#অনপেখিত
পর্ব ১২
লিখা: Sidratul Muntaz
মেহেক বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠানের বকুল গাছটির নিচে এসে দাঁড়ালো। তার চোখের কার্ণিশ হতে ধাবমান অবাধ জলরাশি কিছুতেই থামছে না! মেহেক দুইহাতে চোখ মুছছে তো মুহুর্তেই আবার ভিজে যাচ্ছে। বিয়ের দিন আম্মাকে বিদায় দেওয়ার সময়ও মেহেক ঠিক এভাবেই কেঁদেছিল। বাসররাতে ফারদিন যখন তাকে ঘর থেকে বের করে দিল তখনও সে কেঁদেছিল। সুজি যখন প্রথমবার ওদের বাড়িতে এলো আর ফারদিন তাকে কোলে নিয়ে বেডরুমে ঢুকলো তখন গেস্টরুমের দরজা আটকে মেহেক চিৎকার করে কেঁদেছিল। আবদ্ধ ঘরের দেয়ালগুলো তার সেই হাহাকারের সাক্ষী! বাঁধভাঙা এই কান্নার সাক্ষী! আর আজকের কান্নার সাক্ষী এই অপূর্ব সুন্দর বকুল গাছ। সাদা সাদা বকুল ফুলগুলো তারার মতো দেখাচ্ছে। কিছু ফুল ঝরে পড়ে আছে সবুজ ঘাসে উপর। হলদে আলোয় ফুলগুলোকে দেখলে মনে আকাশ থেকে খসে পড়া তারা। এই সুন্দর ফুলগুলোও যেনো মেহেকের কান্নার সঙ্গী। তারাও মেহেকের দুঃখে হতাশ হয়ে কাঁদছে। ফারদিনকে যেদিন মেহেক প্রথমবার দেখেছিল সেদিনও কেঁদেছিল। তখন ফারদিনের গাঁয়ে ছিল টকটকে লাল শার্ট। কালো জিন্স। উজ্জ্বল শ্যামলাবর্ণের লম্বাটে, দীর্ঘদেহী এক অপরিচিত পুরুষ। মেহেকের আজও বুক কেঁপে উঠে সেই দিনের কথা মনে পড়লে। ফারদিনের সরু নাকের ডগায় যেন তেজের হলকা ছিল। মাঝারী আকৃতির ঘন পল্লবে বেষ্টিত চোখ দু’টি অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলছিল। ওই দৃষ্টি কারো উপর নিক্ষিপ্ত হলে সেই মানুষটি অবলীলায় নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। তার ঠোঁট ছিল কালচে, তাও কত মাধুর্য সেই ঠোঁটে। চেহারার গড়ন লম্বাটে, মাথায় ভর্তি খাড়া চুল। অতি সাধারণ চেহারা নিয়েও ফারদিন যেনো অসাধারণ! মুচকি হাসলে তার চেহারা যে কি মিষ্টি দেখায়! মেহেকের মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর পুরুষকে সে দেখে নিয়েছে। খুশিতে কান্না পেল মেহেকের। প্রথমবারের মতো ফারদিনকে দেখে সে কাঁদলো। আনন্দের কান্না! ভালোবাসলো, সুখের ভালোবাসা! কিন্তু কে জানতো? এই সুখের ভালোবাসাই তাকে প্রতি মুহুর্তে দুঃখের সাগরে ভাসাবে। এইতো মেহেক ভাসছে, দুঃখের বোঝা বইতে না পেরে ডুবে যাচ্ছে। তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
ফারদিন প্রচ্ছন্নভাবে মেহেকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। মুখে হাত রেখে নীরব দর্শকের মতো দেখছিল মেহেকের কান্না। মেহেক তাকে লক্ষ্য করেনি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ফারদিন গলা ঝেড়ে হালকা কাশির মতো শব্দ করতেই মেহেক চমকে পেছনে তাকালো। ফারদিনকে দেখে দ্রুত চোখ মুছল। ফারদিন নিষ্পলক চেয়ে রইল মেহেকের গোলাপী মুখটার দিকে। এতোক্ষণ ধরে কাঁদার ফল। মেহেকের ফরসা,মসৃণ, মিষ্টি মুখখানা গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। এই অবস্থায় তাকে আরও মায়াবী দেখাচ্ছে। ফারদিন যথেষ্ট বিনয়ের সাথেই প্রশ্নটা করল,” তুমি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছো মেহেক?”
