।”
” সেক্রিফাইস কি তুই শুধু একাই করেছিস? আমি করিনি? সবচেয়ে বড় সেক্রিফাইস তো আমাকেই করতে হচ্ছে।”
” তাহলে তুই ভাবলি কি করে আমি এতোবড় মিথ্যে বলবো? তুই যা বলেছিস সবকিছু আমি মেনে নিয়েছি না? তুই বলেছিস আমাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক হবে না। আগের মতো শুধু বন্ধুত্বই থাকবে। সেটা মেনে নিয়েছি না আমি?যদি মেহেককে আসলেই আমি জেলাস করতাম তাহলে কি এতো সহজে সব মানতাম? তুই-ই বল!”
ফারদিন চুপ করে আছে। সুজি গলা উঁচিয়ে বলল,” আমারই ভুল হয়েছে। তোকে চিনতে ভুল করেছি আমি। তুই আসলে আমার যোগ্যই ছিলি না।”
” এইখানে যোগ্যতার প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
পূর্বি ওদের থামানোর চেষ্টা করে বলল,” আচ্ছা তোরা কি এখন ঝগড়া শুরু করবি?”
ফারদিন বলল,” না, না ওয়েট, লেট মি ক্লিয়ার। এইখানে যোগ্যতার কথা কিভাবে আসলো আমাকে বল।”
সুজি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,” যোগ্যতার কথা এজন্যই এসেছে কারণ এতোদিন তোকে আমি আত্মসম্মানী পুরুষ ভাবতাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম তুই আসলে বউয়ের গোলাম।”
ফারদিন আর রাগ চেপে রাখতে পারল না। সুজির দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বউয়ের গোলাম?”
পূর্বি ফারদিনকে দুইহাতে থামাল,” দোস্ত প্লিজ, সিন ক্রিয়েট করিস না। এইখানে আমরা ছাড়াও অন্য মানুষ আছে। দু’টো বাচ্চা আছে। ওরা কি ভাববে?”
সুজির চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,” কথায় আছে আল্লাহ যা করে মঙ্গলের জন্য করে। আজকে বুঝলাম কথাটা একদম সত্যি। তোর সাথে প্রেম না হওয়ায় আমার মঙ্গলই হয়েছে। তুই আসলে আমাকে ডিজার্ভই করিস না। তোর জন্য মেহেকের মতো মিচকা শয়তানই ঠিকাছে।”
” আর তুই নিজে খুব ডিজার্ভ করিস তাই না আমাকে? তোর মনের মধ্যে নোংরা এজন্যই তুই আমাকে পাসনি। ”
” তোকে পাওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছিলাম না। কোথাকার কোন রাজপুত্র তুই যে পেতেই হবে? যা ভাগ!”
” তুই ভাগ। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হো।”
” তুই দূর হো।”
” দারুণ। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই দূর করা হচ্ছে। এইটা আমার বাড়ি সো তুই দূর হবি।”
পূর্বি আশ্চর্য হয়ে বলল,” টিনেজার হয়ে গেছিস নাকি তোরা? আমার বাড়ি, তোমার বাড়ি এইসব কি? এমন চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার তোদের এই বয়সে মানায় না। বি ম্যাচিউর!”
সুজি যেন পূর্বির কথাটা শুনতেই পেল না। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,” ওহ রাইট! তোর বাড়ি। এই বাড়িটা তো তোর তাই না? তাহলে আমি এইখানে কি করছি? আমার তো এইখান থেকে এখনি চলে যাওয়া উচিৎ।”
” অভিয়াসলি। প্লিজ গেট লস্ট।”
ফারদিন হাত দিয়ে চলে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিল। পূর্বি মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে। এখন এই কাহিনী কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে? সুজি রেগে-মেগে ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করল৷ আর ফারদিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পূর্বি সুজিকে থামানোর চেষ্টায় বলল,” দোস্ত আমার কথা শোন।”
সুজির সোজা জবাব, ” পূর্বি তুই আমাকে আর একটা কথাও বলবি না। আমি এক মিনিটও এইখানে থাকতে চাই না। ফারদিনকে আমার চেনা হয়ে গেছে। আই জাস্ট হেইট হিম।”
” প্লিজ, এমন করিস না সুজিতা। বাহিরে বৃষ্টি তার উপর রাত। তুই এইসময় কোথায় যাবি?”
” যেখানে খুশি সেখানে যাবো৷ কিন্তু এই বাড়িতে থাকবো না।”
” আল্লাহ!”
পূর্বি আর কোনো উপায় না পেয়ে ওয়াসীম আর আনজীরের ঘরে গেল। তাদেরকে ঘটনা খুলে বলল।
ফারদিন নিজের রুমে এসে বিছানায় বসল। খুব রেগে গেলে তার হাতের রগ কাঁপতে শুরু করে। মুখ ক্রমশ লাল হতে থাকে। এখনও হচ্ছে। উর্মি ভয়ে ভয়ে ফারদিনের কাছে এসে বলল,” ভাইয়া, আপনার জন্য শরবত।”
ফারদিন চোখ তুলে উর্মির দিকে তাকালো। উর্মির মুখটা ভয়ের চোটে ছোট্ট হয়ে গেছে। হাত কাঁপছে। ফারদিন আচমকা উর্মির হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ছুড়ে মারল। উর্মি এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার প্রাণ অর্ধেকটাই নাই হয়ে গেছে। এতো ভয় বাপের জন্মেও সে পায়নি। মেহেক রান্নাঘরের দরজার চিপায় লুকিয়ে ছিল। উর্মি মেহেকের কাছে এসে মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলল। মেহেক বলল,” দেখেছিস বলেছিলাম না? অনেক রাগ উনার। শরীরের প্রতি শিরায় শিরায় কমপক্ষে তিন-চার কেজি করে রাগ। তোকে দেখে তো তাও গ্লাস আছাড় মেরেছে। আমাকে সামনে পেলে মনে হয় তুলে আমাকেই আছাড় মারতো।”
” আপনি তাইলে সামনে যাইয়েন না আপা। পরিস্থিতি মোটেও সুবিধার না। আমার তো ভয় করতাসে। আপনি লুকায় থাকেন, লুকায় থাকেন।”
উর্মি দরজার সামনে ভালোমতো পর্দা টেনে মেহেককে আড়াল করে রাখলো।
চলবে