অনপেখিত পর্ব-১৩

0
1764

#অনপেখিত
পর্ব ১৩
লিখা: Sidratul Muntaz

মেহেক আর ফারদিন এখন এমন একটা রেস্টুরেন্টে আছে যেখানে বারোশো টাকার একটা বড় পিজ্জা দশমিনিটে খেয়ে শেষ করতে পারলে তেরোশো টাকা পুরষ্কার! ফারদিন এই চ্যালেঞ্জ দেখে তুমুল উৎসাহ নিয়েই টেবিলে বসলো। মেহেক বলল,” পিজ্জার সাইজ দেখেছেন? এইটা তো দশজন খেয়েও শেষ করতে পারবে না।”
” তোমার মতো দশজন হলে তো শেষ হবেই না। আমার মতো একজনই যথেষ্ট। ”
” না খেতে পারলে কিন্তু ডাবল পেমেন্ট করতে হবে। শর্তে লেখা আছে। দেখেছেন?”
” দেখেছি। আর সমস্যা কই? প্রয়োজন হলে করবো ডাবল পেমেন্ট!”
” কি দরকার শুধু শুধু এমন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার? ”
” মজা আছে। তুমি বুঝবে না৷ এটা শুধু আমাদের মতো ভোজনরসিকরাই বুঝবে। দেখো, কত মানুষ এসেছে চ্যালেঞ্জ নিতে।”
” এরা সবাই পাগল। সাথে আপনিও পাগল।”
ফারদিন হো হা করে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ পরেই ওয়েটার ইয়া বড় একটা পিজ্জা এনে ফারদিনের সামনে রাখল। ভিডিও করা হবে। স্টপওয়াচ ধরে একজন দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্যজন ডিরেকশন দিতে থাকবে। মেহেকের এইসব দেখতে ভালো লাগছে না। খাবার নিয়ে এই ধরণের বাজি তার একদম পছন্দ না। কি দরকার একজন মানুষকে ঠেসে ধরে একগাঁদা খাওয়ানোর? এতে যেমন মানুষটির শারীরিক ক্ষতি হয় তেমনি খাবারও অপচয় হয়। অথচ রাস্তায় কত মানুষ না খেতে পেয়ে মরে। কত ক্ষুধার্ত কুকুর-বিড়াল আছে। এইভাবে খাবার নষ্ট করার চেয়ে তাদের বিলিয়ে দেওয়াই কি ভালো না? মেহেক টেবিল থেকে উঠে চলে এলো। সে দেখবে না এই তামাশা। আসার সময় ফারদিনের থেকে তার মোবাইলটাও চেয়ে এনেছিল। রেস্টুরেন্টের পেছন সাইটটা অনেক সুন্দর। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে মেহেক নিজের কয়েকটা ছবি তুলল। ফারদিনের খাওয়ার অভিযান শুরু হয়ে গেছে। কেমন রাক্ষসের মতো খাচ্ছে, ছি! কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ওই অবস্থাতেও মানুষটিকে দেখতে চমৎকার সুন্দর লাগছে। এই লোক কেন এতো সুন্দর? মেহেকের হাতে ফারদিনের মোবাইল বেজে উঠলো। ফোন করেছে সুজিতা। মেহেক নামটি দেখে আক্রোশে জ্বলে উঠল। এই মেয়ে কি তাদের একফোঁটাও শান্তি দিবে না? বিয়ের পর এই প্রথমবার ওরা কোথাও ঘুরতে এসেছে। তাও এই সুজির হালুয়ার জন্য শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না। উর্মি যে ওর সুন্দর চুলে আঠা লাগিয়ে বারোটা বাজিয়েছে তাও কি শিক্ষা হয়নি? মেহেক সুজির ফোনটা কেটে দিল। তারপর নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট করে রাখল যেন সুজি আর ফোন দিতে না পারে। একটু পর কল আসলো পূর্বিতার নাম্বার থেকে। মেহেক সেটাও কেটে দিল। বার-বার সবাই ফারদিনকে কল দিচ্ছে কেন আজ? মেহেক কারো সাথে ফারদিনকে কথা বলতে দিবে না। আজকে সারাদিন ফারদিন শুধু তার সঙ্গে কাটাবে। অন্যকারো কথা ভাববে না। মেহেক পূর্বিতার নাম্বারটাও ব্ল্যাকলিস্ট করে দিল। তারপর একে একে আনজীর, ওয়াসীমের নাম্বারও ব্ল্যাকলিস্ট করল। ব্যস, এখন শান্তি! আর কেউ জ্বালাবে না তাদের। মেহেক ফিরে এসে দেখলো ফারদিনের পিজ্জা খাওয়া শেষ। মাত্র ছয়মিনিটেও সে পুরো পিজ্জা কমপ্লিট করে ফেলেছে। মেহেক আশ্চর্য হয়ে গেল। একটা সাধারণ মানুষ এতো কিভাবে খেতে পারে? তেরোশো টাকা পুরষ্কার পাওয়ার পর ফারদিন মেহেকের কাছে এসে বিজয়ীর মতো হাসি দিয়ে বলল,
” দেখেছো, বলেছিলাম না? আমি হেরে যাওয়ার ম্যাটেরিয়াল না।”
” হুম দেখলাম। আপনি হচ্ছেন খাদক ম্যাটেরিয়াল।”
” এখন বলো তুমি কি খাবে?”