” না,না, আপনার উপর আমি কেন রাগ করতে যাবো?”
” তাহলে কাঁদছো কেন? কান্না থামাও প্লিজ।”
” থামিয়েছি। আর কাঁদবো না।”
কয়েক সেকেন্ড পর ফারদিন আবার বলল,
” তখন ওই কথাগুলো বলার মানে কি? আমি কি তোমাকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছি?”
” কোনো কষ্ট দেননি তো। আপনি আমাকে কষ্ট দিতেই পারেন না।”
” তাহলে আমি কি জানতে পারি তুমি সারাদিন কেন না খেয়ে ছিলে?”
” বলেছি তো। ক্ষিদে পায়নি।”
” তাহলে এখন খেতে চলো।”
” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি যান।”
” ভালো করে বলছি। আমার কথাটা শোনো। খেতে চলো।”
” বললাম তো, আমার ইচ্ছে করছে না। আপনি যান!”
” মেহেক তুমি চলবে কি-না?”
” না।”
ফারদিন আর কোনো কথা না বলে তেড়ে আসলো মেহেকের দিকে। মেহেক কিছু বুঝে উঠার আগেই ফারদিন ওকে পাঁজাকোলায় নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। ডাইনিংরুমে তখন সবাই খেতে বসেছে। ফারদিন সবার সামনে দিয়েই ওকে নিয়ে রুমে চলে এলো। মেহেক ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছিল। কিন্তু যখন দেখল সুজি তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তখন মনের অজান্তেই মেহেকের একটা পৈশাচিক আনন্দময় অনুভূতি হলো। কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে যদি নিজের মনে আনন্দের সঞ্চার হয় তবে তাকেই পৈশাচিক আনন্দ বলে। মেহেক সেই আনন্দেই উচ্ছ্বসিত। সাথে একটা নাম না জানা তৃষ্ণাও পেয়ে বসলো তাকে। ফারদিন মেহেককে বিছানায় বসিয়ে আদেশ দেওয়ার মতো বলল,” চুপ করে বসে থাকো এখানে। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
ফারদিন চলে যেতে নিলেই মেহেক ওর শার্টের কলার খামচে ধরল। ফারদিন একটু চমকালো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” কি ব্যাপার?”
মেহেক মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার নজর ফারদিনের কালচে ঠোঁটের দিকে। ফারদিন সেটা বুঝতে পেরে হালকা অপ্রস্তুত হলো। না চাইতেও তার দৃষ্টি চলে গেল মেহেকের কোমল,পাতলা গোলাপী ঠোঁটে। সেই অপূর্ব ঠোঁটজোড়া দেখেও ফারদিন কোনো অনুভূতি পেল না। তার কাছে মনে হলো, এ যেন পাঁচ বছর বয়সী কোনো বাচ্চা মেয়ের ঠোঁট। এই ঠোঁটে স্পর্শ করাও অন্যায়! মেহেক তখন সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। ফারদিনের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া। ফারদিন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
“হোয়াট রাবিশ! হোয়াট’স রংগ উইথ ইউ মেহেক?”
মেহেক ভয়ে কেঁপে উঠলো। ফারদিন জোর করে নিজের কলার থেকে মেহেকের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁডাল। রাগান্বিত স্বরে বলল,” কি করছিলে তুমি এটা?”
মেহেক টলমল চোখে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ চেয়ে রইল। একটু পর কান্নার ঢোঁক আটকে বলল,” সবসময় আমার সাথেই কেন এমন করেন আপনি? আমি যে আপনাকে ভালোবাসি সেটা কি আপনি বুঝেন না?”
ফারদিন স্তব্ধ,বাকরুদ্ধ এবং অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল। হাজারবার নিজের মনকে বুঝানোর চেষ্টা করেও সে মেহেককে মেনে নিতে পারছে না। তার অবাধ্য মন কিছুতেই মানতে চাইছে না যে সামনে বসে থাকা পিচ্চি মেয়েটি তার বউ হয়! হ্যাঁ মেহেককে তার ভালো লাগে। মেহেক সুন্দর, কিউট, ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু ফারদিন তাকে বউ হিসেবে ভালোবাসতে পারছে না। ওই কথা ভাবতে গেলেও তার দম বন্ধ হয়ে আসে। কিভাবে বুঝাবে সে মেয়েটিকে?বুঝানো বড় কঠিন। তাও ফারদিন চেষ্টা করল,” দেখো মেহেক, তুমি এখনও খুব ছোট। তোমার এখন যেটাকে ভালোবাসা মনে হচ্ছে সেটা কিন্তু আসলে ভালোবাসা না। এটা একটা আকর্ষণ। তুমি আরেকটু বড় হলে নিজেই বুঝতে পারবে কেন আমি তোমাকে বাঁধা দিয়েছি।”
মেহেক এই কথা শুনে ভস করে জ্বলে উঠল ম্যাচের কাঠির কতো। বলল,
” বড় হওয়ার দরকার নেই। আমি এখনি সব বুঝতে পারছি। আপনি সুজিকে ভালোবাসেন। এজন্যই আমাকে আপনার সহ্য হয় না।”
” হোয়াট? না মেহেক এরকম কিছুই না। শোনো…”
ফারদিন কথা শেষ করার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠলো। দু’জনেই তাকালো বিছানার কোনায় বাজতে থাকা মোবাইলটির দিকে। ‘সুজিতা’ নামটি স্পষ্ট ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। মেহেকে ক্রোধে, আক্রোশে ভেতরে থেকে ফেটে যাচ্ছিল৷ ফারদিন মোবাইলটি নেওয়ার আগেই সে নিয়ে আছাড়া মারল। ফারদিন হতবাক হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা মেঝে থেকে তুলে দেখল স্ক্রিন ফেটে গেছে। ফোনটাও সুইচড অফ হয়ে গেছে। ফারদিন ক্ষীপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মেহেকের উপর। আর মেহেক এতে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না। মাথা নিচু করে এমনভাবে চোখের জল মুছতে লাগল যেন কিছুই হয়নি। ফারদিন হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রাতে কেউ কারো সাথে কথা বলল না। হোসনেয়ারা চাচীর অনুরোধে মেহেক ভাত খেয়ে নিল। রুমে এসে দেখল ফারদিন ঘুম। মেহেক ওকে বিরক্ত না করে সাবধানে বিছানার একপ্রান্তে শুয়ে পড়ল। রাতটা কেটে গেল। সকালে বন্ধুরা আবার প্ল্যান করল ঘুরতে বের হবে। চট্টগ্রামে তারা ঘোরার জন্যই এসেছে। মাত্র তিনদিনের ট্রিপেই তাদের চট্টগ্রাম শহরের সব সুন্দর জায়গা ভ্রমণ করতে হবে। আজকে অবশ্য পূর্বিতা,আনজীর, ওয়াসীম প্রত্যেকেই মেহেককে অনুরোধ করল তাদের সাথে যাওয়ার জন্য। গতকাল মেহেক যায়নি বলে তারা অনেক মনখারাপ করেছে। কিন্তু মেহেক কি কম ঘাড়ত্যাড়া? যতই মানুষ তাকে অনুরোধ করুক যতক্ষণ না ফারদিন নিজে এসে বলবে ততক্ষণ মেহেক রাজি হবে না। সে পূর্বিতাদের বলে দিল তার মাথাব্যথা। যেতে পারবে না। এই কথা বলে ঘরে এসে ঘাপটি মেরে বসে রইল। একটু পর ফারদিন এসে বলল,” তুমি তাহলে যাচ্ছো না?”