” আপনার খাওয়া দেখে আমারই পেট ভরে গেছে। আমি আর কিছু খেতে চাই না। এখন চলুন এখান থেকে। ”
” এই, সিরিয়াসলি?”
” হ্যাঁ।”
মেহেক রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই দেখতে পেল ফুটপাথে এক লোক রঙ-বেরঙের গ্যাস বেলুন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেক আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলল,” বেলুন কিনবো!”
” তুমি কি বাচ্চা মেহেক?”
মেহেক বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” বাচ্চা না হলে কি বেলুন কেনা যায় না? তাছাড়া আপনিই তো আমাকে পুচকী বলেন। তাহলে এখন পুচকীকে বেলুন কিনে দিন।”
” কি করবে বেলুন দিয়ে?”
” একটা একটা করে আপনার কানের কাছে এনে ফাটাবো। হি-হি!”
” এইসব বান্দরামি করার জন্য তোমাকে আমি বেলুন কিনে দিতে পারবো না। স্যরি।”
” আরে, দুষ্টুমি করেছি। বেলুন নিয়ে আমি আকাশে উড়াবো। প্লিজ,প্লিজ কিনে দিন না!”
ফারদিন দশটা বেলুন একসাথে সুতোয় বেঁধে মেহেকের কাছে নিয়ে এলো। মেহেক বেলুনগুলোর সুতো আঙুলের সাথে বেঁধে কি খুশি! একবার ডানে ঘুরায় তো আরেকবার বামে। পারলে নিজেই বেলুন নিয়ে আকাশে উড়ে যায়। একদম বাচ্চাদের মতো আচরণ! পুরো বিকেলটা ফারদিন আর মেহেকের নেভাল সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে কাটলো। বন্ধুরা হয়তো ওয়ার সিমেট্রি ঘুরছে। ফারদিন বন্ধুদের ফোন করতে নিয়েও মেহেকের জন্য করতে পারলো না। মেহেক বলেছে যতক্ষণ ও পাশে থাকবে ততক্ষণ ফোনে কথা বলা যাবে না। ফারদিন আজকের জন্য সব মেনে নিচ্ছে। মাত্র একটাদিনেরই তো ব্যাপার। সুজিতাদের সাথে যোগাযোগ না হওয়ার কারণে ফারদিনের আর জানা হলো না যে তারা কেউই আসলে ঘুরতে বের হয়নি। সন্ধ্যা নামার আগেই দুনিয়া অন্ধকার করে বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। ফারদিন আর মেহেক তখন সোজা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। আর কিছুক্ষণ পরেই তারা ফিরে যেতো। এর মধ্যেই শুরু হলো বৃষ্টি।গাড়ির পার্কিং লট এখান থেকে অনেক দূরে। বৃষ্টির মধ্যে কিছুতেই যাওয়া যাবে না। গাড়ি পর্যন্ত যেতে হলে একটা রিকশা লাগবে। ফারদিন মেহেককে বড় একটি ছাউনির নিচে দাঁড় করিয়ে রিকশা আনতে গেল। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে সড়কে রিকশা নেই তেমন। যারা আছে তারাও যেতে রাজি হচ্ছে না। ফারদিন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজলো। শেষমেষ পেল না। ওইদিকে মেহেক অনেকক্ষণ ধরে একা। ওর কাছে মোবাইলও নেই। ফারদিন তাই বেশি দেরি না করে মেহেকের কাছে ফিরে গেল। কিন্তু ছাউনির নিচে এসে মেহেককে পেল না। ফারদিনের হৃৎপিন্ড অজানা ভয়ে চিলিক দিয়ে উঠলো। কোথায় মেহেক? দূরে তাকাতেই দেখল মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজছে আর একা একা নাচছে। নাচের তালে সে এতোটাই বিভোর যে দিন-দুনিয়ার কোনো খবরই নেই। ওদিকে তার লেহেঙ্গার স্কার্ট পেট থেকে সরে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। সেই খেয়াল কি আছে মেয়েটার? ফরসা, মসৃণ পেটটা অন্ধকারে ঝিলিক দিচ্ছে। যে কোনো সাধারণ মানুষের মাথা নষ্ট করার জন্য এমন একটা দৃশ্য যথেষ্ট। ফারদিন এই মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবে? সামান্য কমন সেন্সও নেই মেয়েটার। সে দৌড়ে গিয়ে মেহেকের কোমড় ধরে ওকে তুলে এনে ছাউনির নিচে দাঁড় করালো।স্কার্টের নাট উপরে তুলে শক্ত করে বেঁধে দিতে দিতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,” ইডিয়েট একটা। বৃষ্টিতে কেন ভিজতে গিয়েছো? তোমাকে না দাঁড়িয়ে থাকতে বললাম? ”
মেহেক ফারদিনের কথার উত্তরে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিল। ফারদিন বিস্ময়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর ক্ষেপে বলল,” কথায় কথায় চুমু খাওয়া এটা কোন ধরণের অভ্যাস?”