” কোথায় যাবো?”
” আমরা ওয়ার সিমেট্রি যাচ্ছি। তুমি যাবে আমাদের সাথে?”
ইশশ, এই জায়গাগুলোতে ঘোরার কত শখ ছিল মেহেকের। কিন্তু আব্বা কখনও তাকে ঘরের বাহিরে যেতেই দেয়নি। ঘুরতে যাওয়া তো তার কাছে স্বপ্ন। ঘুরাঘুরির এতো সূবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে মন চায় না। কিন্তু এক কথায় রাজি হয়ে নিজের দাম তো কমানো যাবে না। তাই মেহেক বলল,” না।”
” কেন যাবে না? সুজি যাচ্ছে তাই?”
মেহেক একটু হকচকিয়ে বলল,” না, তা কেন হবে? আমি এমনিই যাবো না।”
ফারদিন মেহেকের পাশে বসে সুন্দর করে বলল,
” আচ্ছা থাক, সুজিকে নিবো না। শুধু তুমি আর আমি যাবো। এইবার চলো।”
মেহেক বিস্মিত হয়ে বলল,” সত্যি বলছেন?”
” হুম।”
” শুধু আপনি আর আমি?”
” হুম!”
” তাহলে বাকিরা? সবাই তো যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেছে।”
” হোক রেডি। ওরা অন্য গাড়িতে যাবে। আমরা আমাদের গাড়িতে যাবো!”
” শুধু গাড়িই আলাদা হবে? নাকি জায়গাও আলাদা?”
” তুমি চাইলে জায়গাও আলাদা হবে।”
মেহেকের এই মুহুর্তে আসলেই খুশি লাগছে। সে খুশিটা চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেলল,” আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরি?”
ফারদিন কঠিন মুখে বলল,” না।”
মেহেক তোয়াক্কা না করে আচমকা ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” আমরা আজকে অনেক ঘুরবো! অনেক মজা করবো! শুধু আমি আর আপনি। অন্যকেউ না কিন্তু!”
” ঠিকাছে। তুমি তাহলে রেডি হও? আমি বাহিরে ওয়েট করছি।”
” আরে দাঁড়ান।”
” কি?”
মেহেক লাজুক মুখে বলল,” আপনি তো আমার বর। আমি রেডি হলে আপনাকে বাহিরে ওয়েট করতে হবে কেন? ভেতরেই থাকুন। কিছু হবে না।”
ফারদিনের চেহারায় অস্বস্তি ফুটে উঠলো। মেহেকের হাতটা আস্তে করে ছাড়িয়ে বলল,” গেলাম আমি।”
ফারদিন বেরিয়ে যেতেই মেহেক বিরবির করে বলল,” আমি মেয়েমানুষ হয়ে লজ্জা পাই না। আর উনি পুরুষ হয়েও লজ্জায় মরে যায়। কি আজব!”
মেহেকের সাজ দেখে ফারদিন অবাক। কটকটে গোলাপী রঙের একটা লেহেঙ্গা পড়েছে। মাথায় বাচ্চাদের মতো গোলাপি ফুলের ব্যান্ড পড়েছে। ঢেউ খেলানো চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো। তার মাথাটাকে এখন মনে হচ্ছে গোলাপ ফুলের বাগান। ফারদিন কতক্ষণ হা করে চেয়ে থেকে হঠাৎ হেসে ফেলল। ওর হাসি দেখে মেহেকের উজ্জ্বল মুখ চুপসে গেল। কোমড়ে হাত রেখে বলল,” কি ব্যাপার? আপনি হাসছেন কেন?”
” তুমি মাথায় কি লাগিয়েছো এটা? তোমাকে মালিনীর মতো লাগছে। মালিনী চেনো? মালির বউ!”
” তো কি হয়েছে?”
” কি হয়েছে মানে? এইটা খুলো। ভালো দেখাচ্ছে না।”
” সত্যি খুলে ফেলবো?”
” হুম। নাহলে এই অবস্থায় বাহিরে গেলে আমার মতো সবাই হাসবে।”
মেহেক মাথার ব্যান্ডটা খুলে রাখল। ক্লাস ফোরে থাকতে শখ করে আব্বা মেলা থেকে কিনে এনেছিলেন এইটা মেহেকের জন্য। কখনও পড়া হয়নি। আজকে মেহেক একটু আগ্রহ নিয়ে পড়েছিল। অথচ সে ভুলেই গেছিল, এখন তার এইগুলো পড়ার বয়স নেই। সে তো বড় হয়ে গেছে! ফারদিনের ব্যঙ্গাত্মক হাসি দেখে মনটা খারাপ হলো মেহেকের। ফারদিন ওইভাবে না হেসে মেহেককে বুঝিয়ে বললেও তো পারতো! তার হাসিটাই ইনডিরেক্টলি প্রমাণ করে,মেহেকের ফ্যাশন সেন্স কতটা বাজে! ড্রয়িংরুমে সবাই রেডি হয়ে গল্প করছে। ফারদিন আর মেহেক এখনি বের হয়ে যাবে। বাকিদের জন্য উবার ডাকা হয়েছে। উবার আসতে আরও আধঘন্টা বাকি। তাই ওরা একসাথে বসেছে আড্ডা দিতে। এদের মধ্যে সুজি নেই। ফারদিন সবার উদ্দেশ্যে বলল,” টাটা, আমরা চলে গেলাম।”
আনজীর বলল,” বায়। ”
ওয়াসীম প্রশ্ন করল,” আচ্ছা তোদের সাথে আমাদের কোথায় দেখা হবে?”
ফারদিন ইশারায় বুঝালো ফোনে জানাবে। পূর্বিতা মেহেকের দিকে চেয়ে বলল,” তোমাকে সুন্দর লাগছে মেহেক।”
ঠিক সেই সময় সুজির আগমন হলো। খুব সুন্দর লাগছিল তাকে দেখতে। হলুদ রঙের একটা কূর্তি তার গাঁয়ে। পায়ে কালো জিন্স। মুখে ভারী মেকাপ। তার সুন্দর, লম্বা, সোনালী চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। সে বার-বার হাত দিয়ে চুল ঠিক করছে। ড্রয়িং রুমে ঢুকেই সে সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,” হাউ এম আই লুকিং গাইজ?”
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,” গর্জিয়াস!”
সবার মধ্যে ফারদিনও ছিল। সুজি হাত দিয়ে নিজের শরীরে বাতাস করার মতো একটা ভাব নিল। যেনো সে বিশ্বসুন্দরীর এওয়ার্ড পেয়ে গেছে! মেহেকের মেজাজ বিগড়ে গেল। সে নিজে যখন সেজেছিল তখন তো ফারদিন একবারও প্রশংসা করেনি। উল্টা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছে। আর সুজির বেলায় কি-না গর্জিয়াস! গতকাল রাতের ওই ভিডিওর দৃশ্যটি আবার চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো। ফারদিন সুজির চুল নিয়ে খেলছিল। কতটা অসহ্যকর দৃশ্য! সুজির অর্ধেক সৌন্দর্য্য তার ওই লম্বা চুলে। আর এই চুল নিয়েই তার যত অহংকার। মেহেকের এই মুহুর্তে মন চাইছে সুজির চুলগুলো কাচি দিয়ে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে কাটতে। ফারদিন বলল,” চলো মেহেক। আমরা বের হই।”
” এক মিনিট। আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।”
” ঠিকাছে যাও। আমি তাহলে গাড়ি নিয়ে বাহিরে ওয়েট করছি।”
মেহেক ওয়াশরুমে গেল না। মেজাজ খারাপ করে বিছানায় বসে রইল। তার পুরো পৃথিবী তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে। ওই সুজি কেন এতো সুন্দর? কেন? মেহেক কেন সুজির মতো সুন্দর করে সাজতে পারে না? কেন তার মতো স্মার্ট হতে পারে না? সে এতো বোকা কেন? হয় সে নিজে সুজির মতো স্মার্ট হবে নয়তো সুজিকেও আনস্মার্ট হতে হবে। নাহলে মেহেকের শান্তি লাগবে না। কিছুতেই না! ভিডিওর সেই দৃশ্যটি বার-বার মনে পড়ছে। মেহেক এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারছে না। এইভাবে চললে সে পাগল হয়ে যাবে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ এসেছে নাকি? এই রুমের পাশেই রান্নাঘরটা। মেহেক রুম থেকে বেরিয়ে দেখল উর্মি।
” কিরে উর্মি, কি করিস?”
” মেহমানদের জন্য নাস্তা নিতাসি। আপনি খাবেন?”
” নাস্তা না সবাই সকালে খেয়েছে? এখন আবার নাস্তা কিসের?”
” সুজি আপা ইন্টারনেটের বেডাগো কাছে মুরগির রান অর্ডার করসে। এখন সবাই সেই রান খাইবো। আমি প্লেটে কইরা সাজায় নিতাসি।”
” বাহ, দেখি তো। ভালোমতো খাওয়াচ্ছি মুরগির রান। সাদা সসের বাটিটা আমার হাতে দে।”
” কি করবেন?”
” তোকে দিতে বলেছি।”
ম্যায়োনিসের বাটিটা উর্মি মেহেকের হাতে দিল। মেহেক বলল,” আচ্ছা উজান কোথায়?”
” ঘরেই আছে।”
” ডাক।”
উর্মি উজানকে ডাকল। একটু পর উজান এসে বলল,
” ডাকসেন আমারে?”
” এইতো উজান, তুই না আগে ড্রয়িং করতি? তোর কাছে কি আঠা আছে?”
” উম.. ড্রয়ারে থাকতে পারে। চেক করতে হইবো।”
” থাকতে পারে না। থাকতেই হবে। না থাকলে এক দৌড়ে কিনে আনবি। টাকা লাগলে আমার থেকে নিয়ে যাবি।”
” আচ্ছা।”
উজান ঘর থেকে এসে দাঁত কেলিয়ে বলল,” ঘরেই ছিল আপা। দোকানে যাইতে হয়নাই।”
” গুড। তুই যা এইবার।”
উজান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মেহেক আঠার বোতলটা খুলে মেয়োনিসের বাটিতে ঢেলে দিল। তারপর চামচ দিয়ে মিশিয়ে নিতে লাগল। উর্মি কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,” হায় হায়, এইটা কি করতাসেন? এইটা তো খাওনের জিনিস৷ ”
” চুপ থাক তুই। ”
মেহেক বাটিটা সুন্দর করে প্লেটে সাজিয়ে রেখে বলল,” নে। এখন এইটা ওদের কাছে নিয়ে যাবি৷ কিন্তু কাউকে খেতে দিবি না। সুজির হালুয়ার চুলে এই আঠার মিশ্রণ যদি ঢালতে পারিস তাহলে তোকে আমি এক হাজার টাকা দিবো। সাথে অনেক সুন্দর একটা উপহার দিবো।”
” আমারে মাইরা ফালাইবো আপা। উনি যেই দজ্জাল। প্লিজ আমারে এই ঝামেলায় ফালায়েন না। উজানরে কন।”
” উজান পারবে না। তুই-ই পারবি। না পারলে তোর খবর আছে। যা এখন।”
উর্মি মুখটা বাংলার পাঁচের মতো বানিয়ে খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে গেল। মেহেক চলে যাওয়ার সময় দেখল উর্মি সুজির চুলে ফট করে আঠার মিশ্রণ ঢেলে দিয়েছে। সবাই চিৎকার-চেচামেচি শুরু করেছে। ওইদিকে কান না দিয়ে মেহেক চলে গেল ফারদিনের কাছে। গাড়িতে উঠেই বলল,” দ্রুত চলুন। এমনিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এক মিনিটও দেরি করা যাবে না।”
চলবে