মেহেক মিষ্টি হেসে বলল,
” নিজের বরকেই তো চুমু খাচ্ছি। অন্যমানুষকে তো না।”
” আর কখনও এই কাজ করবে না ”
” কেন করবো না? অবশ্যই করবো। আমার এটা করতে খুব ভালো লাগে।”
” শোনো মেহেক, তুমি যদি আর কখনও আমার পারমিশন ছাড়া আমাকে কিস করো তাহলে আমি তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবো। মনে থাকে যেন।”
” আপনি না, পুরাই একটা ভেলকা।”
” হোয়াট?”
” আপনার জায়গায় রুমি ভাই হলে এতোক্ষণে আমাকে দশটা চুমু দিয়ে ফেলতো। আর আপনি ধমকাচ্ছেন।”
” এই রুমি ভাইটা আবার কে?”
” আমাদের গ্রামের এক ভাই৷ আমাকে খুব পছন্দ করেন।”
” তোমাকে তো তোমার গ্রামের সব ভাই পছন্দ করে। তাদের ঘাড়ে না ঝুলিয়ে তোমার বাপ কেন আমার ঘাড়েই তোমাকে ঝোলাতে এলো কে জানে?”
মেহেক মুখ দিয়ে ভেংচি কাটলো। অর্থাৎ ফারদিনের কথা তার পছন্দ হয়নি।
বাড়ি ফিরতেই পূর্বিতা ফারদিনের হাত ধরে বলল,” দোস্ত এসেছিস? তোর অপেক্ষাতেই ছিলাম৷ একটা ঘটনা ঘটেছে।”
” কি ঘটনা?”
ওদিকে মেহেকের মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। পূর্বিতা মেহেকের দিকে একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে ফারদিনকে বলল,” এদিকে আয়, বলছি।”
ফারদিন পূর্বিতার সাথে চলে গেল। মেহেক তখন দৌড়ে উর্মিদের ঘরে গেল। উর্মির মুখ বিমর্ষ। চেহারা কাঁদো কাঁদো। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। কিন্তু হয়েছে কি? মেহেকের এই প্রশ্নের উত্তরে উর্মি বলল,” এদিকে আহেন। বলতাসি।”
উর্মি মেহেককে ঘর থেকে বের করে আড়ালে নিয়ে এলো। এরপর পুরো ঘটনা খুলে বলল। সুজির চুল থেকে শেষমেষ আঠা ছাড়ানো যায়নি৷ মাথায় ম্যায়োনিস পড়ার পর সে প্রায় সাত-আটবার গোসল করেছে। তাও কোনো লাভ হলো না। অবশেষে বিকালের দিকে পূর্বিতা আর সুজিতা পার্লারে গিয়ে চুল কেটে এসেছে। সুজির কোমড় পর্যন্ত চুল এখন ঘাড় পর্যন্ত। এই কথা শুনে খুশিতে মেহেকের মন চাইলো নৃত্য করতে। কিন্তু উর্মি বলল, সুজি নাকি সবকিছু বুঝে ফেলেছে। চুল কাটার দুঃখে সে প্রচন্ড রেগে ছিল। উজানকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে ম্যায়োনিসে আঠা কিভাবে এসেছিল। কারণ উজান ডেলিভারি ম্যানের থেকে খাবারের পার্সেল রিসিভ করেছিল৷ তাই সুজি প্রথমেই ওকেই সন্দেহ করে। উজানকে যখন সুজি ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল তখন উজান ভয়ে সবকিছু সত্যি বলে দেয়। এখন সুজি ফারদিনকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছে মেহেকের নামে বিচার দেওয়ার জন্য। এই কথা শুনে মেহেকের ছোট্ট কলিজ ভয়ে নিভু নিভু। সে কি করবে এখন? ওই উজানের বাচ্চাকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। ফারদিন নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবে। মেহেক ঠিক করল সে এখন কোথাও লুকিয়ে পড়বে। যাতে ফারদিন তাকে খুঁজেই না পায়। কিন্তু কোথায় লুকাবে সে? আলমারীতে? খাটের নিচে? না,না, আরও ভালো কোনো জায়গা খুঁজতে হবে লুকানোর জন্য।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে